উৎসব সংখ্যা গল্প: হরিচাঁপার ঘুগনি । সরোজ দরবার
হরিচাঁপার ঘুগনি
ঢলঢলে আর ট্যালটেলের মধ্যে তফাৎ আছে। লঘু মানেই তরল নয়। গুরুতর অনেক কিছুই তা অনেক ক্ষেত্রে ধারণ করতে পারে। হরিচাঁপার ঘুগনির কথাই ধরা যাক! মাখো-মাখো। হালকা ঝাল। মটরগুলো সব গায়ে গা। কিন্তু একেবারে গলে গলে ঢলেও পড়েনি। মাখামাখি হয়ে ঘণ্ট হয়ে গেলে আর ঘুগনির রইল কী! মটরের মন নরম হবে, একে অন্যের স্পর্শে ছিটকে বেরিয়ে যাবে না, অথচ প্রত্যেকে বস্তুত পৃথক। এরকম না হলে আর ঘুগনি কী! ঠিক যেমন হরিচাঁপার ঘুগনি। দু-এক কুচি নারকেল, উপরে ছড়ানো শশা-পেঁয়াজ, বিটনুন। তেতুল-লেবু জলের ছিটে।
-ব্যাপারটা সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল বলো দেখি?
-ঘুগনি-ই তো!
-ভুল। একে বলে অমৃত।
-ঘুগনি খেয়ে কে কবে অমর হয়েছে?
-হয়নি বলছ?
-ইতিহাস তো এরকম কোনও সাক্ষ্য দিচ্ছে না।
-বালের ইতিহাস।
-কী বললে?
-কিছু না। তবে, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, অমর না হলেও পুনর্জন্ম হয়েছে। হরিচাঁপার ঘুগনি খেতে লোকে আবার জন্ম নিয়েছে।
বাড়িয়ে বলা মুদ্রাদোষ। আমার, আপনার, প্রধানমন্ত্রীর, মুখ্যমন্ত্রীর- কার নয়! বললে বিশ্বাস করবেন না, বাড়িয়ে বলতে বলতে জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গেল। সে-কিস্সা অন্যদিন ফাঁদা যাবেখন। আপাতত বলা যাক, হরিচাঁপার ঘুগনি নিয়ে অনেকখানি বাড়িয়ে বলা হয়েছে। অমরত্বের প্রত্যাশা-ফত্যাশা ছেড়েই দিলাম। হরিচাঁপার লোক যে ঘুগনি খেতে আবার হরিচাঁপাতেই জন্ম নেবে তার গ্যারান্টি কোথায়! আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি পর্যন্ত নিশ্চিত করা যেতে পারে। তারপর? এর উত্তর নেই। তা ছাড়া পুনর্জন্ম ব্যাপারটা জাতিস্মরের মতোই হেঁয়ালি। তবে হ্যাঁ, ভাল খাবার খেয়ে লোকে বলতে পারে যে, এই স্বাদের জন্য আরও একবার জন্মাতে পারি। যেমন এই হরিচাঁপার ঘুগনির ক্ষেত্রে। তবে, বোঝাই যাচ্ছে যে, তা যত ভালই হোক না কেন, সেটাকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা বিশুদ্ধ বাড়াবাড়ি। মুদ্রাদোষে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা। বাড়িয়ে বলাটাকে আবার কেউ কেউ লুফে নেয়, যেমন রানা।
অবশ্য এর জন্য রানাকে কসরৎ করতে হয়েছিল বিস্তর। লুফে নেওয়া বললেই কি আর নেওয়া যায়! চাইলেই কেউ যুবরাজ বা কাইফের মতো ক্যাচ নিতে পারবে? খেয়াল করে দেখবেন, যে দু’জনের নাম এল, রানার ছোট থেকে বড় এবং আর-একটু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে তাঁরাই জড়িয়ে। অতএব রানার বয়স, ভাবনাচিন্তা, মানসিক গঠন, রানার সময় বলতে যা যা বোঝায় তা এখান থেকে আন্দাজ করে নেওয়া যায়। রানা চাকরি করছিল। প্রাইভেটে। চাকরিতে উন্নতিও করছিল। রানার বেতন বাড়ছিল, খরচ আরও বাড়ছিল, পাল্লা দিয়ে মানি ব্যাগে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বাড়ছিল। রানার বন্ধুবান্ধব ছিল। উইকএন্ডে হুল্লোড় ছিল। প্রেম-সোহাগ-যৌনতৃপ্তি। ছিল না এমন জিনিস তালিকা মিলিয়ে খুঁজে পাওয়া ভার। তবে, মোদ্দা কথা, রানা সুখী ছিল না। সুখ নেই, কেন নেই, কোথায় সুখ ইত্যাদি করে সে বেশ কিছুদিন ঘুরে মরল। তারপর দেখল, ব্যাপারটার কোনও কূলকিনারা নেই। আঙুলে রত্ন পরো কি বাজুতে শিকড় বাঁধো কিংবা কাউন্সেলিং করো কিচ্ছুতে কিচ্ছুটি হবার নেই। তখন, সে সব দোষ দিল বিশ্বায়নকে। পাঁচতলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে, কোনও এক শনিবার রাতে, রানা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, বাল বাল গ্লোবাল…। সে-কথা কেউ শোনেনি। রানার তৎকালীন প্রেমিকা তখন তাকে ফোন করছিল, অবধারিত ভাবেই কল রিসিভ হয়নি। ঠিক এইখানে এসেই রানার জীবনে ঢুকে পড়ল হরিচাঁপার ঘুগনি। তার পর্ব এবং পর্বান্তরগুলো খতিয়ে দেখা যায় এইভাবে:
ঘুগনি মাহাত্ম্য
ঘুগনি সম্পর্কে দু-চারটে সাধারণ কথা রানা আগে থেকেই জানত। যেমন, ঘুগনির মটর আগের রাতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। প্রেশার কুকারে খান তিনেক সিটি পড়লে মটর সেদ্ধ হয় ইত্যাদি। তবে, ঘুগনি কোনোদিন তার প্রিয় খাবার ছিল না। স্ট্রিট ফুড ব্যাপারটাকেই সে তেমন পছন্দ করে না। ঘুগনিকে ঠিক স্ট্রিট ফুড বলা যায় কি-না তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। রানা ঘুগনি খেয়েছে ক্যাজুয়ালি। বাড়িতে বা বন্ধুর বাড়িতে— মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। মুড়ি-ঘুগনি, পাউরুটি-ঘুগনি— এরকম বিন্যাসগুলোকে মাথায় রাখলে গরিবগুর্বো মানুষের খাদ্যাভ্যাসের আভাস পাওয়া যায়। তবে, ঘুগনি বিত্তউচ্চ কিংবা মধ্যবিত্তের বাড়িতেও দিব্যি চলে। বাড়িতে হয়, রাস্তায় বিক্রি হয়। মজার ব্যাপার হল, ঘুগনির ভিতর এক রকমের নস্ট্যালজিয়া জমানো আছে। নির্জন ঝিম্ ধরা পাড়ায় আসা ঘুগনি-ফেরিওয়ালার গল্প বা স্কুল-কলেজের বন্ধুদের আড্ডা কিংবা প্রথম প্রেমের সঙ্গে ঘুগনির বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শ্রেণি নির্বিশেষে ঘুগনির প্রতি যে একটা সর্বজনীন টান আছে, এইটে রানা একদিন, রবিবার, সেই আউটবার্স্টের পরে আবিষ্কার করল, যখন সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল উদ্দেশ্যহীন, এবং আচমকা প্রায় স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া ঘুগনিওলার থেকে কিনে শালপাতার বাটিতে দেওয়া ঘুগনি খেতে শুরু করেছিল। চারপাশে দাঁড়িয়ে আরও অনেকেই খাচ্ছিল। তারা বলাবলি করছিল নানা কথা। নানা স্মৃতি। সুখস্মৃতি। ঘুগনির মতোই মাখো-মাখো। আবেগের অল্প ঝোল, একটু ঝালে চোখে স্বল্প জল। তাতেই আনন্দ। সবকিছু ঘাঁটা মণ্ড নয়। ঘুগনির মটরের মতোই সব বয়ানগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল গায়ে গা ঠেকিয়ে, আর এক রকমের ঘুগনি হয়ে। ঘুগনি স্বাধীন। সর্বত্র তার বিচরণ। ঘুগনি পক্ষহীন। উদার।
খেতে খেতেই মনে মনে এরকম চকিত একটা সমীক্ষা চালিয়ে নেয় রানা। এবং তার চোখে পড়ে ঘুগনির অমিত সম্ভাবনা।
ডিসকভারি অফ ঘুগনি
এর পর রোববার করে করে এখানে ওখানে বেরিয়ে পড়ত রানা। শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে। মফস্বলের গলিতে, অলিতে চলিতে চলিতে ঘুগনির খোঁজ করত সে। তার প্রেমিকা তাকে সন্দেহ করতে শুরু করল। দু-দিন ছুটির পুরো একটা দিন প্রেমিক যুবক এমন বেপাত্তা হয়ে গেলে কোন মানুষ স্থিরচিত্ত হয়ে বসে থাকতে পারে! তবে, কিছুতেই কিছু হল না। রানা ঘুগনি-পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঘুগনি তাকে কুহকিনীর মতো টানছে, ঘুরিয়ে মারছে। নেশাতুরের মতো রানা ঘুরে বেড়ায়, ঘুগনি খায়। ঘুগনির গল্প শোনে। শহরের ঘুগনির একরকমের গল্প। শৌখিন নস্ট্যালজিয়া মটরের গায়ে আলতো আলগা লেগে থাকা খোসাগুলোর মতো। ছোটবেলার ছুটির দিন কিংবা বড়বেলার এক দিনের আড্ডার গল্প, অথবা, ন-কাকা কিংবা ডাকসাইটে বড় জ্যাঠার স্মৃতি মিশে আছে ঘুগনির গায়ে গায়ে। কেউ ব্রিলিয়ান্ট ছিল পড়াশোনায়, কেউ নকশাল ছিল, কেউ পার্টি করেছিল সারা জীবন ধরে। ভালোবাসত সব ঘুগনি খেতে। অকীর্তিত মানুষের ভিড় খাবারের সুতোয়। উত্তরপুরুষের রোজনামচায় এমনিতে তাঁদের ফিরে আসা কঠিন। ধরতাই হয়ে লেগে আছে এই ঘুগনি। একটু করে উসকে দিচ্ছে পুরো ব্যাপারটাকে।
শহর ছাড়িয়ে শহর-ঘেঁষা মফস্সলগুলোয় ঘুগনির ভিতর আবার খিদে-খিদে ভাব আছে। এই খাওয়াটা ব্রেকফাস্টও নয়, জলখাবারও নয়। শুধুই খিদে, মানে, ‘পেট চুঁইচুঁই মুড়ি-ঘুগনি খাবি?’ খুব একটা স্মৃতি-স্মৃতি বাতিক লেগে নেই এইসব ঘুগনির গায়ে। বরং পেট ভরানোর তাগিদ আছে। সকাল কিংবা সন্ধে। হয় খেয়ে খাটতে যাওয়া; নয় খেটে এসে খাওয়া। ঘুগনির সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস বেশ মিলেমিশে যাচ্ছে মফস্সলের গলিতে গলিতে। আরও ভিতরের দিকে অর্থাৎ গ্রামে-গ্রামেও সে চরিত্রটা ঠিক বদলায় না। তবে, রানা খেয়াল করে দেখল সেখানে যেন ঘুগনির কোনও গল্পই নেই। যেমন ভাতের নেই। মুড়ির নেই। কোনও কিছুরই নেই। আস্ত বেঁচে থাকারই কোনও গল্প নেই। স্রেফ প্রতিদিন টিঁকে যাওয়া। অতএব প্রতিদিন ঘুগনি হয় এরকমও কোনও ব্যাপার নেই। হলে খাওয়া, নইলে নয়।
হরিচাঁপার নির্মাণ
মাসখানেক ঘোরার পর, রানার সঙ্গে ঘুগনির সখ্য বেশ মাখো-মাখো। সে তখন যেখানেই ঘুগনি খায় পাশের লোককে জিজ্ঞেস করে, হরিচাঁপার ঘুগনি খেয়েছেন? হরিচাঁপা কোথায়! কেউ জানে না। তবে, কথা তো সেটা নয়। সেই যে সেখানকার ঘুগনি, যা কিনা রানা খেয়েছে বলে দাবি করে, সেটাই মূল কথা। এবং রানা বলে রাখে,– সেই ঘুগনিতে এমন কিছু একটা লুকিয়ে আছে, যা ভূ-ভারতে আর কোথাও নেই। মানে দামি রেস্তরাঁয় গিয়েও পাওয়া যাবে না। মফস্সলের পুরনো গলিতেও নেই। গ্রামের চালা দোকানে জনতার উপর কড়াইতে যে ঘুগনি ফুটছে সেখানেও নেই। ঘুগনির মতো ঘুগনি ছিল কেবল হরিচাঁপাতেই।
-নারকেল থাকত?
-থাকত।
-বিটনুন?
-সেটাও
-পেঁয়াজ, শশা কুচি?
-একদম।
-তাহলে আলাদা কী ছিল?
-এইটে বলা মুশকিল। সবই চেনা। ওরই মধ্যে অচেনা কী–একটা ছিল। যে না খেয়েছে বুঝবে না।
-কীভাবে খাওয়া যায়?
এই উত্তরটা পর্যন্তই অপেক্ষা করত রানা। ততদিনে তার দৌলতে চতুর্দিকে লোকে জানতে শুরু করেছে যে হরিচাঁপার ঘুগনি ছিল সেরার সেরা। কেউ কেউ, যাঁরা একটু তর্ক করতে ভালোবাসেন, প্রশ্ন করেছিলেন যে, হরিচাঁপা মানচিত্রে ঠিক কোথায়? রানা খেয়াল করে দেখেছিল, গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। এই যে জয়নগরের মোয়া, কতজন ইন্টারেস্টেড জয়নগরের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ নিয়ে! শক্তিগড়ের ল্যাংচা- শক্তিগড় নিয়ে কার মাথাব্যথা! ঠিক তেমনই হরিচাঁপার ঘুগনি। কারুর হরিচাঁপা নিয়ে কৌতূহল নেই। ঠিক যেমন রানার ছিল না। এক দিন এক গলিতে ঘুগনি খেতে খেতে এক বাচালের মুখে হরিচাঁপার কথা সে প্রথম শুনেছিল। লুফে নিয়েছিল। এরপর একটু একটু করে যত্ন করে হরিচাঁপাকে তৈরি করেছিল রানা। তবে শুধু তাতেই তো হবে না। হরিচাঁপার ঘুগনিও আনতে হবে।
ক্লাউড কিচেন। শনি-রবি করে করাই যায়। চাকরির বাইরে। দাঁড়িয়ে গেলে শালা চাকরির মুখে লাথি মারবে। অতএব, সবার উপর হরিচাঁপা সত্য, তাহার উপর ঘুগনি।
মানুষ মাংসাশী প্রাণী
যে যাই বলুক না কেন, মাংসের ঘুগনি একটা ব্যাপার। হরিচাঁপার ঘুগনি যদি এতই বিখ্যাত, তাহলে কিমা দিয়ে ঘুগনি তারা তৈরি করল না কেন? বেশ কিছুদিন চলার পর এই প্রশ্ন উঠল। তুলল রানার খরিদ্দাররা, সোশাল মিডিয়ায়। রানা বুঝল, মানুষ মূলত মাংসাশী প্রাণী, বিশেষত ছুটির দিনে। দুপুরে মাটন-ভাত খেকো বাঙালি, ছুটির দিন ক্লাউড কিচেন থেকে যদি ঘুগনি আনায় তাহলে শুধু হরিচাঁপার মাহাত্ম্যে তা কাটবে না। সেখানে কিমা-ই থাকতে হবে। কুচি কুচি করে কাটা মাংস মিহি হয়ে মিশে মিশে যাবে মটরের গায়ে গায়ে। ঢলঢলে ভাবখানা আরও একটু গাঢ় হবে। আর সেই সঙ্গে দমদার খুশবু। তা-ও রানা ‘দেখছি, দেখব’ করে কয়েকদিন কাটাল। তবে, এসব ক্ষেত্রে যা হয়, খুব বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় না। মাংসের ঘুগনি না হলে আর যখন চলে না, তখন রানা তার রাঁধুনিকে বলল, এবার কিমা ঘুগনি। হরিচাঁপার ঘুগনির নিউ এডিশন। রানার ক্লাউড কিচেন মোটের উপর জমেই উঠেছিল।
রাঁধুনির সকালে পাঁচ বাড়ির কাজ। বিকেলে একটা রুটির দোকানে রুটি বেলে বাড়তি ইনকাম। একদিন সেই দোকানে তড়কা, ঘুগনি বানাত যে লোকটা, সে আসেনি। ফলত এই রাঁধুনিকেই ঘুগনি করতে হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেদিন ঘুগনি-রুটি দুই-ই বিক্রি হল বেশি।
দোকানের মালিক তখন তাকেই বলল, এবার থেকে ঘুগনিটা তুমিই করো।
রাঁধুনি তাকায়। মালিক চোখ দেখেই ধরতে পারে। বলে, টাকা কিছু বেশিই পাবে। মাগনা খাটাব না।
বেশ কিছুদিন পর রানা যখন সেই দোকানে ঘুগনি খেতে গেল, তখন তার ডিসকভারি অফ ঘুগনি অনেকটাই এগিয়েছে। সে টেস্ট করে, জিভ চেটে আড়ালে এই রাঁধুনিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে একটা লম্বা সিগারেট খাওয়াল। তারপর খোঁজ নিল যে, সে কত টাকা এখান থেকে পায়। সব শুনেটুনে বলল, তোমাকে আমি মোটা টাকাই দেব। তুমি নিজে এখানে একটা দোকান করো। সারা সপ্তাহ তুমি এখানে নিজে ঘুগনি বেচো, সপ্তাহে দু’দিন আমার জন্য ঘুগনি করে দেবে, আমি অনলাইনে বিক্রি করব। রাঁধুনির রুটি বেলে বেলে হাতের বাজু খুলে পড়ত। মালিকের ইচ্ছেয় কর্ম, বিশেষ কিছু বলতে পারত না। এই প্রস্তাব সে লুফে নিল। লুফে নেওয়া মূলত টাইমিং-এর খেলা। রাঁধুনি ভাবল, টাইমটা ভালো যাচ্ছে। সেদিন সে বাড়ি ফেরার সময় ভুল বানানের আরসালানের স্পেশাল বিরিয়ানি কিনে নিয়ে গিয়েছিল।
মাংসের ঘুগনি করলে খরচ কিন্তু বাড়বে। ক্লাউড কিচেন হোক আর রাঁধুনির পাড়ার দোকান, দুয়ের ক্ষেত্রেই পড়তায় পোষাবে তো! রাঁধুনি হিসেবি লোক। তার মনে প্রশ্ন। রানা বলল, কোনও ব্যাপার নয়। টাকা-পয়সার হিসাব বুঝে নেওয়া যাবেখন।
অফিসে ইতিমধ্যে একটা ক্যাচাল শুরু হয়েছে। রানা আর উপরওলার চোখরাঙানি সহ্য করছে না। দিয়েছে রেজগিনেশন মেল করে। শালা, বাঁধা চাকর নাকি কোম্পানির! দরকার হলে, হরিচাঁপার ঘুগনিকে সে আরও বড় করবে। নোটিশ পিরিয়ডের দুটো মাস জাস্ট দেখে নেওয়া। আর তখনই শুরু হল কিমার বায়না, অতএব মাংসের ঘুগনির প্রস্তুতি।
তা চললও ভালো। হরিচাঁপার ঘুগনির মাহাত্ম্যে যে টোল পড়েছিল, মাংসের ঘুগনি তা অনেকটা পূরণ করে দিল। মাংসের স্বাদ মানুষ যখন পেয়েই গেছে, তখন একটু চালিয়ে খেলতে হবে, ভাবে রানা। দোকান-টোকান যা করার এই সময় করে ফেলাই ভালো। ঘুগনির সঙ্গে আরও কিছু আনতে হবে। এক্সপ্রেস ট্রেনের পাশে যেমন বন্দে-ভারত। চমক না হলে দেশ চলে না, তা দোকান চলবে কী করে! রানার প্ল্যান তো ছকাই ছিল মনে মনে।
এর মধ্যে ছোট্ট একটা ঘটনাই শুধু ঘটেছিল। এক রবিবারের রানার ক্লাউড কিচেনের জন্য বানানো কিমা ঘুগনি খানিকটা রয়ে গিয়েছিল, যা সোমবারের ঘুগনিতে মিশিয়েছিল রাঁধুনি। হালকা বাস ছেড়েছিল। ভেবেছিল, এ জিনিস তো অনলাইনের বাবুরা আর খাবে না, খাবে তার দোকান এলাকার লোকজন। গায়েগতরে খাটিয়ে মানুষ, বাসি খাওয়া চিরকালের অভ্যেস! এ আর এমন বড় ব্যাপার কী! ভাতের হোটেলের ডালে কি ফ্যান মেশায় না! নাকি পুরনো মাছ নতুন ঝোলে দেয় না!
কিন্তু কী করে যেন ছড়িয়ে গেল কথাটা। বাসটা বিফ্ বিফ্। বিফ্ আগে কে খেয়েছে। এ রাম! কেউ না। অথচ গন্ধটা খুব সন্দেহজনক। চেনা-চেনা। উত্তরপ্রদেশে, রাজস্থানে এমন গন্ধ পাওয়া যায়। তাই বলে এখানেও! হালকা একটা গন্ধ মস্ত গুজব হয়ে পাড়া ঘুরে বেড়াল।
বোধহয় আগের মালিকই ছড়িয়েছিল, তার রাগ ছিল ষোলআনা। ফলত, গণধোলাই, হসপিটাল এবং রাঁধুনির মৃত্যু। কাগজের টুকরোয় ধরানো হয়েছিল তা নিয়ে বাহাত্তর শব্দ। রানার চোখে পড়েনি। সে জানল দেরিতে। পুলিশ-টুলিশও হয়েছিল। তবে দোষ কারও নয় গো মা! রানার তো নয়ই। সে বরং গরিবকে বিজনেস করতে সাহায্য করেছিল। পুলিশ বলল, হরিচাঁপা নাম দিয়েছেন কেন? রানা বলল, লিটারারি ফিকশনে এরকম নাম থাকে। আমরা সাহিত্য ভালোবাসি কিনা! পুলিশ বলল, হুঁ। ব্যাপারটা একদিন চুকেবুকেই গেল। সবাই ভেবেছিল সিবিআই অব্দি গড়াবে, সে সব কিছু হল না। এখনকার দিনে গণপিটুনি আর মৃত্যু মামুলি ঘটনা। তা ছাড়া বিফ্।
শুধু রানা বুঝল, মানুষ ছুটির দিন ছাড়াও মাংসাশী এবং মাংসের স্বাদ পেলে সে খতরনক।
আত্মনির্ভর
চাকরিটা ছাড়তেই হবে। নিয়মমাফিক। রানা আরও মন দিল ঘুগনিতে। আর একটু প্ল্যান করে অর্গ্যানাইজড ভাবে করতে পারলেই হবে। হরিচাঁপার ঘুগনি কখনও মার যায় না! তবে, এবার যেহেতু কস্ট কাটিং নিয়েও ভাবতে হবে, তার উপর রাঁধুনিও মরে গেছে, অতএব ঘুগনিটা সে নিজেই বানাবে। এ সম্পর্কে সাধারণ দু-চার কথা সে আগেই জানত। বাকিটা ইউ টিউব দেখে নিলেই হল।
কেবল একটা খটকা, হাতের ফেরে টেস্টে হেরফের হলে যে কাস্টমার রিঅ্যাকশন হবে, তার কী জবাব সে দেবে? ভেবে ভেবে ঠিক করল, নিজের গল্পটাই সে চালাতে পারে। একটা ছেলে। স্বপ্ন দেখা ছেলে। চাকরি থেকে সরে যাওয়া। ব্যবসা করতে চাওয়া। এই আত্মনির্ভরতা দিয়ে ঘুগনি স্বাদুই লাগবে। রাজার ছেলেকেই রাজপুত্র হতে হবে! ঘুগনি বানিয়ে কেউ রাজা হতে পারে কি পারে না? প্রশ্নটা এভাবে ছুড়ে দিলে কে আর মুখের উপর না বলবে! অতএব সমর্থন রানার পক্ষেই যাবে। বুঝে নিয়ে ঘুগনি বানাতে শুরু করল সে।
মুশকিল অন্যত্র। স্বাদ নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল, তবে এখন ঘুগনিটাই হচ্ছে না। হয় বেশি সিদ্ধ হয়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। নয়তো মটরগুলো এমন চোখা রয়ে যাচ্ছে যেন পড়শি মটরের দিকে অপরিসীম ঘৃণায় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সেই যে রাঁধুনি ঘুগনি করত – মটরগুলো গলে দলাও পাকাচ্ছে না আবার একে অন্যের গায়ে গা লাগিয়ে গোটা গোটা জেগে আছে – নিজের হাতে সেরকম ঘুগনি না করেও যা নিয়ে রাঁধুনিকে বহুবার বহুবিধ পরামর্শ দিয়েছে রানা- সেই রকম ঘুগনি সে আর কিছুতে বানিয়েই উঠতে পারছে না। আত্মনির্ভরের গল্পটা তাই বাচালতার মতো শোনায়। তবু ঢাক পিটিয়ে যায় রানা। নিজেকে জোকারের মতো লাগে। জানে, লোক হাসাচ্ছে, তাই সে নিজেও হাসে। গল্প বলে আর ঘুগনি ফেরি করে। নামে খানিক কাটে, খানিক দামে। তবে এমনি করে আর কদ্দিন! রানা বুঝতে পারে যেন ছেলের হাতের খেলনা ভেঙে গেছে। কিছুতেই আর তা জোড়া লাগানো যাচ্ছে না।
রানা ভাবত, দেশ চালানো, রাজ্য চালানো কি প্লেন চালানো শক্ত ব্যাপার! ঘুগনি বানানো যে কঠিন, সে কোনওদিন ভেবেও দেখেনি।
নিউ নর্ম্যাল
হরিচাঁপার ঘুগনি শেষমেশ আর রানার হাতে হলই না। তবে, সে অবাক হয়ে দেখল, চারিদিকে তৈরি হচ্ছে হরিচাঁপার ঘুগনি। মফস্সলের গলি বলছে, অনলাইনে ঝুটা জিনিস কেন খাবেন। হরিচাঁপার ঘুগনি তো আমরাই তৈরি করি। আমার ছোটপিসির শ্বশুরবাড়ি তো হরিচাঁপাতেই।
গলিতে গলিতে হরিচাঁপার ঘুগনি বিকোচ্ছে। অথচ রানা কিছুতেই বলে উঠতে পারছে না যে ব্যাপারটা ভুয়ো। কী করেই বা বলবে! একদিন সবে বলা শুরু করেছিল,
-এই হরিচাঁপার ঘুগনি এল কোথা থেকে?
-সবাই জানে, আপনি জানেন না?
-বলুন দেখি। আপনার আর আমার জানা এক কি-না দেখি।
-হরিচাঁপার ভুঁইয়া রাজা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করলেন, তখন নতুন বউয়ের মান ভাঙাতে…
-আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে।
-আপনার কি বিশ্বাস হয় না?
-না, হয় না।
-কেন হয় না? নিজের দেশের ইতিহাসে আপনার বিশ্বাস হয় না কেন?
-বালের ইতিহাস।
শেষ কথাটা যথাসম্ভব নিচু গলায় বলে। মানুষ মাংস ভালোবাসে, রানা জানে। গল্প ভালোবাসে আরো বেশি। গল্পকে এখন ভয় পায় রানা। মানুষকেও। যদি ইতিহাসে সন্দেহে কেউ আহত হয়। তারপর ভীষণ রেগে যায়! আর মারতে মারতে মারতে মেরে ফেলে! রাঁধুনির মুখটা ভাবার চেষ্টা করে রানা। নিশ্চিত সে বলার চেষ্টা করছিল, মিথ্যে কথা ছড়ানো হয়েছে তার নামে। তখনই মারের উপর মার। রক্ত! রক্ত। রানা কল্পনা করেই ভয় পায়, শিউরে ওঠে। তবু হরিচাঁপার ঘুগনিকে আর থামানো যায় না। রানা মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করে, হরিচাঁপার ঘুগনি তো মানুষের মাংসে তৈরি। মানুষ মানুষকে খায়!
সে সব কথা অবশ্য বাতাসে মিলিয়ে যায়। রানাও খেয়াল রাখে কেউ যেন তা শুনতে না পায়।
জন্ম ১৯ মে, ১৯৮৮ পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায়। পড়াশোনা প্রথমে ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং,পরে মাস কমিউনিকেশন। পেশা প্রথমে মিডিয়াকর্মী, বর্তমানে প্রকশনা সংস্থায় যুক্ত। লিখতে ভালোবাসেন। পড়তে আরো ভালোবাসেন। বই চলতি হাওয়ার পঙক্তি, কৃষিকথা সামান্যই, বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভ ( গল্পসংকলন)