সেই সব মানুষ (পর্ব-১)
অদৃশ্য হাত
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। আ্যাটর্নী বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ছোটছেলে। নরেন্দ্রনাথ দত্তের ( স্বামী বিবেকানন্দ) ছোট ভাই। কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তারপরে যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে। ব্যারিস্টার পি মিত্রের নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতিতে গিয়ে যতীন বন্দোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে পরিচিত হন।
১৯০৬ সালের মার্চ মাস। বারীন্দ্র ঘোষ আর অবিনাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করে একটা গরম খবেরে কাগজ বের করার পরিকল্পনা করলেন ভূপেন্দ্র। যে কাগজের লেখা পড়ে গায়ে ফোস্কা পড়বে দখলদার ইংরেজ শাসকদের। যে কাগজ এ দেশের মানুষকে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা দেবে। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জোগাড় হল ৩০০ টাকা। কিন্তু কি হবে কাগজের নাম ? শিবনাথ শাস্ত্রী মশায়ের ‘যুগান্তর’ উপন্যাসের নাম মনে এল ভূপেন্দ্রের । তিনি তাঁর দুই বন্ধুকে বললেন, আমাদের কাগজের নামও হবে যুগান্তর। নতুন যুগের সূচনা করবে এই কাগজ।
যেমন কথা তেমনি কাজ। প্রকাশিত হল নতুন কাগজ ‘যুগান্তর’। পরামর্শদাতা হিসেবে থাকলেন অরবিন্দ ঘোষ আর সখারাম গণেশ দেউস্কর। কাগজে লিখতে লাগলেন বারীন্দ্র ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, দেবব্রত বসু আর ভূপেন্দ্রানাথ দত্ত। লেখা তো নয়, যেন এক-একটা আগুনের গোলা। দেশের মানুষের কাছে অচিরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল ‘যুগান্তর’। হবে নাই বা কেন! ‘বন্দেমাতরমে’র মতো এ কাগজ শিক্ষিত, বিদগ্ধজনের কাগজ নয়। আপামর জনসাধারণের মুখের ভাষা আর বুকের ব্যথা যে প্রকাশ পাচ্ছে ‘যুগান্তরে’। হু হু করে বাড়তে লাগল বিক্রি। এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার, পাঁচ থেকে দশ হাজার। মাত্র এক বছরের মধ্যে সেটা হল বিশ হাজার।
ভূপেন্দ্ররা ভাবলেন আরও কিছু করা দরকার। বিশেষ কিছু লেখা যাতে মানুষের কাছে থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই বিশেষ বিশেষ লেখা নিয়ে তাঁরা সংকলনগ্রন্থের কথা ভাবলেন। এরকম দুটি সংকলন হল: ‘মুক্তি কোন পথে’ এবং ‘বর্তমান রণনীতি’। বছরখানেক পরে, বিশেষ করে সংকলন দুটি বেরুবার পরে টনক নড়ল ইংরেজ শাসকদের। বলছে কি এরা? বলছে জনমত গঠনের কথা, বলছে অস্ত্র সংগ্রহের কথা! কি সর্বনাশ! অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ডাকাতি করবে! সৈন্যবাহিনীতে ঢুকে ভারতীয় সৈন্যাদের ভড়কাবে তারা! বলে কি ! এসব লেখায় প্রতি লাইনে ব্রিটিশের প্রতি জ্বলন্ত ঘৃণা, প্রতি লাইনে বিপ্লবের নিঃশ্বাস।
নাঃ, এরকম কাগজকে ছাড় দিলে চলবে না।
এই তো কাগজের বর্তমান সংখ্যায় বেরিয়েছে দুটো লেখা। ‘ভয় ভাঙো’ আর ‘লাঠ্যৌষধি’। নিশ্চয়ই ভূপেন্দ্রনাথের লেখা। সন্দেহ শাসকদের। প্রথম লেখায় বলা হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এক সাজানো তামাশা, এক ধাক্কা দাও ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে। তাহলে টেকে আছে কেন এই সাম্রাজ্য? ভারতবাসীর নির্বুদ্ধিতার জন্য। ধরেছে ঠিক ব্যাটারা। কিন্তু এ কথা তো ভারতবাসীকে বুঝতে দিলে চলবে না। দ্বিতীয় লেখায় আছে পঞ্জাবের কথা। সেখানে খাল-করের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মানুষ। তাদের মাথা ফাটিয়ে, ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে শাসক তাদের ঠাণ্ডা করেছে। নাঃ, আর দেরি নয়। ব্যবস্থা একটা নিতেই হবে। গ্রেপ্তার করতে হবে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে। ছাব্বিশ বছরের এই ছোকরাই তো ‘যুগান্তরের’ সম্পাদক।
ভুল হয়েছিল ইংরেজ শাসকদের। ভূপেন্দ্রনাধ সে কাগজের সম্পাদক নন, আর যে দুটি লেখার জন্য ইংরেজ মতলব ভাঁজছিলেন, সে দুটি লেখা উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের। জামালপুরে গিয়েছিলেন ভুপেন্দ্রনাথ। ফিরে এসে শুনলেন তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ। গুরু অরবিন্দ ঘোষ তাঁকে ডেকে বলে দিলেন, তোমাকে কাগজের সম্পাদকের দায়িত্ব যেমন স্বীকার করে নিতে হবে, তেমনি প্রবন্ধ দুটি তোমার লেখা সে কথাও বলতে হবে।
কেম মিথ্যা কথা বলতে হবে সে প্রশ্ন তোলেন নি ভূপেন্দ্র। গুরুর কথা তো বেদবাক্য। ইউ আর নট টু কোশ্চেন হোয়াই। ১৯০৬ সালের ২৪ জুলাই ভূপেন্দ্রনাথ গুরুর কথামতো ঘোষণা করলেন, ‘ আমি ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত একথা জানাচ্ছি যে আমি যুগান্তরের সম্পাদক এবং প্রশ্নাধীন সকল প্রবন্ধের জন্য দায়ী। আমি সৎ বিশ্বাসে আমার দেশের জন্য যা করা উচিত মনে করি তাই করেছি। আমি আর কোন বিবৃতি দেব না এবং বিচারে আর কোন অংশ নেব না।’ ভূপেন্দ্রনাথের সাহসকে বাহবা দিয়ে অরবিন্দ ‘বন্দেমারতমে’ লিখলেন, ‘ Bhupendra Nath Dutta imprisoned for telling the truth with too much emphasis.’ –সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলে ভূপেন্দ্রনাথ জেলে গিয়েছেন।
অরবিন্দ কিসের জন্য, কাকে বাঁচানোর জন্য ভূপেন্দ্রকে বলি দিলেন আমরা জানি না । তিনি যে উপেন্দ্রকে সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে বলেছিলেন সে কথা কোথাও স্বীকার করেন নি। পরবর্তীকালে ‘On Himself’ প্রবন্ধে অরবিন্দ বলেছেন, ‘ Bhupendra Dutta was at that time only an obscure hand in the Jugantar office incapable of writing anything important’—‘যুগান্তরে’ অনুল্লেখযোগ্য মানুষ ছিলেন ভূপেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু লিখতে পারতেন না, বাংলাভাযায় দখল ছিল যাঁদের সেই বারীন্দ্র আর উপেন্দ্রই ছিলেন সে কাগজের প্রধান লেখক। অরবিন্দের মতে কাগজের প্রকৃত সম্পাদক বারীন্দ্র, উপেন্দ্র ও দেবব্রত। ‘ভূপেন্দ্র লিখতে পারতেন না ‘ এটা অরবিন্দের গা-জোয়ারি কথা। যাঁরা ভূপেন্দ্রনাথের ‘অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস’, ‘যুগসমস্যা’, ‘তরুণদের অভিযান’, ‘জাতি সংগঠন’, ‘যৌবনের সাধনা’, ‘সাহিত্যে প্রগতি’, ‘ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি’, ‘আমার আমেরিকার অভিজ্ঞতা’, ‘বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব’ পড়েছেন, তাঁরাই বুঝবেন অরবিন্দের কথায় কতটা সত্যতা আছে।
বিচারে ভূপেন্দ্রনাথের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
এই রায়ের কথা ছড়িয়ে পড়লে কলকাতার সম্ভ্রান্ত নারীরা ডাঃ নীলরতন সরকারের ৬১নং হ্যারিসন রোডের বাড়িতে সমবেত হয়ে ভুবনেশ্বরীদেবীকে দেশপ্রেমিক পুত্রের জন্য অভিনন্দন জানান: ‘আমরা কতিপয় বঙ্গনারী যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদভার লইয়া আপনাকে অভিনন্দন করিতে আসিয়াছি। আপনার পুত্র অকুণ্ঠিত সাহসভরে স্বদেশের সেবা করিতে গিয়া রাজদ্বারে যে নিগ্রহ প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাতে আমরা প্রতি বঙ্গনারী অসীম গৌরব অনুভব করিতেছি।’
ভুবনেশ্বরীদেবী অভিনন্দনের উত্তরে বলেন, ‘ভূপেনের কাজ সবে শুরু হয়েছে। দেশের জন্য আমি তাকে উৎসর্গ করেছি।’
ভুবনেশ্বরীর মতো আর একজন নারীও গর্ববোধ করেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথের জন্য। বিদেশিনি তিনি। কিন্তু বিদেশিনি হলেও এ দেশকে ভালোবেসেছিলেন তিনি। অংশগ্রহণ করেছিলেন এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। তিনি নিবেদিতা। গর্বের সঙ্গে ব্যথাও অনুভব করেছিলেন। এক বছরের সশ্রম করাদণ্ড তো গুরুদণ্ড। আদালতের দাবি অনুযায়ী নিবেদিতা ভূপেনের জন্য কুড়ি হাজার টাকা জামিন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। অবশ্য তার আগেই তাঁর মাসতুতো ভাই চারুচন্দ্র মিত্র এবং ডাঃ প্রাণকৃষ্ণ আচার্য এগিয়ে এসেছিলেন জামিনের জন্য। এসবের জন্য নিবেদিতাকে কম মূল্য দিতে হয় নি। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা তো তাঁকে a traitor to her race বলতে দ্বিধা করে নি।
নিবেদিতার অদৃশ্য হাত ভূপেন্দ্রনাথকে রক্ষা করার জন্য বারবার প্রসারিত হয়েছে। নিবেদিতা জানতেন এই মামলায় মুক্তি লাভ করলেও আলিপুর বোমার মামলায় তাঁকে জড়িয়ে দিতে পারে ইংরেজ পুলিশ। তাই মুক্তি লাভ করে ভূপেন্দ্র যাতে আমেরিকা চলে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা গোপনে করে গিয়েছিলেন তিনি। নিবেদিতা এই ভার দিয়ে গিয়েছিলেন সিসটার ক্রিস্টিনের উপর। ভূপেন্দ্র মুক্তিলাভ করে বাড়ি ফিরে এলে তাঁর দাদা মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে সেকথা জানান।
শুধু বিদেশ যাত্রার বন্দোবস্ত নয়, সেখানে গিয়ে কোথায় থাকবেন, কি করবেন তারও গোপন পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন নিবেদিতা। নিবেদিতা জানতেন ভূপেন আত্মাভিমানী । তাঁর আত্মাভিমান যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সে ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন নিবেদিতা। মিস ম্যাকলাউডকে একটি চিঠিতে নিবেদিতা লিখছেন, ‘ আমি গোপনে তোমাকে ‘কালী’ ( দি মাদার) বই থেকে প্রাপ্ত একটি চেক পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটি স্বামীজির ভাইএর জন্য ব্যবহৃত হোক, তাই চাই । তুমি জানো আমি তাকে লিখতে পারি না। যখন আমি ভাবি যে স্বামীজির লোকেরা আমার ভাইএর জন্য কি করেছেন, তখন তাঁর রক্তের ভাইএর ভরণ-পোষণের ভার নেওয়া নিশ্চিত উচিতকাজ মনে করি।’
আর একটি চিঠিতে নিবেদিতা লিখছেন, “যথার্থই চমৎকার মানুষ সে –তার হাসি অনিবার্যভাবে তার বিরাট প্রতিভার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পুরুষোচিত, বীরোচিত তার আচরণ—জেলে গিয়েছিল নিছক অপরদের বাঁচাতে। ‘সব দায়িত্ব আমার’- সে বলেছিল, অথচ অভিযুক্ত পত্রিকাটির সে সম্পাদকও নয়, মালিকও নয় । বিয়ের ব্যাপারে সে সর্বদা না করেছে। স্বামীজি যখন তাকে এই ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখেছিলেন, তখন ‘বাঃ মস্ত বড় মানুষ’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। যাইহোক তার হয়ে তোমার কাছে ওকালতি করার দরকার নেই। ক্রস্টিনের চিঠি থেকেই দেখতে পাবে, মিস ওয়ালডোর ২৪৯ নং মনরো স্ট্রিট , ব্রুকলিন, এই ঠিকানা মারফত তার সন্ধান পাওয়া যাবে।”

গবেষক