‘আত্মপ্রতিকৃতি’ ও নিরুদ্দিষ্ট কবি মুনির আহমেদ
আশির দশকে অচিরা পাঠচক্রের আড্ডায় গিয়েই তাঁর সাথে পরিচয়। একটু ছোটোখাট মানুষ। নাকের নীচে একগুচ্ছ গুম্ফও রয়েছে। কিন্তু চোখ দুটোতে ছিলো একটা স্বপ্ন ও দৃঢ়চিত্তের ক্ষীণ ইশারা। কথা বলতেন মেপে মেপে। ডি.সি. হিলের সামনে ফুলকি’র লম্বা হল ঘরে মাদুর পেতে বসা অচিরা আড্ডাতেই তাঁর সাথে প্রথম পরিচায়।
অচিরায় কবিতা পড়ার পরে একে একে কতো জনের কতো আলোচনা সমালোচনা শেষে আড্ডার প্রধান সকলের মান্যজন কবি আবুল মোমেন বলে যেতেন কবিতার গঠন ছন্দ ও ভাব নিয়ে সুন্দর কিছু কথা। সাথে থাকতো সেই পঠিত কবিতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের আঙ্গিকে বিশ্বসাহিত্য ও শাশ্বত বাংলা কবিতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ টেনে এনে এক অসাধারণ বিস্তার। এই আড্ডায় সম্ভবত তখন আমিই কনিষ্ঠ জন। মোমেন ভাইকে সবাই বেশ সমীহ করে আড্ডায় বসেন এবং তাঁর কথা শোনেন। এই আড্ডায় শিক্ষণীয় অনেক কিছু পেয়েছি। বিশেষত কবি জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি ওমর কায়সার, কবি সেলিনা শেলী সহ আরও অনেক কবির পাঠ ও অভিজ্ঞতার এবং তার সাথে তাঁদের সৃজনশৈলীর বিকাশ আমাকে ঋদ্ধ করতো। আমি এবং কবি হোসাইন কবির, কখনও কখনও কবি ইউসুফ রেজাও বোস ব্রাদার্সের আমাদের একান্ত নিজস্ব স্বনন আড্ডা শেষ করে দ্রুত পা চালাতাম ‘অচিরা’ পাঠচক্রের আলোচনা ধরবার জন্যে। এখানে এসেই আমার চেয়ে ২/৪ বছরের অগ্রজ এই ছোটখাট মানুষটি আমাকে বেশ আকর্ষণ করেছিলো।
অচিরায় অনেক জ্ঞানগর্ভ আলাপ হতো তা সত্য; এবং আমাদের মতো তরুণ কবিদের সৃজন বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখলেও যে কথাটি না বললে চলে না, তা হলো এই পাঠচক্রের শেষ কথা কিন্তু কবি আবুল মোমেন বলতেন। মোমেন ভাইয়ের বলার পরে আর কথা চলতো না। কিন্তু হয়তো আমাদের অজ্ঞতা হেতু অথবা তারুণ্যের সহজাত বিদ্রোহী মনোবৃত্তির জন্যে আমাদের অপেক্ষাকৃত তরুণ ২/১ জন শেষ কথার পরে আরও কিছু বক্তব্য মনের ভেতরে পুষে রাখতাম। সে অল্প বয়সে মোমেন ভাইয়ের সৌম্য সুন্দর স্থির রাবিন্দ্রিক ভাবের যে ছবি আমাদের মুগ্ধ করতো, সেই সৌম্য প্রতিকৃতির সুন্দর বচনের পরে আমরা আর কিছুতেই তাঁর ভাষ্যের বিপক্ষে আমাদের ভেতরে ভেতরে পুষে রাখা কথা হয়তো বলে উঠতে পারতাম না। তেমন একজন সদস্য এই তরুণ কবি মুনির আহমেদ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের ছাত্র। আমিও মেডিকেলের ছাত্র। অচিরা’র আড্ডা ভেঙে গেলে আমরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চা’ দোকানে ঢুকতাম। চা এবং ধূম্র পানের আয়োজন চলতো যার যার মতো, আর শুরু হতো মনের ভেতরে ফুঁসতে থাকা কথাগুলোর উদগীরণ ও উত্তেজিত আলোচনা। মুনির আহমেদকে দেখেছি বেশ দৃপ্ত স্বরে অনেক কথা বলতে, যা অচিরার আনুষ্ঠানিক আড্ডায় বলতে পারেননি। তাঁকে বলতে দেখেছি প্রথাসিদ্ধ এইসব আলোচনা প্রচলিত কবিতার আমেজে প্রচলিত কাব্যভঙ্গি ও কাব্যভাষাকে অনুসরণ কবিতা লেখার যে প্রয়াস তার বিপক্ষে নিয়ম ভাঙার ভাষা ও স্বরে কবিতাকে নির্মাণের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিতে। কখনও কখনও তারুণ্যের সেই তেজ দর্পের রূপও গ্রহণ করেছিলো। নিজেকে সময়ে শ্রেষ্ঠ কবির কল্পনা করতেও তিনি কুন্ঠা বোধ করেননি। অবশ্য অনানুষ্ঠানিক আড্ডায় এমন রাজাউজির কতো ঘাটে কতো জনই তো মেরে আসছেন। কিন্তু মুনির আহমেদকে দেখেছি, তিনি যেন কবিতার এক অনন্য ঘোরের মধ্যে বাস করতেন। তাই সে ঘোরের ভেতর কবি যেন মনসুর হেল্লাজের ভাষায় ঘোষণা দিতেন ‘আনাল হক’—আমিই শ্রেষ্ঠ। এমন একটা প্রত্যয় ছাড়া কি কবি বা স্রষ্টা প্রকৃত মহিমায় বিকশিত হতে পারে?
মুনির আহমেদের বাসা ছিল ব্যাটারী গলিতে। আসকর দিঘীর পাড় দিয়ে সার্সন রোডে ঢুকে একটু এগিয়ে পশ্চিম দিকে একটি চিকন গলি ঢুকে পড়ে। সেই গলিতে ঢুকে কতদূর গিয়ে হাতের বামে সেই বাসাটি এখনও আমার স্মৃতিতে সতেজ। মুনির আহমেদের সাথে সেই বাসায় ঢুকে তার একটি ছোট্ট ঘরে বসে আমাদের কাব্যালাপ ঘটেছিলো কতো। তার কাছ থেকে বেশ কিছু বই নিয়ে পড়েছিলাম। সম্ভবত শহীদ কাদরী’র ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ এবং ‘সমর সেনের কবিতা’ বইগুলোর ফটোকপিও করে রেখেছিলাম। মুনির আহমেদ সে সময় আমাকে একবার বলেছিলেন কবিতা থেকে মেদ ঝরানোর পদ্ধতি তিনি কেমন করে করেন। কবিতাকে শ্রেষ্ঠতম শব্দবন্ধের এক উৎকৃষ্ট প্রয়োগে প্রকাশের জন্যে ছিল তাঁর সনিষ্ঠ আরাধনা।
১৯৯১ সালে মনন প্রকাশন থেকে পীযুষ দস্তিদারের প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয় মুনির আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ‘আত্মপ্রতিকৃতি’। এই একটি বই প্রকাশের পরে এই কবি কোথায় হারিয়ে গেলেন, তাঁর কোনো খোঁজ আমি পাইনি। কেউ জানে কিনা তা’ও জানি না। সমসাময়িক কবিদের আলোচনায় এই নামটি আর উচ্চারিত হতেও শুনিনি। যেন তিনি ছিলেনই না। আজ অকস্মাৎ তাঁর বইটি আমার আলমিরার এক কোণে পড়ে থাকতে দেখে কতো স্মৃতি যেন জেগে উঠলো মুহূর্তের ভেতর। মাত্র ৪৮ পৃষ্ঠার বইটিতে ৪০টি কবিতা নিয়ে বইটি বারবার মুনির আহমেদের সেই দৃপ্ত প্রতিকৃতিটি আমার মানসপটে যেন ভাসিয়ে রাখলো। হ্যাঁ, তাঁর সেই ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ যেন বলছে, এখানেই, এই বইতেই মুনির আহমেদের মুখ জেগে আছে, জেগে থাকবে—এই কবিতাই তাঁর প্রকৃত প্রতিকৃতি। যদিও আমি দেখেছি, মুনির আহমেদ বরাবরই মস্তিষ্ক চালিত ব্যক্তি মানুষ এবং যুক্তিবাদী চিন্তার অনুসারী তবুও তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন “মন’কে”। এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার বটে।
কবি হিসেবে তাঁর এই গ্রন্থ নিয়ে আবির্ভূত হওয়া “পায়ে পায়ে” এগিয়ে যাওয়ার মতো। দীর্ঘদিনের নিরলস কাব্যসাধনার যে প্রকাশ তিনি গ্রন্থিত করেছেন তাতে তিনি এগিয়েছেন “পায়ে পায়ে” শিরোনামের কবিতাটি দিয়ে।
“দূর পদচিহ্নে ফুসফুস
বাতাস আটকে ছেড়ে দেয় ধীরে ধীরে
আর অধীর পৌরুষ
তাকে ঝরা পাতা দিয়ে ঢেকে দিই
তাকে আলতো দু’হাতে ঢেকে দিই
দূরে তার চিহ্ন ছিল বুকের ভেতর”
(পায়ে পায়ে / পৃষ্ঠা ৯ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
ফুসফুস ক্রমাগত বাতাস ছাড়ছে আমাদের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ফুসফুস কখনও বিশ্রাম নেয়নি। ক্রমাগত ছেড়েছে নিঃশ্বাস—কতো দীর্ঘশ্বাসও তার সাথে বেরিয়ে এসেছে এই জীবনের দীর্ঘপথ চলার বাঁকে বাঁকে। কিন্তু “অধীর পৌরুষ”! পৌরুষের অস্থিরতাও এই ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসে কবির পংক্তিতে। সেই ছেড়ে দেওয়া অধীর অস্থির পৌরুষকে ঝরা পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া আর আলতো দু’হাতে ছেঁটে দেওয়ার পরও দূর কোনো গভীরে বুকের ভেতরে তার চিহ্ন থেকে যায়। কবি এখানে তাঁর যে আত্মপ্রতিকৃতি দেখেন তাতে “এই মুখ / আর ঘোড়া এক ধাবমান ক্ষুর তার ক্ষয়ে গেছে”। তবুও প্রত্যয় এবং আশা কবির হৃদয়ের ভেতরে প্রোথিত। তাই ঘুরে দাঁড়ানোর উচ্চারণ আসে পরবর্তী পংক্তিতে। কবি দেখেন তার সামনে “বিপুল স্বপ্নের ছাই / হাতের মুঠোয়, ভালবাসা”।
মুনির আহমেদ সংসার করেছিলেন বা করেছেন কিনা আমি জানিনে। ১৯৯১ সালে সংসার করেও থাকতে পারেন। “রাশিদা মুনির” নামে একজন এই গ্রন্থের স্বত্ব পেয়েছেন। জানিনা তিনি কবির কন্যা না কি জায়া। জননী হয়তো নয়। ধরে নিচ্ছি সংসারের স্বাদ কবি পেয়েছিলেন এই বইটি প্রকাশের সময়। তিনি সে প্রকাশ “সংসার” কবিতায় করেছেন বৈকি। তার বর্ণনায়—
“সংসার
একটি নদী
ফেনা বুঁদ নদী
হাত পা ডুবিয়ে টানে
ফেনায় হৃদয়”
(সংসার / পৃষ্ঠা ১৫ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
এই সংসার, জগৎ-সংসারও হতে পারে। আর এই সংসারের টানেই বুঁদ হয়ে আজ হয়তো মুনির আহমেদ কবিতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। কবির উপমায় এই সংসার এই ‘ফেনা বুঁদ নদী’ যেন “বুড়ো পাতা এক কোমর কুঁকড়ে একা”।
“বিস্ফারিত” কবিতায় কবি এই সংসারের দিকে যেন বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখেন এর অদ্ভুত রহস্যময়তা, যেখানে অনুভূতি পুড়িয়ে কবিকে চলতে হয় আর সঙ্গী বলে “আরো যেতে হবে”। “তমসা নদীর তীরে / তার জলে আমার মনিহীন বিস্ফারিত চোখ” (বিস্ফারিত / পৃষ্ঠা ১৭ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)। এই তমসা নদীর তীরে মনিহীন বিস্ফারিত চোখে কবি বুঝতে পারেন, জীবন তারপরও আরও আরও কিছুদূর এগিয়ে যাবার নামান্তর।
মুনির আহমেদের জীবন যেমনই হোক, তাঁর কবিতায় নাগরিক ক্ষত, ক্ষয় এবং বিষণ্নতাকে চিত্রনের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। তাই “মরা নৌকা” কবিতায় —
“নৌকার ঋজুতা খোয়া গেছে জলে,
পেরেক মরচে আর মাস্তুলে জলের
ক্ষয়;
এ নৌকা আমার সমুদ্রে যাবে না”
কিংবা
“আমার শরীর ক্ষয়ে গেছে”
কিংবা
“আমাদের কথাগুলো মুদ্রিত হল না
হাড়ের ওপর প্রাচীন কৌশলে,
শুধু ভাবি দিনগুলো নৌকা হল কবে
পচা কাঠ খসে পড়ে।”
(মরা নৌকা / পৃষ্ঠা ৩৮ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
এই ক্ষয়, খসে পড়া, পচা কাঠের উপমা, সব কিছুই এক হতাশার উচ্চারণ। তারপরও তাঁর যে সম্ভাবনার প্রতি প্রত্যয় , তার প্রকাশও এখানে দেখতে পাই, যখন মরা নৌকা কবির গোড়ালি ছুঁয়ে বলে “জলদাস তোর সুখ হবে ভেসে”। এই যে আশাবাদ এটা কবির সহজাত প্রবৃত্তির উচ্চারণ।
‘মেঘের খিলান’ কবিতায় তাঁর ভেতরের কিছু হাহাকার বা আর্তনাদ খুব শৈল্পিকভাবে ফুটে ওঠে। তার অদ্ভুত উচ্চারণে মানুষের কান্নার বিবরণ এরকম—
“মানুষেরা রোদে শুয়ে থাকে
কান্না তার মাটির দেয়ালে”
“মানুষের বুক থেকে
হাড়ের গভীরে গর্ত খুঁড়ছে সময়— —“
(মেঘের খিলান / পৃষ্ঠা ৩৯ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
মুনির আহমেদের সাথে যতো আড্ডা দিয়েছি, মনে পড়ে, প্রায় পুরোটা সময় আমি শ্রোতা থাকতাম, তিনি বলে যেতেন অনর্গল। কতো না কথার ফোয়ারা তাঁকে স্বপ্নাতুর করে তুলতো। নিজেকে তৈরি করার জন্যে ছন্দের ব্যাপারে খুব জোর দিতেন। ছন্দ নিয়ে তাঁর কন্ঠ ছিল পরিষ্কার। কবিতা মানে টান টান ছন্দে, আঁটসাঁট শব্দবন্ধে উপমায় উৎপ্রেক্ষায় চিন্তার প্রকাশটাকে নির্মাণ করতে হবে। তাঁর উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহারেও একটি নিজস্ব বর্ণনার ভঙ্গি লক্ষ করা যায়—
১.
“বাউলের মত চূড়ো করে বেঁধে খোঁপা
পাঁজরে আমার টান দাও একতারা”
বাতাসের ঘোড়া নামে জানালার কাছে
তোমাকে বৃষ্টির রথে নিয়ে,
আমিও উদাস ডুবে যাই বুকের প্রান্তরে
জল আর ঝড়ে
জল কণা হও তুমি, ঠাঁই নাও চোখে,
তুমি রাত্রি শামুকের শূন্য খোলে বাঁধো ঘর,
বাউলের মত চূড়ান্ত করে বেঁধে খোঁপা
পাঁজরে আমার টান দাও একতারা।”
(বৃষ্টি রাত্রি দয়িতা / আত্মপ্রতিকৃতি / পৃষ্ঠা ১২/ ১৯৯১)
২.
“যদি ছুঁয়ে দিই, ছুঁয়ে দিই তাকে
নির্জন অন্তরে
সে ত হ্যাংলা খুব, অর্ধেক আলো ও অন্ধকারে
আমাকে বাজায় স্নায়ু তারে;
… … … …..
ঘাসফুল বাঁকা পথ ধরে
দুটি রক্তজবা ছিন্ন করে পায়ে,
ঘাসফুল রাত — —
ঘাসফুল রাতের অধরে
অনুশোচনায় পুড়ি,
ধীরে কেঁপে ওঠে কালো দুটি হাত।”
(ঘাসফুল রাত / পৃষ্ঠা ১৯ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
মাঝে মাঝে দেশ ও রাজনীতির কথাও বলতেন। যেমন তাঁর “মানচিত্র” কবিতায় আমরা এই দেশচিন্তাকে খুব সুন্দরভাবে মূর্ত করেছেন—
“কপাল থেকে নেমে এসেছে শিরা কানের ওপর
ভাবনাগুলো স্ফীত রক্তে
কোনো দক্ষ শিল্পীর তুলির টানে
মূর্ত হয়ে আছে
সামনে এক পোড় খাওয়া মানচিত্র
স্নায়ু আলোড়িত
কবে মানচিত্র হবে মানুষের বাসভূম
ভাবনার মাস্তুলে দাঁড়িয়ে কি দেখা যাবে
সবুজ সময়ের
কতদূর বন্দর ও বাতি ঘর!
মানচিত্রে বৃক্ষ নেই, শস্য নেই,
ঢেলে দেয়া ঘাম আর জল
কোমরে জড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস বাষ্প হয়ে যায়
স্বপ্নের সরু বীজ পোড় খায়
পৃথিবীর পিঠ ফোঁড়ে আগুনের জিব
মনোযোগ ফেরালে নিজের দিকে
তবু প্রাণ পেয়ে যাই,
পেশীর ফোকর থেকে উঁকি দেয় ঘাম
ভ্রুণ হয়ে বেড়ে উঠি
পৃথিবীর সবুজ জরায়ুতে— —
সমস্ত ছবিটা মূর্ত, সঞ্চরণশীল
সামনে একটা পোড় খাওয়া
মানচিত্র
(মানচিত্র / পৃষ্ঠা ৪৭ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
এই সংবেদনশীল কবির স্মৃতিমগ্নতাও দৃষ্টিগ্রাহ্য। এই যে জীবন, এ জীবনস্রোতে কতো লোকের সাথে আমাদের মেলামেশা হয়। কতো লোক কতো কথা বলে। কেউ থাকে, কেউ চলে যায়। যে যায়, সে যায়। কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে কোথাও জমা থেকে যায়। মুনির আহমেদও এমনি করেই আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছেন। যেখানেই যাক না কেন, আমার কাছে মুনির আহমেদ সেই হাত নাড়া, ঠোঁটের দৃঢ়তায় উচ্চারিত সত্য শব্দগুলো আজ ফের মূর্ত হয়ে উঠছে। তাঁর কবিতায়ও আমরা দেখি, কবির কাছে এই স্মৃতি যেন ইস্পাতের দাঁত যা খুলি ফাঁক করে বিঁধে থাকে—
কত বেলা অবেলায়
কতজন কতকিছু বলে চলে যায়।
যে যায়, সে যায়
আমরা দিনের পিলসুজে
সময় পোড়াই
স্মৃতির ইস্পাত দাঁত
বিঁধে যায়
খুলি ফাঁক করে।
(স্মৃতি / পৃষ্ঠা ৪৬ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
আজ কতদিন এই শহরে মুনির আহমেদকে দেখি না। জানি না কোথায় বসে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর ব্যাটারী গলির সেই ঘর যেন অবকাশ যাপন করছে কতো কাল ধরে। আজ কবিকে না দেখার কারণেই হয়তো, কবির দৃষ্টিতে ‘অবকাশ’ যেন এক ভিন্ন মাত্রা পায়—
বাসি পড়ে আছে বিছানা কাল থেকে।
শুয়েছিল রাত,
তার বাহু ও নিতম্ব চোয়ালের ভাঁজের পাশে
চাদরে লেগে আছে স্বপ্নের শেফালী।
চাঁদ ডুবে গেলে, সুগোল চাঁদের বাহু
আকাশের দীর্ঘ তরঙ্গে কাঁপছিল খুব।
বাসি পড়ে আছে বিছানা কাল থেকে।
ঝরছিল মেঘের কাশফুল
জানালা ও শিয়রে;
বিছানা মুড়ে বসে আছে একজন
তার জন্মান্ধ চোখে
বাসি পড়ে আছে বিছানা কাল থেকে।
(অবকাশ / পৃষ্ঠা ৪৮ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
প্রেমের কবিতায়ও মুনির আহমেদ বেশ কিছু সুন্দর পংক্তি আমাদের উপহার দিয়েছেন। আমরা যদি ‘তোমার প্রিয় মুখ’ কবিতা থেকে পাঠ করি তবে দেখি—
“নিংড়ে নিয়েছ আমাকে
পৃথিবীর সবুজ খোসা থেকে,
তোমার ঠোঁটের ফাঁক থেকে
গড়িয়ে পড়ছি আমি”
“আংশিক তোমার মুখ
করেছে আমার ঠোঁট স্পর্শ
সূর্যের ডুবন্ত কালো
তোমার চোখের কোলে”
“তোমাকে বাড়ানো হাত
উঠেছে বাতাসে দুলে”
(তোমার প্রিয় মুখ / পৃষ্ঠা ২২ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
আবার স্বপ্ন-১ কবিতায় দেখি আরেক অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণনা—
“নীলাভ ওড়ান কব্জিতে বেঁধে
নিপুণ উড়াল সে’ও দেয়, উড়ে যাও সেও।
ঘামের নিটোল বৃত্ত থেকেও
স্বপ্নের বাঁধো ঘর, এই তার ইঙ্গিত।
হঠাৎ আঁধার-ঘন সেও।
বা সে এক নদী পাহাড়ের উরুতে গড়ায়, যার
স্বচ্ছ বুকের ক্ষতে সংগীত।
নীলাভ ওড়না কব্জিতে ওড়ে তার।
(স্বপ্ন-১ / পৃষ্ঠা ৩৪ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
এমন বহুমাত্রিক কবিতা আরও অনেক রয়েছে। যেমন ‘অনাম্নী’, ‘রহস্য’, তুমি ও তিনি’ এবং ‘শ্বাস’—এই কবিতাগুলো যেন রহস্যময়তার এক জাল বিস্তার করে বাস্তবতা ও স্বপ্নের মধ্যে অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন কবি। তাঁর ‘পদ্মাসন’, ‘খাঁড়ি’, ও ‘মাছি’ আবার আরেক মেজাজের লেখা। ভিন্ন স্বরভঙ্গি দেখি আবার ‘বেশ্যা’, ‘ঝড়’ ও ‘কাঁচের বাক্সে ষাঁড়’ কবিতাগুলোতে। চমকে উঠতে হয়, যখন ষাঁড়ও কপাল কুঁচকায়। সেই ষাঁড় আবার কাঁচের বাক্সে একা তড়পায়।
“ষাঁড়
কপাল কুঁচকে ক্ষুর গাঁথে
কাঁচে”
(কাঁচের বাক্সে ষাঁড় / পৃষ্ঠা ১১ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
এতো বহুমাত্রায় কবিতাকে যাপন করেছিলেন একসময় মুনির আহমেদ। তারপরও তিনি এই কবিতার সংসারে থাকেননি (নাকি থেকেছেন, আমরা জানিনে)। থাকেননি এই শহরেও। হয়তো সংসার তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে কোনো দূর সবুজ কাঁচের শহরে, যেখানে দূর পদচিহ্নে তাঁর ফুসফুস ছাড়ছে শ্বাস, ছাড়ছে হয়তো অধীর পৌরুষও। হয়তোবা এ শহর তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছে। তিনি এ শহরে খুঁজে পাননি মনের মতোন কোনো বন্ধু। তাই হয়তো আমাদের এ শহরকে ছেড়ে তিনি খুঁজতে গিয়েছেন কোনো এক রূপকথার ‘সবুজ কাঁচের শহর’। এ শহর বন্ধুহীন; তিনি প্রতিদিন শূন্যতা মাড়িয়ে হেঁটে যান, সেই শূন্যতার নীলের গভীরে পড়ে থাকে কবির গভীর জুতার ছাপ। কবির মনে হয়, রাস্তার উপর দিয়ে তাঁর জুতোর শব্দ গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। আমরাও যেন আবছা শুনতে পাই কোথাও হেঁটে যাচ্ছেন কবি মুনির আহমেদ।
“এ শহরে আমার বন্ধুরা নেই
ওদের খুঁজছি আমি
ওরা অন্য শহরে, সবুজ
কাঁচের মতন এক
নতুন শহরে।
আমি হেঁটে হেঁটে
শূন্যতা মাড়িয়ে দিচ্ছি।
নীল রঙয়ের শূন্যতার
গভীরে পড়ছে
আমার জুতোর ছাপ।
আমার আঙুলগুলো
শব্দ করে
একে একে ভাঙছি আমি।
রাস্তার ওপর আমার জুতোর শব্দ
গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
এ শহরে আমার বন্ধুরা নেই
আমি খুঁজছি ওদের।
ওরা অন্য শহরে, সবুজ
কাঁচের মতন এক
নতুন শহরে।”
(সবুজ কাঁচের শহর / পৃষ্ঠা ১৬ / আত্মপ্রতিকৃতি / ১৯৯১)
বিঃদ্রঃ— কবিতার শিরোনাম ও কবিতার উদ্ধৃতিতে কবির ব্যবহৃত বানান বিধি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)