| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

  মা তোমার আঁচলে হলুদের গন্ধ

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

আকাশ ফেটে রোদ্দুর অথবা বর্ষার মেঘে ভরা আকাশের অবিরাম বৃষ্টি সবটাতে একটাই কথা বলতে ইচ্ছে করতো, ‘মা গো, একটা গল্প শোনাবে?’ মায়ের সেই শাড়ির আঁচলটা পেছন থেকে ধরে সারাদিন এ ঘর, ও ঘর ঘুরে বেড়াতাম। যতক্ষণ না হেঁশেলের কাছটাতে থাকতো ততোক্ষণ মাটির দেওয়ালে হেলান দিয়ে শাড়ির আঁচলটা ধরে বসে বসে গতরাতে মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্প টা একটু রঙ চং মাখিয়ে এলোপাথাড়ি বলতেই থাকতাম। তখন সবে বয়স চার কি পাঁচে পড়েছে ।

আস্তে আস্তে বড় হচ্ছি। মায়ের কাছে শুনছি নানান রকম গল্প। সবে গল্পগুলোই জেন আমার ছেলে মানুষি দিয়ে লেখা। তবে এখন বুঝি গল্প গুলো ছিলো আমার মায়ের।

ছোটবেলায় বাবা একটা কাজের খোঁজে শহরে গিয়েছিলেন। তখন আমার আট মাস। সকালে মায়ের হাতের কচুরি এর পাবদার ঝোল খেয়ে বেড়িয়েছিলেন। সেই যে গেল এর এলো না। সেই দুঃখিনী মা আজো যেন বাবার অপেক্ষায় থাকে। অনেকেই বলেছিলো সেদিন, বাবাকে নাকি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরা ধরে নিয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে, পাকিস্তানীরা নাকি বাবাকে মেরে ফেলেছে। আর আমি বলতাম, ‘বাবা নিশ্চই একদিন আমায় দেখতে আসবে।’

মা আমাকে একা একাই বড় করে তুলেছে। আমি উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা সবে শুরু করেছিলাম। যখন আমি মাধ্যমিক দিচ্ছিলাম তখন মাঝে মাঝেই দেখতাম আমাদের বেলেঘাটাতে কদিন পর পর পাকিস্তানের সৈন্যরা এসে কাদেরকে যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মা কে বলতাম কেন ওই লোকগুলো আমাদের গ্রামের মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে। মা একটা কথাই শুধু বলতো,  ‘তোর ওগুলো জানতে হবে না। ওরা ভীষণ খারাপ।’

আমাদের বাড়িটা ছিলো বেলেঘাটার একেবেরে পূর্ব দিকে। আর আমি ছিলাম মায়ের একেবারে নেওটা ছেলে। আমার সারাদিনের অনুভুতিগুলো শোনার জন্য মা-ই ছিলো একমাত্র শ্রোতা। তাই মায়ের শেষ কথার পরে আমার আর কোন কথাই যেন সাজে না।

মাধ্যমিক দেওয়ার পরে একদিন বাজার থেকে ফিরবার পথে দেখলাম বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী মিলিটারি একটা জলপাই রঙের গাড়িতে করে আসছে। আমি একটু কৌতুহলী হয়ে তাদের পেছন পেছন গেলাম। তারা বাজারের শেষ প্রান্তে হরি কাকার চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। দেখলাম কয়েকজন সিগারেট ধরিয়ে সেটাতে টান দিয়ে কয়েকটা ধোঁয়ার রিং ছাড়ছে। তাদের মধ্যে একজন হরি কাকাকে জিজ্ঞেস করলো, তুম বাঙ্গালীকো সাপোর্ট করতে হো ইয়া পাকিস্তানকো সাপোর্ট করতে হো? হরি কাকার মুখটা যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। সে খানিকটা চিৎকারের সুরেই বলল “জয় বাংলা”।

আমি ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, ওই পাকিস্তানী একটা বন্দুক হরি কাকার পেটের নিচে রেখে সজোরে বলল ‘ফেরছে বোল হারাম খোর, বাঙ্গাল ইয়া ফের পাকিস্তান’। হরি কাকা চোক্ষ বন্ধ করে গলার সবটুকু জোড় দিয়ে বলল ‘জয় বাংলা’। ঠিক তখনি চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঠিক বাজ পড়ার মতো একটা আওয়াজ হলো আর আমি দেখলাম সামনে থাকা মিলিটারির হাতে থাকা বন্দুকের নল থেকে ধয়া বেরুচ্ছে আর কিছুক্ষন আগে যে মানুষটা সকলকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছিল, যেচে যেচে পান সাজিয়ে দিচ্ছিলো, সেই মানুষটার চর্বিওয়ালা উঁচু পেট ফুরে রক্ত বের হচ্ছে। গুলি। খুন। হত্যা? হত্যা! একদল মানুষ হত্যা করলো আর একটা মানুষকে! কিন্তু কেনো? জয় বাংলা বলেছে বলে! মিলিটারিরা চলে গেল। আমি দেখলাম, হরি কাকা চোখ মেলে চেয়ে আছে আকাষের দিকে। আজকের আকাশটা খুব স্বচ্ছ। তবে হরি কাকা সেটা আর উপলব্ধি করতে পারছে না। কাঠের পুতুলের মতন শুধু চেয়ে আছে। বাড়ি ফিরলাম। মা আমার বলল ওই জানোয়ারগুলোর কথা। মা বলল, ওরা মানুষকে যন্ত্রণা, অবিচার আর পরাধীনতার জালে বেধে ফেলছে। মা বলল, ওরা তোর বাবাকেও ছাড়ে নি। ওরা দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে বাবা। ওরা…।

মা কাঁদছে, এই প্রথমবার মাকে কাঁদতে দেখছি। বাবা চলে যাওয়ার সময় তো আমি খুব ছোট ছিলাম, তাই জানি না সেদিন মা কতটা কেঁদেছে। তবে এর পরে মা কখনোই বাবার কথা মনে পরলেও কাঁদেনি, তবে আজ কাঁদছে কেন! এতটাই যন্ত্রণা দিয়েছে কি ওড়া, যে মা আজ কাঁদছে!

উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম। এখন আমার ঊনিশ বছর। ঊনিশ বছরে আমি অনেক কিছু দেখেছি। জানুয়ারির দিকটায় মা কে নিয়ে বীষ্ববীডয়ালোয়ে ভোড়ড়টীড় শোব কাজ শেষ করে ফেলি। এর মাঝে অনেক বন্ধুই জুটে গেছে। আর চারদিকে এখন শুধু ওই পাকবাহিনীর অত্যাচারের খবরই শুনতে পাই। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মানুষ মরছে, কার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে ,কোন বাড়ির মেয়েকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে, কারো বাবা, কারো মামা, চাচা, ফুফার,রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে।

দিন জতই যাচ্ছে বাংলার ছেরেরা ফুঁসে উঠছে। তারপর একদিন শুনলাম ঢাকার রেস্কোর্স ময়দানে শেখ মুজিব নাকি ভাষণ দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কয়েকটা ছাত্রলীগের গ্রুপ সেই মিছিলে নেমেছে। তারা সেদিনের অপেক্ষাতে ছিলো। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, ‘মা বলল, বাংলার নেতা ভাষণ দেবে। বাংলার মাটিতে আবার যেন সোনা ফলে সে জন্য আমার যেতে হবে মা। মা গো তুমি চাওনা তোমার ছেলে দেশকে রক্ষা করুক?’ মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো আমার মুখের দিকে। তারপর হলুদের গুড়োলাগা শাড়ির আঁচলটা টেনে আমার বুকে বুলাতে বুলাতে বলল, “তুই খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না!” আমি মাকে দু-বাহুতে জড়িয়ে বললাম, “মা সংগ্রামের চেতনা যে আমাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার হাতের তালুটা ঐ রক্ত মাখা জানোয়ার পিশাচদের মাথার খুলি চাচ্ছে ।আমার দৃষ্টি যে ওই বুটের দাগের ওপর লেগে থাকা রক্তের দাগগুলোর দিকে চলে যাচ্ছে। তোমার খোকাকে বড় হতে হবে মা। তুমি চাও না, তোমার খোকা অম্লান বদনে রনক্ষেত্রে যুদ্ধ করুক!”

মা’র চোখ ছলছল করে উঠছিল, সামনে নিয়ে বলল, “আজকাল অনেক কিছুই ভাবছিস তুই কবির। আমি তো তোর মুখের ওই ছট ছোট দাড়িগুলো দেখেই বললাম বড় হওয়ার কথাটা।”

আমি মায়ের কাছে আগে কখনো এতো লজ্জা পাই নি। ফীক করে একটু হেসেই ফেললাম বটে। মাও হলুদের গুড়োলাগা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মুখ চেপে হাসতে লাগলো।

৭ই মার্চ ১৯৭১। ঢাকার রেস্কোর্স লক্ষ লক্ষ জনতার ভীর । শিশু বৃদ্ধ থেকে শুরু করে হাজার মানুষ এসেছে এই মঞ্চে দাঁড়ানো মহান নেতার কিছু কথা শোনার জন্য। একবারের জন্যে আমার মনে হয়েছিলো, মাকে যদি আনতাম…।

১১ই মার্চ ১৯৭১। বিকেল তা ছিলো এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্মদাতা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধুকে নিয়ে ঢাকার মিরপুর এগার নম্বরে গিয়েছিলাম। শুনেছি গতকাল এখানে ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে। তাই বন্ধুরা মিলে একটু দেখে আসতে যাই। যে দৃশ্যটা দেখেছিলাম, তা এখন চোখের ভিতরে প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা আর ধমনীর ভেতর ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। দেখেছি, মিরপুর ছাত্র শিবিরের পারে আছে কত মায়ের সন্তান। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পঁচা-গলা মাংসের গন্ধ। কোথাও কোথাও তখনো ধোয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে আকাশের দিকে ছুটছে। পেছনে লাশ, সামনে লাশ, বা দিকে লাশ, ডান দিকে লাশ। লাশের বাজার করে রেখে গেছেওই দানবের বাচ্চাগুলো। কোথাও কারো হাত কারো কাটা পা ,কারো কাধের অংশটা ,কারো নখগুলো তুলে ফেলা, কারও হাতের আঙ্গুল কারো এটা কারো ওটা পড়েই আছে। দেখলাম ড্রেনের মধ্যে মাথা ডুবানো অবস্থায় পড়ে আছে একটি মেয়ে।শরীরে তাঁর বস্ত্র নেই। স্পস্টভাবেই দেখতে পেয়েছি তাঁর শরীরের খত। এক্টু দূরেই পড়ে আছে একটা বুড়ো, পাশে ভাঙ্গা চশমা।কাঁচটা দারুণভাবে ভেঙ্গে গেছে। হয়তো তিনি এখানকার দারোয়ান। দেখলাম শিবিরের ভেতরে ভাঙ্গা কাঁচে রক্ত দিয়ে লেখা, ‘জয় বাংলা’। দেখলাম সিঁড়িগুলো রক্তে ভরা। হয়ত গুলিখেয়ে নামার সময় রক্ত গুলো ঝরে ঝরে পড়েছে। বিশাল একটা হলঘরে গেলাম, চারিদিকে গলিত রক্তের শুকিয়ে জওয়া কালো দাগ, সেই দাগের মাঝে ওই হারামীর বাচ্চাদের বুটের দাগ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। জানালার রডগুলোতে কয়েকগোছে চুল দেখতে পেলাম। হয়তো কোন মেয়ের চুলদিয়ে রডটা পেঁচিয়েছে। সৃশংসতার আর কিছু দেখার বাকী রয়েছে কী!

বিশাল একটা আকাশের নিচে একদল মানুষকে নাকি সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। যদি সেই সেরা জিনিস্টাই একজন একজনকে বিলুপ্ত করার নেশায় মত্ত থাকে তাহলে সেরা জীব জিনিসটা সম্পর্কে আমি সত্যিই অজ্ঞ। নিজেকে নিজে শপথ করলাম, এই ভিনদেশি হিংস্র জানোয়ারগুলোকে লাখো মায়ের শহীদ সন্তানদের পক্ষ হতে আমি নিশ্চই জবাব দিতে পারবো।

১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১। গত দু মাসে দুটো মুক্তিবাহিনীরপক্ষ থেকে ছ-সাতটি পাকিস্তানি ক্যাম্প উড়িয়ে দিয়েছে। এতে ওরা আমাদের ওপর আরো খেপে গিয়েছিলো এবং উত্তেজনার জন্য নির্বোধ পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের আওতায় বন্দি অবস্থায় ছিল বেশ কিছুদিন ।এর মাঝে খুব কম মায়ের সাথে দেখা হয়েছে। মাঝে মাঝে আমার আরো কিছু সহযোদ্ধাদের নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের বেলেঘাটার বাড়িটাতে। মা আমাকে ওসব পোশাকে আর দাড়িতে দেখে ছলছলে চোখে মাথায় হাত দিয়ে সূরা পড়ে বুকে ফুঁ দিচ্ছিলো। বলছিলো, ‘বাবা খাচ্ছিস তো ঠিক মত? কী দিচ্ছে ওখানে তোদের? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে কী! কি খাবি বল। আমি রান্না করবো। তোর জন্য চালতার আচার করে বয়াম ভরে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই আসছিলি না। আজ আমার হাতে আচার খাবি?এমা! তোর চুলগুলো এত বড় হয়েছে কী করে…আরও কত্ত কী!

গতকাল এলিফেন্ট রোডের শরনার্থী শিবিরে ওই পাক বাহিনীরা আক্রমণ চালালে আমাদের মুক্তিফৌজের দলটা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। আর সেই গুলিবর্ষণে ওই কাদার নিচে থাকা অবস্থাতেই আমার ডান পায়ে একটা গুলি লাগে। কিন্তু পাকবাহিনীর লোক আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। আমাকে গিজ্ঞেস করে, আমার সহকর্মী বন্ধুরা আর কোথায় কোথায় আক্রমণ চালাবে। আমি গুলি খাওয়া অবস্থাতেই ওদের মুখে থু থু দিয়ে বলি, কেনো ভয় পাচ্ছিস? ভয় পাচ্ছিস হারামির বাচ্চারা? সাথে সাথে বেয়নটের একটা তীব্র আঘাত আমার মাথায় লাগে। আমি পায়ে হাতটা চেপে ধরে রক্ত থামাতে চাই আর মাথাটা সামান্য কাত করে বলি, বাংলার মায়েরা ঘরে ঘরে প্রার্থনা করছে। সোনার বাংলায় সোনা আবার ফলবে। আর তোদের মত কিছু পোকাদের নিধনের জন্য বাংলার ছেলেরা মাঠে নেমেছে। কতক্ষণ বেয়নটের খোঁচা মেরে থামিয়ে রাখবি। কতক্ষণ গুলিবর্ষণ করবি, এগিয়ে আসছে তারা … জয় বাংলা …।

আমি জ্ঞান হারাই। সকালে (১২ সেপ্টেম্বর) ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি কারাগারে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। দু মাস আগে মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো। মা লাল লাল টমেটো দিয়ে রুই মাছের ঝোল রেধেছিলো। খাওয়া শেষে হলুদের গুড়োলেগে থাকা শাড়ির আঁচল টা দিয়ে আমার মুখ মুছে দিয়েছিলো। বড্ড মনে পডছে। আর দেখলাম আমার চোখে পানি…।

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। চার মাস হয়ে গেছে। মায়ের কোন খবর নেই। আমি এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। মায়ের কোন খোঁজ নিতে পারি নি। দেশের অবস্থাও জানি না। হঠাৎ বিকেলের দিকে একজন এসে বলল, আমার মা এসেছেন। মা কে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু জানি না কেনো মা এসেছে, শোনার পড় ভয় হতে লাগলো। ভাবতে লাগলাম ‘মা সহ্য করবে কি করে আমার পরিনতি! ততদিনে আমার শরীরে অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন। রোজ রোজ কেউ না কেউ এসে পিটিয়ে যাচ্ছে। একটাই কথা, আমার সহকর্মীরা কোথায়। বলি নি। বলব কী করে! তারা তো আমার মায়ের মতই কোন মায়ের একটি মাত্র ছেলে।

মাকে আনা হল। তবে ভিতরে আসতে দিলো না। একটু দূরে দারিয়ে ছিলো। প্রথমটাতে মা শুধু তাকিয়েই ছিলো আমার দিকে। ভেবেছিলাম, তাঁর চোখ বুঝি ছলছল করছে। কিন্তু না! আজকের মা’টা খুব ভিন্ন। আজকের মা প্রতিদিনের সেই করুনাময়ী মা নন!। আজকের মা জ্বলন্ত শিখার একটা বিশাল উল্কা। চোখে তাঁর কী অসামান্য দীপ্তি। মা বলল, তুই ভালো আছিস? আমি কেঁদে ফেল্লাম। মা কাঁদল না। কারণ মা জানে আজ মাই আমার একমাত্র প্রেরণা।

মা বলল, কী খেয়েছিস? আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, শুকনো রুটি আর…আর…বাতাসা। মা আমার হাতে পড়ানো শিকলটা ধরে বলল, ‘সব সময় কি পড়ানো থাকে?’ আমি বললাম, শুধু খাওয়ার সময় খুলে দেয়। ‘মা বলল, ভাত খাবি?’ আমি আর পারছিলাম না। বললাম …মা … মা গো …ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার মা। ওরা ঠিক মতন খেতে দিচ্ছে না। খুব মারছে। দেখ মা, রক্তের দাগগুলো এখনো শুকিয়ে আছে…আমি খুব একটা চাপা আর্তনাদ করে বসে পড়লাম। মা এগিয়ে এসে একটা টিফিন বক্স এগিয়ে দিলো। আমি নিলাম গেটের ফাঁকা দিয়ে। আস্তে আস্তে খুল্লাম। মা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গরম ভাত এনেছে মা। বক্স খুলতেই ধোয়ে বেরুতে লাগল। কতদিন পর ভাতের গন্ধ পেলাম। একজন এসে মাকে বলল ‘টাইমস আপ’, আব আপ যা সাকতে হে। মা চলে জাচ্ছিলো। আমার খাওয়াটা দেখতে পারলো না। আমি পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে বললাম…

‘মা তোমার আচলে হলুদের গুড়ো’

মা বলল, আজ আর তোর মুখটা মুছে দিতে পারবো না খোকা। তবে দেশ স্বাধীন হবে। আমার খোকা আসবে আমার কাছে। হলুদের গুড়ো লাগানো আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছে দিবো আমি তোর খোকা।

আমি চিৎকার করে মাগো মাগো বলছিলাম। মা একবারো কাঁদে নি। আমি এখনো কারাগারে। হতে পারে কালই আমাকে ফাঁসি দিতে পারে। জলদি আমায় গরম ভাতটা খেতে হবে। জলদি। মায়ের হাতের গরম ভাত।ধোয়া ওড়া গরম ভাত। জলদি খেতে হবে।

মা, তুমি ভালো থেকো। আমি ঠিক আসবো, হলুদের গুড়োলাগা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছতে।

প্রচ্ছদ: অব্যয় আত্মদীপ
নালন্দা
বয়স: ৪

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত