গোষ্ট ওন দ্যা ওয়ে
প্রতিদিন বিকেল হলেই বাড়ি ফিরে আসে বিতান। বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। বিকেলের দিকে গ্রামের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সব কাজ শেষ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
নতুন চাকরি একটু কষ্ট তো করতেই হবে। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে। তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা অনেক ঘুর পথে। কয়দিন আগে একটা শর্টকাট আবিষ্কার করেছে সে। রাস্তাটা খুব নির্জন অবশ্য কিন্তু দিনের বেলায় যায় বলে ভয় ততটা লাগেনা।এই রাস্তা নিয়ে বেশ অনেক প্রচলিত গল্প আছে, কদিন আগেই গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ হারুদাদু বলছিলেন, বৃটিশ আমলে এই পথে নাকি মটরগাড়ি ছুটিয়ে শিকারে যেতেন লর্ডসাহেব আর তার মেম। কোন একবার শিকারে যেতে গিয়ে তারা এখানে রোড একসিডেন্টে মারা যান কিন্তু অবাক ব্যাপার লর্ডসাহেব ও তার মেমের লাশ এমন কি গাড়িটিরও নাকি কোন হদিস পাওয়া যায়নি কোনদিন। তখন থেকেই নাকি এই পথ পরিত্যক্ত কিন্তু লোকজন প্রায়ই নাকি এই পথে মটরগাড়ি চলার শব্দ পায়। কেউ কেউ নাকি হিমরাতে মোটরগাড়ির আলোও দেখেছে। বিতানের কাছে গল্পটা গল্পই মনে হয়েছে সে বিজ্ঞানের ছাত্র সে জানে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশেই বিশাল জঙ্গল হয়ত সেইদিন কোন জন্তু লাশ টেনে বনের গভীরে নিয়ে গেছে, কিংবা সামনের খাদে গাড়িটা পড়ে নদীতে ভেসে গেছে কিংবা তলিয়ে গেছে এত বছর আগের গল্প মুখে মুখে ভূতের গল্প হয়ে গেছে।
শীতের সময়, বিকাল হতে না হতেই এই বন্য পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যা গভীর রাতের মত নেমে আসে। আজ কাজ শেষ করতে করতে বিতানের বেশ দেরিই হয়ে গেল। বেশ কিছু রোগী ছিলো। শীত পড়লেই সর্দি কাশির প্রকোপ খুব বাড়ে এখানে। অফিস ঘরে তালা মেরে কয়েকবার টেনেটুনে দেখে বিতান বের হলো। প্যাডেলে পা দিয়েই সে একবার মনে মনে ভাবলো সর্টকাটে না গিয়ে ঘুরপথেই যাবে কিন্তু পরক্ষণেই নিজের উপর সে হাসলো।
ধুর, এই শী্তের মধ্যে এত দূর ঘুরে যাব! বড় টর্চটা ঝোলা থেকে বের করে নিয়ে তাড়াতাড়ি সাইকেলে প্যাডেল মারতে লাগলো বিতান। আজ ঠান্ডাটা কালকের চেয়ে বেশি। কুয়াশায় এক হাত সামনেরও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
রাস্তাটা পাকা নয়। পাকা হবার কথাও না। এমনিতেই মানুষজন খুব কম চলাচল করে এখান দিয়ে আর এই প্রচন্ড শীতের মধ্যে এখন তো কারো আসার প্রশ্নই আসে না।ভাবতে ভাবতে আর গানের কলি গুনগুন করতে করতে এগোচ্ছে বিতান।
হঠাৎ করেই ফুশ করে শব্দ আর সেই সাথে সাইকেল নড়বড়। সাইকেল খুব জোরে চলছিল। তাই ছিটকে গিয়ে সরাসরি মাটিতে।
শব্দ শোনার পর আর বুঝতে বাকি রইল না কি হয়েছে। বিতান তিক্ত মনে ভাবল বাঙালী বাঘা জিনিস। কী কী প্রবাদ যে বানিয়েছে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই কিনা সন্ধ্যা হয়! টায়ারটাও এখনই পাংচার হবার ছিলো! হাত থেকে পড়ে টর্চটা নিভে গেছে। ভয় ভয় মনে বিতান মাটি হাতড়াতে শুরু করল। টর্চের মত কিছু একটা হাতে ঠেকল। তুলে নিয়ে সুইচ চাপতেই আরো রাগ হলো তার।একা একাই বললো, “চমৎকার! আর কী চাই!” এইটাও শেষ।
সোজা হয়ে দাড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করল বিতান। চারপাশ নিঝুম, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর বুকের ধিপধিপ শব্দ ছাড়া কিছু নেই। কি করা যায়! অনেকক্ষন ভেবে এটুকুই বুঝল সে, এখানে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করতে থাকলে মাথা চিরদিনের মত ঠান্ডা হয়ে যাবে। অনেক ভেবে চিন্তে-
প্রথমে সাইকেলটাকে ঝোপের আড়ালে নিয়ে রাখলো কোনরকমে। ভেবে দেখলো নিজেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াটাই ভাল।কেননা নিজে কষ্ট করে বাড়ি যেতে পারলেও সাইকেলটা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব! তাই সাইকেলটা বরং সকালে নিয়ে গেলেই হবে।
রাস্তায় দাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ আশায় বুকটা নেচে উঠল। দূরে গাড়ির দুটো হেডলাইট এদিকেই আসছে। এই জায়গায় গাড়ি কিভাবে এল এ চিন্তা মাথায় এলেও বিতান তা মাথায় স্থান দিল না। বিতান অপেক্ষা করতে থাকল। কিন্তু গাড়িটা খুব বেশী স্লো চলছে। বিতান নিজেও একটু এগিয়ে গেল। গাড়িটা ওর সামনে এসেই থামল। বিতান আলো আধাঁরীতে ঠিক বুঝলো না ড্রাইভার সিটে কে বসা,তবে মনে হলো হয়ত কোন মেয়ে, সংকোচে সে কিছু বললো না। খানিক নীরবতা কাটিয়ে পিছনের দরজা খুলে বিতান খুশি মনে গাড়ির পেছনের সীটে গিয়ে উঠে বসলো। আস্তে করে গাড়ির দরজা লাগাতেই গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল।
গাড়ির ভেতরটা বেশ গরম। বিতানের মনে হল গাড়িটাতে নিশ্চয় হিটার চলছে তাই এই কনকনে ঠান্ডাতেও গাড়ীর ভেতরটা এত গরম। মনে মনে সে কথা সাজাতে লাগলো গাড়ীর চালককে কিভাবে ধন্যবাদ দেবে কেমন করে বলবে সেইসব। পেছন থেকে ও বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। জীবনটা বাঁচালেন, না হলে আজ যে কি হতো!”
চালক জবাব দিল না।
একটু অস্বস্তিতে পড়ল বিতান। আবার বলল, “রাস্তায় হঠাৎ সাইকেলের চাকা পাংচার হয়ে গেল আর কি হে হে।”
এবারো কোন জবাব নেই।
বিতান বুঝতে পারছিল না এই মহিলা কথা বলছে না কেন?
আবারো ও বলল
“এদিকে কার বাসায় যাবেন?”
এবারো কোন জবাব নেই।
এবার একটু মেজাজ খারাপ হল বিতানের। ব্যাপার কি? যাই হোক সে চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ পর ওর মনে হলো। কি ব্যাপার! গাড়ী এত আস্তে আস্তে চলছে কেন? সামনে ঝুঁকে বিতান ঐ মহিলাকে ডেকে বলতে চাইল “ম্যাডাম গাড়ি এত আ-
মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতল স্রোত তার কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিল। চালকের আসনে কেউ বসে নেই। সবার আগে যে সম্ভাবনাটা মাথায় এল তা আর ভাবতে চাইল না বিতান। গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইল ও। কিন্তু আতঙ্কে ও নড়তে পারছিল না। সামনে রেল ক্রসিং। গাড়িটা খুব আস্তে আস্তে ঐ রেললাইনের উপর গিয়ে দাড়াল। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলের শব্দে বিতান যেন চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছিলো। ঘোর কাটিয়ে বিতান এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে এখন ট্রেন এলে সে একদম চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ও দরজার হাতল ধরে টানাটানি করলো। আবারো ভয়ে ও পাগল হয়ে গেল। বারবার হাতল ধরে টান দিলেও ওটা খুলছে না। গাড়িটা আবারো নড়তে শুরু করছে। ওদিকে ট্রেন কাছে চলে আসছে। ভয়ে আর পরিশ্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ও জীবনের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখনই ও খেয়াল করল দরজাটা তো লক করা। কখন লক করলো, ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি লকে হাত দিয়ে লকটা খুলে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাটিতে গড়িয়ে ও অনেকটা দুরে গিয়ে পড়লো। বিতান দেখলো
গাড়িটা আবারো চলতে শুরু করেছে। গাড়িটা রেললাইন পার হতেই শোঁ শোঁ করে ট্রেন চলে গেল। বিতান মাটিতে শুয়ে, চোখে মুখে আতঙ্ক তবু সে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে। গাড়িটা ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির পেছন থেকে হঠাৎ এক যুবতি বের হয়ে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। তার সারা গায়ে এই শীতের রাতেও ঘাম। বিতানের একটু খটকা লাগল।হেডলাইটের আলোয় মেয়েটি দেখতে একদম মেমদের মত তবে কি সেই মেমভূত? ভূতেরাও ঘামে! বিতানের মুখের কাছে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি, বলল ”কী ব্যাপার, মাটিতে শুয়ে আছেন কেন? আমার গাড়িটা যে রেললাইনের উপর হ্যাঙ হয়ে ছিল দেখেন নি? ”
বিতান কোনরকমে ঘাড় নাড়ল।
”আচ্ছা মানুষতো আপনি মশাই! আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিলাম, গাড়িতে উঠেই লক করে বসে পড়লেন, মানুষ তো আসে পাশে তাকায়, ড্রাইভিং সিটে হুডিটা দেখেও তো কেউ খোঁজে কিংবা ভাবে কেউ নেই গাড়ি চলছে কি করে, নাকি? এত যে ডাকছি তাও কানে যায়নি, যাক তারপর যে এতবড় বিপদ আর আপনি হেল্প করতে আসলেন না? পাক্কা দুই কিলোমিটার ধরে গাড়িটাকে ঠেলছি! আসুন আসুন, আমার সাথে ঠেলুন।
বিতান বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি তো ভাবলাম ভূতের পাল্লায় পড়েছি।
তাই বুঝি! সত্যি বলতে কি আমিও, বন্ধুরা বলেছিলো এই পথে নাকি কোন সাহেব, মেম আর তাদের গাড়ির ভূত ঘুরে বেড়ায়,আপনি যখন কিছু না বলেই উঠে বসলেন আমিও ভয় পেয়েছিলাম তার উপর ডাকাডাকিতে সাড়া না পেয়ে আরো কিন্তু যখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভয়টা কেটে গেলো। দুজনে প্রাণ খোলা হাসি উড়িয়ে গাড়ি ঠেলতে শুরু করল।
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।