শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ
শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ পালিত হবে ২০২০’র মার্চে। মনে আছে, হাই স্কুলে পড়ার সময়ে ১৯৭১’এর ২৫শে মার্চ সেসময়কার পূর্ববঙ্গে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি মিলিটারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে। গণধর্ষণ ও নির্মম অত্যাচারও শুরু হয়েছিল — যার পিছনে ছিল রাজাকার ও আলবদরের দল।
আর আমি টিউশন করার সামান্য পয়সায় একটা কালো কাপড় কিনে কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে কালো ব্যাজ তৈরী করেছিলাম স্কুলের বন্ধুদের জন্যে। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে সবাইকে শোকের ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছিলাম। আর ধ্বনি দিয়েছিলাম, “জয় বাংলা। শেখ মুজিবর রহমান জিন্দাবাদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জিন্দাবাদ।” চীনপন্থী নকশালরা চটে গিয়েছিলো, আর আমিও তারপর কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলাম বন্ধুদের পরামর্শে।
তারপর এলো ১৯৭৫’এর ১৫ই আগস্ট। কলেজে পড়ি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি সন্ধেবেলা উত্তর কলকাতায়। পানের দোকানের ট্রানজিস্টরে খবর শুনলাম, হত্যাকারীরা শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে গুলি করে শেষ করে দিয়েছে। পরে শুনলাম সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সি আই এ এবং কিসিঞ্জারের মদত ছিল এই ভয়াবহ গণহত্যার পিছনে। কেমন যেন একটা ভীষণ হতাশা আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেললো।
১৯৭১’এ যে বিপুল উদ্দীপনা ও উল্লাস গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আমাদের পশ্চিম বাংলায়, ১৯৭৫’এ তা শেষ হয়ে গেলো।
এসব ঘটনা বাস্তব ইতিহাস। আজ যারা মুজিবের শতবর্ষ পালন করতে যাচ্ছে আমেরিকায়, তারা আমেরিকার এই ঘৃণ্য ভূমিকার কথা কি জানে? বেশিরভাগই জানেনা। আর যারা জানে, তারা বেশিরভাগই চেপে যাবে। অর্থাৎ, একটা ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে সেলিব্রেশন হতে চলেছে, এবং বিশাল বড় বড় বক্তৃতাও হবে। মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তুমুল কথার ফোয়ারা ছুটবে। মালায় মালায় ছবি ঢাকা পড়ে যাবে।
আর ইতিহাসও।
দুই বাংলার বহু হিন্দুবিদ্বেষী ও মুসলমানবিদ্বেষী রাতারাতি বন্ধুত্বের অভিনয় করবে, লাইমলাইটে আসার জন্যে। কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হবে। কিসিঞ্জার এখনো বেঁচে। তাকে নিয়ে এই ভয়ঙ্কর ঐতিহাসিক যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবী এই নাটকে উঠবেনা। গণধর্ষণের অপরাধের বিচারের দাবী উঠবেনা। ইতিহাস নিয়ে কোনো বাস্তব আলোচনাও হবেনা। ওপার বাংলায় যে অগণিত মুসলমান ও হিন্দু দেশের স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলো, তারা এখনই প্রায় বিস্মৃত। তাদের কথা কেউ বলবেনা।
ক্ষমতা দখল করেছে আমেরিকাপন্থী, রেসিস্ট, যুদ্ধ ও হিংসাপন্থী একদল ধর্মান্ধ। তারা ৩৬৪ দিন বাংলাদেশ ও মুসলমানদের সম্পর্কে বিষ ছড়াবে। আর একটা দিন সেজেগুজে মঞ্চে উঠবে। লোকে তাদেরই জয়ধ্বনি করবে।
হয়তো এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাদী ও জাতিবিদ্বেষী মার্কিন সরকার ও ভারত সরকারের প্রতিনিধিরাও সেখানে বুলবুলি আর পায়রা ওড়াবেন।
আমরা দেখবো দূর থেকে।
আমেরিকায় তিরিশ বছর আছেন। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক শহরে শ্রমিক-শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী। সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার জগতে তিনি বহু বছর ধরে কাজ করছেন। তাঁর অনেক রচনা ভারত এবং আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখার বাইরে শখের মধ্যে পড়ে গান গাওয়া ও শোনা।