একটি বেকার প্রেমিক এবং
কবি সমর সেন (১৯১৬ – ১৯৮৭) ৪০দশকের একজন উজ্জ্বল কবি। যিনি খুব অল্পসময় কবিতা লিখেছেন। আজ ইরাবতী’র পাঠকদের জন্য রইল সমর সেনের তেরটি কবিতা।
………………………………………………………………..
বিস্মৃতি
ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে।
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস।
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।
হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হ’লো,
তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ ধতা এলো,
বৃষ্টির আগে শব্দহীন গাছে যে-কোমল, সবুজ স্তব্ধতা আসে।
………………………………………………………………..
বিরহ
রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায়।
তুমি এখনো এলে না।
সন্ধ্যা নেমে এলো : পশ্চিমের করুণ আকাশ,
গন্ধে ভরা হাওয়া,
আর পাতার মর্মর-ধ্বনি।
……………………………………………….
স্বর্গ হ’তে বিদায়
সমুদ্র শেষ হ’লো,
আজ দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো।
সমুদ্র শেষ হ’লো
গভীর বনে আর হরিণ নেই,
সবুজ পাখি গিয়েছে ম’রে,
আর পাহাড়ের ধূসর অন্ধকারে
দুরন্ত অন্ধকার ডানা ঝাড়ে
উড়ন্ত পাখির মতো।
সমুদ্র শেষ হ’লো,
চাঁদের আলোয়
সময়ের শূন্য মরুভূমি জ্বলে।
………………………………………………………………..
বসন্ত
বসন্তের বজ্রধ্বনি অদৃশ্য পাহাড়ে।
আজ বর্ষশেষে
পিঙ্গল মরুভূমি প্রান্ত হতে
ক্লান্ত চোখে ধানের সবুজ অগ্নিরেখা দেখি
সুদূর প্রান্তরে।
…………………………………………………………..
স্তোত্র
আদিদেব একা সাজে পুরুষ প্রকৃতি।
মহাজন চাষি তিনি সবাকার গতি।
কৃষ্ণকালো বড়ো মেঘ জুড়েছে আকাশ।
শ্যামবর্ণ মূর্তি তার চাষির আশ্বাস।
ধান দেখে মহাজন বলেছে সাবাস।
আকাশে শুনেছি আজ মেঘের বিষাণ
ঘরে-ঘরে বুঝি আজ রাসলীলা গান।
সাপ যত বসে আছে শিকারের তালে
রাত্রি এল, মৃত্যু লেখা ব্যাঙের কপালে।
মহাজন গান গায় নদারৎ ধান
অন্ধকার প্রেতলোকে ভাবে ভগবান।
অক্ষম এ রায়বার ঈশ্বর কথনে
প্রভুর বন্দনা শুনি বেনের ভবনে।
…………………………………………………………
নচিকেতা
“কে এসেছে কালরাত্রে কৃতান্তনগরে?
এখন হাটের বেলা, এখানে মজার খেলা,
সারি-সারি শবদেহ সাজানো বাজারে।
বজ্রনখ উলূক রাত্রির কালো গানে
দেশভক্ত বিভীষণ, মত্সবন্ধু বকধার্মিকের
কাঁধে হাত রেখে, দেখ, চলে,
মহম্মদী বেগ্ খর খড়্গ শানায়,
বাজার ভরেছে আজ হন্তারক দলে।
দুঃসাহসে তুষ্ট আমি | আশীর্বাদ করি,
পৃথিবীতে জন্ম যেন না হয় তোমার।”
“রক্তজবা সূর্য ওঠে পর্বত শিখরে,
বৃষ্টিবিন্দু দাও দেব বটের শিকড়ে।
অনাবৃষ্টির আকাশ হোক অন্যরূপী
তিন কুল ভ’রে দাও জনে ধনে জনে সুখী।”
………………………………………………………………..
বিকলন
তোমাকে দেখেছি দেবী লোহিত সকালে,
মাইকেলী মেঘনাদে, বিদ্যাসাগরের
বজ্রগর্ভ করুণায়, বিপ্লবী আরাবে।
আজ বিলাপের কাল! আনন্দ আকাশে
জুটেছএ অন্যান্য জীব, হননের মন্ত্র মুখে।
পোড়ামুখ ভুলে যাও, হে জননী, এ ঘোর দুর্দিনে ;
রজকের কি বা লাভ উলঙ্গের কাছে!
বিফলে গভীর রাত্রে চাঁদ ওঠে।
অতীতের ঐশ্বর্যমহিমা চেতনার প্রান্তে আজ
বিভীষিকা মূর্তি ধরে, পদ্দার উদ্দাম গান
মাত্রারিক্ত! করাল জোয়ার! আমার সোনার ধানে
পরিচিত হাত রাখে শত্রুর দালাল।
দিগন্তে ধূসর মাঠে গতপত্র বট
মাথা নাড়ে প্রবীণ ক্লান্তিতে। সে কি জানে
যৌবনে অন্যায় ব্যয়ে বয়সে কাঙালি
দিনগত পাপক্ষয়ে মূঢ় ভ্রান্তমতি
লোকায়ত কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন বিধুর
মধ্যবিত্ত মানসের বিড়ম্বিত গ্লানি?
……………………………………………………………..
মেঘদূত
পাশের ঘরে
একটি মেয়ে ছেলে-ভুলানো ছড়া গাইছে,
সে ক্লান্ত সুর
ঝ’রে-যাওয়া পাতার মতো হাওয়ায় ভাসছে,
আর মাঝে মাঝে আগুন জ্বলছে
অন্ধকার আকাশের বনে।
বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা। বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্র জলে ঘরবাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু ও মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন
সদলবলে গাইবে দুর্ভিক্ষের স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস,
ফিরে যাবে তুমি বিবাহিত প্রেমিকের কাছে।
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও,
কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে ?
…………………………………………………………….
মুক্তি
হিংস্র পশুর মতো অন্ধকার এলো—
তখন পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশ রক্তকরবীর মতো লাল
সে-অন্ধকার মাটিতে আনলো কেতকীর গন্ধ,
রাতের অলস স্বপ্ন
এঁকে দিল কারো চোখে,
সে-অন্ধকার জ্বেলে দিলো কামনার কম্পিত শিখা
কুমারীর কমনীয় দেহে।
কেতকীর গন্ধে দুরন্ত,
এই অন্ধকার আমাকে কী ক’রে ছোঁবে ?
পাহাড়ের ধূসর স্তব্ধতায় শান্ত আমি,
আমার অন্ধকারে আমি
নির্জন দ্বীপের মতো সুদূর, নিঃসঙ্গ।
…………………………………………………..
উর্বশী
তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!
কিংবা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,
হে ক্লান্ত উর্বশী,
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে
উর্বর মেয়েরা আসে
কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধার ক্লান্তি,
কত দীর্ঘশ্বাস,
কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,
আর কতো দিন!
………………………………………………………..
নিরালা
বর্তমানে মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা,
মাঝে মাঝে মনে হয়,
দুর্মুখ পৃথিবীকে পিছনে রেখে
তোমাকে নিয়ে কোথাও স’রে পড়ি।
নদীর উপরে যেখানে নীল আকাশ নামে
গভীর স্নেহে,
শেয়াল-সংকুল কোনো নির্জন গ্রামে
কুঁড়েঘর বাঁধি ;
গোরুর দুধ, পোষা মুরগির ডিম, খেতের ধান ;
রাত্রে কান পেতে শোনা বাঁশবনে মশার গান ;
সেখানে দুপুরে শ্যাওলায় সবুজ পুকুরে
গোরুর মতো করুণ চোখ
বাংলার বধূ নামে ;
নিরালা কাল আপন মনে
পুরোনো বিষণ্ণতা হাওয়ায় বোনে।
…………………………………………………
তুমি যেখানেই যাও
তুমি যেখানেই যাও,
কোনো চকিত মুহুর্তের নিঃশব্ দতায়
হঠাৎ শুনতে পাবে
মৃত্যুর গম্ভীর, অবিরাম পদক্ষেপ।
আর, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে?
তুমি যেখানেই যাও
আকাশের মহাশূণ্য হ’তে জুপিটারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
লেডার শুভ্র বুকে পড়বে।
——————————————————-
একটি বেকার প্রেমিক
চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি।
সকালে কলতলায়
ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,
খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্ দ শুনি ;
মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভাবে কী যেন ভাবি—
হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি ;
আর শহরের রাস্তায় কখনো প্রাণপণে দেখি
ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।
আর মদির মধ্য রাত্রে মাঝে মাঝে বলি
মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূণ্য মরুভূমি।
…………………………………………………
একটি মেয়ে
আমাদের স্তিমিত চোখের সামনে
আজ তোমার আবির্ভাব হ’লো
স্বপ্নের মত চোখ, সুন্দর, শুভ্র বুক,
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভিক আভাস
আমাদের কলুসিত দেহে
আমাদের দুর্বল, ভীরু অন্তরে।
সে-উজ্জ্বল বাসনা যেন তীক্ষ্ণ প্রহার।
…………………………………….
নিঃশব্দতার ছন্দ
স্তব্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বিশাল অন্ধকারে শুধু একটি তারা কাঁপে,
হাওয়ায় কাঁপে শুধু একটি তারা।
কেন তুমি বাইরে যাও স্তব্ধরাত্রে
আমাকে একলা ফেলে?
কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন, নিঃশব্দ পাথরের মতো?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাঁপে;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায়?
মাঝে মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তোমার নিঃশব্দতার ছন্দ :
সহসা বুঝতে পারি—
দিনের পর কেন রাত আসে
আর তারারা কাঁপে আপন মনে,
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে সবুজ প্রাণ;
চপল, তীব্র, নিঃশব্দ প্রাণ—
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে কেন তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায়।
