প্রসঙ্গ: ‘সঞ্জয় উবাচ’
‘মহাভারত’-এর সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের খবরাখবর জানাচ্ছিলেন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে। এ-যুগের সঞ্জয় আমাদের কী সংবাদ জানাচ্ছেন দেখা যেতে পারে মুয়িন পারভেজের ‘সঞ্জয় উবাচ’ কবিতার পাঠে।
সঞ্জয় উবাচ
পাণ্ডবদের রথ গেছে থানচিতে, চিম্বুকে
ম্রো ভাষার এক পাণ্ডুলিপির মতো পাড়ায়
কুরুরাও গেছে লংগদু থেকে নানিয়ারচর
বড়ইতলির আঁকাবাঁকা পথে বনরূপায়
স্বয়ং শ্রীমতী কালিন্দী রাণী দিয়েছেন চিঠি
হাসিমুখে তাই পথ ছেড়ে দেয় সেপাই-দূত
বাচ্চা হাতির বৃংহিত হয়ে বেজে ওঠে দিন
করাতিরা বনে গান গেয়ে গেয়ে তাড়ায় ভূত
বাঁশকুড়ুলের মতো যেন মন দুর্যোধনের
লাউয়ের খোলে ঝরনার জল করেন পান
রাধামনু-ধনপুদির দুঃখে কাতর শকুনি
শোনেন একাকী চন্দ্রগ্রস্ত ঝিঁঝিঁর তান
কেউ-কেউ গেছে বরকল থেকেলেমুঝিরিপাড়া
বহুদূর থেকে হেঁটে হেঁটে নির্ভরতা আসে
তাঁবু ঘিরে ঘিরে কুয়াশাপরিরা নাচে রাতভর
রক্তশিশির ঝরে না সবুজ পাতায়, ঘাসে
বাণের বদলে বীণ নিয়েছেন কর্ণার্জুন
পাহাড়ে এখন নিবিড় শান্তি, মান্যবর
লোগাং, নাইক্ষ্যংছড়ি আর ভূষণছড়ায়
মহুয়ামাতাল হয়ে আছে সব ধনুর্ধর
ইয়াজুজ-মাজুজ জাতির অত্যাচার থেকে নিরীহ জনগণকে রক্ষা করতে পরাক্রমশালী ব্যক্তি জুলকারনাইন তুলে দিয়েছিলেন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম, ইয়াজুজ-মাজুজ না কি এখনও দেয়াল খুঁড়ে যাচ্ছে, কেয়ামতের আগে-আগে ওরা সেটা ঠিক ভেঙে ফেলবে। তারপর ইসা নবি, কানা দাজ্জাল, ইমাম মেহেদির আগমন অর্থাৎ ইতি-নেতি আর সত্য-মিথ্যার এই দ্বন্দ্বসংঘাত চলবে কেয়ামত পর্যন্ত। আরবি মিথ অনুযায়ী পৃথিবীধ্বংসের পূর্বমুহূর্তে কী-কী ঘটতে পারে কিংবা ঘটবে তার সাথে আমাদের বর্তমান অস্তিত্বের সংকটকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন কবি। কেবল সত্য কিংবা মিথ্যা, হ্যাঁ অথবা না-এর ঘেরাটোপে বন্দি থাকতে থাকতে আজ আমরাও আহ্বান জানাই জুলকারনাইনকে, আরেকটি প্রাচীর যেন গড়ে দেন তিনি। বিকল্পহীন এই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা, এই অচলায়তনে আমাদের যে-বিবেক প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে-বিবেক বরং ওই দেয়ালে অবরুদ্ধ থাকুক, ওখানেই বন্দি থেকে মাথা কুটে মরুক আমাদের ‘সমস্ত চৈতন্য, দ্বিধা’।
জুলকারনাইন
অচিরেই আসবেন হয়তো-বা ইমাম মেহেদি
কালো পতাকার নীচে দলে-দলে দাঁড়াবে লোকেরা
ধরণী উঠবে কেঁপে হ্রেষাধ্বনি আর অভ্রভেদী
চিৎকারে। রক্তস্রোতে ভেসে যাবে পথ ও প্রশ্নেরা
জেরুজালেমের পথে আসবে ইসার মহাকাল
তার আগে ইয়াজুজ-মাজুজ ছুটবে দিকে-দিকে
আর সেই হন্তারক, চোখকানা নিষ্ঠুর দাজ্জাল
মক্কা ও মদিনা ছাড়া খুঁড়ে নেবে পুরো পৃথিবীকে
এক হাতে অগ্নি তার, অন্য হাতে জলের এস্রাজ
সত্যমিথ্যা ছাড়া যেন নেই আর শস্য পৃথিবীর
এতই সরল যদি ক্রুশবিদ্ধ জীবনের মানে
এবং স্বপ্নও যদি কূটাভাসহীন, তবে আজ
হে জুলকারনাইন, গ’ড়ে দিন একটি প্রাচীর
সমস্ত চৈতন্য, দ্বিধা মাথা কুটে মরুক সেখানে
…………………………………….
বইয়ের নাম: ‘সঞ্জয় উবাচ’
কবি: মুয়িন পারভেজ
প্রকাশক: কবিতাভবন
প্রচ্ছদ: মইনুল আলম
মূল্য: ১০০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান: বাতিঘরের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিপণনকেন্দ্র ও রকমারি.কম।
জন্ম ২৯ জুন, ১৯৮১; সোনাগাজী, ফেনী, বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাহমুদুল হকের উপন্যাসের উপর এম.ফিল. এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প নিয়ে পিএইচ.ডি. করেছেন। বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ লালবেজি (গল্পগ্রন্থ; বাতিঘর, ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) জলভ্রমি (গল্প; চৈতন্য, ফেব্রুয়ারি ২০২২) সম্পাদিত গ্রন্থ শালবনের গান (কবিতা সংকলন; বাতিঘর, আগস্ট, ২০১৯) পুরস্কার : কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার ২০১৯। ই-মেইল : [email protected]