| 29 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

বর্ডার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comদেওয়াল ঘড়ির কাঁটা টিক টিক। এই টিক টিকের কোনো গন্ধ নেই। আছে শব্দ। নিস্তব্ধ রাত্রে সেই শব্দ বড় বেশি কানে বাজে, টিকটিকির বিনম্র ডাকের মতন ঠিক ঠিক ঠিক। ভাবছিলাম ঘড়ি যদি না থাকতো তাহলে সময়কে আমরা কি ভাবে জানতাম ও চিনতাম। আসলে সময় আমদের কাছে শুধু চিহ্ন মাত্র। কতকগুলি সংখ্যার দ্বারা চিহ্নিত। রোদের ওঠা নামা,সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়, দিন ও রাত্রিকে চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় সরণি বেশ তো ছিল। সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ঘড়ির গঠন ও আকারের বিবর্তন এতটাই পারিবারিক যে অন্যরকম ঘড়ি চোখে পড়লেই কিনতে ইচ্ছে করে বা কাউকে উপহার দিতে ইচ্ছে করে। 

আমি এখন ঘড়ি সচরাচর ব্যবহার করি না।  

আমরা শহুরে মানুষ নিজেরাই কৃত্তিম অনুশাসনের জালে এতটাই আবদ্ধ যে নিয়মমাফিক কাজগুলি না করলে সারাদিনের গতির সাথে পিছিয়ে যেতে হয়। যেমন অফিসে যাওয়ার সময় বাসের ভিড় দেখেই বুঝতে পারি এখন ঠিক কটা বাজে? রেল স্টেশনের মানুষের ব্যস্ততা মালুম করিয়ে দেয় নিশ্চিত ঘড়ির কাটার থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছি। সময় দেখার জন্য খুব একটা যন্ত্রের সাহায্যও নিই না। 

সারাদিনের কাজ সময় ধরে করলেই ঘড়ির প্রয়োজন পড়ে না। আশেপাশের পরিবেশ ব্যস্ততা যানবাহনের গতিপ্রকৃতি আমাদের সময়ের একটা ধারণা দিয়ে দেয়। আমরা মানুষকে ঘড়ি উপহার দিতে পারি। কিন্তু কখনই সময় উপহার দিতে পারি না। অনেকেই বলেন সময় খুব মূল্যবান। 

আমার কাছে কথাটি খুব বোকা বোকা লাগে।  

সারাদিনের কাজের শেষে রাত্রে যখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি, তখন দেওয়ালে ঘড়ির কাঁটা টিক টিক। ওই টিক টিক শব্দ শুনতে শুনতে চোখে ঘুম আর আসে না। তখন মনে হয় এই বুঝি ভোর হয়ে এল। বিছানায় শুয়ে থেকে রাত জাগা মানুষের যেমন স্নায়ুর চাপ হয় তেমনিই আর কি। যতই ঘড়িকে এড়িয়ে চলতে চাই ঘড়ি ততই সাংসারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে জড়িয়ে যায়। এমনকি বিশ্রাম ও অবসরের জীবনেও নির্লজ্জ ভাবে ঘড়ি টোকা দিয়ে যায়।  

ছুটির দিনগুলোতে বেশ থাকি। সেদিন মনে হয় আমি বেশ স্বাধীন। কোনো তাড়াহুড়ো নেই নিজের খেয়ালে নিজে থাকি, হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে, খবরের কাগজ বুকে ফেলে অলস ঘুমের পাড় ভাঙ্গি।  দিন দিনের মতন যাক না আজ তো ছুটির দিন, আজ রবিবার।  

আজ রবিবার। ছুটির দিন। মোবাইলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের রিং টোন… সময় যখন থমকে দাঁড়ালো…। মনে পরে গেল বহু বছর আগে আমাদের বংশের আদিকালের একটি  তোরঙ্গের জিনিসগুলো ঘাটতে ঘাটেতে বিবশ হয়ে গেছিলাম। অনেক জিনিস হাতে উঠে এসেছিল।  যেমন মায়ের সুপারি কাটার জাতি। উলের কাঁটা। পিতলের পানের ডিবে। মায়ের শীতের চাদর। চশমা। তৃষ্ণা মেটানোর জলের পিতলের পালি। আর মায়ের হাতে বোনা বাবার উলের দস্তানা। সাথে কিছু পুরানো হলুদ পোস্টকার্ড। আর ওপার বাঙলার নানান টুকিটাকির মধ্যে একটি সবুজ ডায়ালের সিটিজেন হাত ঘড়ি।

অবাক হয়ে গেছিলাম হাত ঘড়িটি দেখে। উফফফ কোথায় ছিল এতদিন! তক্তপোষের  নিচে ভুলে যাওয়া তালাবন্দী তোরঙ্গটি আজ আবার নিয়ে গেল সেই নির্জন দুপুরে যখন মা আমাকে হাত ঘড়িটি দিতে দিতে চোখে জল এনে বলেছিলেন, রাজাকার শয়তানগুলো নাদন ভাইকে মেরে ফেলল কি না কে জানে। মনটা বড়ই অস্থির করছে রে। এই ঘড়িটা তুই নে। কলেজে ভর্তি হয়েছিস। এখন তোর ঘড়ি লাগবে। 

মুক্তি যুদ্ধ। একটা দেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। আর আমার মায়ের বাংলাদেশ থেকে আনা সিটিজেন ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে ঘুরছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম। মা হঠাৎ করে বলেছিলেন -ঘড়িটা যত্ন করে রেখে দিস রে। একদিন ঘড়িটা তোর জন্য অনেক স্মৃতি বহন করবে। কে জানে কি ভাবে ঘড়িটা তোরঙ্গের ভিতরে আশ্রয় পেয়েছিল। আজ আর মনে নেই। 

এই সব কিছু দেখে, তোরঙ্গটিকে পুনারায় তালা দিয়ে একটি ফেলে আসা স্মৃতিকে বন্দী করে দিলাম। তারপরে তক্তপোষের নিচে তোরঙ্গটিকে এক কোণে ঠেলে দিলাম।   

অনেক রাত হয়ে এল। হয়ত তোরঙ্গের ভিতরে  টিক টিক করে হয় তো ঘড়ির কাটা ঘুরেই যাচ্ছে। বহুদূরের স্বাতী নক্ষত্রের আলো জ্বলা টিপ টিপের মতন তোরঙ্গের ভিতরে ঘড়িটি জেগে আছে একটি মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসের মতন। 

শহরতলীর রাত, ছুটির রাত ফুরিয়ে আসার জন্য যেমন মনের গহীনে চিন চিনে ব্যাথা, অবসর এক যেন বরফে ঢাকা পাহাড়। দূরে বহুদূরে বরফচিল ডানা মেলে গাইছে দূর বহুদূর, বরফ ভেঙ্গে যাওয়ার আনন্দে জাহাজের মাস্তুলে, মহাদেশের অনুভব উড়ছে, উড়ছে রাষ্ট্রীয় ধ্বজা, সীমান্ত সৈনিকরা গাইছে বাদ্যি হাতে জলের ওপরে বাজনা বাজায় এমন এক বালিকার গান। পাহাড়গুলি বরফ ছাড়ছে, পাহাড়ের নিচে মেষপালক ভেড়ার দল নিয়ে খুঁজে যাচ্ছে, কিছু খাসা সবুজ লতাগুল্ম। মেষপালকের ঘরের ওপরে ধুয়ো লতিয়ে যাচ্ছে। কাঠকুটো পুড়ছে। বরফের নিচে জমে থাকা হাজার বছরের পুরানো মৃত তুষার হরিণের মাংস রান্না হবে আজ। বহুদূরে দেখা যাচ্ছে, এক পাল লোমশ হরিণ পাহাড় বদল করে ফিরে যাচ্ছে, বরফঘুমের অবকাশের জন্য।  

না। এ আমার দেশের কল্পনা নয়। আমার দেশের বসবাসের ভূমি মোটেই এমন নয়। বৃষ্টি অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি ক্ষেত খলিয়ান, ঘন জনপদ পৌরসভার ইট পাতা রাস্তায় ঘেরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনপদের বসবাস। এক ছাপোষা লোকালয়ের সাধারণ বাসিন্দা বরফের উপত্যকার কল্পনা করছি। মাঝে মাঝে জিভ বার করে বরফের ভেড়ার দুধের স্বাদ নিচ্ছি। এ কেমনতর ভাবনা আমার? যদি কাউকে বলি, বলবে খালি গায়ে ছুটির দিনের গড়িয়ে আসা রাতে, আর প্যাচপ্যাচে গরমে বরফের দেশের কথা একমাত্র পাগল ছাড়া কেই বা ভাবতে পারে। আমি নিজের ইচ্ছে মতো, পরের পর পছন্দমতো ঋতুগুলিকে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম।

এতক্ষণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে আমার এতসময় দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। ঘরের ভিতরে এক একটা দিক যেমন অনভ্যস্ত থাকে, আমি ঝুঁকে পড়লাম তক্তপোষের নিচে, দেখলাম মায়ের লোহার তোরঙ্গটি অন্ধকারের দলা হয়ে দেশ বিভাগের যন্ত্রণা নিয়ে, গুমরোচ্ছে। তোরঙ্গের পাশে আরও একটি কাঠের বাক্স, পুজোর ঘরের বাসনপত্র পিতলের বড় পিলসুজ, গৃহস্ত বাগান করার টুকিটাকি, রান্নার লোহার বড় কড়াই। আমি তক্তপোষের নিচে যতটা পারলাম, উবু হয়ে গেলাম, সামনে থাকা জিনিসগুলিকে সরিয়ে তোরঙ্গটিকে টেনে আনলাম। জংপড়া তালা। কিন্তু এই তালার চাবি কোথায় আছে তা তো আমি জানি না। মনে থাকার কথাও নয়। বহু বছর আগে তালা দিয়ে সেই  যে তক্তপোষের নিচে রেখে দিয়েছিলাম। 

চাবিগুলি হয় তো এমনই, হারিয়ে যায়। খুঁজে পেতে স্মরণে থাকে না। আমি জানি, অতীতের কোনো স্মরণকে ফিরিয়ে আনা কতটা ঝক্কির আর কষ্টের। তবুও এদিক সেদিক টেবিলের ড্রয়ার নানান সরঞ্জামের কাঠের বাক্স, ঠাকুরের আসনতলে, নিজের একটি শতপুরানো থলিয়া, সব কিছু আতিপাতি খুঁজে যখন হাফিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম তখন হারানো চাবি খুঁজে না পাওয়া এক পরাজিত। 

তোরঙ্গটি খুলব, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। 

কিন্তু আমি তোরঙ্গটি খুলব কেন?

আমি কি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি? 

স্মৃতিকাতরতা এই দিন ফুরিয়ে আসা রাতে বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। 

এই বিলাসিতার কি অর্থ আছে? 

থাক না যা আছে, যেরকম আমার পারিবারিক স্মৃতি। 

এই তোরঙ্গের ভিতরে জমে আছে অনেক ক্ষত, অনেক ক্ষতের অবশেষে এক পারবারিক বিকেল। যে বিকেলের মধ্যে প্রবাহিত অনেক নদী খাল বিল দিঘি জলাশয়, ল্যাম্পপোস্ট, লন্ঠনের আলো, গুমরে ওঠা সোনালি আমের আঁটি, রেশমের গুঁটি, রঙ্গিন শামুক ঝিনুক আর আর…  

যে ভাবে মনে মনে মন প্রস্তুত হয়, সেই ভাবেই, নিজেকে প্রস্তুত করে অনেক খুঁজে পেতে একটি হাতুড়ি সন্ধান করে পেলাম। অনেক ফাঙ্গাস আর্দ্র জড়ানো হাতুড়িকে পরিচ্ছন্ন করে, বিস্তীর্ণ সময়কে আঘাত করলাম, পরের পর কয়েক ঘা, তারপরে সময়গুলি চৌচির হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, তোরঙ্গের ঢাকনা খুলে দেখলাম, তোরঙ্গের ভিতরে মেঘ ভেসে যাচ্ছে, বর্ষা বিদায়ের মাটি কাদা শুকিয়ে আসছে, একদল মানুষ মাথায় বোঝা ও তোরঙ্গ নিয়ে দেশ পার হয়ে যাচ্ছে, গ্রীস থেকে ইতালি, আলজিরিয়া থেকে সুদান, ইছামতি পার হয়ে এপারে এক বঙ্গ দেশ থেকে ওপারের বঙ্গে…।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত