| 6 অক্টোবর 2024
Categories
শিশুতোষ সাহিত্য

টোটোন ও ছোটন

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

শ্রাবনী সেনগুপ্ত

 

ছোট্ট টোটোন।  তার বাড়ি উত্তরবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে। গ্রামের দুই দিকে জঙ্গলে ঘেরা।  সেখানে নান জীবজন্তুর বাস। টোটোন তার বাবা , মা আর ছোট্ট বোনের সাথে সেই গ্রামে থাকে। তার বাবার আছে সামান্য চাষের জমি। সেখানে ধান চাষ করেই তাদের সারাবছর দিনানিপাত করতে হয়। বছর আটকের টোটোন পড়ে কাছেরই এক অবৈতনিক স্কুলে। সেখানে যেতে গেলে তাকে জঙ্গলের পাশ দিয়েই যেতে হয়।  টোটনের জঙ্গলের পাশ দিয়ে যেতে খুব ভালো লাগে।  কারণ কতরকমের গাছপালা, ফুল , পাখি , দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।  এইভাবেই তার একদিন দেখা হয়ে গেলো ছোটনের সঙ্গে।  ইস্কুলের থেকে ফিরতে টোটনের সেদিন সন্ধ্যে পার হয়ে গেছিলো।  সে যখন নিস্তবদ্ধ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একা একা বাড়ি ফিরছিলো , তখন হঠাৎ মনে হলো কে যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।  ভয়-ডরহীন  টোটোন একটু ভয় পেয়ে গেলো।  মনে জোর এনে পাশে তাকিয়ে সে দেখলো যে একটা বাচ্চা হাতি তার দিকে তাকিয়ে কান নাড়াচ্ছে। টোটোন বড়োদের কাছ থেকে শুনেছিলো , হাতিদের মেজাজ ভালো থাকলে  তারা কান আর লেজ নাড়ায় ।  অনেকদিন ধরে বনের পথ ধরে যেতে যেতে টোটোন বনের গাছপালা, পশুপাখির ভাষা বুঝতে পারতো।  ছোট্ট হাতিটাকে সে জিজ্ঞাসা করলো – কি গো তুমি এখানে কি করছো? হাতিটা কান – মাথা দুলিয়ে বললো – তোমাকে রোজ এখন দিয়ে যেতে দেখি, তাই আলাপ করতে এলাম গো। টোটোন তো খুব খুশি, সে বললো – তুমি আমার বন্ধু হবে? ছোট্ট হাতিটা খুব খুশি হয়ে দুবার জোরে জোরে মাথা নাড়ল।টোটোন বললো – শোনো আজ থেকে তোমার নাম দিলাম ছোটন।  এখন আমি বাড়ি যাবো , রাত হয়ে গেলে বাবা-মা চিন্তা করবেন আর খুব বকবেন।  তাই আজকে আমি যাই।  কাল ইস্কুল থেকে ফেরার সময় তোমার সাথে খেলা করে বাড়ি ফিরবো। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো কিন্তু। এই বলে টোটোন দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ালো আর ছোটন যতদূর দেখা যায় ছোটন তার দিকে আকুল নয়নে চেয়ে রইলো।

পরের দিন বিকালে ইস্কুল থেকে ফেরার সময় টোটনের আর তর সয় না , ছোটন যে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আগের দিনের জায়গাটাতেই ছোটন দাঁড়িয়ে ছিল।টোটোন দৌড়ে তার কাছে যেতেই ছোটন চট করে তাকে নিজের শুর দিয়ে তাকে পিঠে তুলে নিলো। তারপর দুই বন্ধু বনের মধ্য দিয়ে কত যে পথ ঘুরলো, আর কত যে মনের কথা বললো তার ইয়ত্তা নেই। টোটোন বললো – বন্ধু আজ তোমার জন্য আমি কত অজানা গাছপালা , কত না নাম না জানা ফুল , পাখির দেখা পেলাম, মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল। আর ছোটন বললো – তোমাকে পেয়েওতো আমি খুব খুশি বন্ধু।  আমার দলের সবাইতো অনেক বড় , তাই এতদিন আমার  কোনো খেলার সঙ্গী ছিল না। আজ থেকে বেশ আমরা দুজন একসঙ্গে খেলা করে বেড়াবো। টোটোন বললো – ঠিক আছে বন্ধু , আজ আসি। কাল আবার ফেরার পথে দেখা হবে। ছোটন বললো কাল তোমাকে এক নতুন জায়গায় নিয়ে যাবো। এই বলে দুই বন্ধু দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরলো।

 বাড়ি গিয়ে টোটোন আজ খুব লক্ষী ছেলে। মা তো অবাক।  মাঠ থেকে ফিরে এসে বাবাও খুব খুশি, ছেলেকে না বকতেই পড়তে  বসে যেতে দেখে। যেহেতু বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে তাই টোটোন যাতে কেউ না বকতে পারে , তার জন্য হাত-মুখ ধুয়ে , একটু মুড়ি খেয়েই পড়তে বসে গেছিলো। পরদিন আবার ইস্কুল থেকে ফেরার পথে ছোটনের সঙ্গে দেখা। টোটোন বললো – চলো বন্ধু , আজ আমাকে নতুন কোনো জায়গায় নিয়ে চলো। ছোটন বললো – যাবো বন্ধু, আগে আমার পিঠে চড়ে বস।  টোটোন ছোটনের পিঠে চড়ে বসতেই ছোটন বনের গাছপালার মধ্যে দিয়ে দুলকি চালে হেলতে দুলতে এগিয়ে চললো। যেতে যেতে তারা এক ঝর্ণার সামনে উপস্থিত হলো।  সে যে কি সুন্দর জায়গা , বনের মধ্য দিয়ে ছোট্ট ঝর্ণা নিজের পথ কেটে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে। তার চারধারে কতো না রঙিন ফুল আর প্রজাপতি।ছোটনের পিঠ থেকে টোটোন এক লাফ দিয়ে নেমে ঝর্ণার দিকে ছুটে লাগাল। চারিদিকে এতো ফুল প্রজাপতি দেখে টোটোন তো আনন্দে আত্মহারা।  দুই বন্ধু মিলে সেই ঝর্ণার ধারে ছোটাছুটি করে খেলতে লাগলো। টোটোন ছোটনকে বললো – বন্ধু তুমি যেন আজ আমাকে সেই রূপকথার দেশে নিয়ে এলে, এতো সুন্দর জায়গা আমি কখনো দেখিনি। ছোটনও তার বন্ধুর আনন্দে খুবই খুশি হলো। সেই দিন বাড়ি ফিরতে টোটনের সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। খুব বকুনি খেলেও টোটোন মুখ ফুটে ছোটনের কথা বাড়িতে কিছু বললো না। কারণ যদি তার মা-বাবা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে না দেন। হাতির সাথে বন্ধুত্ব তো কেউ বিশ্বাস করবে না , বরং সবাই ভয় পাবে। তাই এরপর থেকে দুই বন্ধু ঠিক করলো যে টোটোন ইস্কুলে যাবার সময় একটু আগে বেরোবে , আর ছোটনের সাথে খেলে নিয়ে তারপর ইস্কুলে যাবে।  তাহলেই আর কেউ কিছু বুঝতে পারবে না।সেই কারণে টোটোন  বাড়িতে বলে দিলো যে সামনে পরীক্ষা তাই ইস্কুলের মাস্টারমশাই তাদের একটু আগে যেতে বলছেন, একটু বেশিক্ষন পড়াবেন বলে।  যদিও সে ইস্কুল থেকে শিখেছে ‘মিথ্যা বলা অপরাধ’, তবুও তাদের বন্ধুত্বের জন্য এইটুকু মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হবে।  এইজন্য সে মনে মনে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো।

এইভাবেই দিন কাটতে লাগলো দুই বন্ধুর, হেসে খেলে মনেরআনন্দে।ছোটন কিন্তু টোটোনকে ইস্কুলের সময়ের আগেই ছেড়ে দিতো, আর বলতো – বন্ধু ভালো করে পড়াশুনো করো,তোমায় অনেক বোরো হতে হবে, মা-বাবার দুঃখ দূর করতে হবে। টোটোনও তার বন্ধুর কথা রাখতে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশুনো করতো। সে ইস্কুলে যা যা শিখতো , সেগুলো পরের দিন ছোটনকে শোনাতো।

এইভাবে অনেকগুলো দিন কেটে গেলো।  এসে গেলো ধান কাটার মরসুম। এইসময় যেন হাতি আর মানুষের মধ্যে যেন একটা শত্রুতা তৈরী হয়। টোটোনদের গ্রামের মানুষ হাতিকে ভয়মিশ্রিত ভক্তি ভরে বলে  ‘বড়ো বাবা’। এই বড়ো বাবার দল তখন পাকা ধানের লোভে গ্রামে দল বেঁধে হানা দেয়।  কি বিরাট দাঁতাল হাতির দল।  গ্রামের মানুষ তখন  ধানক্ষেতের মধ্যে বিশাল উঁচু সব মাচা বানিয়ে সারারাত জেগে ধান পাহারা দেয়। হাতির দল দেখতে পেলেই পটকা ফাটিয়ে এবং কানেস্তারা বাজিয়ে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সম্বৎসরের ফসল বাঁচাতে গ্রামের মানুষ তখন মরিয়া হয়ে ওঠে।

এত সতর্কতা সত্ত্বেও একরাতে বিস্তৃত ধানের জমির বেশিরভাগ ধান খেয়ে গেলো দাঁতালের দল।  রাতপাহারা কোনো কাজে এলো না। পরের দিন সূর্য উঠলো একটা মনখারাপ মাখা সকালে। প্রভাত আলোকোজ্জ্বল হলেও , মানুষের মন কুয়াশা আবৃত। গ্রামের কোনো বাড়িতে সেদিন হাঁড়ি চড়লো না। সারাবছরের অন্ন লুঠ হয়ে গেলো।এতো কিছুর মধ্যেও টোটোন বনের দিকে পা বাড়ালো। টোটনের দেরি দেখে ছোটন অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাকে দূর থেকে আসতে দেখে ছোটন ছুতে গেলো – ‘কি গো এতো দেরি করলে কেন ? আমি তো ভাবলাম তুমি বুঝি আজ আর এলেই না ‘।  টোটোন বললো – কি করবো বলো  বন্ধু , আজ যে আগে বেরোতে পারিনি। আমরা যারা ইস্কুলে যাই তারা সব একসাথে বেরোলাম।  আমি কোনোরকমে লুকিয়ে বনের পথ ধরেছি। আসলে আজ আমার খুব মন খারাপ। আজ গ্রামের কারো বাড়িতে আজ হাঁড়ি চড়বে ন। তাই সব বাচ্চারা ইস্কুলে গেল, কারণ ইস্কুলে গেলে খেতে পাবে বলে।  ছোটন বললো – কেন কেন ? টোটোন বললো – তুমি কি কিছুই জানোনা বন্ধু।  কাল রাতেরবেলা তোমাদের দলবল মিলে আমাদের ক্ষেতের ধান নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তাই সবার খুব মন খারাপ। সারাবছর আমাদের কিভাবে চলবে কে জানে ?কত লোক যে না খেতে পেয়ে মরে যাবে। ছোটন বললো – তাইতো কালকে সবাইকে খুশি খুশি দেখছিলাম।  আমি তো নিজের মনে থাকি , তাই দাঁতালরা কোথায় যায় জানি না।  তবে সবাই বলাবলি করছিলো যে বহুদিন বাদে তারা পেট পুরে খেতে পেলো। টোটোন বললো – কেন বন্ধু তোমরা তো জঙ্গলের গাছপালা খেতে পারো , আমাদের সারাবছরের খাবারে কি হাত না দিলেই নয় ? ছোটন খুব দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললো – বন্ধু, এখন আর সেই আগের জঙ্গল নেই গো ,যা আমাদের সবার পেট ভরাতে পারে। তোমরাও যে আমাদের জঙ্গলে হানা দিচ্ছো ; গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছো বিক্রি করতে। টোটোন সব শুনে চিন্তিত হয়ে বললো – তাইতো, এই কথাটা তো ভেবে দেখিনি , জঙ্গল তো তোমাদের বসবাসের এবং খাবারের জায়গা।  তাতে যদি আমরা হাত দেই, তাহলে তোমাদের চলবে কি করে? ও সেই জন্যই তোমরা বেশি বেশি করে আমাদের জমিতে হানা দাও, আগে নাকি এতো দাঁতালের হানা ছিল না, আমাদের গ্রামের বড়োরা বলে। মোড়ল বুড়ো আরো বলে ‘লোভ, লোভ লোভই আমাদের সব শেষ করে দিচ্ছে ‘। এখন বুঝতে পারছি , মানুষ বন-জঙ্গল কেটে ফেলছে বলেই তোমরা বাসস্থান আর খাবারের খোঁজে আমাদের গ্রামের দিকে চলে আসছো।দুই বন্ধু তখন চিন্তিত হয়ে ভাবতে বসলো , কি করা যায়? দু দলেরই বাঁচার লড়াই , অস্তিত্বের সংকট, জীবনের যুদ্ধ। জানি না দুই বন্ধু আলোচনা করে কোনো সমাধানের পথ খুঁজে পেলো কি না ?ছোট্ট বন্ধুরা এসো না , আমরা সবাই মিলে এই বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবি।  তোমরাই তো পারো , এই পৃথিবীকে আবার মানুষ-প্রাণী -উদ্ভিদ সকলের বাসযোগ্য করে তুলতে , যাতে সবাই মিলে আমরা সুন্দর ভাবে বাঁচতে পারি।  ‘বন্ধুরা বাড়িয়ে দাও হাত ‘। আগামী দিনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার ভার তোমাদের আর টোটোন -ছোটনদের হাতে তুলে দিয়ে শেষ করলাম আমার এই গল্প।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত