গীতরঙ্গ: পাখি যখন গান বাঁধেন । সংগ্রামী লাহিড়ী
শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো। ভারী ঘটার, জাঁকজমকের পুজো। মহারাজা রাধাকান্ত দেব নিজে পুজোর আয়োজন করেন। রাজার অঢেল পয়সা, দিলদরিয়া মেজাজ, খরচে কার্পণ্য নেই। মেলা সাহেব–মেম নেমন্তন্ন পান। জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে পুজো দেখতে আসেন। তার সঙ্গে হরেক আমোদপ্রমোদ। বাইনাচ, থিয়েটার, বুলবুলির লড়াই, কী নেই! লাখ লাখ টাকা ওড়ে শোভাবাজারের রাজবাড়ির পুজোয়। সাহেব–মেমরা দু‘শো মজা লুটে, হরেক উপঢৌকন নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
সবসময় নতুন কিছু করার সুযোগ খুঁজতেন রাজা রাধাকান্ত দেব। একবার মনে হল, এই যে ফি বছর পুজোয় তিনি নাচগানের আসর বসান, নামী ওস্তাদ, তবায়েফ গান করেন, সবই ঠিক আছে। কিন্তু গানের কথা তো সাহেব–মেম বোঝেন না! আসরে বসে তাঁরা ঘাড়–টাড় নাড়েন বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই উসখুস। বাইনাচ অবশ্য তাঁদের পছন্দের। লাস্যময়ী বাইজিদের পেশোয়াজের চমক আর ওড়নার ঠমক বেশ রসিয়েই উপভোগ করেন তাঁরা। নাঃ, গান নিয়ে কিছু একটা করতেই হচ্ছে।
খবর পাঠালেন রূপচাঁদকে। পটলডাঙ্গার রূপচাঁদ দাস, বাগবাজারে তার আখড়া। আদি নিবাস ছিল উড়িষ্যা। খাসা গান লিখিয়ে। নানারঙের, নানা রসের গান। ভক্তিরসের গান, বাউল ও দেহতত্ত্বের সহজিয়া সংগীত, পশ্চিমের ধাঁচে টপ্পা, সবরকমের গান বাঁধায় সিদ্ধহস্ত। সেবার লিখল কেমন একখানি আগমনী গান,
‘গো মেনকা! অম্বিকা হের আসিয়ে।
একবার নয়ন প্রকাশিয়ে,
গগনের শশী আসি উদয় তবালয়ে।’
উমা এসেছেন মেনকার ঘরে। সে গান শুনে সব্বার চোখে জল।
উড়িষ্যানন্দন রূপচাঁদের মাথায় বুদ্ধির চাষ। কয়েকটা ছেলেছোকরা জুটিয়ে একখানা পাঁচালির দল গড়েছে। তারা নিজেদের বলে ‘পক্ষী‘ অর্থাৎ পাখি। এক একজন এক এক পাখির ডাক নকল করে। পাখির ভাষায় নাকি কথা বলে তারা। রূপচাঁদের লেখা গান গেয়ে আসর মাতায় পাখির দল। আর গাঁজা টানে ছিলিম ছিলিম। রূপচাঁদ তাদের মধ্যমণি। পক্ষীরাজ। এমনকি নিজের পাল্কিতেও কারিকুরি করে তাকে পাখির খাঁচার আকার দিয়েছে।
রাধাকান্ত দেব নিজের মনেই হাসেন। ছোকরার মাথায় অদ্ভুত সব আইডিয়া গজায়। ও–ই পারবে।
খাঁচার গাড়িতে চেপে শোভাবাজারে হাজির হল রূপচাঁদ, “ডেকেছেন মহারাজ?”
“হ্যাঁ, তোমাকেই আমার দরকার।“
“আদেশ করুন।” রূপচাঁদ মাথা নুইয়েছে।
“এমন একখানি গান বাঁধতে পারো, যা শুনে সায়েবরা খুশি হয়ে যাবে?”
“ওঃ, এই কথা, আমি তো ভাবলুম কী না কী!”
“কাজটা বড় সহজ নয় রূপচাঁদ। সায়েবরা আমাদের ভাষা বোঝে না।“
“মহারাজ, অধমের পেটে একটুআধটু ইংরিজি বিদ্যে আছে।“
“তুমি ইংরেজিতে গান লিখবে নাকি?” মহারাজ অবাক!
“না না মহারাজ, আমি গাইব কীর্তন।“
“আরে? এরা কীর্তনের কী বুঝবে? গাঁজা টেনে টেনে মাথাটাই গেল নাকি তোমার?”
“মহারাজ, আর যাই বলে গাল দিন না কেন, গাঁজা টেনে কথা বলবেন না।” রূপচাঁদ খুবই দুঃখ পেয়েছে। “আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। দেখুন কী হয়। আপনি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিন, এবার দুগ্গাপুজোয় পক্ষীদের রাজা রূপচাঁদ গান শোনাবে।“
পেন্নাম ঠুকে বিদায় নিল। রাজা চিন্তিত। সায়েব-সুবোর সামনে ব্যাটা মুখ ডোবাবে না তো? দেখা যাক!
পুজোয় বসেছে গানের জলসা। আসরে হাজির হল রূপচাঁদ। পিঠে পাখির মত ডানা। খগরাজ বলে পরিচয় দিল নিজের। সভায় সব সায়েব–মেমকে আগে বুঝিয়ে দিল তার গানের বৃত্তান্ত।
“তোমাদের যে গড, আমাদের সে–ই হল শ্রীকৃষ্ণ। সেই কৃষ্ণের সঙ্গে গোয়ালিনী শ্রীরাধিকার প্রেম হল। তারপর একদিন কৃষ্ণা বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় গিয়ে রাজা হলেন। শ্রীরাধিকা পড়ে রইলেন বৃন্দাবনে। দুঃখের সীমা নাই। ‘লাভার‘ তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন।“
সায়েবরা উৎসুক। জমজমাট একখানি প্রেমের কাহিনি।
“তারপর?”
“‘লাভার‘কে ছেড়ে থাকতে না পেরে রাধিকা এক সখীকে পাঠালো মথুরায়, কৃষ্ণের কাছে। কিন্তু কৃষ্ণ যে মথুরার রাজা! রাজার দেখা পাওয়া কি অতই সহজ? রাজসভার রক্ষীরা গলাধাক্কা দিলে শ্রীরাধিকার দূতীকে। তবে সে মেয়েও জাঁহাবাজ। ছাড়বার পাত্র নয়। গান ধরল,
Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী
এসেছি ব্রজ হতে আমি ব্রজের পুরনারী
Beg you doorkeeper let me get, I want to see blockhead
For whom our রাধে date, আমি যে তার search করি
Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী।
ও রাধার কেনা servant, এই দ্যাখো দাসখত agreement
এখুনি এ করবো present, আমি ব্রজপুরে লবো ধরি
Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী।
Moral character শোনো ওর, ও butter thief ননী চোর
আর black আর রাখাল poor, চোর মথুরার দণ্ডধারী
Let me go ওরে দ্বারী, I visit to বংশীধারী।
কহে রূপচাঁদ bird’s king, Black nonsense very cunning
আবার flute বাজিয়ে করে sing, মজায়েছে রাইকিশোরী।“
ঝিঁঝিটখাম্বাজ রাগে গানটির মজাদার চলন খুব সহজেই শ্রোতার মনোযোগ টেনে নেয়। তার ওপর এমন একখানি খাসা প্রেমকাহিনি। প্রেমিক ‘গড‘এর বৃত্তান্ত শুনে সায়েব–মেমের দল ভারি খুশি। হাততালিতে আসর ফেটে পড়ল। খুব ভালো লেগেছে গান।
রাধাকান্ত দেব খুব খুশি। মান রেখেছে রূপচাঁদ।
পাখির রাজা রূপচাঁদের ছিল অসামান্য প্রতিভা। গান লিখতেন, সুর দিতেন, আবার গাইতেনও। বিশেষ করে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গান বাঁধতে তাঁর জুড়ি ছিল না। পক্ষীর সঙ্গে মানুষের জাতিবিচার মিলিয়ে লিখেছিলেন এক মজার গান –
পক্ষীর ওছা কাদাখোঁচা, কালোপেঁচা বাহাডুরে,
পাখি আরগিন বঙ্গের কুলীন গুহ পদবী ধরে,
কোকিল বৈদ্য বুদ্ধি হদ্দ, ঠকায় কালো কাকেরে,
নবশাক চক্রবাক নবরঙ্গের নয় জাতি।।
কলকাতা শহরের বর্ণনা অক্ষয় হয়ে আছে তাঁর গানে।
ধন্য ধন্য কলিকাতা শহর।
স্বর্গের জ্যেষ্ঠ সহোদর।
পশ্চিমে জহ্নবীদেবী দক্ষিণে গঙ্গাসাগর।
এখানেই না থেমে আরও একধাপ এগিয়ে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করলেন শহর কলকাতাকে –
স্বর্গধামে মন্দাকিনী, কলকাতাতে সুরধুনী,
নন্দনকানন ইডেনগার্ডেন সম নিছনি,
ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, কলকাতাতে ফিটেন রথ,
পারিজাতকে করে মাত গোলাব সেঁউতি নাগেশ্বর।।
সিন্ধু কাফি রাগে যৎ তালে বাঁধা গান। এখনো শোনা যায় পুরাতনী গানের শিল্পীদের গলায়।
সেকালে নব্য শিক্ষিত বাবুদের রেওয়াজ ছিল ইংরেজির মিশেল দেওয়া বাংলায় কথা বলা। অনেকটা এখনকার মতই আর কী – ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না‘ গোত্রের ব্যাপার। বাংলার আক্ষরিক অনুবাদে অনেকসময় হাস্যকর ইংরেজি শব্দের সৃষ্টি হত। কিন্তু তাতে কী? ইংরেজি বলতে পারা ছিল শ্লাঘার বিষয়।
বাংলা ইংরেজির মিশেলে রূপচাঁদের গানগুলি এই গোষ্ঠীর বাঙালিকে লক্ষ্য করেই লেখা। শ্রদ্ধেয় রামকুমার চট্টোপাধ্যায় গানগুলি গেয়ে জনপ্রিয় করেছেন। এরকমই আরেকটি গান, অভিনব দো–আঁশলা ভাষায় শ্রীরাধার বিলাপ। জংলাগৌড় রাগে একতালে বাঁধলেন।
আমারে fraud করে প্রাণকৃষ্ণ কোথায় গেলি
I am for you very sorry
আমার golden body হল কালি।
My dear dearest(ও), মধুপুরে গেলে কেষ্ট
বলো এখন how to rest(ও), শোনো dear বনমালী।
আমারে fraud করে প্রাণকৃষ্ণ কোথায় গেলি।
রাধা জাতে গোয়ালিনী। এ গানের পরের কথাগুলিতে সেই পরিচয় উঠে এসেছে।
আমরা poor creature milky গারেল (girl)
তাদের breastএ মারিলি শেল
Nonsense তোমার নাইকো আক্কেল, Breach of contract করে গেলি
আমারে fraud করে প্রাণকৃষ্ণ কোথায় গেলি ।
শ্রীনন্দের boy young lad, Very crooked, mind hard
কহে R. C. the bird (রূপচাঁদ পক্ষীর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে এখানে)
বলি Half English half Bengali…
এই শেষ লাইনেই রূপচাঁদ চাবুকটি মারলেন। ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে‘ স্বভাব বাঙালীর মজ্জাগত। বাদামী চামড়ার সাহেব হয়ে উঠতে বরাবরের চেষ্টা। বলাই বাহুল্য, রূপচাঁদ পাখির চিৎকার–চেঁচামেচিতে সাহেব–হতে–চাওয়া বাঙালির চৈতন্য হয়নি। বরং পাখির দলই একদিন কলকাতার বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পক্ষীরা নিশ্চিহ্ন, দল উঠে গেছে, গাঁজার আড্ডা ভেঙে দিয়েছে কলকাতার মিউনিসিপ্যালিটি। তবে রূপচাঁদের লেখা গানগুলি রয়ে গেছে সবার স্মৃতিতে, তাদের অভিনব কথা ও সুরের আবেদন নিয়ে।
[দুটি অডিও গানের কন্ঠ লেখক সংগ্রামী লাহিড়ী]

ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুদিনের চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ‘এ’ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা’র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পারসিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত ‘অভিব্যক্তি’ ও ‘অবসর’ পত্রিকার সম্পাদক।
‘ও কলকাতা’ ই-ম্যাগাজিনে ধারাবাহিক ‘সুরের গুরু’ প্রকাশিত হচ্ছে রাগসংগীতের শিল্পীদের নিয়ে। এছাড়া ‘বাংলালাইভ ডট কম’, ‘বাতায়ন’, ‘পরবাস’, ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক’, ‘গুরুচণ্ডা৯’, ‘ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।