জীবনে অনেক বেশি দুঃখ না পেলে সুখ স্থায়ী হয়না ৷ সুখের জন্য স্থায়ী ঠিকানা, বিরল ঘটনা জীবনের ৷ কখনো মহিমের মত ধীর, স্থির ও শান্ত, নির্লিপ্ত মানসিকতা তো কখনো সুরেশের মত বিচক্ষণতা, ইন্দ্রনাথের মত মহান চরিত্র ৷ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাই বাঙালির মননের চিরসঙ্গী ৷ তার জীবন দর্শন বিশেষ করে মুগ্ধ করে প্রতিটি বাঙালিকে ৷
তার অনবদ্য সৃষ্টি বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, মেজদিদি, শ্রীনাথ বহুরূপী, মহেশ, পল্লীসমাজ, দেবদাস, শ্রীকান্ত প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই মিশে রয়েছে বাঙালির চিরন্তন চেতনা ৷ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অসাধারণ সৃষ্টি ৷
শ্রীকান্তের মত পরের জন্য যার হৃদয় কাঁদে, শ্রীনাথ বহুরূপী হয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করতে করতে নিজের জীবনের সমস্ত রঙ হারিয়েছে, এক অভাগা মা বিন্দুর জীবনের বারোমাস্যা, এক অবলা প্রাণীর জীবনের আর্তি নিয়েই মহেশ রেঙে উঠেছে, ভাগ্যের কাছে পরিহাস ৷ নিঠুর বাস্তবকে সঙ্গী করে অন্ধকারে মিশে যাওয়ার কাহিনিই দেবদাস ৷
১৮৭৬ সালের তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের দেবানন্দপুর, হুগলি জেলা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এক বড় দারিদ্র্যপীড়িত ব্রাক্ষ্মণের ঘরে এই মহান সাহিত্যিকের জন্ম হয়। পিতা ভবঘুরে, সংসারে দরিদ্রতা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, স্কুলের মাহিনা দিতে না পারায় তাকে স্কুল ছাড়তে হলো, শরৎচন্দ্রের পড়ার আগ্রহ দেখে তাঁর মামা পাঁচকড়িবাবু অবশেষে শরৎচন্দ্রকে তাঁদের স্কুলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্রের ছোটমামা স্থানীয় মহাজন গুলজারীলালের কাছে হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার নিয়ে স্কুলের মাহিনে পরিশোধ করলেন। স্কুলটা পাস হলো। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে কলেজ ভর্তি হতে পারলেন না।
শরৎচন্দ্রের পড়া হবে না দেখে মণীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবীর বড় মায়া হল। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে, তাদের দুই ছোট ছেলেকে পড়াবার বিনিময়ে শরৎচন্দ্রের কলেজে ভর্তি হওয়ার এবং কলেজে প্রতি মাসে মাহিনা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এর ফলে শরৎচন্দ্র কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হলেন। শরৎচন্দ্র রাত্রে মণীন্দ্রনাথের ছোট দু ভাই সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন।
কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে কলেজের পাঠ্য বইও কিনতে পারেননি। সহপাঠী বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়তেন এবং সকালেই বই ফেরত দিয়ে আসতেন। কলেজে এইভাবে দু বছর পড়লেন শেষে অর্থাভাবে আর এগোতে পারলেন না, শিক্ষাজীবনের ইতি টানলেন।
শরৎচন্দ্র কেবল সাহিত্যিক লেখক ছিলেন না। তিনি গায়ক, বাদক, অভিনেতা ও চিকিৎসকও ছিলেন। তার চরিত্রে আরও অনেকগুলি গুণ ছিল। তার চরিত্রের যে বৈশিষ্টটি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হল- মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন দরদী মানুষ। মানুষের, এমন কী জীবজন্তুর দুঃখ-দুর্দশা দেখলে বা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলে, তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় এজন্য তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত।
পুরুষ-শাসিত সমাজে পুরুষ অপেক্ষা নারীর প্রতিই তার দরদ ছিল বেশি। আবার সমাজের নিষ্ঠুর অত্যাচারে সমাজপরিত্যক্তা, লাঞ্ছিতা ও পতিতা নারীদের প্রতি তার করুণা ছিল আরও বেশি। পতিতা নারীদের ভুল পথে যাওয়ার জন্য তিনি হৃদয়ে একটা বেদনাও অনুভব করতেন।
জীবজন্তুর প্রতি স্নেহবশত শরৎচন্দ্র বহু বছর সিএসপিসিএ. অর্থাৎ কলকাতা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির হাওড়া শাখার চেয়ারম্যান ছিলেন।
এক সময় অবশ্য তিনি একজন ছোটখাট শিকারীও ছিলেন। তখন ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে এবং বন্দুক নিয়ে পাখি শিকার করতে তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। পরে এসব ছেড়ে দেন। তিনি বরাবরই দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। সাপুড়েদের মত অতি অনায়াসেই বিষধর সাপও ধরতে পারতেন
তিনি ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল পত্নীপ্রেমিক। বিলাসী না হলেও কিছুটা সৌখিন ছিলেন- বিশেষ করে বেশভূষায় ও লেখার ব্যাপারে। তিনি ঘরোয়া বৈঠকে খুব গল্প করতে পারতেন। বন্ধুদের সঙ্গে বেশ পরিহাস-রসিকতা করতেন। আত্ম-প্রচারে সর্বদাই বিমুখ ছিলেন এবং নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কিছু বলা কখনো পছন্দ করতেন না।
শরৎচন্দ্রের প্রথম বৈবাহিক জীবন সুখের বলা চলে না, শান্তি দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়, তাদের একটি পুত্রও সন্তানও হয়। পুত্রের বয়স যখন এক বৎসর, সেই সময় রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী এবং শিশুপুত্র উভয়েরই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে শরৎচন্দ্র তখন গভীর শোকাহত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হিরণ্ময়ী নিঃসন্তান হলেও তারা সুখী ছিলেন।
শেষ বয়সে শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার দেখা দেয়। শরৎচন্দ্র মৃত্যু সন্নিকটে জেনে একটি উইল করেন। উইলে তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতি স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবীকে দান করেন।
শরৎচন্দ্রের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ শুনে রবীন্দ্রনাথ তখন এক পত্রে লিখেছিলেন- কল্যাণীয়েষু, শরৎ, রুগ্ন, দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে।
সেই সময়কার বিখ্যাত সার্জন ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পেটে অপারেশন করেছিলেন। অপারেশন করেও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো সম্ভব হল না।
অপারেশন হয়েছিল ১২.১.৩৮ তারিখে। এর পর শরৎচন্দ্র মাত্র আর চারদিন বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যুর দিনটা ছিল রোববার, ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি(বাংলা ১৩৪৪ সালের ২রা মাঘ)। এই দিনই বেলা দশটা দশ মিনিটের সময় শরৎচন্দ্র সবার চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬১ বছর ৪ মাস। হিরণ্ময়ী দেবী স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শরৎচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলেন-‘ যিনি বাঙালীর জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি।’
এর কয়েকদিন পরে ১২ মাঘ তারিখে কবি আবার শরৎচন্দ্রের মৃত্যু সম্পর্কে এই কবিতাটি লিখেছিলেন-
যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে।
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।
