| 9 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: সোনার খাঁচা ।  পলি শাহীনা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

আবহাওয়া শীতল হওয়া সত্ত্বেও শিউলি দরদর ঘামছে, ওর হৃদয় মুহুর্মুহু কাঁপছে। বুকে যে কোন কারণে চাপ অনুভূত হলে শিউলি মেয়েটাকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদর করলে অদ্ভুত আরাম পায়, ঠিক প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে গল্প করার মতোন, কিংবা প্রিয় কবিতার বই পড়ার মতো। ও তমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়, চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কিছু সময় মেয়ের কক্ষে অতিবাহিত করে রায়হানের কথা ভেবে হুড়মুড় বেরিয়ে আসে। রায়হান এবং শিউলি দম্পতির আদরের ছোট মেয়ে তমা। মেয়ের জন্য বাবার পছন্দের পাত্র মাহিন আজ বাসায় আসবে, একসঙ্গে ডিনার করবে। এই উপলক্ষে রায়হানকে বেশ আনন্দিত দেখাচ্ছে। ওর মুখে বৈকালিক আলোর সোনালী আভা চকচক করছে। এই ঘর হতে ওই ঘরে ও হাঁটছে, হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। নতুন অতিথি আসবে ঘরে, একটা উৎসব উৎসব ভাব রায়হানের মধ্যে, এত এত আনন্দের ভীড়েও শিউলির বুকটা মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে। আনন্দে যেমন সুখ আছে তেমন ব্যথাও আছে। ওর মনে পড়ে ছোটবেলায় পোষা টিয়া পাখিটার কথা। বহুদিন ধরে খাঁচায় পোষা টিয়া পাখিটাকে যেদিন ছেড়ে দিয়েছিল মুক্ত আকাশে, মুক্তির ডাকে ও যখন উড়ছিল তখন বড় সুখ সুখ লাগছিল। উড়তে উড়তে টিয়াটি যখন দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়, আর ফিরে আসে না, তখন বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়েছিল। ওর ফেলে যাওয়া পালক, আদর, ভালোবাসা, মায়া, ছায়া আজো মনের দেয়ালে গভীর চুম্বনের মতো লেগে আছে। আজো তাই কোন বিচ্ছেদের সুর প্রাণে বেজে উঠলেই শিউলির মনে পড়ে যায় টিয়া পাখিটির কথা। তমা ওর আনন্দ, শান্তি, স্বস্তি। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েটা ঘর ছেড়ে যাবে, ভাবতেই কী যে কষ্ট, হৃদয় নড়ে উঠে যেন। শিউলির বড় হাসফাস লাগে। 

 

একটা বিজবিজে কষ্টের কুয়াশা আপাদমস্তক জড়িয়ে ধরলে শিউলি বারান্দায় গিয়ে বসে। ওর নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে, মন পোড়ে। কষ্ট ভাগ করলে কমে, কিন্তু ওর ব্যক্তিগত কষ্টের কথা শোনার মতো আপাতত ঘরে কেউ নেই। রায়হান ব্যস্ত মাহিনকে ঘিরে, তমা শব্দহীন হয়ে আছে। বাহ্যিকভাবে কোন বিভেদ না থাকলেও হৃদয়ে হৃদয়ে একটা শান্ত লড়াই চলছে বাপ, মেয়েতে, শিউলি ভালোভাবে তা টের পাচ্ছে। ওর এমন ব্যাক্তিগত  দু:শ্চিন্তায় যদিও স্বামীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, মেয়েরও কোন মাথাব্যথা নেই। মনকে অন্যদিকে ধাবিত করার চেষ্টায় টবে রাখা নীল অপরাজিতার দিকে চোখ রাখতেই একটা শনশন হাওয়া বয়ে যায়। অল্প ক’দিনেই অপরাজিতা গাছটি বেশ বড় হয়েছে। দুদ্দাড় হাওয়ায় নীল অপরাজিতা দুলছে, শিউলি মুগ্ধ চোখে দেখছে। ঝুল বারান্দা থেকে কয়েক হাত দূরে একটি বিশালাকৃতির গাছ ছাতার মতো পথচারীদের ছায়া দিচ্ছে। এই বড় গাছটির দিকে তাকালে শিউলির ফেলে আসা গ্রামের বটগাছটির কথা মনে পড়ে। যে বটগাছের ছায়ায় সহপাঠীদের সঙ্গে ছুটির দিনে ও রান্না বাটি খেলেছে। বাতাসে গাছটির চিরল চিরল পাতা নড়ছে, আর ওর বুকে অতীতের সবুজ ছায়া এসে পড়ছে। এই গাছটা বোধহয় ওর একান্ত ভালোবাসার কথা জানতে পেরেছে, জানতে পেরে আরো বেশি দুলছে। গাছটি প্রার্থনার ভঙ্গীতে শিউলির দিকে পূর্ণ মনোযোগে অপলক চেয়ে আছে। শিউলি এবং গাছটি, মাঝখানে দেয়াল, যখন পথচারী থাকে না, ঘরে মানুষ থাকে না, তখন ওরা প্রাণ খুলে কথা বলে, খলবল হাসে, একে অপরের শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়। ওরা যখন মগ্ন নিজেদের নিয়ে ঠিক তখনই একদল ঘরে ফেরা পাখির কিচিরমিচির শব্দে ওদের মনোযোগ ব্যাহত হয়। শিউলি কান পেতে শোনে কোন কোন পাখি অস্থির, ঝাঁঝালো স্বর, আবার কোনটির ডাক ভালোবাসার মতোন কোমল। ও ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে, যে দুটি পাখি ঝগড়া করছে ওদের থেকে একটু দূরে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে আরেক জোড়া পাখি। আদর করা পাখি জোড়া দেখে শিউলির ভ্রম হয়, ইচ্ছে করে চার দেয়ালের বাসা ছেড়ে উড়ে যেতে মুক্ত আকাশে। ও পেছন ফিরে তাকাতেই চার দেয়াল যেন ডেকে বলছে, আজকে নয়, আজকে নয়। ও আবার গাছটির দিকে অসহায় চোখে তাকায়। দিন-রাত্রির সন্ধিক্ষণে গোধূলির আলো গাছটির সর্বাঙ্গে মায়া হয়ে ফুটে উঠেছে। এমন মায়ার জাল প্রাণে আরাম দেয়, ওর হৃদয়ের যত ক্ষত সেরে যায় প্রকৃতির আদরে, কিংবা প্রকৃতির নিয়মে। 

 

ইতোমধ্যে হুড়মুড় সন্ধ্যা নেমেছে। পোঁচ পোঁচ অন্ধকার ঝাপ্টে ধরেছে চারপাশে। ছুটির দিন এই সময় সাধারণত রায়হান বাসায় থাকে না। আজ মাহিনের অপেক্ষায় অনড়ভাবে বসে আছে পথ চেয়ে। শিউলি ঘরে এসে দেখে রায়হান অস্থির পায়চারি শুরু করেছে। ওর হাইপার টেনশন রোগ আছে, শিউলির ভয় লাগে কখন আবার হৈচৈ শুরু করে দেয়। ঠিক সেসময় বাসার ড্রাইভওয়ে গাড়ির হর্নের শব্দে ওর দুর্ভাবনা কেটে যায়। উচ্ছ্বসিত রায়হান বেরিয়ে যায় দ্রুত পায়ে মাহিনকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে। শিউলি নিজেকে এক পলক আয়নায় দেখে গুছিয়ে নিয়ে ছুটে যায় রান্নাঘরে। সব ঠিকঠাক আছে কী না আরেকবার দেখে নেয়। খাওয়ার টেবিলে আজ অনেক খাবার। সারাদিন ধরে ও মাহিনের সব পছন্দের খাবার বানিয়েছে। মাহিনের কাছ থেকে ওর পছন্দের খাবারগুলো জেনে নিয়ে রায়হান ওভাবেই বাজার করেছে। শিউলি সেগুলো দিনভর যত্ন করে রেঁধেছে। 

 

ঘরে প্রবেশ করে হাসিমুখে সালাম দেয় মাহিন। ওর ভদ্রতা, মিষ্টি স্বর, নির্মল হাসি শিউলির ভালো লাগে। ওর কথা বলার মন্থর ছন্দে শিউলির বুকে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর অন্ধকারে আবার বিদ্যুৎ হঠাৎ ফিরে এলে যেমন চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠে ঠিক তেমন একটি আলোর রেখা ঝলসে উঠে ওর বুকের মন্দিরে। এমন মধুর অমায়িক স্বর ও কতদিন শোনে নি। হাত ধরে মাহিনকে সোফায় বসিয়ে দেয় শিউলি। কুশলাদি বিনিময় শেষে আরো কিছু সময় ওরা গল্প করে। রায়হান গলা উঁচিয়ে তমাকে ডাক দেয়। তমা ‘আসছি’ বলেও বেশ দেরি করে। মাহিনকে নিয়ে রায়হান খাবার টেবিলে এসে বসে। তমা এসে যোগ দেয় ওদের সঙ্গে। শর্ট প্যান্ট, টি শার্ট পরে ঘরের আটপৌরে সাজে তমা সামনে আসতেই রায়হান কটমট দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকায়। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আসে, বিব্রত বোধ করে। মনে হলো, এই বুঝি গন্ডগোল লেগে গেলো। মাহিনের সঙ্গে স্বাভাবিক স্বরে তমার পরিচয় করিয়ে দেয় রায়হান। শিউলি স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে এই যাত্রায় সমস্যা এড়াতে পেরে। মাহিনকে ‘হাই’ বলে তমা চুপচাপ নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খেতে থাকে, অন্য কোন দিকে ওর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। খেতে খেতে রায়হান এবং মাহিন নানান গল্প করছে, শিউলি ওদের তদারকি করছে, মাঝেমধ্যে ওদের গল্পে হ্যাঁ, আচ্ছা, এসব নিরীহ কথা বলে শরিক হচ্ছে। মাহিন চিকেন রোস্টের ভূয়সী প্রশংসা করতেই রায়হান বলে, ‘ এটি তমা রান্না করেছে। ‘ তমা খাবার প্লেট হতে মুখ তুলে মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ আমি চিকেন রোস্ট রান্না করি নি, আসলে আমি কোন রান্নাই পারি না, আদতে রান্না করার প্রয়োজন পড়ে নি এখনো। টেবিলের সব খাবার সে সূর্যদয় থেকে আম্মু একাকী রান্না করেছেন। তাঁকে আমি কিংবা আব্বু কেউ সাহায্য করি নি। ‘ বাবার মিথ্যা কথার প্রতিবাদ করে এই প্রথম তমা একাধারে অনেক কথা বলে। মেয়ের চোখেমুখে তীব্র ক্রোধ দেখে শিউলির আত্মা থরথর কাঁপতে থাকে। মাহিন একটু সময় চুপ থেকে পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিলেও রায়হান প্লেটে এদিক ওদিক এলোমেলো আঙুল নাড়াচ্ছে, থম মেরে আছে। শিউলি বুঝতে পারে আকাশে ভারি মেঘ জমেছে, আজ ঝড় হবে। রায়হানের খানিক আগের উদ্ভাসিত মুখমণ্ডল কালো কালিতে ঢেকে গেছে। 

 

খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় মাহিনের উদ্দেশ্যে তমা বলে, 

– আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভালো লেগেছে। 

-আমার অনুভূতিও একইরকম। 

– অনেক অনেক ধন্যবাদ। 

-আমাদের সম্পর্ক স্বচ্ছ , সুন্দর হোক।

– সম্পর্কে যাওয়ার আগে লিভ ইন এ যেতে চাই। 

 

উত্তরে মাহিন কিছু বলার আগেই মেয়ের মুখে লিভ ইন এর কথা শুনে রায়হান সিংহের মতো গর্জে উঠে বলে, ‘ধর্মীয় অনুশাসন, সমাজ, বাঙালি সংস্কৃতি, ভদ্রতা বলে তো কিছু আছে, এসব শুনলে লোকে কী বলবে? সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে? ‘ 

 

বাবার চেয়েও দ্বিগুণ হুংকার ছেড়ে মেয়ের জবাব,

 

 ‘ প্রথমত, ধর্ম মানুষের ভালো থাকার জন্য, যা আমাকে ভালো রাখবে তাই ধর্ম, কাছ হতে দেখেছি ধর্ম পুঁজি করে কীভাবে এক মানুষ অন্য মানুষের জীবন নরক করে তোলে, দ্বিতীয়ত, লোক সংসার করবে না, করব আমরা, লোকের কথায় আমাদের ভালো – মন্দ কোনটাই হবে না, তৃতীয়ত, কালচার ইজ রাবিশ টু মি, মানুষ কালচার তৈরি করে নিজের সুবিধামত। আমার সম্পর্ক হবে আমার সুবিধামত, আমার নিয়মে। সম্পর্ক হতে হলে আমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা, এবং এটাই ভদ্রতা ‘ বলে তমা হনহন করে নিজের কক্ষে চলে যায়। 

 

বাবা-মেয়ের বাকবিতন্ডার মাঝখানে মাহিন এবং শিউলি দু’জনেই প্রাণহীন প্রাণীর মতো নীরব হয়ে থাকে। নীরবতা ভেঙে মাহিন বলে, ‘ ঠিক আছে আংকেল, তমাকে সময় দিন। ‘ শিউলি টু শব্দটা করার সাহস পায় না, কিংবা কী বলা উচিৎ ভেবে পায় না। রায়হান পাথরের মূর্তির মতো দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে। কথায় কথায় হুংকার ছড়ানো রায়হান খুব ভারি গলায় মাহিনের উদ্দেশ্যে বলে,

‘ তোমাকে ডেকে এনে এমন একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় ফেলার জন্য দু:খিত। ‘ মাহিন চেয়ার ছেড়ে রায়হানের পাশে দাঁড়ায়, বলে, ‘ আজ আমার খুব ভালো লেগেছে আংকেল। আমার মা নেই। আন্টির হাতের রান্না খেয়ে নস্টালজিক হয়ে উঠেছি, যেন আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়েছি। সম্পর্ক তো আর সরল অংকের মতো নয় যে নিয়ম মেনে সমাধান হবে। আমি আর তমা, দুজনেই সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা। আমাদের একে অপরকে জানতে হবে, চিনতে হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সময়ের হাতে ছেড়ে দেন আমাদেরকে। সময় যা-ই ফয়সালা করুক আপনাদের ভালোবাসা সবসময় আমার আষ্টেপৃষ্ঠে  জড়িয়ে থাকবে। ‘ কথাগুলো বলে মাহিন বিদায় নিয়ে চলে যায়। ছেলেটার কথাগুলোর মমতায় ডুবে থেকে শিউলি ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকে। 

 

মাহিনকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে রায়হান একটি কথাও না বলে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দেয়। এমন দৃশ্যের সঙ্গে শিউলির পরিচয় আছে বহু বছর ধরে।  নুন থেকে চুন খসলেই রায়হান এভাবে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দেয়। শিউলি তখন লিভিং রুমের সোফায় কিংবা মেঝেতে ঘুমায়। ব্রিটিশ রাজ পরিবারে রানী এলিজাবেথ আর রাজা ফিলিপের আলাদা রুম ছিল। এই পরিবারে রায়হানের রুম আছে, শিউলির নেই। এই পরিবারে রাজা আছে, রানী নেই। শিউলির মনে পড়ে, মেঝেতে শীতের রাতে ওর কষ্ট হতে দেখলে বড় মেয়ে লিজা গায়ের কম্বল এনে মায়ের গায়ে দিতো। শিউলি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আপনমনে আওড়াতে থাকে, এই কক্ষ কী শুধু রায়হানের? আমার নয়? যদি আমার হয় তাহলে অধিকার কোথায়? রাজা ফিলিপের কক্ষের উপর কী রানী এলিজাবেথের অধিকার ছিল? কি জানি। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশের চারটি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে শিউলি ভাবে, কক্ষ বাদ দিলাম, এই ঘর কী আমার? চারটি দেয়াল থাকলেই কী ঘর হয়? ভালোবাসা আর ঘর করা কী এক জিনিস নয়? কিসের পেছনে ছুটছি জীবনভর? আমার ঘর কোথায়? গন্তব্যই বা কোথায়? আমি আর জলে ভাসা কচুরিপানার মধ্যে পার্থক্য কী? জীবনের কী নিদারুণ উপহাস! ভালোবাসা বঞ্চিত ঘরহীন আমি ছুটছি সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি, এই দেয়াল হতে ওই দেয়াল ঘেঁষে।  

 

ঘরের দেয়ালে ঝুলানো কন্যা দ্বয়ের ছবিটির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে শিউলি। স্বভাবসুলভ শান্ত বড় কন্যা লিজার সঙ্গে ছোট কন্যা তমা ময়ুরের মতো পেখম মেলে খলবল হাসছে। বাঁধভাঙা হাসির সেই ছোট্ট তমা কখন যে এতবড় হয়েছে, এত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে, আজকের আগে ও টের পায় নি। সংসারে শিউলির প্রাণহীন অসাড় সবকিছু সহ্য করার বিপরীতে মাঝেমধ্যে তমা মৃদু প্রতিবাদ করতো, তবে আজকের মতো এতোটা কখনো ক্ষেপে যায় নি। রাত দুইটা বেজে সতেরো মিনিট। চার দেয়ালের মাঝে ডিম লাইটের সোনালি আলোয় শিউলি পায়চারি করছে। মধ্য রাতের নীরবতায় ওর চিন্তার জগতে গড়াগড়ি খাচ্ছে অজস্র দীর্ঘশ্বাস। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শিউলি নিজের গন্তব্য না জেনে নি:শ্বাস বন্ধ করে প্রানপণ শক্তিতে সংসার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। সাঁতার কাটার এই যুদ্ধ বহু দিনের অভ্যাসে পরিণত হলেও আজ একটা অন্যরকম মনোপীড়ন আঁকড়ে ধরেছে। 

 

একটু শীত শীত লাগায় ক্লোজেট থেকে চাদর নিতে এসে দেখে তমা রোজকার মতো কক্ষের আলো না নিভিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়ের গায়ে কাঁথা টেনে দিতেই মায়ের হাত বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে তমা বলে, 

 

-আলোটা নিভিয়ে দাও, মা। 

-ভয় পাবি না? 

-না, মা। তুমি আমার আলো। 

-এই কেমন কথা? 

-তোমার মুখে আমার সব আলো খেলে। তুমি থাকলে আলো লাগে না আমার।

 

মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে শিউলি লিভিং রুমে এসে বসে। ঘুমানোর চেষ্টা করে, ঘুম আসছে না। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে ওর মায়ের শুকনো লিকলিকে মুখখানা। বাবার থেকে পাওয়া চরম তাচ্ছিল্য ভরা দিনগুলোতেও বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শিউলির মা হাসতো। যদিও সে হাসি ছিল রুগ্ন, ক্ষীণ। মায়ের জীবনের শেষ সময়টা ভেবে শিউলির কান্না পায়। একই পথে ক্রমশ ও নিজেও তো হাঁটছে। মায়ের বেদনার্ত কন্ঠস্বর স্পষ্ট কানে বাজছে। চোখের বিলে জলভাঙা শব্দ ক্রমাগত বেড়েই চলছে। কান্না একান্ত ব্যাক্তিগত, এই কান্না কেউ দেখতে চায় না, ঈশ্বর চায় কী না, তাও জানা নেই।

 

ঘরের দেয়ালে মাথা রেখে জানালার পর্দা ফাঁক করে শিউলি আকাশটার দিকে চেয়ে থাকে, ঠিক ওর ছোটবেলায় খাঁচায় পোষা টিয়া পাখিটির মতো। অন্ধকার ডিঙিয়ে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। শিউলি ভাবে, ফর্সা আকাশ থেকে আলো গড়িয়ে পড়ছে, না কী শিউলির মতো অসংখ্য নির্ঘুম মানুষের রাশি রাশি শূন্যতা?

 

রায়হানের হাঁকে রাতের সমস্ত ঘোর কেটে যায় শিউলির। ঘুম ভেঙে লেবু,পানি খেতে গিয়ে মধুর বয়াম না পেয়ে ওর চিৎকার শুরু হয়েছে, এই চিৎকার চলতে থাকবে অফিস যাওয়ার আগ পর্যন্ত, শেষ হবে রাতে ঘুমানোর আগে। শিউলি দিনরাত্রি ভয়ে রীতিমতো কাঁপতে থাকে। মধুর বয়াম ওর হাতে দিয়ে শিউলি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়৷ ভোরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় যেমন করে মানি প্লান্টের পাতাগুলো দুলছে, একইভাবে ওর মাথাও দুলছে। শারীরিক দূর্বলতাকে পাত্তা না দিয়ে ও তাড়াতাড়ি রায়হানের নাশতা তৈরি করতে থাকে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে রায়হান অফিসের জন্য তৈরি হয়ে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। 

 

-এত তাড়াতাড়ি বের হচ্ছো যে? 

-তোমার মেয়ে গতরাতে আমার সম্মান হানি করেছে। ওর সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না, ভাববো না। 

 

কথাগুলো বলেই বেরিয়ে যায় রায়হান। নিরীহ শিউলি রায়হানের নাশতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চল। 

 

তমা ঘুম ভেঙে প্রতিদিনের মতো ফ্রেশ হয়েই মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়, আর বলে, 

 

-বাবার কথা শুনে স্বস্তি পেয়েছি।

-অতিথির সামনে কেন এমন অসভ্য আচরণ করলে? আমি কী এসব শিখিয়েছি? 

-সত্য বেছে নিয়েছি, সত্য বলেছি, মা।

-মাহিন তোকে অসভ্য ভাববে যে। 

-লিজা আপুর মধ্যে ঠিক তোমার মতো সভ্যতার বীজ বপন করেছ, কাছ হতে দেখেছি তার অশুভ রুপ, সংসারের প্রতিটি অন্যায় মেনে নিয়েছে ও ঠিক তোমারই মতো, একটু আধটু প্রতিবাদ করলে পরিবার ওর সমস্ত ভালো ভুলে সভ্য মানুষের চিহ্ন মুছে দিয়েছে, কী লাভ হলো সভ্য হয়ে?  যন্ত্রণা না বাড়িয়ে শুরুতেই সত্য বলেছি, এই যা। 

-বুঝি না তোদের এত জটিল কথা। বুকটা ধড়ফড়  করছে রে। 

-মা, তুমি বিশ্রাম নাও। বাবাকে খুশি করার জন্য তুমি যেভাবে ক্ষয়ে গেছো, বিনিময়ে অসম্মান, মানসিক নির্যাতন, কান্না ছাড়া আর কী পেলে? তোমার মতো নিভৃতে ক্ষয়ে যাওয়া জীবন আমি চাই না। কেউ এসে আমার জন্য আলো জ্বালিয়ে দিবে, তা-ও চাই না। আমার আলো আমিই জ্বালবো। তোমার চতুর্দিকের দেয়ালগুলো একদিনের তৈরি না মা, বহু দিনের। এই চার দেয়ালের সোনার খাঁচায় তোমার স্বপ্নগুলো ছুঁতে না পারার সামর্থ্য একদিনে খোয়া যায় নি, বোধ জ্ঞান হওয়ার পর হতে দেখেছি তুমি কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করো নি। ব্যাপারটা অদ্ভূত লাগে, সহ্য হয় না, মা, অসহ্য হয়েই তোমার ভাষায় গতরাতে আমি এমন অসভ্য আচরণ করেছি। খুব কষ্ট হয় তোমার জন্য, মা। 

 

মেয়ের কথাগুলো ভালো লাগলেও শিউলির মুখে কোন কথা ফোটে না। এরমধ্যে তমার ফোন আসে, কথা বলতে বলতে ও নিজের কক্ষে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর তমাও বেরিয়ে পড়ে অফিসের কাজে। 

 

চার দেয়ালের ভেতর বড় একটা শ্বাস টেনে চিরাচরিত ঠিকানা বারান্দায় গিয়ে বসে শিউলি। পুরনো নিয়মে গাছ, ফুল, পাখিদের সঙ্গে কথা বলে। খানিক আগে তমার বলা কথাগুলো শক্তি দেয় ওকে। শরীরটা শিমুল তুলোর মতো হালকা লাগছে। ঘরে এসে রান্নার জন্য ফ্রিজ থেকে মাছ, মাংস বের করে যায় লন্ড্রি রুমে। কাপড়গুলো ড্রায়ারে দিয়ে এসি অন করে কফি হাতে নেটফ্লিক্সে অমিতাভ বচ্চনের ‘গুডবাই’ মুভিটি ছেড়ে বসে। কফি, মুভি কোনটাই ওর চোখজোড়া খোলা রাখতে পারছে না। ঘুমের আবেদনের কাছে কফির ঘ্রাণ, মুভির আনন্দ কুয়াশার মতো ঘোলাটে হয়ে আসে। শিউলি সোফার উপরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। 

 

আলতারাঙা ঝকঝকে পায়ে জাহানারা, শেফালী, কুসুম অশ্বত্থ গাছের ডালে পা দুলিয়ে খোলা আকাশের নিচে সুর করে গাইছে, কবিতা পাঠ করছে। ওদের কলকল হাসিতে আকাশ থেকে শূন্যতা নয়, সুর, কবিতা ঝরে পড়ছে। ওদের চারপাশে দেয়াল নেই, ঘরে এসি নেই, প্রেশার কুকার, কাপড় ধোয়ার মেশিন নেই, ডিপ ফ্রিজ নেই। ওরা এসবের কিছু চাইছেও না। ওরা অলকানন্দার মতো স্বাধীন। ওরা যৌবন ভরা আনন্দের কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম করছে, বন বাদাড়ে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, সবুজে অঙ্গ ডুবিয়ে স্নান করছে। কবিতা, গান ভুলে সংসারে বিলীন হওয়া শিউলি দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের আনন্দ দেখছে, আর ভাবছে আমি কী এখনো ওদের সই হই? আমি কী আছড়ে পড়তে পারি ওদের এমন আনন্দে? ঠিক তখনই কুসুম চিৎকার করে শিউলিকে কাছে ডাকতে থাকে। ওর চিৎকারে শিউলির ঘুম ভেঙে যায়। 

 

ঘুম ভেঙে শিউলি দেখে মসৃণ টাইলস থেকে সোনারঙ আলো বিকিরণ হয়ে এসে ওর মুখে পড়ছে। সোনার থালার মতো সূর্যের হলুদ রঙ ওর চারপাশের দেয়ালে ঢেউ তুলছে। ওর চার দেয়ালের ঘরটা সোনারঙা আলোয় আরো অভিজাত হয়ে উঠেছে। ও আয়নার সামনে এসে বসে, নিজেকে দেখে, এত এত আলোর মাঝেও মুখটা ফ্যাকাসে, চিনতে পারে না। অগণিত রাতের নিদ্রাহীনতার ফলাফলস্বরুপ কোটরে ঢুকে পড়া চোখের চারপাশের ডার্ক সার্কেলের দিকে তাকিয়ে বুক মুচড়ে কান্না পায়। পেট ভরা থাকলেও ওর হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে, হৃদয় ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। চার দেয়ালের এই ঘরটা যেন সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে ও পুনরায় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, আশ্রয় নেয় সেই বড় গাছটির কাছে। শূন্যে তখন সোনারঙা দিনের আলো গায়ে মেখে একদল পায়রা চক্রাকারে উড়ছে, আর শিউলির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আচমকা তীব্র হাঁটু ব্যথা অনুভূত হওয়ায় ও চার দেয়াল বেষ্টিত সোনার খাঁচার মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। পায়রার দল উড়ে উড়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। শিউলি হাঁটু থেকে মাথা তুলে পরিবারের দুপুরের খাবার তৈরি করতে ঝাপসা চোখে রান্নাঘরের দিকে দ্রুত ছুটতে থাকে। 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত