| 29 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

প্রিয়েমশন

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comআমজাদ হোসেনের “মাধবী সংবাদ” ছিল আমার জীবনে প্রথম পড়া বড়দের বই। আজ এত বছর পর বইয়ের বিষয়বস্তু পরিষ্কার মনে নেই তবে এটুকু মনে আছে যে, সে অর্থে ঠিক বড়দের বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু ওতে না থাকলেও চলচ্চিত্র পরিচালক লেখক সিনেমার রঙিন জগতের পর্দার পিছনের নানা খুঁটিনাটির পাশাপাশি এক শ্রেণির নায়িকাদের শরীরি প্রেমকে সিনেমায় টিকে থাকার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা নিয়ে আলোকপাত করেছেন আর তাতেই প্রসঙ্গত শরীর-সংক্রান্ত বিষয়-আশয় চলে এসেছে। ঐ বারো-তের বছর বয়সে যখন সবে নিজের চেনা শরীরটা বদলে যেতে শুরু করেছে, অকারণ হরষ আর বেদনা ভর করে মনের আকাশ তার রঙ, সীমানা চেনাচ্ছে তখন স্বভাবতই ওরকম একটা বই পড়ে যথেষ্ট কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। অবশ্য শুরুটা হয়েছিল মায়ের নিষেধ ভাঙার ইচ্ছা থেকেই, পরে বিষয় বস্তুর প্রতি আকর্ষণ আর বর্ণনাভঙ্গির কারণে গড়গড় করে পড়া হয়ে যায়। সেদিন কী কারণে যেন মায়েদের বিকেলের আসরে সন্ধ্যা পিসি অনুপস্থিত ছিল আর তাতেই আমার সুযোগ এসে যায়। মা এক গোল্লা হলদেরঙা উল আর ঐ বইটা হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘যা সন্ধ্যা পিসিকে দিয়ে আয়। সাবধান অন্য কারো হাতে কিন্তু দিবি না, পিসিকেই দিবি। আর ভুলেও বইটা খুলিস না যেন।’ এই কড়া নিষেধাজ্ঞাতেই আগ্রহ জন্ম নেয়, কী এমন আছে বইতে দেখি তো! 

তখন বয়সটাই ছিল কৌতূহলের, নিষেধ ভাঙার!

আজ আবার বইটার কথা মনে হল কারণ ওখানে এক জায়গায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দুই পাশের বৃক্ষরাজির সৌন্দর্যের কথা বলা আছে। যদিও নিজে পড়ার সময় সেসব বিশেষ কিছু বলে মনে হয় নাই কিন্তু বিস্ময় জেগেছিল মিনুপার কথায়। সে-ও মায়েদের বিকেলের আসরের একজন সদস্য কিন্তু ঢাকায় পড়াশোনা করার কারণে নিয়মিত নয়, ছুটিছাটায় বাড়িতে এলে তখনই কেবল দেখা পাওয়া যায়। মিনুপা কী সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় গুছিয়ে কথা বলে! শুনলে মনে হয় সে বুঝি আমাদের প্রতিবেশী চেনাজানা কেউ না, রেডিয়োর ভিতরকার কারো কণ্ঠ ভেবে ভুল হয়। মিনুপাই বলছিলো মাকে, ‘মামি, মাধবী সংবাদ পড়া শেষ? ওখানে মানিকগঞ্জের নামও একটু আছে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, খেয়াল করেছেন?’

“মাধবী সংবাদ” নামটা শুনে কান খাড়া করি। বুঝতে পারি বইটা তাহলে মিনুপাই এনেছে আর এখন আসরের সবার হাতে হাতে ঘুরছে। ‘আসলেই আমাদের মহাসড়কটা ভীষণ সুন্দর। বিশেষ করে পথের দুই ধারের বৃক্ষরাজি যেভাবে বাহু বাড়িয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাথার ওপর সবুজ ছাতার মত তৈরি করেছে গাড়িতে বসে তা দেখলে মনে হয় যেন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কোনো টানেলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।’ মিনুপার এমন বর্ণনা শুনে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম এটা আবার কী রকম কথা! গাছেরা কীভাবে গলা ধরতে পারে? টানেল জিনিসটা কেমন? যদিও আমাদের বাড়ি থেকে বাস চলাচলের শব্দ পাওয়া যেত এবং সে বাসপথ গড়িয়ে-বেয়ে ঢাকা আরিচা মহাসড়কে গিয়েই ঠেকতো তবু সে পথ চর্মচক্ষে দেখা হয় নাই তখনও। তাই ঢাকা আরিচা মহাসড়ক রূপকথার রহস্যময় স্থানের মতোই কিছু একটা হবে বলে ধরে নিয়ে খেলায় মন দিয়েছিলাম। আজকে আমি বহুদিন পর সেই পথ ধরে বাড়ি ফিরছি, ফিরছি মানে আমাদের বাড়িটাকে চিরদিনের মতো খুইয়ে ফেলতে ঢাকা থেকে ঘিওর যাচ্ছি। গাড়িতে বসে অবলোকন করছি গাছেদের গলাগলি ধরে বানানো সেই সবুজছাতা, প্রাকৃতিক ট্যানেল।

শৈশবের স্মৃতি আসলে বকুল ফুলের মতো, শুকিয়ে গেলেও বুকের গভীরে ঘ্রাণ থেকে যায়। সময়-অসময় নাড়াচাড়া করে সে শুকনো বকুলের ঘ্রাণেও মন উদাস, আকুল হয়।

 

১৯৭২ সালে আমার দাদাভাই এন্তাজউদ্দিন সরকার যখন মোহিনী গুহের পুরনো বাড়িটা কিনে নেন তখন আত্মীয়বন্ধু সবাই বাহবা দিয়ে বলেছিল, যাক, সস্তায় বড় বাড়ি কিনেছো।কিন্তু দাদা ভাইয়ের তাতে আত্মতুষ্টি মেলেনি। কারণ বিশেষ প্রয়োজনে গুহ মশায় তিনশ শতকের পুরনো বাড়িটার ২৭৫ শতক বিক্রি করলেও বাকি ২৫ শতক তার বর্তমান বসতবাড়ির খেদমদগার নিতাইয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন। পুরো জমিটা কিনতে না পেরে দাদাভাই আফসোস করে বলতেন, ‘নিতাইয়ের বাড়িটুক আমার বাড়ির ঘাড়ে একটা বিষফোঁড়ার মতন। বাড়ির সৌন্দর্যডাই কানা কইরা রাখছে।’

 

না, দাদাভাই কোনো সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ ছিলেন না। সেরকম হলে হিন্দুপাড়ার মধ্যখানে গিয়ে বাড়ি কিনতেন না। ধার্মিক এবং অন্য ধর্মের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল দাদাভাইয়ের সমস্যাটা ছিল অন্যখানে। তিনি ছিলেন গোছানো স্বভাবের একজন হিসেবি মানুষ। ঘিওর হাট থেকে কাঁচা পাট কিনে নারায়ণগঞ্জের পাটকলে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করতেন। ব্যবসার সুবিধা আর নিজের দুই ছেলের জন্য পৃথক বাসস্থান গড়ে দিতেই কাশিমপুরের এজমালি আদিবাড়ি ছেড়ে ঘিওর বাজারের কাছাকাছি এই বাড়ি কেনা। কাজেই তিনশ শতকের পুরোটাই নিতে পারলে তার মন ভরতো। এতে যেমন সমানভাবে দুই ছেলেকে ভাগ করে দেওয়া যেত তেমনি বাড়িটার পেটের মধ্যে অন্য একটা বাড়ি থাকার খচখচানিটাও থাকতো না। এমন ইচ্ছার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটা খুব প্রাসঙ্গিক লাগছে না ? মায়ের মুখে গল্প শুনে আমার তেমনটাই লেগেছিল। মায়ের কাছেই শুনেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাশ আমার রাশভারি দাদাভাই সবসময় ধবধবে সাদা টরে কাপড়ের ভাঁজভাঙা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে শরিফ ছাতা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হতেন। তার বৈষয়িক বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও ছেলেদের মধ্যে ছিল না বলে সময় পেলেই দাদিকে খোঁটা দিতেন আর দাদি মাথার ঘোমটাটা টেনে নিয়ে পাশ থেকে সরে যেতে যেতে সাবধান করে বলত,‘ বেশি বুদ্ধির বড়াই কইরেন না, সবই অদৃষ্ট।’দাদাভাই সে সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করলেও বাস্তবিকই  অদৃষ্টের পীড়ণে একসময় তার বুদ্ধির অর্জনের পুরোটাই বিসর্জন দিতে হয়েছে।বলা যায় সেই অদৃষ্টের কফিনে চ‚ড়ান্ত পেরেক ঠুকতেই আজ আমার ঘিওর যাত্রা।

বিপর্যয়ের শুরুটা হয়েছিল বাড়ি কেনার বছর তিনেক পর।নিতাইয়ের বাড়িতে হঠাৎ অচেনা লোকজন দেখে পাড়াপ্রতিবেশী কৌতূহলী হলে জানা যায় যে, নিতাই তাদের কাছে ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে ওপারে চলে গেছে। মাস দুই আগেই টাকাপয়সা লেনদেনপূর্বক দলিল সম্পাদন হয়েছে, এখন নিতাইয়ের চলে যাওয়ায় তারা ভোগ দখলে এসেছে। ক্রেতা অমল ঘোষের হরিরামপুর বাজারে বংশানুক্রমে দই, মিষ্টির দোকান ছিল। বসতবাড়ি পদ্মার ভাঙনে বিলীন হবার পর কিছুদিন ভাড়ায় থেকে ব্যবসা চালিয়েছে। কিন্তু স্ত্রী, নয় ছেলেমেয়ের বিরাট সংসার নিয়ে ভাড়া থাকাটা যেমন অসুবিধা তেমনি দোকানের অনেক কাজই বাড়িতে করতে হয় বলে বাড়িওয়ালাদের আপত্তি সহ্য করাও মুস্কিল। এমতাবস্থায় বাড়ি কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ঘিওরের এক জ্ঞাতি ভাইয়ের কাছে নিতাইয়ের বাড়ি বিক্রির খবর পেয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায় তার। অর্থাৎ কেনাবেচা গোপন রাখার শর্তে কম টাকায় বাড়িটাও পায় আবার জ্ঞাতি ভাইয়ের তৎপরতায় ঘিওর বাজারে দোকান ঠিক করে নতুনভাবে ব্যবসারও বন্দোবস্ত হয়ে যায়। ঘটনার বিস্তারিত শোনার পর উপস্থিত সবাই নিতাইয়ের নিন্দামন্দ জুড়ে দেয়। ছোটলোক, বেআক্কেল বলে গালাগাল করে। এরকম একটা কাজ করায় গুহ মশায়ও বেজায় চটেছেন, তিনি নিতাইয়ের নামে শাপ-শাপান্ত করে অমল ঘোষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘দুইডা পয়সা কম পাওয়ার লোভে কামডা আপনে ঠিক করেন নাই মশাই, অন্তত আমারে এট্টু জানাইতে পারতেন। আইনকানুন কিছু জানেন? একই দাগ খতিয়ানের জমি, এহন যদি সরকার সাবে প্রিয়েমশনের মামলা ঠুইকা দেয় আপনে তো হাইরা যাইবেন। তহন কেমন ঠেকবো?’

তিনি আবার দাদাভাইকেও সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করেন, ‘হতচ্ছাড়া তলে তলে এতসব করছে অথচ আমাগো কিচ্ছুটুক জাইনব্যার দেয় নাই। তিন পুরুষের চাকর ওরা। সেই কৃতজ্ঞতা থিকাই তো জমিটুক দেওয়া, নাইলে ওতে যে আপনার বাড়িডা অপূর্ণাঙ্গ থাইকা যায় সেকি আমি বুঝি না? কইছিলামও যে বেচাবিক্রির চিন্তা করলে আপনেরে য্যান আগে জানায়। হারামজাদা আমার নাম ডুবাই গেল! জাতের মুখে কালি দিল!’

সবাই যে যার কথা বলা শেষে চলে গেলেও সেদিনের পর থেকে দাদাভাইয়ের শান্তি উড়ে যায়। গুহ মশায়ের মধ্যস্থতায় অমল ঘোষ দাম ফেরত নিয়ে জমিটুকু দাদাভাইয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব অমান্য করায় জিদের বশে তিনি ‘শুফার দাবি’ তুলে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। এরপর এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালতে দৌড়ঝাঁপ করে নিজের পক্ষে ডিক্রি আনেন। আদালতের রায় মোতাবেক ঘোষেদের তুলে দিয়ে দখলও বুঝে পান। কিন্তু ঐ যে একটা গ্রামীণ প্রবাদ আছে, ‘যে করে মামলা, সে দেয় কামলা, সেই অনুযায়ী দাদাভাইয়ের কামলা দিতে হয় নাই বটে তবে ‘আদালতের বারান্দার ইট-কাঠেরাও পয়সার জন্য হা করে থাকে’ সে কথার সত্যতা হারে হারে টের পেয়েছেন। একদিকে দীর্ঘদিন মামলা চালানোর ফলে অর্থ, সময় ব্যয় অন্যদিকে পাটের বাজার খারাপ হতে থাকায় ব্যবসায় মন্দাভাব তাকে সংকটে ফেলে দেয়। এরমধ্যে আকস্মিক ছোট চাচার মৃত্যু যেন তার পাঁজরের হাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।

মায়ের ভাষ্য মতে, বাড়ি কেনার বছর পাঁচেক পর আমার জন্ম। তারপর পিঠাপিঠি আরো দুই বোন। বিশাল বাড়িটাতে নানান জাতের গাছ গাছালি, ঝোপ-ঝাড় ভর্তি থাকায় শেয়াল, বাগডাস, বেজি, সাপ এরাও যেন ভাগে-যোগে বসবাস করত। শেয়ালের উপদ্রব এতই বেশি ছিল যে, বেলা একটু পড়ে এলে আমাদের বোনেদের আর একলা উঠানে নামতে কিংবা বারান্দায় খেলতে পর্যন্ত দিতো না, পাছে শেয়ালের পেটে চলে যাই এই ভয়ে। পন্ডিত মশাইয়েরা সুকৌশলে একজন আরেকজনের পিঠে উঠে গাছের উঁচু ডাল থেকে নিঃশব্দে পাকা কাঁঠাল সাবাড় করত। সকালবেলা গাছতলায় বিচি আর ছাল চামড়া পরে থাকতে দেখে সেসব আন্দাজ করা যেত অথচ রাতে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পেত না।

মজার ব্যাপার হল, বছরের পর বছর ধরে ঘোষেদের সাথে মামলা চলায় দুই বাড়ির পুরুষদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না একথা ঠিক কিন্তু সে বৈরিতার লেশমাত্রও নারী-শিশুদের স্পর্শ করতে পারে নাই। মা-কাকি-পিসিদের আচার আর তরকারির বাটি চালাচালির পাশাপাশি মায়ের ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে বিকেলবেলা নিয়মিত যে আসর বসতো তাতে উলের গোল্লা, কুরুশের সুতা কিংবা সেলাইয়ের নকশা ছাড়াও গল্পের বই, গানের ক্যাসেট আদানপ্রদানের কোনো ব্যত্যয় দেখিনি। আমাদের বাগানের ফুল তুলেই ওবাড়ির ঠাকুমা নিত্য পূজা করতো আবার আমাদের কারো ঠান্ডা কাশি দেখলে নিজ হাতে তাদের তুলসী গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে এনে দাদিকে বলতো, —মধু মিশাইয়্যা খাওয়াই দেও, কাশি ভালো হইয়্যা যাইবো।

আমার ছোট দুইবোন ওবাড়ির আরতি, মালতি, শেফালি পিসিদের কোলে কোলেই ঘুরতো। কোনো কোনো দুপুরে হয়তো শম্ভু কাকার স্ত্রী অর্চনা কাকি তাদের ছেলে মনীশের পাশেই ঘুম পাড়িয়ে দিত ওদের। এমন সরল-নির্মল সম্পর্কের দেয়ালে মামলার মতো জটিল-কুটিল-স্বার্থগন্ধী বিষয় দাঁত বসাতে পারে নাই। কেবল যেদিন মামলার তারিখ থাকতো সেদিন দুই বাড়ির কর্তাদেরই মাথা গরম আছে বিবেচনায় ঝি-বৌয়েরা সামলে চলতো। দু-চারদিন দেখে বুঝে আবার ঠিক একইরকম মেলামেশা চালিয়ে যেত। তবে হঠাৎ কখনও খুব সাবধানে, ফিসফিসিয়ে তারা নিজেদের শঙ্কা ভাগাভাগি করতো। কিন্তু কোনো আশা জাগানিয়া সদুত্তর না পেয়ে সময় তথা ভবিষ্যৎ নামক ভূতের ঘাড়ে চিন্তা চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের বর্তমানটুকুতেই মনোযোগী হতো।

আদতে সময় এক আশ্চর্য পরিব্রাজক। সে তার আপন গতিতে চলমান থাকলেও তাকে ঘিরে আবর্তিত মানুষের যে জীবনচক্র তাতে বহু চড়াই-উৎরাই থাকে। সে জীবনের রঙ কখনও বর্ণিল, কখনও ধূসর হয়। সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাবও সময়ের ফেরে গোলমেলে হয়ে যায় অথচ সে থাকে দিব্যি নির্বিকার! জীবনের উপর গিয়েই সব দায় বর্তায়; মানে, যে যাপন করে তার! যেদিন উচ্চ আদালতের রায়ে দাদাভাইয়ের জিদের জয় হল সেদিন ওবাড়ি থেকে মরাকান্নার সুর ভেসে এসেছিল। দাদাভাই অমল ঘোষকে অর্বাচীন, মুর্খ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও দাদি আর মা নীরবে চোখ মুছেছিল। প্রকৃতির খেয়ালে এর দিন দুই পরই ছোট চাচা মারা যায়। অসুখবিসুখ কিছুই না, অমন ছটফটে তরতাজা তরুণ ছেলে ঘুমের মধ্যেই মরে ছিল। সকালে দরজা ভেঙে তার লাশ বের করা হলে কেউ বললো স্ট্রোক, কেউ বললো শত্রæতা করে বাণ মারা হয়েছে। আমার দাদি সেসব কানে না তুলে বিলাপ করেছিল ‘অভিশাপ’ ‘অভিশাপ’ বলে।

ঘোষেদের চলে যাওয়ার পর দাদাভাই বাড়ির সীমানা প্রাচীর বর্ধিত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। যদিও আমাদের খুব মনমরা লাগতো। ঐ ঘটনায় পুরো পাড়া জুড়েই শোক নেমেছিল বোধহয়! দরকার ছাড়া প্রতিবেশীরা আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়াই একরকম ছেড়ে দিয়েছিল। আসলে দাদাভাইও যে জিদ, আগ্রহ নিয়ে মামলা শুরু করেছিলেন সময়ের সাথে তা থিতিয়ে পড়েছিল। শেষের দিকে একরকম বাধ্য হয়েই টেনে নিয়েছিলেন হয়তো। উপরন্তু ছোট চাচার মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানা নেন এবং বাড়ি দখলের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মারা যান।

এরপর দাদি আর মা গোঁ ধরে বাবাকে এই অভিশপ্ত বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেন। দাদার ব্যবসার অবশিষ্ট পুঁজি আর সঞ্চয়ের সবটুকু দিয়ে বাবা ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটে মামাদের সাথে দোকান নিয়ে বসেন। এত বছরের ইপ্সিত সম্পত্তি, ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে কিছুদিন পর আমরাও বাবার কাছে চলে আসি। আমাদের পড়ালেখা, বিয়ে পর্যন্ত ভালোই চলছিল সব। মাঝে অবশ্য দাদি মারা যায়। তবে রোগেশোকে সে নিতান্ত কাহিল হয়ে পড়েছিল বলে ওটা একরকম স্বাভাবিকই ধরে নিয়েছিলাম। সমস্যা বাঁধে বাবার মৃত্যুর পর। গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মা একসাথে আহত হলে হাসপাতালে বাবার মৃত্যু হয় কিন্তু মা কোনোরকমে বেঁচে যায়। মার এই বেঁচে যাওয়ায় তাৎক্ষণিক আনন্দিত হলেও গত এক বছরে দুর্ঘটনা পরবর্তী বিবিধ জটিলতায় আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। মায়ের দেখাশোনা আর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বোনেদের হিমশিম অবস্থা! অগত্যা ঘিওরের এই বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে, ছোট চাচার মৃত্যুর পর দাদাভাই পুরো বাড়িটা বাবার নামে লিখে দেন আর পুত্রসন্তান না থাকায় উত্তরাধিকারের ঝামেলা এড়াতে বাবা আমাদের তিনবোনকে হেবা করে দিয়েছেন।তাই ওটা বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে তা থেকেই মায়ের যাবতীয় খরচ চালানোর বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। স্বামীদের কাছে হাত না পেতে নিজেদের আত্মসম্মান বাঁচাতেই এই ব্যবস্থা। সেমতে স্থানীয় এক জমির দালালের মাধ্যমে দরদাম চূড়ান্ত করে আজকে রেজিস্ট্রি দিতে আসা। বাকি দুই বোন পাওয়ার অফ এটর্নি দেওয়ায় আমি একাই এসেছি। ঘিওর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার একটু আগে দালালকে ফোন দিলে সে জানায় লাঞ্চের পর কাজ হবে। খাসকামরায় বসে বিশেষভাবে কাজটা করতে চেয়েছি বলে সাবরেজিস্ট্রার সাহেব উনার অন্যান্য নিয়মিত কাজ শেষে আমাদের সময় দিয়েছেন। এ সংবাদে খানিক স্বস্তিবোধ করি এই ভেবে যে, শেষবারের মতো বাড়িটাতে যাওয়ার একটু ফুরসৎ মিলে গেল।

বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে বার কতক থামতে হয় আমার। এতদিন পর পাল্টে যাওয়া পথঘাট চিনতে লোকেদের জিজ্ঞেস করে করে তবেই গন্তব্য খুঁজে পাই।আমাদের বাড়ি লাগোয়া খালটা এখন পাকা রাস্তা। বর্ষাকালে ঝোড় সামাদ আর চোর সামাদের বাড়ি আলাদা করা এই খাল বেয়েই নদীর পানি আমাদের বাঁশতলা, বকুলতলা ভাসিয়ে এসে পড়তো পুকুরে। ফলে রাতারাতি পুকুরের পানি বেড়ে গিয়ে পাশের পালান, সামনের হালট ডুবিয়ে দিতো। ঘোষ বাড়ির ছোট মেয়ে টুবলি আর আমি পুকুরপাড়ে আলাদা আলাদা কঞ্চি পুঁতে রেখে ‘জল’ আর ‘পানি’ বাড়ার মাপ রাখতাম। অবশ্য তখনও আমরা ‘পুঁতে রাখা’ শব্দটা চিনি না; আমরা তখন কঞ্চি গাইরা থুইতাম। কোনো কোনোদিন কঞ্চি বেয়ে শামুক উঠতো, উঠতো মানে কামড়ে ধরে থাকতো। দাঁত নেই তবু ওরা কীভাবে কামড়ে থাকে জিজ্ঞেস করলে ছোট চাচা ফট করে একটা শামুক ধরে বাড়ি দিয়ে ভেঙে ভেতরটা দেখাতো। থকথকে অস্থি, পিলপিলে পা দেখে গা গুলাতো, আমি আর টুবলি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে যেই চোখ বন্ধ করতাম তা আবার খুলতাম ছোট চাচারই ডাকে।পুকুরের ‘চোখে’ পেতে রাখা জালে আটকা নতুন পানির মাছ দেখিয়ে সে আমাদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করতো।কী আমুদেই না ছিল ছোট চাচা!

প্রবেশপথের সদর দরজায় ‘সরকার বাড়ি’ লেখাটা শ্যাওলা আর জংলি লতায় ঢেকে গেছে। অযতœ, অবহেলায় বাড়ির ভিতরের গাছপালা, ঝোপঝাড়েরাও এমন বেয়াড়া আকৃতিতে বেড়েছে যে দুপুরবেলার তেজদীপ্ত সূর্যের আলোও তেমন সুবিধা করে উঠতে পারছে না। আশেপাশের বসত বাড়িগুলোর তুলনায় এ যেন বিচ্ছিন্ন নির্জন এক ভুতুড়ে বাড়ি।কেন ‘সরকার বাড়ি’ খোঁজ করায় লোকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল আর ‘ভুতের বাড়ি’, ‘প্রেমশন বাড়ি’ এসব অদ্ভুত নাম বলছিল,বাড়ির সামনে এসে তা বোঝা গেল।সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভার বলল—ম্যাডাম, বহুদিনের পরিত্যক্ত বাড়ি, সাপখোপ থাকতে পারে ভিতরে না ঢুকাই ভালো হবে। আমি ওর নিষেধ উপেক্ষা করে একটা ছোট ডাল হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ি। স্মৃতি আর বুনো গন্ধের ঝাপটায় আমার মস্তিষ্ক ক্রমে আচ্ছন্ন হয়ে আসে, কেমন যেন ঘোরলাগার মতো মনে হয়।  কুয়াতলায়, পুকুর ঘাটে, যেখানে আমাদের শোবার ঘর ছিল তার সামনের উঠানে, সবখানে আমার লেগে থাকা শৈশব দেখতে পাই। মনে হয় ঐ তো টুবলি, যার সাথে হরিহর-আত্মা হয়ে সারাদিন বিচিত্র কর্মকাণ্ড করে বেড়াতাম। পাড়ার অন্য সাঙ্গপাঙ্গরাও এসে জুটতো আমাদের সাথে। বাড়ির সামনের নীচু জমিকে আমরা বলতাম ‘পালান’। রান্নাবাটি খেলায় সে পালানের জঙ্গল থেকে দুধকলসের ফুল তুলে এনে মধু চুষে খেয়ে তা দিয়ে খই বানাতাম। একধরনের জংলি লতায় ফুটে থাকতো থোকা থোকা সাদা ফুল, নাম জানি না, সেসব হত ফুলকপির তরকারি। আবার তেলাকুচা ফলকে তরমুজ, জগডুমরাকে রসগোল্লা আর পিপলটি পাতা পানিতে ডলে পিচ্ছিল তরলে পরিণত হলে তাকে মিষ্টির সিরা বানিয়ে কুটুমবাড়ি নিয়ে যেতাম। মেলা থেকে কিনে আনা মাটির পুতুল বিয়ে দিয়ে সদ্য হওয়া সেসব কুটুমেরাও নানা উপাচারে আমাদের সমাদর করতো। পাল বাড়ির এলা, গদা, ইতি, সাহা বাড়ির ডুডু, গৌড়, বুড়ি কিংবা হালটের ঐপারের সুমন, মুরাদরাও খেলতে আসতো। ওরা কেউ দোকানদার, কেউ গাড়োয়ান আবার কেউ আমাদের বেয়াই বেয়াইন সাজতো। সে বয়সে ছেলেমেয়েতে প্রভেদ বুঝতাম না, সবাই এক সাথেই খেলতাম। তবে ছেলেদের কিছু কিছু আচরণ বুঝিয়ে দিতো, ওরা খানিক আলাদা! খেলতে খেলতে ওদের কোনো একজনের হিসু চাপলে একে একে সবাই গিয়ে দাঁড়াতো। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে হিসু করার পর কারটা বেশি দূরে গেছে তা নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধাতে। সে গণ্ডগোল হাতাহাতিতে পৌঁছালে মাটিতে দাগ দেখে বিজয়ী সনাক্ত করে তবেই ওদের থামানো যেত। আবার খেলা শেষ হলে ধুলামাটি মাখা প্যান্ট খুলে বাঁশের মাচাইলে রেখে ওরা পুকুরে নাইতে নামতো। অনেকক্ষণ ধরে ডুবানোর ফলে পানির শ্যাওলা লেগে নাকের তলায় গোঁফ গজাতো, চোখ হয়ে উঠতো কানাকুয়ো পাখির মত টুকটুকে লাল, ততক্ষণে কারো না কারো মা এসে কঞ্চির লাঠি হাতে নিয়ে বকে-ঝকে সবকটাকে পানি থেকে তুলে বাড়ি পাঠাতো। ওদের বেশ শাস্তি হয়েছে দেখে আমি আর টুবলি মাথাভাঙা কৃষ্ণচূড়া গাছের গোড়ায় বসে হেসে কুটপাট হতাম। ক্যামেরার ফ্ল্যাশব্যাকের মত মাথার ভিতর গচ্ছিত স্মৃতির ফিতা টেনে টেনে শৈশব হাতড়ে বাড়িময় হাঁটা শেষে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াই, টলটলে সেই জলাধার আজ হাজামজা ডোবা। টুপ করে একটা ঢিল ছুঁড়ে দেই কিন্তু তাতে জলের বুকে আলোড়ন না তুলে বরং আমার বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি ওঠায়।

দালাল লোকটা অপেক্ষা করতে পারছে না। দলিলের কাজটুকু হয়ে গেলে তবেই সে তার প্রাপ্য টাকাটা পাবে তাই ক্রেতা-বিক্রেতার চেয়ে তার তাগিদই যেন বেশি। আমি বাড়িতে এসেছি শুনে এখানেই হাজির হয়, তার সাথে নিয়ে আসা ভদ্রলোকের পরিচয় দিয়ে বলে, আফা, উনি হইলেন আপনের জমিনের ক্রেতা মনীশ ঘোষ, পিতা স্বর্গীয় শম্ভু ঘোষ। রেজিস্ট্রি করনের আগে আপনেরা দুইজনেই দলিলডা পইড়া দ্যাহেন, ভুলত্রুটি কিচু থাকলে এহনই সাইরা নেওন বালো।

লোকটার কথার জবাব না দিয়ে মনীশের মুখের দিকে তাকাই। আমার চমকে যাওয়াটা ও কীভাবে উপভোগ করছে বোঝার চেষ্টা করি। নিজেকে সংবরণ করে ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ঝুলিয়ে বলি, চলুন, তাহলে গাড়িতে গিয়ে বসা যাক।

ওরা তাগিদ দিতেই এসেছিল। বলা মাত্র লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত এগিয়ে যায় আর আমি যেতে যেতে থমকে থামি, অস্ফুটে শুনতে পাই ঘোষদাদুর কণ্ঠ! অমল ঘোষ প্রতি রাতে বাজারের দোকান বন্ধ করে সস্তা মদে চুর হয়ে টলমল পায়ে বাড়ি ফিরতো আর জড়ানো গলায় গাইতো—‘আামি অকৃতি অধম বলেও তো মোরে কম করে কিছু দাওনি, যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি…।’

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত