উৎসব সংখ্যা গল্প: পানসুন্দরী । শাহনাজ মুন্নী
পান বড় আয়েশী লতা। খুব সৌখিন আর ভারী আহ্লাদি। কেমন বড়লোকের ঘরের সুন্দরী আদুরে কন্যাদের মতোন নরম সবুজ চকচকে গা এলিয়ে অলস পড়ে থাকে দেখো ! পান লতাদের জন্য বরজ মেরামত করতে করতে আপন মনেই এসব ভাবে মোতালিব। ইশ্রে কত যতœ আর পরিশ্রম করে যে বাঁশ, নারকেল পাতা আর পাটকাঠি দিয়ে অবসর-বিলাসী পান কন্যাদের হেলান দেয়ার জন্য বরজ বানাতে হয়, সেটা কেবল তার মত পানচাষীরাই জানে। আর এই এক পানেরও কত রকমের জাতরে ভাই, সাঁচি পান, মিঠা পান, বাংলা পান, কর্পূরী পান, উজানী পান। আর পান লতাগুলির যা দেমাক! তাদের রাখতে হয় উঁচা জায়গায়, দোআঁশ মাটির ভিটায়, গোড়ায় দিতে হয় সরিষার খৈল আর ইউরিয়া সার।
আচ্ছা, পানপাতাগুলি কি বট পাতার সহোদর বোন? রূপে আর চেহারায় কতো মিল দুইজনের, পান আর বট দুজনেরই আগাটা চোখা, গোড়াটা চেপ্টা আর ছড়ানো, একজনের আকৃতি অবশ্য খানিক বড়, আরেকজন খানিক ছোট, এই যা তফাৎ! একজন ঝোলে লতায় লতায় আরেকজন ঝোলে ডালে ডালে। হুম, আবার হয়তো স্বাদেও তাদের অমিল আছে, পান পাতার স্বাদ কেমন তিতা আর ঝাল ঝাল। বট পাতার স্বাদ? কে জানে কেমন?
অবশ্য পান পাতার পাতলা গড়নের সঙ্গে বটপাতা ছাড়াও আরেকজনের মুখের মিল খুঁজে পায় মোতালিব, সে হচ্ছে ধুমরাইল গ্রামের করম আলীর মেয়ে রৌশনের। একদম পান পাতার মতোই মুখের কাটিং তার। আর সে পান খাইতেও খুব পছন্দ করে, পানের রসে পাতলা ঠোট দুইটা টুকটুকা লাল কইরা রাখে সবসময়। রৌশন এই গ্রামের সেরা সুন্দরী, তারে নিয়া স্বপ্ন দেখে না এমন যুবক এই গ্রামে বোধহয় একজনও নাই। পান লতার মতোই আহ্লাদি, সৌখিন আর ঢলো ঢলো লাবণ্যে মোড়া এই মেয়েটিকে মোতালিবেরও খুব পছন্দ। মোতালিবের ধারণা রৌশন-ও মনে মনে তাকে পছন্দ করে, কিন্তু মুখে সেই কথা স্বীকার যায় না। ওই যে পান পাতার মতোই স্বভাব তার, একটু দেমাগি আর ভাব মারা। খালি সে রহস্য করে। অকারণে ঠিশারা করে। চিরল দাঁতে পান চিবায়, তর্জনিতে চুন লাগিয়ে জিহŸার আগায় লাগায়, মুচকি মুচকি হাসে আর মুখ বাঁকা করে ছড়া কাটে,
‘পানবেপারি, পানবেপারি, সঙ্গে রাইখো চুন সুপারি, আরো রাইখো মিষ্টি জর্দা, নাইলে খাইবা বউয়ের গর্দ্দা ..’
এর উত্তরে মোতালিব গম্ভীর মুখে বলার চেষ্টা করে,‘ শোন রৌশন, পানের রস উপকারি, এই ব্যাপারে সন্দেহ নাই। কিন্তু চুন জর্দা দিয়া পান খাইও না, এইগুলি পানের গুণ নাশ করে। শরীরের ক্ষতি করে।’
মোতালিবের এইসব জ্ঞানের কথা থোড়াই পাত্তা দেয় রৌশন। ধরা দিয়েও যেন ধরা পড়তে চায় না সে। ডাঁট দেখিয়ে মুখ মুচকি মেরে কোমর বাঁকিয়ে চলে যায়। এখন যায় যাক্্, শেষ পর্যন্ত তো মোতালিবের কাছেই আসতে হবে তাকে। পারিবারিকভাবেও তাদের বিয়ের কথা অনেকটা পাকাপাকি হয়েই আছে, দুই পরিবারের সবাই জানে সামনের বছর ফসল উঠার পর রৌশনকে বিয়ে করে ধূমধাম করে তুলে আনা হবে মোতালিবের ঘরে। সমস্যা একটাই, রৌশনের উড়াধূরা রূপ, সেই রূপের আগুন তো শুধু মোতালিবকে একাই পুড়ায়নি, পুড়িয়েছে আরো শত শত প্রেমিকের হৃদয়। রৌশনের সেইসব বঞ্চিত প্রেমিকদের নিয়েই ভয় মোতালিবের, বিশেষ করে পূর্বপাড়ার নাসির এই প্রেমিকদের মধ্যে সবচে ডেয়ারিং, সবচে বেপরোয়া। সম্প্রতি বাবরি চুলা নাসিরের বেশ টাকা পয়সাও হয়েছে, ফলে তার দাপটও বেড়েছে। বাঁচোয়া একটাই, রৌশন এইসব পোলারে কানি আংগুল দিয়াও পোঁছে না। তবে ভেতরে ভেতরে হয়তো আগুনরূপী রৌশন পতঙ্গের মতো তাকে ঘিরে এলাকার রূপমুগ্ধ যুবকদের এইসব ব্যাকুল আকুল ডানা ঝাপটানো উপভোগও করে। ফুল যেমন ভালবাসে তাকে ঘিরে ভ্রমরের আনাগোনা। রৌশনও হয়তো তেমনি ভালবাসে তার অনুরাগি যুবকদের মুগ্ধ তৃষ্ণার্ত চোখ।
মোতালিবের দাদাজান প্রায়ই বলে,‘সুন্দরী বউ নিয়া সংসার করা পুরুষ মানুষের জন্য বড় যাতনার হয় রে নাতি। সাবধান ! এরা একের নারী হতে চায় না, হয় দশের নারী ..’
তো মুরুব্বীদের এসব সতর্ক বাণী শুনেও জেনে-শুনে বিষপানের সাহস করেছে মোতালিব। যতœ-আত্তি করে ডাঁটিয়াল পান লতাকে যদি বশ মানানো যায়, রূপদেমাগি রৌশনকে সে কি জয় করতে পারবে না? দেখা -শোনায় মোতালিবও তো ফেলনা নয়। বিষয়-সম্পত্তিও তার কম না। রূপে গুণে রৌশনের পাশে তাকে মানায় বৈকি। আকারে ইঙ্গিতে সে বুঝেছে রৌশন তাকে অপছন্দ করে না। অতএব, তার আর চিন্তা কি?
সারাদিন পানের বরজের ভালমন্দ খোঁজখবর করে সন্ধ্যার দিকে জামাইল্যার চায়ের দোকানে যায় মোতালিব। ডিব্বার দুধের চা খায়, গ্রামের মানুষের গুলতানি মারা গাল-গল্প শোনে, টিভিতে খবর দেখে। দোকানে একেকবার একেক বিষয় নিয়া আলোচনা জমে উঠে। গত কয়দিন ধরে মহিমপুরের মিয়াসাবের কেরামতির গল্প খুব শোনা যাচ্ছে চায়ের দোকানের আড্ডাবাজদের মুখে, মিয়াসাবের আশ্চর্য তাবিজে নাকি বিশ বছর পরে এক বন্ধ্যা নারীর সন্তান পেটে এসেছে। তার দেওয়া পানি পড়া খেয়ে অচল মানুষ দিব্যি সচল হয়ে হাঁটাচলা করছে। সবচে বেশি বলা হচ্ছে মিয়াসাবের বশীকরণ মন্ত্র দেওয়া পানের কথা, সেই পানের নাকি এতই ক্ষমতা যে, অবাধ্য পুত্র-কন্যা পিতা-মাতার পায়ের কাছে বাধ্যগত কুকুরের মতো হামাগুড়ি দেয়, ঘর-ছাড়া স্বামী ঘরকুনো হয়ে পড়ে। একবার সেই মন্ত্রপুত: পান খাওয়াতে পারলেই হলো, তোমার পছন্দের নারী তোমার জন্য পাগল দেওয়ানা হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। গ্রামের লোকজন ব্যাপারটিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তখন একটা দৃষ্টান্তের কথা বলে, ঘটনাটি পান সংক্রান্ত হওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আর টিভি পর্দায় চোখ রেখেও মোতালিব কান খাড়া করে মিয়াসাবের মন্ত্র পড়া পানের গল্পটা শোনে।
মাইজপাড়ার এক বখাটে ছোকড়া নাকি কিছুতেই তার পছন্দের এক নারীর মন ভজাতে না পেরে মিয়াসাবের মন্ত্র পড়া পানের শরণাপণœ হয়। তারপর নানা কায়দা কানুন করে একজনের হাত দিয়ে সেই মন্ত্রপুত: পান নারীটির কাছে পাঠায়। তখন ছিল দুপুর বেলা, নারীটি সেই পান পেয়ে ভাবলো, আগে ভাত খেয়ে নেই, তারপর জুত করে পানটা খাওয়া যাবে। সে পানের খিলিটা রেখে দেয় রান্নাঘরের এককোনায় পেতে রাখা শিল-পাটার উপরে। তার কিছুক্ষণ পরেই ঘটে আশ্চর্য ঘটনা-টা, নারীটি দেখে ঘরের কোণায় পড়ে থাকা পাথরের প্রাণহীন শিল-পাটা নড়ে উঠেছে। শুধু নড়ে উঠাই নয়, শিল-পাটা হেঁটে হেঁটে রওনা দিয়েছে সেই ছোকরা মজনুর বাড়ির দিকে .. বোঝ অবস্থা, মন্ত্রের কি জোর ! ধরো যদি নারীটি সেই পান নিজে খেতো অথবা পানের খিলিটি গুঁজে রাখতো ঘরের বেড়ায়, তাহলে কি হতো? মন্ত্রের গুণে ওই নারী নিজেই অথবা ঘরের বেড়া কি হাঁটা দিতো মজনুর বাড়ির দিকে?
আলবৎ দিতো।
কি তাজ্জব কারবার !
তাজ্জবই বটে, তবে ব্যাপারটা খুব সোজা ভেবো না, কারণ, যেন তেন পান দিয়া এই কাজ হবে না। তুমি যদি তোমার পছন্দের মেয়েকে বশ করতে চাও তাহলে পান যোগাড় করতে হবে তোমার নিজেকেই, হে হে. তাই বলে মনে করো না, এ আর এমন কি, বাজার থেকে নিজ হাতে পান কিনে এনে দিয়ে দিলেই তো হবে, ল্যাঠা চুকে গেলো! তা না, পান যোগাড় করতে হবে পানের বরজ থেকে। কাউকে সাথে না নিয়ে একা একা অমাবস্যার মধ্য রাতে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় প্রেমিক পুরুষকে তাজা লতা থেকে পান পাতা ছিঁড়ে আনতে হবে, তবেই সেই পানের মন্ত্র কাজ করবে, নয়তো না।
এই গল্প শুনে চা-পানরত গ্রামবাসী চমৎকৃত হয়, শুধু মোতালিব হঠাৎ আতংকিত হয়ে উঠে রৌশনের পানের নেশার কথা ভেবে।
যদি কেউ পানের প্রতি রৌশনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ওকে বশীকরণ মন্ত্র পড়া পান খাইয়ে ফেলে ! এরপর যে কি হবে তা আর চিন্তা করতে পারে না মোতালিব। জামাইল্যার দোকানের সুস্বাদু দুধের-চা হঠাৎ তার মুখে বিস্বাদ লাগে।
নেহায়েতই রাতের বেলা হবু শশুরবাড়িতে যাওয়াটা কেমন অদ্ভুত দেখায়, সে কারণে ভোর হতেই বরজ থেকে এক বিড়া পান তুলে মোতালিব গিয়ে হাজির হয় রৌশনদের বাড়ি।
মোতালিবের কথা শুনে রৌশনের খিল খিল হাসি যেন থামতেই চায় না। সেই উথাল-পাতাল হাসির সামনে মোতালিবের নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগে।
‘পান-বেপারি পান বেপারি, করতে আইছো খবরদারি? পান-বেপারির লাগে ডর, ভাঙ্গে বুঝি নিজের ঘর?’
রৌশনের এমন সব বিদ্রæপাত্মক ছন্দের মুখে মোতালিব দ্রæত ওদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। দেখে বাজারের কাছাকাছি নাসির আরো কয়েকটি ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ওরা কি তাহলে রৌশনকে নিয়েই গল্প করছিলো? নইলে মোতালিব কাছাকাছি আসতেই ওরা হঠাৎ কথা থামিয়ে চুপ মেরে গেল কেন?
‘তোমার বিয়ার তারিখ পড়ছে’নি ভাই?’
ওদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে আন্তরিক ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলে মোতালিব কোনরকমে মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রæত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ‘আমার বিয়া নিয়া ওদের এত মাথা-ব্যাথা কিসের?’ সে মনে মনে ভাবে,‘ওরা আবার কোনো বদ মতলব আঁটছে না তো?’ মোতালিবের কেমন অস্থির লাগে আর এই অস্থিরতা কাটাতে সে পানের বরজে গিয়ে ঢুকে। কী কোমল, সারিবদ্ধ শান্ত সবুজ চারিদিকে, তার শান্তি শান্তি লাগে। প্রতিটা পানপাতায় যেন রৌশনের মুখের লাজুক আদল দেখতে পায় মোতালিব। সে প্রতিটা পাতা আদর করে আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয়, যেন পান পাতা না, রৌশনকেই স্পর্শ করছে।
আর তখনই পানলতাগুলো রৌশন হয়ে যায়।
‘রৌশন তুমি বরজে কিভাবে ঢুকলা?’ মোতালিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘তোমার পিছে পিছেই তো ঢুকলাম বেপারি, তুমি টের পাও নাই? এত আনমনা থাকো তুমি!’ রৌশন তার পান খাওয়া রাঙা ঠোট বেঁকিয়ে চোখে ঝিলিক তুলে হাসে।
‘কিন্তু দাদাজান যে বলে, পান বরজে নারীদের ঢোকা ঠিক না, বিশেষ করে ঋতুমতী নারীর নাপাক ছোয়ায় পান নষ্ট হয়ে যায়, পানে ছুইত্্ লাগে, অশুচি হয়।’
‘আমি তো এখন ঋতুমতি না, বেপারি, আমি এখন কচি পান, তোমার সোহাগের পান লতা।’
রৌশন নরম লতার মতো হেসে গড়িয়ে পড়ে। বাতাসে পান লতাগুলি দুলে উঠে, কেঁপে উঠে, ভেসে যেতে চায়, উড়ে যেতে চায়। পানপাতার সবুজ তিতা ঝাল গন্ধে চারপাশ যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মোতালিবের মনে হয়, পান আর রৌশনের গায়ের গন্ধ একইরকম ঝাঁঝালো, তেঁতো আর মাতাল করা। সে টলতে টলতে পানের বরজ থেকে বেরিয়ে আসে।
নাহ্্ রৌশনকে ঘরে তুলতে আর দেরি করা যাবে না।
পৌষ মাসের আঠারো তারিখ রৌশন আর মোতালিবের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যায়। এখন দুপক্ষেই চলছে অনুষ্ঠান আয়োজনের তোড়জোর আর দিন গোনা। সব কিছুই চলছিলো ঠিক-ঠাক- মোতালিবের লাজুক অপেক্ষার দিনগুলিও ধীরে ধীরে কমে আসছিল, এমন অবস্থায় বিয়ের ঠিক তিন দিন আগে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে উধাও হলো রৌশন। কেউ কিচ্ছু জানে না, সে কোথায় গেছে, কার সঙ্গে গেছে, কেন গেছে, কিভাবে গেছে? ঘরের কোনায় তার পানের বাটা, সুপারি কাটার সরতা, হাকিমপুরি জর্দার কৌটা, চুনের ডিব্বা সব ফেলে রেখে যেন কোন অচেনা নিরুদ্দেশের পথে চলে গেছে মেয়েটা।
রৌশনের বাবা নীরব পাথর। মা উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে,
‘আমার সোনার মাইয়াটারে বশীকরণ পান খাওয়াইয়া ঘর ছাড়া করছে গো .. ’
মোতালিব শুন্য চোখে চেয়ে থাকে। তার ভেতর কখনো ক্ষোভ, কখনো ক্রোধ, কখনো অক্ষমতা জাগে। সে দেখতে পায় যাদু করা পানের প্রভাবে রৌশন সম্মোহিতের মতো দ্বিগবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে হন্্ হন্্ করে হেঁটে যাচ্ছে। তার আধ্্ খোলা দুই চোখের দৃষ্টিতে অচেনা ঘোর! তার পদক্ষেপ এলোমেলো, মুখে পান, পানের রসে ভেজা তার ঠোট দুটো টুকটুকে লাল হয়ে আছে, রৌশন জানে না সে কোথায় কোন সর্বনাশের পথে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। সে এখন মরিচীকা জালে বাধা পড়েছে, সে ভুলে গেছে মোতালিবের কথা, তার প্রতিশ্রুতির কথা, তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের কথা। রৌশন তো স্বেচ্ছায় যায় নাই, সজ্ঞানেও যায় নাই, যাইতে পারে না, কেউ নিশ্চয়ই তাকে ধোঁকা দিয়ে নিয়ে গেছে- মোতালিব ভাবে। আচ্ছা, বশীকরণের মন্ত্র যদি থাকে তবে সেই মন্ত্র কাটানোর কি কোন উপায় নাই? নিশ্চয়ই আছে, মোতালিবের দৃঢ় বিশ্বাস, উল্টা মন্ত্র পড়ে রৌশনকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
দাদাজান সতর্ক করে, ‘ওইসব কুফরি কালামের দিকে যাইছ না ভাই, যে গেছে সে নিজ দায়িত্বেই গেছে, তারে ফেরানোর চেষ্টা বৃথা।’
দাদাজানের সতর্কতা আর পানের বরজ পেছনে পড়ে থাকে যত্নহীন। অভিমানী পান পাতাদের চেহারা থেকে রূপ, রস, গন্ধ সবই একে একে বিলীন হতে থাকে। তাদের কোমল লাবণ্য ঝরে পড়ে, সজীবতা মলিন হয়ে যায়। পান পাতারা হঠাৎ তাদের প্রতি এই অবহেলার কারণ বুঝতে না পেরে মুষড়ে পড়ে। সতেজ পানপাতার মাঝে ধীরে ধীরে পচন ধরে।
কিন্তু মোতালিবের এখন আর সেদিকে দৃষ্টি নাই, সে সকাল বিকাল মহিমপুরের মিয়াসাবের বাড়িতে দৌড়ায়। মিয়াসাব বলেন, ‘উল্টা মন্ত্রের জন্য পানের লতার শিকড় লাগবে, ভর সন্ধ্যায় এক কোপে সেই শিকড় কেটে আনতে হবে, তারপর ওই শিকড় সহ পানের খিলি খাওয়াতে পারলেই হলো। কেটে যাবে সম্মোহনের ধূসর জাল।’
বাবরি চুলের নাসির খবর আনে, রৌশনকে দেখা গেছে জেলা শহরে, চৌধুরীদের মেজো ছেলে মজিদ চৌধুরীর সাথে। শহরে যে দালানে ওরা থাকে সেই দালানের ঠিকানাও চিনে এসেছে নাসির। এবার শুধু উল্টা মন্ত্রের পান খাওয়াতে পারলেই হলো। রৌশনকে আবার ফিরে পাবে মোতালিব।
তারপর, সূর্যাস্তের পর এক ভরসন্ধ্যায় হাতে লম্বা ধারালো দা নিয়ে বরজে ঢুকে মোতালিব। অবসন্ন পান লতারা বহুদিন পর পরিচিত পায়ের শব্দে শিহরিত হয়ে নড়ে চড়ে উঠে। তারা ভাবে উপেক্ষার কাল কেটে গিয়ে আবার বুঝি তাদের সেই পুরনো দিন, সেই সমৃদ্ধি আর ভালবাসার স্মৃতিময় দিনগুলি ফিরে এসেছে, তাদের কচি ম্লান মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠে আশায়, আনন্দে। কিন্তু মোতালিব তো আজ প্রেমিক নয়, সে এসেছে ঘাতক হয়ে অস্ত্র হাতে, পান লতাদের উল্লাসের ভাষা সে বুঝতে পারে না, বোঝার হয়তো চেষ্টাও করে না, বরং উবু হয়ে বসে ঘ্যাস্্ করে নির্দয় ভাবে কেটে নেয় পান লতার জীবন-নালি, তার শেকড়।
পকেটে যাদুপড়া পান নিয়ে নাসিরের মটরসাইকেলের পেছনে চেপে মোতালিব এবার এসেছে শহওে, রৌশনের শ্বশুরবাড়িতে। একসময় যে নাসিরকে মোতালিব প্রতিদ্বন্ধী ভাবতো, প্রতিযোগী ভাবতো, ভাবতো পথের কাঁটা, আজ সেই নাসিরের প্রতিই সে যেন কৃতজ্ঞ। আজ তারা একই পথের পথিক, একইভাবে প্রত্যাখ্যাত, একই দুঃখে দুঃখী, একে অন্যের সমব্যথী।
নিজেদেরকে রৌশনের গ্রাম সম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই পরিচয় দিয়ে মজিদ চৌধুরীর বৈঠকখানায় বসার অনুমতি পায় নাসির আর মোতালিব। ওদের বুক ঢিপ ঢিপ করে রৌশনকে দেখার অপেক্ষায়। কেমন আছে রৌশন? কেমন হয়েছে সে দেখতে? কেমন ব্যবহার করবে সে ওদের সাথে? তাদের উদ্দেশ্য কি সফল হবে? মোতালিবের পকেটে উল্টা মন্ত্র পড়া পানের খিলি গরম হয়ে উঠে। পরনের পাঞ্জাবির নিচে সে ঘামতে থাকে।
ঘরের ভারি পর্দা সরিয়ে ধীর পায়ে রৌশন এসে বৈঠকখানায় ঢুকে।
তার আচরণে আগের সেই চঞ্চলতা নাই, তার চোখে সেই কৌতুক আর বিদ্রæপের ঝিলিকও নাই। এই রৌশন যেন অন্য কেউ, যাকে নাসির বা মোতালিব কোনদিন্ও দেখে নাই।
দু’চারটি স্বাভাবিক কুশল বিনিময় হয়। তারপর দুই পক্ষের কেউ-ই যেন কোন কথা খুঁজে পায় না। মোতালিব ইতস্তত ভঙ্গীতে পকেট থেকে পানের খিলিটা বের করে রৌশনের দিকে এগিয়ে দেয়।
‘আমার বরজের পান, ইসপেশাল কইরা বানায়া আনছি। তোমার জন্য।’
রৌশন এবার ম্লান হাসে, ‘পান খাওয়া তো ছাইড়া দিছি বেপারি, এই বাড়ির কেউ পান খাওয়া পছন্দ করে না।’
এতক্ষণে তার সাদা ফ্যাকাশে ঠোটের দিকে চোখ পড়ে মোতালিবের, সে দেখে রৌশনের মৃত মানুষের মত সাদা ঠোটে পান খাওয়ার সামান্য কোন স্মৃতি চিহ্নই আর অবশিষ্ট নাই।
জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৯ সালের ৮ ই ফেব্রুয়ারি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স করেছেন। পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক, শাহনাজ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশু-সাহিত্য ও প্রবন্ধ লিখে থাকেন। এখন পর্যন্ত তার প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা ২৩।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
১. রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর, ১৯৯০ ( কবিতা, যৌথ) মঙ্গল সন্ধ্যা
২. ক্ষমঃগো শ্বেত দুগ্ধ , ১৯৯২ (কবিতা) মঙ্গল সন্ধ্যা
৩. জ্বিনের কন্যা, ১৯৯৭ (গল্প গ্রন্থ) মঙ্গল সন্ধ্যা ও ধ্রবপদ
৪. প্রেমের কবিতা ১৯৯৮ (কবিতা, যৌথ) অনন্যা
৫. নারী জাগরণ ও নজরুল সাহিত্যে নারী, ১৯৯৭ (গবেষণা) নজরুল ইনসটিটিউট
৬. ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মেয়েলী গীত, ২০০৩ (গবেষণা) বাংলা একাডেমী
৭. আমি আর আমিন যখন আজিমপুরে থাকতাম, ২০০৩ (গল্প গ্রন্থ) মাওলা ব্রাদার্স
৮. আমার নিজের এলাকা, ২০০৩ (কবিতা) মঙ্গলসন্ধ্যা
৯. আত্মঘাতি সুখ, ২০০৪ (কবিতা) মঙ্গলসন্ধ্যা
১০. মাটির ট্রানজিস্টার (গল্পগ্রন্থ) ২০০৬ মাওলা ব্রাদার্স
১১. ২২ আঙ্গুলের জীবন ( উপন্যাস) ২০০৯ শব্দশিল্প
১২. বাদুর ও ব্র্যান্ডি (গল্প গ্রন্থ) , ২০১০, এডর্ণ প্রকাশনী
১৩. তৃতীয় ঘন্টা পড়ার আগেই (কাব্য গ্রন্থ) ২০১০ এডর্ণ প্রকাশনী
১৪. পিঁপড়ার আমেরিকা ভ্রমণ ( ছোটদের গল্প) ২০০৯ পাঠসূত্র
১৫. রাত তেরটা (ছোটদের গল্প সংকলন) ২০১০ ইতি প্রকাশনী
১৬. প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ( ছোটদের জীবনী গ্রন্থ) ২০১০ যুক্ত
১৭. ধূলির শয্যা ( গল্প গ্রন্থ) ২০১১ ধ্রুবপদ
১৮. নির্জনতার খাদ্য (গল্প গ্রন্থ) ২০১২ শব্দশিল্প
১৯. ইশ লিবে ডিষ (উপন্যাস) ২০১৩ জয়তী
২০. হৃদয় ঘরের বারান্দায় (উপন্যাস) ২০১৪ প্রথমা
২১. পান সুন্দরী (গল্প গ্রন্থ) ২০১৫ শব্দশিল্প
২২. থেমেছে শহর (উপন্যাস) ২০১৬ বেঙ্গল পাবলিশার্স
২৩. এক ক্রদ্ধ অন্ধকার ( গল্পগ্রন্থ) ২০১৬ গদ্যপদ্য