| 6 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: কাঁটাতার । সৌরভ হোসেন 

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

                                                              

গমের পাকা শিষগুলোয় চৈতি হাওয়া লাগলেই শিষগুলো ঝুঁকে কোমর বেঁকে যে আলটাতে ঠেকছে সেটাই কাঁটাতারের আল। জমিটাকে ‘বর্ডারের ভুঁই’ বলে নির্মল। জমিটা নির্মলের নয়। জমির মালিক কুদ্দুছ সেখ। হরেকমাল বেচা কুদ্দুছ। গেরামের ভেতরে যেখানে কুদ্দুছের বাপের বাপের বয়সের আসমান ছোঁয়া পাকুড়গাছটা দাঁড়িয়ে আছে তার কোল লাগা বাড়িটা কুদ্দুছের। জমিটা কুদ্দুছ নির্মলকে ভাগে দিয়েছে। ‘জমির আলে তোমার বাড়ি, তুমিই আবাদ করো নির্মলদা। ছাগল-গরু-হাঁস-মুরগি খেঁদাতে পারবে’ বলে নির্মলকে ভাগে দিয়েছে কুদ্দুছ। নির্মলও দেখেছে, বাড়ির কান্টায় ভুঁই। চাষ-আবাদের ঝামেলা কম। চোখে চোখে রাখা যাবে। ঠিকমতো তখিদও করা যাবে। এসব ভেবে, জমিটা ভাগে নিয়েছে নির্মল। তাছাড়া কুদ্দুছের সঙ্গে তার দহরমমহরমও ভালো। রক্তে কুটুম না হলেও দস্তিতে কুটুম। জমিটা পশ্চিমে যেখানে শেষ হয়েছে তার মাথার ডিহিতেই নির্মলের বাড়ি। গাঁয়ের একেবারে শেষবাড়ি! এতে নির্মলের ঠিকানা খুঁজে পেতে লোকের সুবিধা হয়। ‘ওই ওইদিকখানে বর্ডারের ধার লাগা বাড়িটা নির্মল মণ্ডলের বাড়ি’ কিম্বা ‘যেখেনে বিএসএফ চৌকিটা আছে তার কান্টায় নির্মল মণ্ডলের বাড়ি’, এই দুটো কথা বললেই হয়ে গেল, ব্যস, নির্মলের বাড়ি খুঁজে পেতে ভিন মানুষের আর কোনও অসুবিধা হয় না। একটা দেশের শেষ বাড়ি! তাও আবার পুঁচকে ছুঁচকে দেশ নয়, বিশাল বিরাট একটা দেশ! দুনিয়ার সাতখান বড়ো দেশের একখান। সেই ইন্ডিয়া নামক দেশের পূর্বের শেষ বাড়ি নির্মল মণ্ডলের বাড়ি। অবশ্য আরও একটা সহজ পরিচয় আছে নির্মলের। এই গ্রামের একমাত্র হিন্দু বাড়ি! কিম্বা একমাত্র হিন্দু পরিবার! যদিও এই পরিচয়টা শুনতে ভালো লাগে না নির্মলের। সে গেরামের অন্য পাঁচটা মানুষের মতো একজন মানুষ। সাকিন কালিকাপুর। থানা লালগোলা। ব্যস, এটুকুতেই খুশি নির্মল। মহারাজা জোগেন্দ্রনারায়ন রায়ের জমিদারির মানুষ কিম্বা নবাবদের দেশের মানুষ কথাগুলোও গায়ে মাখতে ভালো লাগে না নির্মলের। কোনও জমিদার তাকে তার চোদ্দপুরুষকে মাগনায় পেটের ভাত দেননি কোনও নবাবও তাদের দশখানা পাঁচখানা মহল বানিয়ে দেননি। তারা লাঙলে-জোয়ালে মানুষ লাঙলে-জোয়ালে মানুষ হয়েই থেকে গেছে। সেই যে বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে লুঙ্গি পরে আসছে এখনও সেই লুঙ্গিই পরে। কুদ্দুছ আর নির্মল যখন একসঙ্গে লুঙ্গি পরে ভুঁই বাতাল করতে মাঠে নামে তখন মনে হয় দুই ভাই। হিন্দুর বেটা হয়ে তুই মুসলমানের লুঙ্গি পরিস! কথাটা কেউ কোনোদিন নির্মলকে বলেনি। আসলে নির্মলের কাছে পরনের লুঙ্গি আর জমির ধান একই। এতে আল্লাহ-ভগবানের কোনও জাত-ধর্ম নেই। লুঙ্গির ধর্ম শরীরের ইজ্জত ঢাকা আর ধানের ধর্ম পেটের খিদে মেটানো। এই বিশ্বাসেই দুনিয়াদারি কাটে নির্মলের। যখন একখানা বিড়ি দুজনে ভাগ করে টানে তখন মনে হয় তাদের চেয়ে সুখি মানুষ দুনিয়ায় নেই! তার বাড়ি থেকে নির্মল কতদিন ওজুর পানি এনে দিয়েছে কুদ্দুছকে তার ইয়াত্তা নেই। যে আলে বসে নামাজ পড়ে কুদ্দুছ সেই আলের মাটি দিয়েই ঠাকুরঘর মোছে নির্মলের বউ শ্যামলী। আবার এই ঠাকুরের প্রসাদের মুড়ি-মুড়কি-নাড়ু ধামাই করে শ্যামলী পৌঁছে দিয়ে আসে কুদ্দুছের বউ রাহেলাকে। কুদ্দুছ-রাহেলারা সেই মুড়ি-মুড়কি-নাড়ু দিয়ে রমজানের ইফতার খোলে। এসবে না আছে দেশের কাঁটাতার না আছে ধর্মের কাঁটাতার। তবে নির্মলের বাড়ির পাশে কাঁটাতার আছে এ কথা সত্য। এই কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ওপারের দেশ দেখা যায়। একই রকমের বাড়িঘর, একই রকমের তালগাছ একই রকমের নদী। তবুও ওটা আলাদা দেশ। কথাটায় কেমন অসত্য অসত্য লাগে নির্মলের। নির্মল দেখেছে, কাঁটাতারের ওপারের যে মানুষগুলো ওপারের জমিতে আবাদ করতে আসে তারাও তাদের মতোই দেখতে। কথাও তাদের মতোই বলে। ভিন গ্রহের শামুকমুখো এলিয়েনও নয় আবার দুটোর বদলে তাদের তিনটে-চারটে পাও নেই। সেই দুপেয়ে কালো-ধলো মানুষ। অথচ এই কাঁটাতারের ওপর যখন রাত নেমে আসে তখন এই ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’টা আল্লাহর পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে যায়! পাপীদের কাছে যেমন পরকালের পুলসিরাত ভয়ঙ্কর এই ‘নো ম্যানস ল্যান্ডটা’ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কাছে দুনিয়ার পুলসিরাত! একটু এদিক ওদিক হয়েছে কি দুম করে সীমান্ত প্রহরীদের ছোড়া গুলি লেগে যায় বুকে। তখন সীমান্তের মাঠে মানুষের কান্নার গোঙানি শোনা যায়।

ভিন গাঁয়ে থাকা নির্মলের আত্মীয়কুটুমরা নির্মলের হিম্মত দেখে অবাক হয়, এক গাঁ মুসলমানের মধ্যে ও একঘর হিন্দু হয়ে থাকে কোন সাহসে! নির্মল বলে, হিন্দু না থাকলে কী হল, মানুষ তো থাকে? কৃষ্ণপুরের অনন্ত মণ্ডল পরামর্শ দিয়েছিল, ‘যদি দেশে কিছু একটা হুজ্জুটি বাঁধে তবে কী হবে তোর? ওরা ধরে কচু কাটা করবে। চলে আয়। ভিটেটা বিক্রিবাটা করে দিয়ে কৃষ্ণপুরে চলে আয়। এখানে আমরা তো আছি?’ অনন্ত নির্মলের মাসতুতো ভাই। নির্মলের মায়েরা তিন বোন। আরেক বোন থাকে জঙ্গিপুরের ধনপতনগরে। নির্মলের দাদুর বাড়িও কৃষ্ণপুরে। নির্মলদের এই কালিকাপুর গ্রামে বসবাসেরও একটা মজার ঘটনা আছে। নির্মলদের আগে বাড়ি ছিল পূর্বে যেখানে পদ্মা নদীটা বেঁকে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে তার কোলে। বাড়িটা এক বর্ষায় নদীর গর্ভে চলে গেল। নির্মলরা বলে, হাঘরে নদীটা গিলে খেল। তারপর গ্রামটা সরতে সরতে আরও পশ্চিমে চলে এল। গাঁয়ের কিছু মুসলমান এই সুযোগে পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গেল। তখনও বাংলাদেশ তৈরি হয়নি। নির্মলের ঠাকুরদা সুশীল মণ্ডল বেশি পশ্চিমে সরতে চাইলেন না। এমন জায়গায় ভিটে বানালেন যেখান থেকে বাপ-ঠাকুরদার ভিটেটা যেন চোখে দেখা যায়। সে নদীর গর্ভেই হোক আর কাঁটাতারে ঘেরাই হোক। কিন্তু গাঁয়ের বাকিরা আশেপাশের গ্রামে উঠে গেল। গ্রামের অন্য হিন্দুরা যখন সুশীল মণ্ডলকে বলেছিল, তুমি আবার শেষ বয়সে মুসলমানদের গাঁয়ে থেকে মুসলমান হবে নাকি? সুশীল মণ্ডল তখন উত্তরে বলেছিলেন, আমার কাবা-বৃন্দাবনের দরকার নেই, বাপ-ঠাকুরদার ভিটেটা দেখতে পেলেই সুখ। সেই সুখ নিয়েই এতদিন দিব্যি বাস করছিল নির্মল। হঠাৎ কী যে হুজ্জুটি এল দেশে, ঘর থেকে বের হচ্ছে না নির্মল! বেরোতে গেলেই হাত ধরে টেনে বসাচ্ছে শ্যামলী। “এভাবে ঘরে বন্দি থাইকল্যে খাব কী?” যেই বলছে নির্মল অমনি শ্যামলী বলছে, “জানটা থাকলেই তো ভাত লাগবে নাকি?

“তোমার ভুলও তো হতে পারে? এ গাঁয়ের লোক অমন নয়।“ বুকে একটা বিশ্বাস নিয়ে বলল নির্মল। খ্যাঁক করে উঠল শ্যামলী, “এ গাঁয়ের লোক কি আলাদা জীব নাকি? তলে তলে সবাই এক।“ শ্যামলীর কথাটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চায়ল না নির্মল। এ গাঁয়ে তো আজ নতুন বাস করছে না তারা? বাবা-ঠাকুরদার আমল থেকে দেখে আসছে, মানুষগুলো দায়েদির মতো। কখনও মনেই হয়নি নির্মলের যে সে হিন্দু আর কুদ্দুছ মুসলমান। তাদের মধ্যে কোনও ছুঁত অচ্ছুত তো নেইই কোনও ঘৃণা-বিদ্বেষও নেই! আমি মনে হয় মেয়ে মানুষের কথা শুনে ভুলই করছি। খামোখা খামোখা কুদ্দুছদের সন্দেহ করছি। বাইরে একবার বেরোনো দরকার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জানালার কাছে এল নির্মল। কাঁঠাল কাঠের জানালা। নিম কাঠের ফ্রেম। লোহার শক্ত রড দিয়ে ঘেরা। জানালার সে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চৈত্রের পদ্মা। আধখানা শুকিয়ে ধুধু করছে। পড়েছে সাদা বালির চর। সে বালির ওপর তেরছা হয়ে পড়ছে চৈত্রের রোদ। বালি রূপোর মতো চিকচিক করছে। নির্মল জানে মানুষের অন্তরেও কখনও কখনও এরকম চরা পড়ে। মানুষ শুকোয়। মানুষের জীবনেও আসে শুকান-পর্ব। মানুষ তখন খিটকেলে হয়ে ওঠে। আবার চর পড়া নদীর বুকে যখন বর্ষা নামে। জলে টৈটুম্বর হয়ে ওঠে। ডাকে গ গ করে। তখন গর্ভবতী নারীর মতো সুন্দরী হয়ে ওঠে নদী। নদীর সে অপরূপা রূপ দেখে নির্মলরা ভাবে, নদীর এই জলের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর তাদের পেটের খাবার পাঠান। মাটির ভেতর ঢুকে মাটিকে কানে কানে বীজ ফোটানোর মন্ত্র শিখিয়ে যায় নদীর সে জল। তখন নদীর পাড়ের মানুষগুলোও অঙ্কুরিত গাছের মতো খিলখিল করে ওঠে। সে খুশির একটাই আহ্বান, ধান পুঁতো রে, ফসল তোলো রে। তখন নির্মল কাহানের গন্ধ মাখা কুদ্দুছের কাদান করা পিঠে নখ দিয়ে কাদা তুলে দিয়ে ভাবে, তারা সত্যিই মাটি দিয়ে গড়া। সেই মাটির মানুষগুলো বল্লম-ত্রিশূল হতেই পারে না। শ্যামলীর কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নদীর দিকে দৃষ্টি ফেলে ভাবল নির্মল। ওপারের যে তালগাছটা টিমটিম করছে সেটার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আসা চিলটাকে দেখে দৃষ্টিটা যেই নিচের নতুন গজিয়ে ওঠা চরে পড়ল অমনি নির্মল দেখল একটা গাই গোরু গলায় দড়ি নিয়ে নদীর দিকে ছুটছে! গোরুটার গায়ের খয়েরি রঙ আর বাঁকা শিংজোড়া দেখে নির্মল নিশ্চিত হল এটা তো তারই গোরু! খুঁটি উপড়ে পালাচ্ছে। মনে মনে একবার খিস্তি দিল নির্মল, হারামজাদা গাইটার খুব ছটফটানি বেড়েছে। নান নান খাচ্ছে তবুও পেট ভরছে না! নান নান খাই সেটাই বলে নির্মল কিন্তু গাই গোরুটা যে তার বদলে বালতি বালতি দুধ দেয় সেটা আর বলে না! গোরুটা যে তাদের অভাবে-আকালে অনেক উপকারে লাগে সেটা মাঝেমধ্যে ভুলে যায় নির্মল। আবার গাভিটার ওপর তার মায়াও কম নয়। এতটুকু যত্ন-আতিরের খামতি রাখে না। লালগোলার হাট থেকে হপ্তায় হপ্তায় খইল কিনে আনে। ভাগের ভুঁইটার এক কোণে গাভিটার খাওয়ার জন্য সমবচ্ছর গহমা বোনে। আর পাহাড় করে ধানের নাড়া তো পালা দেওয়া থাকেই। গাভিটা হাট থেকে কেনা নয়। আইনুলের পোষানি নেওয়া গাই গোরুটার কাছ থেকে পাওয়া ভাগের গোরু। গাভিটাকে ছোটো থেকে মেয়ের মতো মানুষ করেছে নির্মল-শ্যামলী। তাদের দ্বিতীয় মেয়ে অর্চনার বয়সও গাভিটার সমান। মাত্র দু-দিনের বড়ো অর্চনা। শ্যামলী তখন আঁতুড় ঘরে। নির্মল ঠাট্টা করে শ্যামলীকে বলত, তুমি একটা মেয়ে মানুষ করো আমি একটা মেয়ে মানুষ করি। পোষানি নেওয়া গাভিটার আগের পালি গাভির মালিক আইনুল পেয়েছিল। এবার ছিল নির্মলের পাওনা। নির্মল তো এক-আধদিন একবার শ্যামলীর পোয়াতি পেটে হাত বোলাত একবার গর্ভবতী গাভিটার পেটে হাত বোলাত। কখনও কখনও পেটে কান রেখে ভ্রূণের নড়চড়নও অনুভব করার চেষ্টা করত। শ্যামলী তখন তার ফোলা ঠোঁটের কোণে মিস্টি হাসি লাগিয়ে বলত, “কোনটা ব্যাটা আর কোনটা বিটি গ?’ এমন ধরণের কথা আইনুলও বলত, ‘বুঝলে নির্মল, একটা মেয়ি তুমার একটা মেয়ি আমার। দুজনাই মেয়ির বাপ। এ কপাল কজুনার হয় গ!’ মা গাভির প্রথম বিহেনের সেই আইনুলের পালি পাওয়া বাছুরটাও মেয়ে ছিল। একবার গলা ফেড়ে চিৎকার করে উঠল নির্মল, “গাইটা দড়ি ছিড়ি পালাচ্চে গ শ্যামলী।“ শ্যামলী তার কথা শুনতে না পেলে একটা খিস্তি দিয়ে উঠল নির্মল, “হারামি গাইটাকে পান্ঠির বাড়ি মেরি পাগুলেন ভেঙি গুড়ি করি দিতে হবে। অর দড়ি ছিঁড়া জনমের মুতন ভুলি যাবে।“ এবার কথাটা শুনতে পেল শ্যামলী। বিড়ির মুখ মারছিল শ্যামলী। কোলে পাতা-মশলার কুলো নিয়েই শ্যামলী জিজ্ঞেস করল, “কার গাই?” নির্মল ধমকে উঠল, তার চোখে তখন আগুনের গোলা, “আমাদের আবার কার? কানে কি তুলে ভরে থুয়েছ নাকি?” থপ করে বিড়ির পাতা-মশলার কুলোটা পাশে রেখে খাড়া হয়ে উঠল শ্যামলী। ঘরের দাওয়া থেকে একেবারে উড়ে এসে পড়ল জানালার ধারে। খুঁটল চোখগুলো ঘুলঘুল করে দেখল তাদের সাধের গাভিটা নদীর দিকে ছুটছে! শ্যামলী চিৎকার করে উঠল, “দোড়ো গো, গাইটা যে নদীর দিকে পালাচ্ছে! বিএসএফ ধরে নেবে!” আর কোনও কথা নয়। পরনের লুঙ্গিটাকে দুমড়ে নিয়ে মাঠপানে দিল ছুট নির্মল। শাড়ির আঁচলাটা কোমরে গুঁজে শ্যামলীও নির্মলের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। গরুটা ততক্ষণে বইতুল্লার জমি পেরিয়ে কাঁটাতারের দিকে ছুটছে! তার গলায় বাঁধা দড়িটাতে গুচ্চের লতাপাতা হিজ্জাবুর হয়ে আটকে গেছে। সেসব নিয়েই গরুটা ছুটছে। মাঝেমধ্যে উপড়ে যাওয়া খুঁটিটা পায়ের খুরে বেঁধে হ্যাঁচকা টান লাগছে গলায়। শ্যামলী তখন পিছন থেকে চিৎকার করে যাচ্ছে, “গরুটাকে ধরো। বিএসএফের হাতে পড়লে কেলেঙ্কারি হয়ী যাবে। গরু পাচার কেসে ফাঁসি দিবে। রাইফেল তাক করি গুলি চালাতেও পারে! দৌড়ো দৌড়ো।“ নির্মল দৌড়চ্ছে। পরনের দুমড়ানো লুঙ্গিটা দক্ষিণি হাওয়াই হলহল করছে। দৌড়োনোর মাঝেই দুমড়ানো লুঙ্গিটাকে নেঙটি মেরে নিল নির্মল। দূর থেকে দেখে তখন নির্মলকে মনে হচ্ছে একজন অর্ধনগ্ন মানুষ নদীর পাড়ে ছুটছে! গরুটা এবার হাম্বা করে একটা লম্বা ডাক দিল। সে ডাক শুনে শ্যামলীর ভেতরটা ধড়াক করে উঠল। কাপড়ের আঁচলাটা ততক্ষণে কোমর থেকে খুলে হাওয়ায় উড়ছে। গোলাপি রঙের ব্লাউজের নিচের পেটটা তখন উদোম। খড়ির মতো শরীরটাকে মনে হচ্ছে মরা বাবলা গাছের গায়ে জড়ানো আছে একখানা শাড়ি! সে শাড়ি ফিনফিন করে উড়ছে। আর তক্ষনি শ্যামলীর নজরে পড়ল, চরের পাড় দিয়ে ছুটে আসছে আসমত কসাই। আসমতের পিছনে আরও একজন। শ্যামলী তার ডাহুক চোখজোড়া ফেড়ে দেখল, লোকটি আইনুল। চিৎকার করে উঠল শ্যামলী, “আর যায়ও না গ, ওই দ্যাখো, আসমত কসাই, আইনুল গেরস্ত দৌড়ি আসচে। গরুডাকে এবার ধরি জবাই করি খেয়ি লিবে। তারপর তোমাকে ধরবে।“ শ্যামলীর নিষেধ শুনল না নির্মল। সে ল্যাকড়াপ্যাকড়া করে ছুটতে লাগল। একটা ঘোরের মধ্যে আছে নির্মল। কোনোভাবেই যাতে গরুটা বিএসএফের হাতে চলে না যায়! তখন নির্মল মহা ফ্যাসাদে পড়ে যাবে। কেস তো খাবেই, ক-খানা যে জেল খাটতে হবে তার ইয়াত্তা নেই। শেষে গুমও হয়ে যেতে পারে! এখন বর্ডার বড্ড কড়াকড়ি। সন্দেহজনক মনে হলেই বিএসএফ গুলি চালাচ্ছে। শ্যামলীর এখন বিএসএফের চেয়ে বেশি ভয় আসমত আইনুল কুদ্দুছদের। তারা নাকি ওত পেতে আছে, কখন নির্মল বাইরে বের হবে। আর অমনি নির্মলের ওপর হামলে পড়বে। অথচ নির্মল কোনও অপরাধ করেনি। কাউকে কোনও গালমন্দও করেনি। সন্দেহটা ক-দিন ধরেই তীব্র হচ্ছে শ্যামলীর। যখন থেকে শুনেছে হাসানপুরের মেলায় ঝামেলা হয়েছে। একজন মুসলমান খুন হয়েছে। সে নিয়ে হুজ্জুটি বেঁধেছে। সে হুজ্জুটি দাবানলের আগুনের মতো ছড়াচ্ছে। শ্যামলীর ভয় এখানেই। সে আগুন কখন না তাদের উঠোনে এসে পড়ে! দু-কামরার বাড়ি। ইঁটের গাঁথুনি হলেও মাথায় ঢালাই নেই। টালির চালা। এ ঘরে আগুন লাগলে পুড়তে কতক্ষণ! ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই নির্মলকে বাড়ির বাইরে বের হতে দেয়নি শ্যামলী। নির্মল ঘরে বন্দি থাকা লোক নয়। কিন্তু পরিস্থিতি আঁচ করে সেও বাইরে বের হতে জেরাজুরি করেনি। শ্যামলী বলেছিল, জীবনে আমার কোনো নিষেধ তো শোনোনি, এই নিষেধটা শোনো। মন সায় না দিলেও বউয়ের নিষেধটা শুনেছিল নির্মল। কিন্তু বাড়ির গাভিটা সেসব লণ্ডভণ্ড করে দিল। বাড়ির বাইরে তো বের হতে হলই, তাও আবার লুঙ্গি দুমড়ে নেঙটি বেঁধে! পদ্মা থেকে ঝিনুকের মতো একটা খাল বেরিয়ে এসেছে ইন্ডিয়ার যে দিকটায় সে দিকে এবার ছুটছে গোরুটা। এই খালের পাড়েই আছে বিএসএফের ওয়াচটাওয়ার। ওয়াচটাওয়ারের নিচে কয়েকজন বিএসএফ টহল দিচ্ছে। গোরুটা ওইদিকেই ছুটছে! আর রেহাই নেই। গুলি ফায়ারিং হল বলে! গোরুটা তো যাবেই নির্মলের না দুনিয়াদারি ঘুচে যায়! নির্মলকে খালপাড়ে উঠতে দেখেই চিৎকার করে উঠল শ্যামলী, “খালপাড়ে উঠো না। বিএসএফ গুলি চালাবে।“ নির্মল থমকে গেল। খালপাড়ের উঁচু ডিহিটায় উঠে বাজপড়া খেজুরগাছ হয়ে গেল। কাছের পদ্মা থেকে তিরতির করে ভেসে আসছে জলের মিহি শব্দ। বর্ষাকাল হলে এই শব্দই গ গ করে হামলাত। দূর থেকে নির্মলকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা দমকা হাওয়া এলেই তার দড়ি-খড়ি শরীরটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে নদীর বুকে। গোরুটা ততক্ষণে খালের নিচে নেমে গেছে। আশপাশের মাঠ থেকে আরও বহু লোক খালপাড়ের দিকে ছুটে আসছে। এত লোক বর্ডারে দৌড়াদৌড়ি করলে তো বিপদ! বিএসএফ নিশ্চিত গুলি চালাবে। আর তখনই দুম করে একটা শব্দ হল! আঁতকে উঠল নির্মল! তার দুমড়ানো শরীরটা হলহল করে হালছে। না, গুলিতে কেউ ছিটকে পড়ল না। শ্যামলীও খাড়া হয়ে দৌড়চ্ছে, আসমতও দৌড়চ্ছে গেরস্ত আইনুলও ঘাড়ে গামছা নিয়ে দৌড়চ্ছে। মাঠে-আলে যে যেখানে দৌড়চ্ছিল সে সেখানেই দৌড়চ্ছে। নির্মল ঠাহর করল, মানুষকে নয়, বিএসএফ শূন্যে গুলি চালিয়েছে। সে আওয়াজই তার কানে পটবাড়ি খেল। এবার আসমতের গলা ভেসে এল, “কাঁটাতারের কাছে যায়ও না নির্মল। বিএসএফ ফায়ারিং করছে।“ কথাটা অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেল নির্মল। তারপর নির্মল ভাবল, আমি কাঁটাতারের কাছে গেলে তো ওদেরই ভালো। বিএসএফের গুলিতে মারা যাব। ওদেরকে আর হেঁসো-পাশনি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে আমাকে মারতে হবে না। ওরা যে কাজটা হাসিল করতে চায়ছিল সেটা বিএসএফই করে দেবে। তাহলে আসমত আমাকে কাঁটাতারের কাছে যেতে নিষেধ করছে কেন? তাহলে কি ওরা অন্য কোনো মতলব এঁটেছে! সন্দেহ বাড়ল নির্মলের। শ্যামলী ততক্ষণে খালপাড়ে এসে পৌছেছে। সে লাঙল টানা মোষের মতো হাঁপাচ্ছে। নির্মলের ভেতরের কলকব্জাগুলোও তখন জোরে জোরে হাঁপ নিচ্ছে। শরীরের এ শব্দের সঙ্গে ভাসানের নদীর শব্দের মিল পায় নির্মল। তখন তার নিজেকে একটা পদ্মা নদী মনে হয়। সে কথা শ্যামলীকে বললে, শ্যামলী খিলখিল করে হেসে ওঠে। হেসে লুটোপুটি খায়। বলে, নদী কখনও ব্যাটাছেলে হয় গ! নদী হল কি না বিটিমানুষ। দ্যাখো না, মেয়েমানুষের মতো কেমন পোয়াতি হয় নদী। আবার প্রসব হওয়া মায়ের পেটের মতো কেমন খোলপেট হয়ে যায়। খালের উল্টো দিক থেকে এসে নির্মলের আগেই খালে নেমে পড়ে আসমত। আসমতের মুখের সুন্নত দাড়িগুলো নদীর হাওয়ায় ফিরফির করে উড়ছে। মাথার গোলটুপিটাকে মনে হচ্ছে খালের মাঝখানে একখানা রূপোর চাঁদ নেমেছে! আসমত সবসময় মাথায় টুপি পরে থাকে। যে বছর আরব খেটে দেশে ফিরে এল সেই বছর থেকেই আসমতের মাথায় সর্বক্ষণ টুপি দেখা যায়। অবশ্য পরনের লুঙ্গিটা তার হাঁটু অবধি গোটানো। তাতে ওজু ভাঙল না থাকল তা ভাবেনি আসমত। দৌড়োনো সুবিধা হবে ভেবেই লুঙ্গিটাকে দুমড়ে নিয়েছে। ততক্ষণে আইনুল গেরস্তও খালপাড়ে উঠে এসেছে। ঘাড়ের গামছাটাকে কোমরে বেঁধেছে। আইনুলের মুখে দাড়ি নেই। মাথায় টুপিও নেই। তবে মুখের ওপরে একটা পেল্লাই সাইজের কুচকুচে গোঁফ আছে। বাড়ির বউ-বেটা-বিটির থেকে এই গোঁফটার নাকি বেশি যত্ন নেয় আইনুল। এ অভিযোগ তার বউ আনুয়ারার। সেই গোঁফমুখো আইনুল গেরস্ত খালপাড় থেকে গলার খ্যাঁকানি দিল, তারপর খিস্তি দিয়ে বলল, “বাহিঞ্চত বিএসএফ আবার ফায়ারিং কচ্ছে। সাবধান কিন্তুক।“ কথাটায় ভয় পেল নির্মল। সে ভাবল, আইনুল আসমতদের আসল মতলব কি তবে এই খালের নিচে তাকে আর তার গোরুটাকে খতম করা! গা’টা কেমন শিউরে উঠল নির্মলের। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে ততক্ষণে একটা হিম স্রোত বয়তে শুরু করে দিয়েছে। পরিস্থিতি আঁচ করে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে শ্যামলী অনর্গল বলে চলেছে, “নিচে নামো না। ওরা মেরি ফেলবে।“ আসমত তখনই গোরুটার গলার দড়ি খপ করে ধরল। তারপর একটা হ্যাঁচকা টান মেরে তাবে আনার চেষ্টা করল। গোরুটা মিহি করে একবার হাম্বা করে উঠল। তারপর আচমকা শিং উঁচিয়ে একবার তিড়িং করে লাফাল। হাতের দড়িটা ছেড়ে গেল আসমতের। কোমর ঝুঁকে আবারও খপ করে গলার দড়িটা ধরল আসমত। গলা উঁচিয়ে নির্মলের উদ্দেশ্যে বলল, “তাড়াতাড়ি নিচে নেমি আসো নির্মলদা। তুমার গোরু খেপি গেলচে।“

“নাহ, নামবে না। একধাপও নামবে না।“ পিছন থেকে চিল্লিয়ে উঠল শ্যামলী। চোখগুলোকে পাকা আমড়ার মতো করে বলল, “উসব ফান্দ। অধের ফান্দে পা দিও না।“ শ্যামলীর কথা শুনে আসমত অবাক হল। শ্যামলী বউদি বলছে কী! মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝে আসমত গলা ফাড়ল, “জলদি করো নির্মলদা। গোরুটা চাট মারবে বুলি মুনে হচ্চে।“ আর তখনই পাড় থেকে হামলে উঠল আইনুল, “তুমি লিটপিট করছ ক্যানে গ নির্মল? তাড়াতাড়ি খালে নামো।“ শ্যামলীর গলায় এবার বাজ পড়ল, “একদম না। তুমাধের মতলব বুঝতে আর দেরি নাই আমাধের।“

মতলব! শ্যামলীর কথা শুনে এবার আইনুলও আকাশ থেকে পড়ল। কোন মতলব? কীসের মতলব? কিছুই বুঝে উঠতে পারল না আইনুল গেরস্ত। নির্মল-শ্যামলীর হাবভাব দেখে আইনুল আসমতের উদ্দেশ্যে বলল, “থাম। আমিই আসচি।“ তারপর হুড়মুড় করে খালে নেমে পড়ল আইনুল। ঢালু আঁকাবাঁকা পথ। ঠিক পথ নয়, পাউঠা। কিছু কিছু জায়গায় সবুজ ঘাস জন্মেছে। দুব্রো আর চাপাটি ঘাস। এখানে প্রবেশ নিষেধ বলে ঘাসগুলো লকলক করে বেড়ে উঠেছে। নির্মল নিচে নামল না। খালপাড়েই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকল। শ্যামলীও ততক্ষণে তার পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। চৈত্রের চিড়বিড়ে রোদ তখন তাদের ঘাড়ে চিড়বিড় করছে। শ্যামলী ফিসফিস করে বলল, “চলো পালিয়ে যাই। গোরুটার জান গেলে যাক। আমরা তো জানে বাঁচি?” শাড়ির আঁচলাটাকে কোমরে আরও পোক্ত করে আঁটল শ্যামলী। চোখগুলো ঘুলঘুল করছে। আর এসবের মাঝে চৈত্রের রোদ তার চামটা পেটে পড়ে খিলখিল করে উঠল। নাভিদেশ স্পষ্ট হল। উঁকি দিল তার সন্তান প্রসবের দাগগুলো। চামড়ায় ভাঁজ নেই, তবে সাদা সাদা দাগ রয়েছে। চৈত্রের বেহুদ্দে রোদ সে দাগে পড়ে দাঁত কেলাচ্ছে। শ্যামলীর চুলগুলোও ধানের শেকড়ের মতো। সে উসকোখুসকো চুলে শুস্ক রোদ পড়ে চুলগুলো বড্ড বেয়াড়া হয়ে উঠছে। নির্মল বুঝে উঠতে পারল না, কী করবে? বউর সাথে পালাবে না গোরুটার কাছে যাবে? বড্ড দোটানায় পড়ে গেল। আর তক্ষনি খপ করে তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল শ্যামলী। নির্মল চিৎকার করে উঠল, “কী করছ!”

“পালাবা না তো অধের হাতে মরবা নাকি?” খেঁকিয়ে উঠল শ্যামলী। আর তখনি দুম করে উঠল। বিএসএফ ফায়ারিং করল। লক্ষণ ভালো নয় দেখে বউয়ের সাথে তর্কে গেল না নির্মল। মন সায় না দিলেও একরকম বাধ্য হয়েই বাড়ির পানে পালানোর মতলব আঁটল। তারা যেই ছুট লাগাবে অমনি খালের নিচ থেকে ডেকে উঠল আসমত, “কুন্ঠে যাচ্চ নির্মলদা। গোরুটা লিয়ি যাও।“ থেমে গেল নির্মল। শ্যামলী স্বামীর হাত ধরে টানতে লাগল। আর বিড়বিড় করতে লাগল, “আবাং মরদডা আর কবে বুঝবে, উসব গোরুটোরু হল ফান্দে ফ্যালার চাল। হাতের নাগালের মধ্যে পালেই গদ্দনে পাশনির কোপ দিবে।“ তবুও পা তুলল না নির্মল। এতদিনের একসাথে বসবাসের বিশ্বাস তাকে আর পা তুলতে দিল না। মনে মনে ভাবল নির্মল, যা হওয়ার হবে। একটু থেমে যাই। স্বামী-স্ত্রীর হ্যাঁচকাহেঁচকির মাঝে এসে দাঁড়াল আসমত আর আইনুল। আর তাদের সঙ্গে গাই গোরুটা। গোরুটা ততক্ষণে রাগ থামিয়ে শান্ত হয়েছে। লেজ দোলাচ্ছে মিহি করে। সে চায়ছে তার মনিব তার পিঠে একবার আদরের হাত বোলাক। তখন সে মিহি করে হাম্বা ডাক দেবে। কিন্তু নাহ, নির্মল সে সাহস দেখাল না। নির্মল শুধু গোরুটার চোখগুলোর দিকে তাকাল। নাহ, কোনও আতঙ্ক নেই। থির পুকুরের জলের মতো শান্ত। কিন্তু তার নিজের চোখে তখন আতঙ্কের কালো মেঘ! শ্যামলী তো থত্থর করে কাঁপছে! শ্যামলী ভাবছে, আসমত-আইনুল এবার লুঙ্গির ভেতর থেকে ভুজালি বের করে তাদের বুকে হাঙবে। তারপর চুলের মুঠি ধরে ভুজালিটা চালিয়ে দেবে গলায়! তারপর লাশগুলোকে খালপাড়ে ফেলে দিয়ে বলবে, “বদলা নিলাম”। দুচারবার ধেই ধেই করে খুশিতে লাফাবে। তারপর মহল্লায় গিয়ে গর্ব করে বলবে, “বিধর্মীদেরকে খতম করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের বেহেশত পাকা।“ নির্মলের জুলপি চুইয়ে নামছে ঘাম। এ ঘাম যতটা চৈত্রের গরমের তার চেয়ে বেশি খুন হয়ে যাওয়া ভয়ের। নির্মল যেই থতমত করে বলল, “গোরুডা খুঁটি উপড়ি পালিয়ে এসচে।“ অমনি আসমত বলল, “উরসের মিটিংএ গতকাল যায়নি ক্যানে, নির্মলদা?” নির্মল বলল, “এমনি। বাড়িতে কাজের খিজিবিজি ছিল।“ শেষ কথাটা মিথ্যে বলল নির্মল। আসল কথা হল, সে ভয়ে যায়নি। আইনুল বলল, “তুমার জন্যি মিটিংএ ফায়সালা হয়নি।“ কথাটায় অন্য কিছুর ইঙ্গিত আঁচ করল শ্যামলী। সে ভাবল, তাহলে আমি যেটা আন্দাজ করেছিলাম সেটাই ঠিক। ওরা আমাদেরকে গাঁ ছাড়া করেই ছাড়বে। চোখগুলো কেমন হেলিয়ে নির্মলের দিকে তাকাল শ্যামলী। ইশারায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু নির্মল শ্যামলীর সে ইঙ্গিত বা ইশারা কিছুই বুঝল না। সে গুম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল। আইনুল বলল, “তুমি হলে কি না উরসের মেলার সভাপতি। তুমি উপস্থিত না থাকলে মিটিং হয়? না মানায়?” আইনুলের কথা শুনে ঠোঁটে এক চিলতে হাসল নির্মল। যেন গুমোট কালো মেঘ চিড়ে এক চিলতে আলো বেরিয়ে এল। আলগোছে নির্মল বলল, “তাতে আর কী আছে। গোটা গাঁয়ের লোক তো আছেই। তারপরে আছো তুমরা। অসুবিধা কোথায়?” কথাটা বলা শেষ হল ঠোঁটের হাসিটুকু গোটা মুখে ছড়িয়ে গেল নির্মলের। নির্মল জানে, তাদের এই কালিকাপুর গাঁয়ের উরস বড়ো উরস। বড়ো করে মেলা বসে। দূরদূরান্তের গাঁ-গঞ্জ থেকে মানুষ আসে। হজ্রুদ্দিপিরের মাজারে মানতকারীরা কতকিছু মানত করে। গোটা গ্রামের লোকদের নিয়ে কমিটি তৈরি হয়। সে কমিটি সাত দিনের এই মেলা পরিচালনা করে। প্রতি বছর কমিটিতে নির্মলের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। গত বছর নির্মল সভাপতি ছিল। সে জাতে হিন্দু সেসব কোনও ফ্যাঁকড়া সৃষ্টি করে না। বরং উল্টোটাই ঘটে। জাতে হিন্দু বলে নির্মল বাড়তি কদর পায়। সবাই তাকে সমীহ করে। গাঁয়ের লোকে নির্মলকে বলে, হজ্রুদ্দিপিরের সেই কথাটি যেখানে পিরহুজুর বলেছেন, ‘আমি মানুষের মানত নিতে চাই, ধর্মের নয়।‘ শ্যামলী তখনও আসমত আর আইনুলের হাতের দিকে নজর রেখে আছে। তারা লুঙ্গির ভাঁজ থেকে কী বের করে, পিস্তুল না ভুজালি? আসমত বলল, “আমরা এবছরও ঠিক করিছি, তুমাকেই সভাপতি করব।“ তারপর গোরুর দড়িটা নির্মলের হাতে তুলে দিয়ে আসমত বলল, “তাড়াতাড়ি পালিয়ে চলো, বিএসএফ আবার গুলি চালাতে পারে!”

 

                                          

                 

  

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত