আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
আট.
অ্যাকোরিয়ামের রঙিন মাছটির একবার সাধ জেগেছিল মুক্তজলে যাওয়ার। এই গোলগাল কাঁচের শহরটি মোটেও তার কাছে খারাপ লাগছিল না, একা থাকলেও একঘেয়ে মনে হচ্ছিল না। সকল নাগরিক সুবিধা এখানে বর্তমান ছিল, মৌলিক অধিকারও। তবুও তার একবার পুকুরের মিঠা, নদীর প্রবাহিত, সাগরের লবণাক্ত জলের স্বাদ নেওয়ার সাধ জেগেছিল। সে তো আর মাছ হয়ে উড়োজাহাজের মতো উড়তে চায়নি, রকেটের মতো মহাশূন্যে ভাসতে! কোন কারণ ছাড়া এই চাওয়াটা তার ন্যার্য।
সে মুক্তজলের খবর কী করে পেল তা জানা যায়নি তবুও মাছের মালিক কীভাবে জানি তা বুঝতে পেরেছিল। তাই তার প্রিয় রঙিন মাছটিকে ছেড়ে দেওয়া হলো খোলা জলে। মুহূর্তে অন্যান্য মাছের সাথে সেও হারিয়ে গেল তাদের রাজ্যে। পানির ভিন্ন ভিন্ন রঙে, আলাদা তাপমাত্রায় হেসে-গেয়ে-খেলে প্রথম দিকে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু একটু পরেই শুরু হলো বিপত্তি, যখন অন্যান্য মাছের সঙ্গে লড়াই করে খাবার সংগ্রহ করতে হচ্ছিল, আবার নিজেই খাবার হয়ে যাচ্ছিল অন্যদের। তাই আতঙ্কিত হয়ে ক্রমশ ছুটে যাচ্ছিল এপার থেকে ওপার, ওপাশ হতে এপাশ। তখনই হঠাৎ মাছটির স্মৃতিহীন মাথায় সিগন্যাল দিচ্ছিল, এর চেয়ে ঐ ছোট কাঁচের ঘরটাই ঢের ভালো ছিল।
নয়.
নিদারুণ চাপ নিয়ে শহরের কোথাও যখন নিজেকে হালকা করার মতো কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না, মার্কেট, দোকান, বাজার, মাজার বা রাস্তায় কোন পাশে তখন অবচেতনে গোপাল ভাঁড় হানা দেয় মনে। এ যেন সেই মহারাজের মহাসমুদ্র বিহারের পুনরাবৃত্তি। বাঘ-ভাল্লুক যাই থাকুক না কপালে এবার একটা কিছু করে ফেলার তাগাদা। এই জমকালো বিপণী বিতান, আলোকোজ্জ্বল রাস্তা ঘাট পেরিয়ে থরে থরে সাজানো অফিস-আদালত, শৈল্পিক বাসভবন,গতিময় ফ্লাইওভার সুনসান টানেল ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
মনে পড়ে টিফিন ছুটিতে সৈন্যের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে হিসি করার কথা, কারও কাছে স্টেনগান, কেউ রাইফেল, বেশির ভাগের হাতে নিছক কাটা বন্দুক, নোনা দেয়ালে ঝাঁঝরা করা হলুদ ক্ষত – এখনও আছে হয়তো সে-সব দুরন্ত দুপুরের দাগ।
দশ.
টিলাটির খাঁজে ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরটির কাছে না গেলে ঘর বলে বোঝা মুশকিল। কোনমতে টিকে থাকা ঘরটার ছাউনিতে পাতারা পাখিদের মতো উড়ে এসে এমনভাবে বসেছে আর যাওয়ার নাম নেই। সবাই কি আর পরিযায়ী হয়! সেখানে থাকে একা এক বুৃড়িমা। যাকে খুব একটা দেখা যায় না। কেউ নেই ভেবে দুষ্ট বাচ্চার দল সামনের বহেড়া গাছটির নিচ থেকে বহেড়া কুড়ায়, মাঝেমধ্যে ঢিল ছুড়ে গাছটির ছাদে। আধভাঙা কপাটের শব্দ শুনতেই দল বেধে ছুটে পালায়। হেসে লুটোপুটি খায়। আবার আসে, আবার যায়। ঘটনাটা প্রতিদিনকার। একদিন দরজায় আর কোন শব্দ হচ্ছে না দেখে দুষ্টের দল পেড়ে পেড়ে কুড়িয়ে চলেছে গাছটির সবগুলো বহেড়া।
এগারো.
নবায়নযোগ্য জ্বালানির খোঁজে যখন বিজ্ঞানীরা হন্তদন্ত হঠাৎ একজন নিয়ে এলো এক নয়া প্রস্তাব। মলমূত্রে দিয়ে তো হয়ই, এবার না হয় বায়ুত্যাগ নিয়ে হয়ে যাক। একজনের নয় শুধু, বিন্দু হতে সিন্ধু যেমন, এই ভবন, মহল্লা, পৌর এলাকা, নগর, শহর, দেশের সকলের পশ্চাৎপদ দিয়ে নির্গত মিথেন গ্যাস যদি সংগ্রহ করা যায় অতঃপর তাকে একসাথে করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা হবে এক নতুন দ্বার উন্মোচন। এ আবিষ্কার ক্রমবর্ধমান অবাসযোগ্য হতে থাকা পৃথিবীটার কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি চাপ কমবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। এ জ্বালানির নাম কি হবে, বায়োগ্যাস না বায়ুগ্যাস সে তর্ক অপ্রয়োজনীয়। সেখানেও হয়তো হালকা মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হবে যা পরিবেশের জন্য ততটা ক্ষতিকর বলা যাবে না।
শিল্পায়নের উন্নয়নের পাশাপাশি যখন ঘরে-ঘরে রান্না হবে ভাত, মাছ-মাংশ ও তরিতরকারি, টেবিলে গরম-গরম পরিবেশনকালে ঘটনাটা মনে করে এই সময়ে কে এ-কাজ করলো ভেবে কোন একজনের নাক চুলকাবে।
বারো.
জংধরা গাছটার নিচে বসে আছে একা এ কোন ঝলসানো যন্ত্রমানব! সীমাহীন যন্ত্রণা যে কাওকে যন্ত্র বানিয়ে দিতে পারে। দূর থেকে আকাশটার পোড়া গায়ে কুণ্ডলিপাকা মাসরুমমেঘ দেখা যাচ্ছে না আর। যদিও আকাশ বলে এখন আর কিছু নেই। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে সূর্যটা মাটিতে নেমে এসেছে। নাকি ভূমি উল্টে গেছে লুত সম্প্রদায়ের মতো, মৃতসাগরে একফোটা জল নেই, চোখের লবণাক্ত জলটুকুও উবে গেছে। ঐ ছোট বালকটির সাদা-নীল রঙের খেলনা থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসছিল যে তেজ, দশ লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার সুনামিতে কীইবা বাকি থাকে আর!
ভাঙা থার্মোমিটারের গলিত পারদের ধূসরতায় চাঁদও হয়তো পোড়া এলুমিনিয়ামের ফ্রাইপেন। সীসার আইসক্রিমের মতো গলে পড়ছে নগরের প্রতিটি ভবন, একরাশ উত্তপ্ত বালিঝড় এক ঝটকায় শুষে নিয়ে গেছে সবটুকু জল। আগুনের জলোচ্ছ্বাসে রক্তও হারিয়ে ফেলেছে রঙ। কালোবৃষ্টিতে কয়লা হতে চলা গাছগাছালির হাত-পা, জলন্ত জলের গরলে ধুয়েমুছে গেছে সব, আছে শুধু যন্ত্রমানবের অস্ফুট স্বরে একফোঁটা জলের গোগানিতে কারবালা।
তেরো.
এ শহরে একটাও ভালো কফিশপ নেই। তারপরও যাই ধোয়া ওঠা আগ্নেয়গিরিতে চুমুক দিতে, নিঃসঙ্গ অথবা সসঙ্গী। ক্যাফেতে বসে ক্যাফেনের তেতো স্বাদের যৌগে কে বিয়োগ হলো সেই যোগসূত্র মেলাই না আজকাল। সে বিরহের বয়স কি পার করে এসেছি!
প্রায় ফেনাহীন অঘ্রাণ অখ্যাত তেতো খেতে বসে মনের নাকে আসে যোজনগন্ধা নয়, গন্ধগোকুলের বিষ্ঠার ঘ্রাণ। কীকরে কাঠবিড়ালিগুলো বন থেকে বেছে নেয় সুমিষ্ট ফল। তার থেকেও কঠিনতম মজার বিষয় হলো, কেমন করে পেছন ছুটে গ্রামবাসী খাট্টাশের বিষ্ঠার খোঁজে। এসব ভাবনার আলোআঁধারিতে কফি হাউজ আড্ডায় জমে ওঠে।
আমাদের পরিপাকতন্ত্রে এসে রঙিন ফলদের পুনরায় গাঁজন হয়।
জন্ম : ২ নভেম্বর ১৯৭৯ সাল; ধূরুং, বিবিরহাট, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। পেশা : শিক্ষকতা। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
মানুষ মানুষ নয় হোমোসেপিয়ানস (২০০৪, বলাকা);
রাফখাতার কাটাকুটি (২০১০, তেপান্তর);
অ্যা জার্নি বাই অ্যাম্বুলেন্স (২০১৮, বাঙ্ময়);
কাঁটাতারে কারাগারে (২০২১, বেহুলাবাংলা)।