| 29 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

পাখির ছবি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comসিদ্ধার্থের কথা হচ্ছে, বিয়ে তো হচ্ছেই দুইদিন আগে আর পরে। ফলে, বাবা-মায়ের বাসায় না থাকার সুযোগে যদি নিজেদেরকে ভালোভাবে চিনে নেয়া যায় তাহলে সমস্যাটা কোথায়? নীলার অনার্স শেষ হতে আরো দেড় বছর, সিদ্ধার্থ প্রায় প্রতিদিন দু’তিনখানা সিভি ছাড়ে এদিক সেদিক। কোথাও একটা তো নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হবে আর তখন, বিয়ে হতেও কোনো সমস্যা থাকবে না। যদিও নীলার বাবা মা চান, সরকারি চাকুরে জামাই আর সিদ্ধার্থ সরকার বিরোধী রাজনীতি করতে করতে সমগ্র কিশোরকাল, তারুণ্যের প্রথম দিক কাটিয়েছে সেজন্যেই তার আর কোনো মোহ নেই ঐ চাকরিতে৷ একান্তে পেতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকে গুরুত্বই দিচ্ছে না অন্যপক্ষ৷ খালি বলে, বিয়ের পরের জন্যে নিজেদের কোনো রহস্য রাখবো না আমরা? সিদ্ধার্থ নিজেকে বঞ্চিত করবার কোনো অর্থ খুঁজে পায় না৷ আটাশ বছরের যুবক, শরীর কারণে অকারণে জাগে৷ ওর বাবা মা দু’জনেই চাকরি করতে করতে চাকরির বয়স প্রায় ফুরিয়ে এনেছেন। বলতে গেলে, ফাঁকা বাসায় মানুষ হয়েছে। দশ/এগারো বছর বয়স থেকেই নিজের খাবার নিজেই বানিয়ে খেতে পারে। 
আমাদের গল্পের শুরুর দিন বৃষ্টিতে শহর ভেসে যাচ্ছিলো। বাবা মা গিয়েছিলেন দেশের বাড়ি৷ এক দাদার কল্যাণে আস্ত এক বোতল রাশান ভদকা নিয়ে বসেছিলো সিদ্ধার্থ, আগের রাতে অর্ধেকটা সেরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো- উঠে দেখে সকাল সাড়ে আটটা- প্রবল খিদে আর অবসন্নতা পেয়ে বসলো- ঠিক ঐ সময় ফোন করলো নীলা। ওর কিছু টাকার খুব দরকার৷ তা, টাকা ছিলো সিদ্ধার্থের কাছে। দিতেও চায় সে। মাত্র গতকাল বিকেলেই টিউশনির টাকাটা পেয়েছে। জানতে চাইলো নীলা, বাবা মা আছেন কি না – এই প্রথম সিদ্ধার্থ মিথ্যে বললো। 
তিনটে ডিমের মামলেট, দু’টো রুটি, এক মগ কফি খেয়ে বেশ চাঙা বোধ করলো দশটা নাগাদ। ল্যাপটপে ছেড়ে দিলো জিবিউনিউ প্রেজনারের সুর। এই লোকটার সুরে কান্না৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেবল নয় তাবৎ বিশ্বের যুদ্ধ বন্দীদের ক্রন্দন যেন এই লোকটার সুরে আটকে গেছে৷ শুনতে শুনতে ইচ্ছে করলো, কাল রাতের বোতলটা থেকে চুমুক দিতে। বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে আবার। এ বৃষ্টির মধ্যে এতো দূর থেকে নীলা কতোটা জরুরি দরকারে আসছে সে কথাটা আর জিজ্ঞেস করা হলো না- সিদ্ধার্থের মাথায় একটা পরিকল্পনা ঘুরছে। প্রথম চুমুকটা দেয়ার সময় সব সময়ই পেগটা বড়ো করে বানায় সে। চুমুক দিতে দিতে দাদার মঙ্গল কামনা করে। আহা! তিনি যেন ব্যবসায় আরো উন্নতি করেন। যেন সারা জীবন ধরে এমন অবসরে আরো অসংখ্য বোতল উপহার দিতে পারেন৷ 
সিদ্ধার্থের বাবা সদাপ্রসন্ন সত্যিই সদা প্রসন্ন। কেউ কোনোদিন তাঁকে রাগ করতে দেখেনি৷ চাকরি জীবনে অনেক রকম অফিস পলিটিকসের তিক্ততা তৃতীয় বিশ্বের আপামর ছাপোষা চাকুরের মতো তাকেও হজম করে নিতে হয়েছে। অনেকগুলো সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় তিনি মাথা নিচু করে বসে টাইপ মেশিন চালিয়ে গেছেন।  চাকরি জীবন অর্ধেক পেরিয়ে আসার পর তাঁদের অফিস কম্পিউটার শিখতে পাঠালো এক জায়গায়, সেখানে তিনি প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিলেন৷ তাঁর সব কাজের মধ্যে একটা নিঁখুত যত্ন থাকে। থাকে একটা ভালোবাসা ভরা মন। তিনি যখন একটা পৃষ্ঠা টাইপ করা শেষে মেশিন থেকে খুলে আনতেন তখন মনে হতো,  তিনি চাইছেন কাগজটা ব্যথা না পাক। তাঁর স্বাক্ষরটি বিকশিত ফুলের মতো। দরকারী কাগজপত্রের নিচে প্রায়ই ফুটে উঠতো। এমন একজন পরিপাটি মানুষ কখনোই নেশা করেননি। একাধিকবার সেলাই করবার পর যখন জুতো একেবারেই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে তার আগে পর্যন্ত কখনো জুতো কেনার ইচ্ছে হয়নি তাঁর। কারো সারল্যের সুযোগ নেননি। এমন একজন মানুষ ছেলে জন্মানোর খবর পেতেই মনে মনে নাম রাখলেন, সিদ্ধার্থ। ভেবেছিলেন, প্রকৃত সিদ্ধার্থের মতোই নিষ্কাম, স্বার্থবোধশূন্য হবে ছেলে। জীবনে প্রথম পার্ট টাইম চাকরির পুরো টাকা যখন হাতে তুলে দিয়েছিলো, তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। চোখে জল এসেছিলো তাঁর। ছেলে যে নিজের মতো  বই পড়ুয়া হলো না এটা নিয়ে কম দুঃখ ছিলো না কিন্তু যখন দেখলেন ছেলে দিব্যি বাবার পছন্দ অপছন্দ খেয়াল রাখে আর হাতে পয়সা থাকলে বইপত্র কিনে আনে তখন মানুষ হিসেবে, বাবা হিসেবে পরিতৃপ্ত বোধ করেন। এখন দেশের বাড়িতে ছোট শালার সাথে দাবা খেলতে খেলতে ছেলের কথা মনে পড়লো।
সকালের চতুর্থ বার গ্লাস ভর্তি করতে গিয়ে বাবার ফোন পেয়ে সোফায় ঠিকঠাক হয়ে বসলো ছেলে-
– হ্যালো, বাবা
-হ্যাঁ, বলো বাবা
– কি করছিস তুই?
– এমনি বসে আছি বাবা
– আচ্ছা, মনে পড়লো তোকে তাই ফোন করা!
ছেলে চুপ।
– আমাদের ফিরতে আরো দু’তিনদিন। অনিয়ম করিস না বাবা-
– আচ্ছা বাবা, চিন্তা করো না…। লাইন কেটে গেলো।
এক ধরণের অন্যমনস্কতা ভর করলো ছেলেকে। চতুর্থ গ্লাস প্রায় সম্পূর্ণ রেখে দিয়ে বেশ কয়েকদিন পর বাবার বুক শেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তিনি সবসময় শেলফ খোলা রাখেন, আশা করেন ছেলে পড়বে একদিন কিন্তু ছেলে কোনোদিন মনোযোগ দিয়ে পড়েনি কেবল বিচ্ছিন্নভাবে বাবাকে কিছু বই এনে দিয়েছে। বাবা তাতেই খুশি। দু’চারটে বই হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে একটা পুরনো বই থেকে কাগজ পড়লো ভাঁজ করা- মলিন, বয়সী একখানা কাগজ- খুলতেই সে দেখলো মায়ের ডাকনাম সম্বোধন করে চিঠি-  কাগজটা ভাঁজ করে আবার রাখতে গিয়েও আগ্রহবশত, মনে অপরাধবোধ নিয়েই খুলে ফেলতে হলো তাকে-
প্রিয় মনো,
সারাদিন রাত তোমার কথা মনে পড়ে। তুমি গ্রামে আছো, আমি শহরে। মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টার দূরত্ব অথচ মনে হয় দুই মহাবিশ্ব। তিন মাস সতেরো দিন তোমাকে দেখি না। অফিসের কাজের চাপে যেতেও পারি না। তুমি কি আমার কথা ভাবো? যদি ভাবো, চিঠি লেখো না কেন? তোমার এক চিঠি পেয়েছি আড়াই মাস আগে, যেন গেলো জন্মে। সবসময় পকেটে রাখি সোনা। যে আসছে সে আমাদের অনেক স্বপ্নে গড়া। ভারি কোনো জিনিস তুলো না। নিজের যত্ন নিও। দেখে এসেছিলাম তোমাদের বাড়ির কালু পেছনের ডান পায়ে আঘাত পেয়েছে? ওর পা কি সেরেছে? বিড়াল মা কেমন আছেন? তাঁর বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটেছে?…’ পড়তে পড়তে সিদ্ধার্থের চোখ ঝাপসা হয়, জল পড়তে থাকে। মা বাবাকে নতুন চোখে দেখতে থাকে৷ চিঠিটা ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে হাত কাঁপে। নিজের জন্য খারাপ লাগে। লজ্জা লাগে। লজ্জা গভীর হয়ে গ্লানিতে পরিণত হয়। শেলফের বাম পাশের কাঁচটা লাগিয়ে দিয়ে মেঝের উপর বসে পড়েই শব্দ করে ফুঁপিয়ে ওঠে। এই কান্না মদের না জিবিগনিউর সুরের জন্যে না মা-কে লেখা বাবার চিঠির প্রভাব সে জানে না৷ সে এতো নীচ! এতো বাজে! একবারও নীলাকে জিজ্ঞেস করলো না, বৃষ্টির মধ্যে অত দূর থেকে কতোটা দরকারে আসছে! সে-ই তো ঘরে তালা লাগিয়ে যেতে পারতো। তুমি না তাকে ভালোবাসো সিদ্ধার্থ! এই তোমার ভালোবাসার নমুনা! 
ছিঃ!
নিজেকে ফিরে পেতে সময় লাগে। একটা শাওয়ার নেয়। বোতল, গ্লাস খাটের নিচে ঢুকিয়ে রেখে সারা ঘরে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে  জানালা সব খুলে জোরে ফ্যান চালিয়ে দিতেই কলিং বেলের শব্দ পায়। 
দরজা খুলতেই নীলা। মলিন মুখ, সালোয়ার কামিজ নীলার খানিকটা ভিজেছে। ঘরে এনে তোয়ালে দেয়। নীলা আস্তে আস্তে মাথা মোছে, গা মোছে। ততোক্ষণে সিদ্ধার্থ ফ্লাস্ক থেকে গরম জল নিয়ে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়েছে।  বিস্কুটের কৌটো থেকে বিস্কুট বের হলো। ক্রিম বিস্কুট। 
বৃষ্টি ধরে এসেছে। 
‘নীলা, আচ্ছা বলো তো,  ভেজা থাকলে মেয়েদের এতো সুন্দর লাগে কেন?’ কফিতে চুমুক দিতে দিতে সিদ্ধার্থ জানতে চায়।  নীলা হাসে, কিছু বলে না৷ সে জানে, অনুমতি না পেলে এমনকি ফাঁকা ঘরেও সিধু অসঙ্গত আচরণ করবে না৷ কফিতে চুমুক দিতে ভালো লাগে নীলার। 
ড্রয়ার থেকে বের করে নীলাকে টাকাটা দেয়। এতোক্ষণে ও খেয়াল করে নীলার জামায় অনেকগুলো ছোট ছোট পাখির ছবি, নানা রকমের। 
সিদ্ধার্থের খুব ইচ্ছে করে কপালে একটা চুমু খেতে। কিন্তু কি ভাববে ভেবে কিছু বলে না৷ হাতটা একবার ধরে ছেড়ে দেয়। ‘দিয়ে দেবো কিন্তু’- নীলা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আবার ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করতে গিয়েও সিদ্ধার্থ থমকে দাঁড়ায়। আলতো একটা চুমু খায় নীলা ওর কপালে। তারপর ধীর পায়ে নেমে যায়। 
বিস্ময়ে প্রস্তরীভূত সিদ্ধার্থের মুখে বাক্য সরে না। বেশ সময় লাগলো প্রথম চুমুর ধকল সামলে নিতে। দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো আবার। ঘুমের মধ্যে দেখলো, ছোট্ট সিদ্ধার্থ বাবার কাঁধে। গ্রামের বাড়ির পেছনে দীঘিটার পাড়ে দাঁড়িয়ে বাবা। বিশাল সে দীঘির উপরের আকাশে অজস্র ছোটো ছোটো পাখি উড়ে যাচ্ছে৷ অসংখ্য ছোটো ছোটো পাখি। 
বাস্তবের পৃথিবীতে তখন রোদ উঠেছে। নীলা একটা ফাঁকা বাসে সিট পেয়ে গেলো। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত