সাক্ষাৎকার: অনুভূতিই আমার কাছে সৃজনশীলতার মূল উৎস- সোমা দত্ত
সোমা দত্ত একটি পরিচিত নাম। জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। প্রাথমিকভাবে নৃতত্ত্ববিদ্যা ও পরবর্তীকালে গ্রাফিক্স ও ওয়েবসাইট ডিজাইন বিষয়ে পড়াশোনার পর বিভিন্ন প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার পাশাপাশি, লেখালেখি করছেন বহুবছর ধরে। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও অন্যান্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘শূন্য থেকে ক্রমশ’, ‘চেতনে অবচেতনে’, ‘দেবদারু গাছের সন্তান’ এবং ‘নীলাভ সবুজ শৈবাল’। বর্তমানে সায়ন্তন কনসালটেন্টস অ্যান্ড পাবলিকেশন এর পাবলিকেশন ডিভিশনের ইনচার্জ এর দায়িত্বে কর্মরত। ‘কলমে কারুকৃতি’ নামের একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক। কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক সোমা দত্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন শৌনক দত্ত।
শৌনক দত্ত: আমি কি তুমি করে সম্বোধন করতে পারি?
অবশ্যই।
শৌনক দত্ত: কেমন আছো? একজন নারীর সাহিত্যচর্চা করতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং?
সোমা দত্ত: ভালো আছি। ধন্যবাদ শৌনক। তুমি নারীর সাহিত্যচর্চা করার চ্যালেঞ্জ বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করেছ। দেখো এই চ্যালেঞ্জ চিরকাল ছিল। আগে বরং আরও বেশি ছিল। এখনো আছে। তবে কম। চ্যালেঞ্জ জিততে হয় কীভাবে সে তো মেয়েরা বহুদিন আগেই দেখিয়ে দিয়েছে। রাসসুন্দরী দেবীর কথাই ধরো না। সেই যুগে এরকম সাহস দেখানো সহজ তো ছিল না। শুধু আমাদের এই দেশেই নয় বিদেশী লেখকদের ক্ষেত্রেও একইরকম।
শৌনক দত্ত: তুমি তোমার প্রায় সমস্ত লেখায় নিজেকেই ধরতে চেয়েছ— তুমি তোমার নিজেকেই সন্ধান করো, সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করো, এবং আমাদেরকেও তুমি তোমার লেখায় ধরতে পারো। তোমার লেখার এ–দিকটি আমার সবচে পছন্দের। আজ আমি এখানে তোমার সমগ্র লেখকজীবনকে আরও বেশি করে ধরতে চাই, অনুসন্ধান চালাতে চাই, এরকম একটি প্রশ্নের মাধ্যমে আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই– তোমার যখন পনের বছর বয়স, সেই সেই সময়ে তোমার প্রিয় বই কোনটি ছিল এবং কেন?
সোমা দত্ত: প্রথম কথা শৌনক পনেরো বছর বয়সে খুব বেশি বই পড়ার সুযোগ ছিল না। বইপত্র কিনব এমন টাকা পয়সা ছিল না। মা লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ত। লুকিয়ে রাখত সেগুলো, বলতো বড়দের বই। আমি ওগুলোই চুরি করে পড়তাম। এভাবেই ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, কোয়েলের কাছে পড়েছিলাম। কিন্তু প্রিয় বই ছিল ‘পথের পাঁচালি’। ওই বইটা আমার ছিল। ওটাই বারবার পড়তাম। কেন প্রিয় ছিল সেটা বলা মুশকিল। শহুরে জীবনে বড় হওয়া মন নিশ্চিন্দিপুরের দুর্গাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আর অপুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিল সম্ভবত। তবে আমি ‘গর্ভধারিনী’ পড়েও খুব মুগ্ধ হয়েছিল। বিপ্লব এবং বিদ্রোহ বিষয়টা ওখান থেকেই জোরালো হয়ে উঠেছিল মনে।
শৌনক দত্ত: লেখালেখির ব্যাপারে জানতে চাই। শুরুটা কিভাবে হলো? কেমন করে লেখক হয়ে ওঠা?
সোমা দত্ত: ক্লাস টু তে পড়ি যখন আজকাল পত্রিকার ছোটদের পাতায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে ভিতর থেকে কোনোদিন যায়নি বিষয়টা। লিখতাম শুধু নিজের জন্য। লেখক হয়ে উঠব ব্যাপারটা আমার মধ্যে কিন্তু অনেক পরে এসেছে। আমি পাঠক হতে চেয়েছিলাম। লেখক হয়ে গেছি কোনোভাবে। তবে এখনো পাঠক হওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিই।
শৌনক দত্ত: সোমা দত্ত কবি, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক, ভালো মা ও সর্বোপরি ভাল মানুষ তুমি নিজেকে কোন চরিত্রে দেখতে ভালবাসো এবং কেন?
সোমা দত্ত: সবার আগে মানুষ হতে চেয়েছি। কারণ এটাই সবথেকে কঠিন কাজ। ভালো কী মন্দ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তত মানুষ অর্থাৎ মানবিক গুণসম্পন্ন। মানুষ না হলে ভালো মা হওয়া যায় না। তাই ও দুটো সমার্থক। তারপরে অবশ্যই সাহিত্যিকের চরিত্রে দেখতে পছন্দ করি নিজেকে। আমি সবসময় বলি, আমি সবার আগে একজন লেখক যে মানুষ হতে চেয়েছিল। ভালো মানুষ কথাটাকে আমি এড়িয়েই চলব। প্রথাগতভাবে ভালো মানুষ কাকে বলে সেটা বড় অস্পষ্ট। আসলে সবগুলোই চাই আর কী! কিছুই ছাড়তে পারলাম না।
শৌনক দত্ত: সেই চরিত্র হিসেবে তোমার জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে একটু জানতে চাই?
সোমা দত্ত: মানুষ হয়ে বাঁচা আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং কারণ বর্তমানে একজন মানুষ, ভালো লেখকের জীবন বাঁচার সুযোগ পায় না। সমান্তরালভাবে দুটোকে পাওয়া খুবই অসুবিধার। আর ভালো মানুষ বলতে কী বোঝায় সেটাও এখন পরিষ্কার নয় আগেও বললাম। একজনের কাছে যে ভালো অন্যজনের কাছে ভালো নাও হতে পারে। আর মানুষ পুরোপুরি ভালো কী করেই বা হবে। সে দ্বৈতগুণের সমাহার। ভালো এবং খারাপ। এই দুটো নিয়েই মানুষ।
শৌনক দত্ত: কেমন করে জানলে তুমি কবিতা লিখতে চাও তোমাকে কবিতা লিখতেই হবে।
সোমা দত্ত: সব বাঙালি একটা বয়সে কবিতা লেখে। আমিও সেরকম লিখতাম। আবৃত্তি করতাম একটা সময়ে। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথ মর্মে প্রবেশ করলেন তারপর জীবনানন্দ। কিন্তু লেখার টান অনুভব করলাম ক্লাস ইলেভেন থেকে জয় গোস্বামীর কবিতা পড়ে। তখন বুঝলাম এই সময়ের, এই মুহূর্তের যা কিছু সত্য তাই কবিতা। ওই তখনই জানলাম কবিতায় আত্মার মুক্তি হয়।
শৌনক দত্ত: মানুষ, না নিসর্গ – তোমার ব্যাক্তি এবং কবিজীবন কোথায় সবচেয়ে স্বত্ত্বিকর বলে তুমি মনে কর ?
সোমা দত্ত: অবশ্যই মানুষ। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে। মানুষের জীবনযাত্রার chaos আমার কবিজীবনের জন্য স্বস্তিকর। নিসর্গ উপভোগ করি, শান্তি পাই। সে আমাকে স্থিতি দেয়। কিন্তু মানুষের জীবনের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন চলন আমাকে অস্থিরতা দেয়। সেখান থেকেই কবিতা আসে। শব্দের পরে শব্দ জন্ম নেয়।
শৌনক দত্ত: তোমার কাছে কবিতা কীভাবে আসে—ধ্বনি চিত্র কথা চিন্তা অনুভূতি হিসেবে অথবা এদের কোনো সমবায়ে? প্রাথমিক তাগিদ থেকে কবিতার পূর্ণরূপে তুমি কেমন করে পৌঁছাও?
সোমা দত্ত: অনুভূতিই আমার কাছে সৃজনশীলতার মূল উৎস। সেই অনভূতি ধ্বনি, চিত্র কথা, চিন্তার যেকোনো মাধ্যম হতে পারে। আর প্রাথমিক তাগিদ থেকে কবিতার পূর্ণ রূপে পৌঁছনোর জন্য আলাদা করে কখনো চেষ্টা করতে হয়নি বা করিনি। আমার মনে হয় কবিতা ভীষণ প্রাকৃতিক একটি গঠন। তাহলে কী এডিটিং এবং ব্যাকরণ, ব্যুৎপত্তি এসব অর্থহীন? নিশ্চয়ই নয়। এসবের প্রয়োজন রয়েছে কবিতায়। কিন্তু আমি এখনো ততখানি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি এইসব চর্চার জন্য। সেক্ষেত্রে আমার কবিতা পূর্ণরূপে পৌঁছতে পেরেছে কিনা কখনো আমি সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই।
শৌনক দত্ত: কবিতা লেখার জন্য পারিপার্শ্বিকতাকে কতখানি স্বীকার এবং কতখানি অস্বীকার করতে হয়েছে তোমাকে?
সোমা দত্ত: পারিপার্শ্বিকতাকে অস্বীকারও তো করেছি কবিতা লিখতে গিয়ে। পারিপার্শ্বিক সংস্কার, কুণ্ঠা, দ্বিধা সবকিছুকে অস্বীকার করেই আমি লিখি। আর স্বীকার যা করেছি তা পারিপার্শ্বিকতার সত্য। জীবনের যেকোনো সত্যকে স্বীকার করে নিতে আমি দ্বিধা করিনা কখনো। এই বিষয়টা পারিপার্শ্বিকতার স্বপক্ষে যতটা যায় তার থেকে ঢের বেশি বিপক্ষে যায়। কারণ তোমার সমস্ত সত্যের সঙ্গে তুমি একা নও সমাজ সংসার জড়িয়ে থাকে।
শৌনক দত্ত: ব্যাক্তিজীবন থেকে তোমার কবিজীবন ঠিক কতটা এবং কীভাবে আলাদা করবে তুমি ?
সোমা দত্ত: লেখার সময় কোনোভাবেই আলাদা করতে চাইনি কখনো দুটো জীবন। যদি চাইতাম তাহলেও মিশে যেত। ব্যক্তি আর কবিকে আলাদা করে দেখার পক্ষপাতী আমি নই।
শৌনক দত্ত: আগে মানুষের কাছে কবিতা সহজে পৌঁছাত না। এখন কবিতা খুব সহজে বহুজনের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তার পরও মানুষ পড়ছে না। কীভাবে দেখ এই বিষয়টা?
সোমা দত্ত: সহজে পৌঁছে যাচ্ছে বলেই তো মানুষ পড়ছে না। ফেসবুকেই তো সবাই কবিতা পড়ে নেয় আলাদা করে বই কিনে পড়বে কেন? তাই জানাটা অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে , বোঝাটা অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে। মানুষ একটা দুটো কবিতা পড়ে কবিকে জাজ করে নিচ্ছে। তাছাড়া পড়বে কে? সবাই তো কবিতা লিখছে। জ্ঞান আর অজ্ঞানের মধ্যে যে দূরত্ব সেখানে যখন ইউ টিউব, রিল, শর্টস জায়গা করে নিচ্ছে তখন আর এর থেকে বেশি কী আশা করতে পারো তুমি?
শৌনক দত্ত: উত্তর আধুনিকতা ও পোস্টমডার্নিটি, পোস্ট কলোনিয়াল এবং সাবঅল্টার্ন লিটারেচার ইত্যাদি সম্পর্কে তোমার মতামত বা অভিজ্ঞতা কি রকম ?
সোমা দত্ত: উত্তর আধুনিকতা এবং পোস্ট পোস্টমডার্নিটি এই দুটো বিষয় আমার কাছে মোটামুটি একই রকম। কিন্তু এর সময়সীমা সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। কারণ আধুনিকতা বা উত্তর আধুনিকতা বিষয়টা দৃষ্টিভঙ্গিমার উপর নির্ভর করে। বলা হয় যে প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু আগে থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল এবং তারও আগে ইওরোপে। উত্তর আধুনিকতার সূচনা হয়েছে সত্তরের দশকে এবং আধুনিকতার মতো এরও আবির্ভাব হয়েছে ইউরোপে। মূলত প্রথাগত সাহিত্যরীতির যে বদল এই দুই ক্ষেত্রে দেখা যায় আমি তার সুবিধা ভোগ করি, ব্যাখা খুঁজি না। ব্যাখা খুঁজবেন যারা এই নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমি এই সময় নির্ভর সাহিত্য থেকে সুবিধা নিই, আনন্দ নিই, উপভোগ করি। তার বেশি বুঝতে চেষ্টা করিনি। তবে হ্যাঁ পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচার থেকে একটা দর্শনবোধ তৈরি হয়। যেমন আমার মনে হয়েছে ওই সময়কার সাহিত্য থেকে একটা মারক্সীয় দর্শন পরিপুষ্টতা পায়। বিভিন্ন জাতি এবং শ্রেনির সংগ্রাম লক্ষ্য করা যায় সাহিত্যে। মানুষ হিসেবে এই সময়কার সাহিত্যের একটা প্রভাব তো অস্বীকার করা যায় না। প্রায় একই কারণে সাবঅল্টার্ন লিটারেচার গুরুত্বপূর্ণ। এসব তো শুধুই নিছক সাহিত্য নয়, ইতিহাস। এটা না জানলে তো মানসিক বিকাশ হবে না। সামাজিক বোধ এবং সামজিক বিকাশে তোমার কোনো ধারণা তৈরি হবে না। সুতরাং এ সম্পর্কে পড়াশুনা খুবই দরকার বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের। দর্শনবোধটা তৈরি খুব দরকার একজন সৃজনশীল মানুষের। কাল সময় ভিত্তিক মানুষের এগিয়ে যাওয়া এবং পিছিয়ে থাকার ইতিহাসটা না জানলে সেটা তৈরি হয়না।
শৌনক দত্ত: তুমি বেশ পাঠক প্রিয় লেখক ও কবি রিডার রেসপন্স থিওরি নিয়ে তোমার মত কী?
সোমা দত্ত: রিডার রেসপন্স থিওরি বলে কিছু হয় কিনা আমি জানিনা। আমি মূলত রিডারের জায়গায় নিজেকে রাখি। মানুষ কী পড়তে চায়, কী ভালোবাসে এটা জানা খুব দরকার। মানুষের জন্য লিখতে হলে নিজেকে সাধারণ হতে হবে। সাধারণের অংশ হতে হবে। আমি লেখক এই মনোভাব নিয়ে থাকলে রিডারকে পাওয়া আরও কঠিন হবে। আরেকটা অন্য দিক হল, এই নিয়ে বিচলিত না হওয়া। রিডারের রেসপন্স জরুরি কিন্তু ওটাই তোমার চর্চার কেন্দ্রবিন্দু নয়।
শৌনক দত্ত: মৃত বা জীবিত কোন সাহিত্যিকের সাথে তুমি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে দেখা করতে চাইবে?
সোমা দত্ত: জীবিত সাহিত্যেকের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ সবসময় বেশি থাকবে। জীবনে বিশ্বাস রাখাই ভালো। মৃত্যুর পর শিল্পীকে নিয়ে মাতামাতি করার অভ্যাস যদিও খুব প্রচলিত এবং বলাও হয় অনেক সময় যে জীবিতকালীন অবস্থায় তোমার কাজ নির্ণীত না হলেও মৃত্যুর পরে হবে। এটাকে এক ধরনের প্রতারনা ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না।
শৌনক দত্ত: তোমার লেখায় খুব গভীর অনুভূতি নিয়ে নারীর মনস্তত্ব এবং সংবেদনশীলতা ফুটে ওঠে। বর্তমানে নারীর অধিকার নিয়ে অনেক প্রশ্ন আলাপ আলোচনা হচ্ছে। নারীর অধিকার নিয়ে লিখতে হলে কি ‘নারীবাদী’ হওয়া প্রয়োজন আছে?
সোমা দত্ত: নারীবাদী হওয়ার প্রয়োজন যেমন নেই তেমনই নারীবাদীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিমা রাখারও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন রয়েছে মানবিক থাকার। সেটুকু থাকতে পারলেই যথেষ্ট। আর নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তো নতুন নয়। ছিল আছে থাকবে। বায়োলজিক্যাল শক্তির দিক থেকে নারীরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল বলেই তার সমানাধিকারের প্রশ্নে এত শৃঙ্খল।
শৌনক দত্ত: গল্প লেখার ক্ষেত্রে বিষয়, কাঠামো, চরিত্র নির্মাণ, ভাষার বিশেষ গঠন (কন্সট্রাকশান) এবং প্রকাশভঙ্গি এসবের কোনটিকে তোমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? নিজস্ব কোনো নির্মাণকৌশল ব্যবহার কর কি?
সোমা দত্ত: গল্পের ক্ষেত্রে প্রথম জরুরি বিষয় হল চরিত্র তারপর হল ভাষার গঠন এবং প্রকাশভঙ্গি তারপর অন্যান্য দিক। প্রকাশভঙ্গিমায় মৌলিক ধরন না থাকলে এবং চরিত্রকে সেই ভঙ্গিমার সাহায্যে গড়ে তোলার দক্ষতা না থাকলে খুব ভালো প্লটও ভালো গল্প হয়ে ওঠে না।
শৌনক দত্ত: তোমার কবিতায় দৃশ্যমানতার যে অনুভূতি তা তোমার লেখায় খুব প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে। আমার জানতে ইচ্ছে করে কবিতায় এই আগ্রহ কোথা থেকে এলো?
সোমা দত্ত: কিছুটা অভিজ্ঞতা আর কিছুটা পাঠরীতি। আমি ছোটবেলা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ পড়ে বড় হয়েছি। বিশেষ করে বিভূতিভূষণের লেখার এই দৃশ্যমানতার অনুভূতি খুব গভীর।
শৌনক দত্ত: আমাদের এখন আর কোনো গল্প নাই, আড্ডা নাই। তবে কি এই প্রযুক্তি মানুষের কাছ থেকে শিল্প সাহিত্য নিংড়ে নেবে? নাকি প্রযুক্তিসম্পন্ন সমাজে এটাই স্বাভাবিক?
সোমা দত্ত: আমি প্রযুক্তির বিপক্ষে নই। কিন্তু প্রযুক্তিসর্বস্ব জীবনের স্বপক্ষেও নই। প্রযুক্তি জীবনের ছন্দকে যান্ত্রিক করে তুলছে তা আমার মনে হয় না। মানুষ প্রযুক্তিকে ভুলভাবে ব্যবহার করছে অনেকক্ষেত্রেই। আমাদের এখন আর কোনো গল্প নাই, আড্ডা নাই এই অনুভব থাকলে এগুলো ফিরিয়ে আনার অনুভবও থাকতে হবে। তবে কারণ যাই হোক না কেন জীবন যে যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে সে কথা সত্য।
আরো পড়ুন: সাক্ষাৎকার: কবি অমিত চক্রবর্তী
শৌনক দত্ত: সম্পাদক সোমা দত্ত কে কিভাবে মূল্যায়ণ করবে?
সোমা দত্ত: এটা তো পাঠক মূল্যায়ণ করবে। আমি নিজেকে শূন্য দেব সব অর্থেই। আমি শিক্ষানবিশ। শিখছি এবং আরও অনেক কিছু শিখতে চাই। আমি মনে করি না আমার যোগ্যতার মূল্যায়ণ করার সময় এসেছে।
শৌনক দত্ত: মরে যাওয়া, নদীর মতন বিমর্ষ তুমি, এই বিমর্ষতা কি সৃষ্টিশীলতার নাকি যাপনের?
সোমা দত্ত: এই যে পঙক্তির উল্লেখ করলে এখানে বিমর্ষতা সৌন্দর্যে উপনীত হয়েছে। সৃষ্টি প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ধ্বংস করে, ফের নতুন করে গড়েও তোলে। এই ক্ষয়, মৃত্যু, অপসারণ এবং নতুনের সংযুক্তি এখানে বিমর্ষতা তো থাকবেই। বিমর্ষতাই তো সুন্দর। কবি সেজন্যেই তো বলে গেছেন, ‘ জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো- তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পার তুমি’। আর যাপনও এর বাইরে নয়। বিমর্ষতা আমি ভালোবাসি বললেও ভুল বলা হবে না হয়তো।
শৌনক দত্ত: শিল্প নাকি পাঠক, তোমার দায়বদ্ধতা কার কাছে?
সোমা দত্ত: অবশ্যই শিল্পের কাছে। এর আগে একটা প্রশ্নে রিডার রেসপন্সের কথা জিজ্ঞেস করছিলে, তার সঙ্গে এই উত্তরের বৈপরীত্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু দায়বদ্ধতার কথা বললে আমি সবসময় শিল্পকেই প্রাধান্য দেব।
শৌনক দত্ত: তোমার কবিতায় কবিতার প্রকরণ, ছন্দ—মানে এগুলোর যে শাসন, আমার মনে হয়েছে তুমি সব সময় এগুলোকে ভাঙতে চেয়েছ আসলেই কি তাই?
সোমা দত্ত: হ্যাঁ, সচেতনভাবেই। আমি লেখার ক্ষেত্রে নিয়ম নিষেধ বা কোনো গণ্ডির মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখার পক্ষপাতী নই।
শৌনক দত্ত: মফস্বল শহরের সাহিত্যিক ও সাহিত্যের সাথে কলকাতার সাহিত্য ও সাহিত্যিকের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাও কি?
সোমা দত্ত: পাই। আজকের দিনে সে পার্থক্য হল গোষ্ঠীগত। মফসসলের লেখকরা নিজেদের একটি আলাদা বৃত্তের মধ্যে রাখতে চান আবার কলকাতার কবিদের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রবণতা দেখেছি। তবে মফসসলের লেখকদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে প্রাণ অনেক বেশি। অনেকেই আছেন যারা প্রচারের আলো নিভিয়ে নিভৃত চর্চায় নিমগ্ন।
শৌনক দত্ত: তুমি কি মনে কর কবিতা লেখায় তোমার পরিতৃপ্তি বেশী না গদ্যে?
সোমা দত্ত: দুটোতেই। পরিতৃপ্তি দুটো লেখাতেই আসে। কিন্তু কবিতা লেখা গদ্যের থেকে বেশি কঠিন বলে মনে করি। তাই গদ্য সহজেই যে পরিতৃপ্তি দেয়, কবিতা ততটা দেয় না। কবিতার জন্য বেশি পরিশ্রম এবং সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রয়োজন হয়।
শৌনক দত্ত: ধন্যবাদ তোমাকে, ভাল থেকো। শেষ একটা প্রশ্ন তোমার লেখায় নীরবতা ও বিরতি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ কেন?
সোমা দত্ত: নীরবতাই তো সর্বস্ব। নিজে নীরব না হলে অন্যকে শুনবে কী করে? বিরতির স্থান না থাকলে নতুন কিছু শুরু করবে কী করে? মানুষ এত কথা বলে, অর্ধেক অনুভব তার স্থূল হয়ে যায় অতিকথনে।

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।