| 20 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

গো গেঁরো

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comনেংটি কুকুরের মতো দুদ্দাড় করে দৌড়চ্ছে কাদের। ধানি জমিটার আঁল দিয়ে পড়িমরি করে ছুটছে। তার দুবলা পাতলা হলহলে শরীরটা ল্যাকপ্যাক ল্যাকপ্যাক করে দুলছে। এক আধবার তার মাথায় ফন্দি ঠকঠক করছে, ধানের গাছের মধ্যে শুইয়ে পড়ব নাকি, নাহ থাক, বুঝে নেবে, ছোট ধান, এখনও সেভাবে ঝোঁপ বেঁধে ওঠেনি।

হাইওয়ের দুদিকে দিগন্তবিস্তৃত আবাদি জমি। যেদিকে চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। কাচা হলুদের মতো পড়ন্ত বিকেলের টকটকে হলুদ রোদ তেরছা হয়ে পড়ছে। দিগন্তে আসমানের ফেরেশতা রঙিন ফুল ঘষে ঘষে দিচ্ছেন।

কাদের হাঁসফাঁস করে হাঁপাচ্ছে। সে একদণ্ডও থির না হয়ে ধুকুর-ধুকুর করে দৌড়চ্ছে। সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, ব্যাপারটা এভাবে তিল থেকে তাল হয়ে যাবে! সে এই লাইনে তো আজ নতুন না, এই করতে করতে বিশ বছর হয়ে গেল। এরকম আপদের মধ্যে কোনদিন পড়তে হয়নি । কিন্তু আজ মিনিট পনেরোর মধ্যেই ঘটনাটা ফোঁস করে ক্যাচাল পাকিয়ে উঠল । অবস্থা বেচক্কর দেখে, কাদেরের সঙ্গীসাথীরা যে যেদিকে পেরেছে কেটে পড়েছে। বেটা কাদের বেহুদ্দের মতো পান্ঠি হাতে গরুটার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। স্থানীয় লোকজন যে ফুঁসে উঠছে, তা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। হ্যাবলার মতো হাঁ করে হুটোপুটি দেখছিল। আসান লুঙ্গি গুটিয়ে পালাতে পালাতে গলা ফাটিয়ে বলেছিল, “কাদের পালা, পালা, লোক খেপে গেছে! ধত্তে পাল্লে গদ্দন কেটে লিবে!”

কিন্তু আবাং কাদের আসানের কথা কান করেনি। যখন লোক লাঠি-বল্লম হাতে বানের জলের মতো হুড়মুড় করে শুসে তেড়ে আসতে লাগল, তখন তার টনক নড়ল, তখন ট্রাকটার পেছন দিক দিয়ে কোন রকমে পরনের লুঙ্গিটা নেংটি মেরে জান-প্রাণ দিয়ে মারল দৌড়।

রাস্তার একদিক দিয়েই গরু হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কাদেররা। একপাল গরু সার বেঁধে লিটপিট করে হেঁটে যাচ্ছিল। আর রাস্তা দিয়ে ‘সাঁই’ ‘সাঁই’ করে ছুটছিল গাড়ি। এদিক ওদিক দু-একটা গরু ঘাড় ঘোরালেই ‘হাট’ ‘হাট’ করে চেঁচিয়ে ‘পটাম’ ‘পটাম’ করে পিঠে পান্ঠির দু-এক ঘা দিয়ে গরুগুলোর ঘাড় সোজা করে দিচ্ছিল কাদেররা। তারা দলে তিনজন। কাদের, আসান আর কাশেম। দলে সব থেকে পুরোনো রাখাল কাদের। গরুগুলোকে সেভাবে দৌড়ায়ওনি কাদেররা। গড গড করে হেঁটে যাচ্ছিল। ফাঁকা রাস্তা পেলে অবশ্য তারা মুখে ‘আরে রে রে হাট হাট হুর রে…’ বলে ‘হলয়’ দিয়ে গরু তাড়িয়ে দৌড়িয়ে নিয়ে যায়। এক-আধবার ধমকানি দিয়েও ওঠে, “হাট হাট তানাহলে পাছায় পান্ঠির বাড়ি দিয়ে কুহারা ছুটাচ্ছি।

হ্যারা গলায় আব্বাসউদ্দিনের গান ধরে, পান্ঠিটা বগলে পুরে কাদের কেবলই বামহাতের তালুতে খৈনির দলাটায় চুন ডলতে শুরু করেছিল, অমনি আচমকা পিছনের দিকে থেকে ‘হুস’ করে একটা বালি বোঝাই ট্রাক এসে রাস্তার দিকের সাদা বলদটাকে পিষে দিয়ে সোজা নয়ানজলিতে নেমে গেল। আসান আর কাশেম তখন বিড়ির সুখটান দিতে দিতে গরুর দামদরের গল্প করছিল। তারা হকচকিয়ে গেল! আর একটু হলেই ট্রাকটা তাদেরকেও পিষে দিত! আসান তার ঢ্যাবা গলায় চিৎকার করে উঠেছিল, “কাদের, কাদের, তুই ঠিক আছিস তো?” কাদের দুরুদুরু কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল, “আমি ঠিক আছি কিন্তু সর্বনাশ হয়ে গেছে! সাদা বলদটা কাটা পড়ে গেছে।

এভাবে জমাট বিকেলে পলষণ্ডার মোড়টায় অ্যাকসিডেন্ট ঘটায় হুড়মুড় করে লোক জমে গেল। কাদের তখন কাটাপড়া গরুটার কাছে ঠাঁই দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে ঘামে ব্যাজবেজে মুখটা মুছছিল। আসান আর কাশেম অন্য গরুগুলোকে ‘হাট’ ‘হাট’ ‘ঘুর’ ‘ঘুর’ করে খেঁদিয়ে একজায়গায় জড়ো করছিল। তারা পাবলিকের ভেতরে ফুঁসতে থাকা রাগটাকে কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি। কেনই বা আন্দাজ করবে? গরু তো তাদের কাটা পড়েছে। ক্ষতি তো তাদের। দোষ তো ট্রাকের ড্রাইভারের। সেইই তো কোথা থেকে ‘হুস’ করে এসে তাদের গরুকে চাপা দিয়ে মেরে দিল। কাদের তো পারলে গলা ফাটিয়ে কাঁদে। বলদটা তার খুউব পছন্দের ছিল। দলদলে শরীর। হরিণের শিঙের মতো বাঁকা শিং। দেড় মানুষ লম্বা গড়ন। বিহনি গাঁথা চুলের মতো দোহারা লেজ। লেজের মাথায় কাশফুলের মতো গোছা চুল। কুলকুল নদীর মতো নীল চোখ। সুল্লুকপাহাড়ের হাটে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো গরু ছিল। গোটা হাটের ব্যাপারিদের নজর সরছিল না বলদটার গা থেকে।

কথাটা প্রথম কানে আসে আসানের, ভীড়ের মধ্যে থেকে কে যেন গেংড়িয়ে বলে উঠল, “এভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গোহত্যা মেনে নেওয়া যায় না। “ব্যাস, কথাটা আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করল। মুহূর্তে হুলুস্থুল বেঁধে গেল। অবস্থা বেগতিক বুঝে আসান আর কাশেম সুড়সুড় করে ভীড় থেকে বেরিয়ে পরনের লুঙ্গি গুটিয়ে ধিকধিক করে চলা একটা দূরপাল্লার বাসে পাই পাই করে দৌড়ে উঠে পড়ল। আসান বাসের ভেতর থেকেও গলা ফাটিয়ে ছিল, “কাদের, পালা, পালা। “কাদের তখন তার খুটোল চোখ দিয়ে আনমনে ড্যাবড্যাব করে মড়া গরুটাকে দেখছিল আর মনে মনে ডুকরে উঠছিল। সে গরু হাঁটানোর সামান্য মুনিষখরচের রাখাল হলেও গরুর প্রতি তার অসম্ভব মায়া। দরদ।

দুই

হাতে বল্লম লাঠি ত্রিশূল নিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে দিতে গোটা মাঠ দিয়ে লোকজন ছুটছে! কাদের পেছনদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্রের স্রোতের মতো লোকজনকে ধেয়ে আসতে দেখে ভয়ে আরও আঁতকে উঠল। আরও একটু জোর দৌড়তে গিয়ে মাটির ঢিবিতে হুঁচোট লেগে ধানের আঁলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গা-গতর কাদা-মাটিতে লেপ্টে গেল। ভেজা আঁল। ভুষভুষে ধরে আছে।

মাঠলাগোয়া মাটির দোতলা বাড়িটার কান্টায় পৌঁছে তাড়া খাওয়া নেড়িকুত্তার মতো হাঁপাতে লাগল। কাদেরের মাথা ঠক করল, বাড়ির ভিতর সাঁদানো ঠিক হবে না। এখানেই কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে, তারপর আন্ধার নেমে এলে লুকিয়ে চুপিয়ে কেটে পড়তে হবে। লালমাটির গাঁথনির লালচে রঙ করা বাড়িটার পেছনেই গুচ্চের জলের আলগা পাইপ লাটমারা। মনে হয় গ্রামটায় জলের পাইপলাইনের কাজ চলছে। কাদের একটা হাড়ামুখো পাইপের ভেতরে গুটিসুটি মেরে সেঁদিয়ে গেল!

আচমকা ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ শব্দ কানে এল কাদেরের। আঁতকে উঠল কাদের। চোখজোড়া বড় বড় করে দেখল, একটা মদ্দা কুত্তা পাইপের অন্য মুখে গুটিয়েসুটিয়ে বসে আছে। পড়ন্ত বিকেলের টেরাকাটা হলদে ফালি রোদে ঘুলঘুলি মারছে কুকুরটার নাদুস নুদুস শরীর। গায়ের রঙ কটা লাল। গায়ে খোচা খোচা লোম। পান পাতার মতো কানগুলো খড় খড় করছে। তাকে লুকোতে দেখেই ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করে উঠল। কাদের দুরুদুরু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, চুপ, চুপ। কুকুরটা চুপ করা তো দূরের কথা, আরও জোরে ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করে উঠল । কাদের ভয় পেয়ে গেল, শালা কুত্তাটার লেগেই তো ওরা আমাকে ধরে ফেলবে! সে এবার চোখ ফেঁড়ে হাত দিয়ে ঘুষি চুকালো। কিন্তু নাহ, কিছুতেই কিছু না, কুকুরটা করাতের মতো মুখ ফেঁড়ে হ্যাড়া দাঁত বের করে আরও জোরে ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করতে লাগল। কাদের ভাবল, পান্ঠিটা মাঠে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই মস্ত বড় ভুলই হয়েছে, পান্ঠিটা সঙ্গে থাকলে কুত্তাটাকে দু ঘা মেরে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতাম। আসলে কাদের ভেবেছিল, হাতে গরু খ্যাদানোর পান্ঠি থাকলে পরে লোকে সহজেই তাকে চিনে ফেলবে, তাকে কাটা গরুর ব্যাপারি বলে সহজেই ধরে ফেলবে, তাই সে ধানের জমিতে পান্ঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কাদের এবার জিভ আর ঠোঁট দিয়ে ‘চু’ ‘চু’ করে আদর ছুঁড়ল। এবার ওষুধে কাজ হল। কুকুরটা মুখে শব্দ না করে লেজ নাড়তে লাগল। ঢেঁড়সফালি চোখ দিয়ে টসটস করে তাকাতে লাগল। কাদেরের ধুকপুকানির পারদটা চুই চুই করে নামতে লাগল। সে এবার পাইপের ধারে ঝুলতে থাকা তার পা দুটোকে পাইপের ভেতরে সড়সড় করে ঢুকিয়ে নিল । আর তক্ষনি দুদ্দাড় করা ‘ধপ’ ‘ধপ’ শব্দ তার কানে বাজল! ধুকপুকানিটা আবারও চড় চড় করে ওপরে উঠতে লাগল। সে কান পেতে জরিপ করল, লোকজন দড়বড় করে ছুটছে। সে শামুকের মতো ঘাপটি মেরে গেল। তাকে নড়তে দেখেই কুকুরটা আবারও ‘ঘেউ’ করে উঠল! কুকুরের ‘ঘেউ’ শব্দটা তার হৃদপিণ্ডের কব্জিতে গিয়ে ‘দুম’ করে হাতুড়ের মতো ঘা মারল! কাদের এবার ক্যাউম্যাউ করে হাত জড়ো করে কুকুরটাকে চুপ করতে বলল। কিন্তু শুনলে তো, কুত্তাটাও গা গড়া দিতে দিতে কাঁইকুই করে উঠল। কাদেরের শিরদাঁড়া দিয়ে আতঙ্কের হিমশীতল স্রোত বইয়ে যেতে লাগল। এবার আর রেহাই নাই! শালা কুত্তাটার লেগেই লোকে জেনে যাবে, তাকে ‘খপ’ করে ধরে পড়পড় করে টেনে পাইপ থেকে বের করবে। তারপর তার গদ্দন কেটে দুগলা পাতলা শরীরটাকে দুভাগ করে দেবে! তার কাটা মুণ্ডুটাকে নিয়ে কেউকেউ ফুটবল খেলবে! তার চামটা পেটে ত্রিশূল ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেবে!

কাদের ঘেমে জুবুথুবু। চিবুক দিয়ে টসটস করে ঘাম চুইয়ে পড়ছে। চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে ‘দ’ হয়ে পাদুটো ভাঁজ করে পেটের সাথে সেটে পাইপের দেওয়ালে হেলান দিয়ে কুঁকড়ি-মুকড়ি হয়ে বসে আছে। আচমকা তার তলপকেট থেকে মোবাইলটা ‘গ’ করে গেয়ে উঠল! একটা পুরোনো দিনের রংটাপ্পা হিন্দি গানের রিমিক্স। মোবাইলটা একটা নীলরঙা সরু ফিতে দিয়ে বেঁধে পরনের জামার ভিতর পকেটে রাখা আছে। ফিতেটা গলায় পুরা আছে, যাতে করে দৌড়নোর সময় পকেট থেকে ছিটকে পড়ে না যায়। কারণ গরু হাঁটানোর সময় তাদেরকে মাঝেমধ্যেই দৌড়তে হয়। আঁতকে উঠল কাদের! মোবাইলের গানটার গন্ধ পেয়ে কুকুরটাও সুর করে ‘ক্যাউ’ করে উঠল! তড়িঘড়ি মোবাইলটা তলপকেট থেকে বের করে ‘কচ’ করে কেটে দিল কাদের। আসান ফোন করেছিল। কাদের ভাবল, মোবাইলটা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো, তা নাহলে আবারও ‘দুম’ করে কখন বেজে উঠবে। সে লাল বাটমটা জোরে চেপে ধরে স্যুইচঅফ করে দিল। সাধারণ মানের কিবোর্ড লাগানো মোবাইল। যেমনি স্যুইচঅফ করে দিয়েছে কাদের অমনি ‘গ’ করে একটা বাজখাই টোন গেংড়িয়ে উঠল! কাদেরের পিলে চমকে উঠল! তার খেয়াল ছিল না যে মোবাইলটা বন্ধ করলে এমন জোর শব্দ করে ওঠে। কুকুরটাও ধড়ফড় করে নড়ে ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করে উঠল। কাদের কুকুরটাকে থামানোর জন্য পাদুটো সাট করে পাইপে ঘষে ‘খস’ ‘খস’ করতে লাগল। হাতের আঙ্গুল নাড়িয়ে ইশারায় ‘থাম’ ‘থাম’ করতে লাগল। কুকুরটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিম মেরে গেল। সেও জিভ দিয়ে কিছুক্ষণ পাইপ চাটল। তারপর একহাত জিভ বার করে ধুঁকাতে ধুঁকাতে লালা ফেলতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর কুকুরটা ‘খপ’ ‘খপ’ করে উঠল। কাদের আলগোছে ঘাড় কাত করে দেখল, কুকুরটা তার গায়ে বসা একটা মাছিকে খাওয়ার জন্য মুখ হাঁ করে ‘খপ’ ‘খপ’ করে ধরার চেষ্টা করছে। বেকায়দায় পড়ে যাওয়া কাদের ভাবল, কুকুরটা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে পরে বাঁচে, একটু জান ভরে শ্বাস নেবে, হাত-পা ছড়িয়ে একটু গা জুড়াবে, কিন্তু কুত্তাটা পালানোর তো দূরের কথা, আশমোড়া দিয়ে বসল! ‘ছপ’ ‘ছপ’ করে নিজের জিভ দিয়ে নিজের শরীর চাটতে লাগল। কাদেরের বিড়ির নেশা চেপে বসল। সে এমনিতেই বিড়িখোর লোক। দিন-রাত মিলে চার বাণ্ডিল বিড়ি লাগে। তার মাথা ঠকঠক করল, বিড়িগুলান আছে না দৌড়ানোর সময় পড়ে গেছে? সে প্রথমে বিড়িগুলো লুঙ্গির ভাঁজে আছে কি না জানার জন্যে লুঙ্গির গিঁটটা আলতো টিপল। মিহি করে খড়মড় শব্দ হল। নাহ, পড়েনি, আছে। কথাগুলি মনে মনে বলেই লুঙ্গির গিঁটটা আলগোছে খুলল কাদের। আধপ্যাকেট বিড়ি, তারমধ্যে বিশিরভাগ ভেঙে মুচড়ে গেছে। ভাঙা বিড়ির মশলাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা পাকিয়ে গেছে। কাদের একটা গোটা বিড়ি ঝাড়া দিয়ে মুখে দিতে গিয়ে ভাবল, নাহ থাক, এখন বিড়ি খাওয়া ঠিক হবে না, বিড়ির ধোঁয়া বেরোলে কেউ তার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। কিন্তু তার নেশাটা আরও চেপে বসল। আধঘণ্টা অন্তর অন্তর যার বিড়ি ফুঁকা অভ্যাস, সে টানা দু-ঘণ্টা বিড়ি ছাড়া কী করে থাকবে? কিছুক্ষণ দোটানায় ভুগার পর বিড়িটা ধরিয়েই ফেলল কাদের। লাইটারটা লুঙ্গির অন্য গিঁটে জড়ানো ছিল। ‘ফিক’ করে লাইটারটার আগুনের শলাকাটা জ্বলে ওঠায়, মুহূর্তে আলো-ছায়ায় ঘেরা পাইপের ভেতরটা আলো হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা ‘ঘেউ’ করে উঠল। তারপর আবারও ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসায় কুকুরটা চুপ মেরে গেল। অন্ধকার সুড়ঙ্গে কাদেরের হাতের জ্বলন্ত বিড়িটা নক্ষত্রের মতো টিপটিপ করে জ্বলছে। কাদের যখন ‘সুড়ুত’ করে ফুঁকে সুখটান দিচ্ছে তখন আলোটা কটকট করে তার তেজ বাড়াচ্ছে। সুখটান দিতে দিতে কাদেরের বাড়ির কথা মনে পড়ল। আরও একটা জিনিস ভেবে ফুঁপিয়ে উঠল কাদের, তার মরহুম বাপ বলেছিলেন, মানুষ মরার আগে নাকি তার আপনজনের কথা বড্ড মনে পরে। কাদেরের মাথা পাক মারল, তবে কি তার মৃত্যু দোরগোড়ায় চলে এসেছে! তাকে এভাবে ছিড়খালি করেই মরতে হবে?

আচমকা একটা থুত্থুরে আওয়াজ ভেসে আসলো! ‘তু’ ‘তু’ করে কেউ একজন কুকুরটাকে ডাকছেন। সঙ্গে কানে বাজল পায়ে হাঁটার ‘গড’ ‘গড’ শব্ ! মেয়েটি পাইপের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছেন। ডাকটা শুনেই কুকুরটা ‘ক্যাউ’ ‘ক্যাউ’ শব্দ করে ধড়ফড় করে পাইপটা থেকে বেরিয়ে গেল। কাদের একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, যাক বাঁচা গেল, শালা কুত্তাটা তো এখান থেকে বেরোল! তার দুশ্চিন্তার ছোপমাখা গালে আলতো করে খুসির চিরিক মারল। কাদের অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে তার ঢ্যালা চোখ বার করে মিটমিট করে দেখল, দুটো পা পাইপটা থেকে আক আঁচল দূরে গিয়ে থির দাঁড়িয়ে ‘লে’ ‘তু লে’ ‘লে’ করছেন। কাদের ভাবল, এ বাড়ির কোন বুড়ি মেয়ে কুকুরটার জন্য খাবার টাবার এনেছেন। সে আরও ঘাপটি মেরে থাকল, কোনভাবেই যেন তার উপস্থিতি টের না পান। কিন্তু ফ্যাসাদ বাঁধালো কুকুরটা। সে খাবারের কাছে না গিয়ে পাইপের যে মুখটায় কাদের লুকিয়ে আছে সেখানে ঘুরেফিরে এসে ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করতে লাগল! লেজ খাড়া করে ‘ক্যাউ’ ‘ক্যাউ’ করছে! কাদেরের ভিতরটা ধড়াক করে উঠল! কপালে ছোপ ছোপ ঘাম। হৃদস্পন্দন সুনামির ঢেউএর মতো উথালপাথাল করছে। মুখটা শুকিয়ে আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে ভাবল, আর রেহাই নাই, মৃত্যু এবার নিশ্চিত, আল্লার খাতায় নিশ্চয় তার মরণের উপর শিলমোহর পড়ে গেছে! আজরাইল নিশ্চয় তার আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন! কাদের ‘আল্লা’ ‘আল্লা’ করে যেটুকু দোয়া-কালমা জানে তা মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগল।

বুড়ি মেয়েটার মাথায় খটকা বাঁধল, কুকুরটা ওখানে গিয়ে কেন ‘ক্যাউ’ ‘ক্যাউ’ করছে? ওখানে কি কিছু আছে? তিনি ভাতের থালাটা উঁচু ঢিবিটায় রেখে পা টিপে টিপে পাইপটার দিকে এগোতে থাকলেন। বৃদ্ধা থুত্থুরে বুড়ি। চামড়া ভাঁজ পড়ে ভাঁজ পড়ে গামের আঠার মতো ঝুলে গেছে। চামটা খড়িশরীর। পরনে সাদা থান। গায়ে ব্লাউজ নেই। টুস্কা পড়া ঠোঙার মতো মোচড়ানো স্তনদুটো পেটের সাথে চেপ্টে লেগে আছে।

কাদের খেয়াল করল, থপ থপ শব্দটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে আরও নিজেকে ন্যাকড়ার মতো হেচিয়ে পেচিয়ে পাইপের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করল। পাইপের ভেতরে সড় সড় শব্দ হতে লাগল। তারপর একসময় বাইরের থপ থপ শব্দটা থেমে গেল। কাদের তার জড়ো করা দুই হাঁটু আলতো করে ফাঁক করে দেখল, দুটো ঘোলাটে চোখ পাইপের মুখে জ্বলজ্বল করছে।

বৃদ্ধা প্রথমে ভেবেছিলেন, কোন কুকুরটুকুর হবে, কোন কুকুর থাকার জন্যেই হয়ত ওই কুকুরটা ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করছিল।

কিন্তু পিঠ কুঁজো করে ছাপুর হয়ে যখন পাইপের ভেতরের ঝাপসা অন্ধকারে দৃষ্টি ফেললেন, তখন তার ভুল ভাঙল। এ তো আস্ত একটা মানুষ! তারপর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় খেলল, এ নিশ্চয় সেই লোক যাকে হন্যে হয়ে গাঁয়ের লোক খুঁজছে, যে লোকটি গোহত্যা করে পালিয়ে এসেছে।

“কে এখানে ?”

কন্ঠটা শুনেই পিলেটা চমকে উঠল কাদেরের! কাদের কোন উত্তর করল না। ঘাপটি মেরে থাকল। বুড়ি মেয়েটি এবার গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “বাইরে বেরিয়ে আসো, কুনু ভয় নাই।”

কাদেরের বুড়ির কথায় বিশ্বাস হল না। ভাবল, এখন আদর করে ডাকছেন, পরে ঠিকই গদ্দন কেটে নেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, বিশ্বাস না করেই বা উপায় কি, দেখে যখন ফেলেছেন তখন আর লুকিয়ে থেকে লাভ কি, নিজে থেকে না বেরোলে লোক ডেকে পড়পড় করে টেনে বার করবেন। অগত্যা কাদের ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বেরিয়ে এল। গোটা শরীরে মাকড়সার জাল আর ধুলোর ঝুল লেগে বিচ্ছিরি অবস্থা। চুলগুলো ধুলো আর ঝুলে সাদা হয়ে গেছে। ভয়ে শুকনো কাঠ মুখটা ঝুঝকি অন্ধকারে যেন সাদা ভুত। থত্থর করে কাঁপছে কাদের। চোখে-মুখে আকুতি, আমাকে ছেড়ে দাও, আমার কোন দোষ নাই, আমার বাড়িতে ছেলেপিলে আছে, বৌ-বাচ্চা আছে, আমাকে ছেড়ে দাও।

বৃদ্ধা ধিকধিক করে বলল, “দ্যাখো বাবা, তোমার কুনু ভয় নাই, এখানে অন্য কুনু লোক নাই।“

বুড়ির কথায় কাদেরের ধুকধুক করতে থাকা জানটা ‘পিট’ করে জ্বলে উঠল। সে কোন কথা না বলে ফ্যালফ্যাল করে বৃদ্ধাটার মুখের পানে চেয়ে থাকল। বৃদ্ধা ফিসফিস করে বলতে থাকলেন, “আমরা হলেম একই দ্যাশের লোক। আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের কুনুদিন দেখিনি জাতপাত লিয়ে মারামারি করতে, আমাদের বাড়িতে, মাঠ-ঘাটে হেন্দু-মুসলমান সব জাতের লোক কাঁধে কাঁধ মিলে কাজ করেছে, মুসলমানপাড়ার আব্দুল, করিম ঘরামিরা না থাকলে আমাদের ঘরই ছাওয়া হত না, আমি হলেম বাপু ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভক্ত, ঠাকুরই তো বুলে গেছেন, ‘যত মত তত পথ’। তাহলে ক্যানো আবার ঠ্যাঙাঠেঙি, পিটাপিটি? তোমার বাবা কুনু ভয় নাই, আমি যা বুলছি কান করে শুনো ।“

“বুলুন মাসীমা, আমি শুনছি।“ ডানাকাটা ফড়িঙের হলহল করে কাঁপতে থাকা ডানার মতো কেঁপে উঠল কাদেরের কাঠশুকনো ঠোঁটগুলি। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে একটা জোরালো মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এল,

“কে গো মা, কার সাথে কথা বলছ?”

বৃদ্ধা গলা ফেড়ে বললেন, “কই? কেউ না তো, এই কুকুরটা ভাত খাতে চায়ছে না, তাই একটু বকাবকি করছি।“ তারপর গলাটা নামিয়ে ফুসুর ফুসুর করে বৃদ্ধা বললেন, “শোনো বাবা, তুমি কুনুসময় পুবদিক দিয়ে যাবা না, সুজা দক্ষিণদিক দিয়ে ডহরে নেমে যাবা, তারপর ডহর থেকে উঠে পুবদিকের রাস্তা ধরবা, কিছুক্ষণ গেলেই মেইন রাস্তা পেয়ে যাবা। ওখানে মেল্লা গাড়ি পেয়ে যাবা। যাও, যাও, আর দেরি করোনা, গডগড করে হেঁটে চলে যাও।“

কাদের আর কোন কথা বলল না। একবার ঝুঁকে বুড়িটাকে প্রণাম করল। কাদেরকে ঝুঁকতে দেখে, কুকুরটা খ্যারখেরে গলায় ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করে উঠল। কাদের এই প্রথম জীবনে কাউকে প্রণাম করল। তার এই প্রণামের মধ্যে দিয়েই যেন সমস্ত জাত, ধর্ম, হিংসা, বিভেদ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তার প্রণামের সাক্ষি থাকল, রাস্তার একটা কুকুর, একটা সজিনাগাছ, কিছু দুব্রোঘাস, আলো-ছায়ার সন্ধ্যারাত আর অফুরন্ত আকাশ।

কাদের বাড়ির আঁলটা ডিঙিয়ে সোজা মাঠের মধ্য দিয়ে নেমে গেল। পুবদিকের মাঠে তখনও টিপ টিপ করে কিছু আলো জ্বলছে। কিছু আলো দক্ষিণদিকেও মোড় নিচ্ছে। কাদের ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কুকুরটা তখনও সুর করে ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করেই যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত