প্যান্থিওন সভাকক্ষে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা! সেখানে শ্বেত পাথরের মেঝের উপর প্রকান্ড বড় একটি ফুলদানি। সেই ফুলদানিতে শোভা পাচ্ছে নানা রং এর মৌসুমী ফুল। সেই ফুলের ঘ্রাণে গোটা সভাকক্ষ মৌ মৌ করছে। ফুলদানি থেকে একটা গোলাপ তুলে নিলেন মহারাজা জিউস। কিন্তু তার আজ মন মেজাজ খুবই খারাপ। গোলাপটা কিছুক্ষণ নাকে ঘষে সংগে সংগে ছুড়ে ফেলে দিলেন সাদা ফকফকে শ্বেত পাথরের মেঝের উপর। মেজাজ খারাপ থাকলে জিউসের কোন হুস জ্ঞান থাকে না। মুখে যাই আসে তাই বলতে থাকেন। কখনো পাগলের মত পায়চারি করছেন, কখনো সভার এক পাশ থেকে আরেক পাশে হাঁটছেন আর নিজেই কিছুক্ষন পর পর খেঁকিয়ে উঠছেন। হাতে তার ঝুলে আছে নতুন কেনা আইফোন। সেটার উপর চোখ রেখেই এবার তিনি ধৈর্য হারা হয়ে গেলেন। চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
”শালা থানাটোস কই? সাভার থিকা ঢাকায় আইতে এতক্ষণ লাগে?
”সভা কক্ষের এক কোনায় চুপ করে বসে থাকা এক সভাসদ মিউ মিউ করে বললেন, “ জাহাপনা জিউস! আমার মনে হয় থানাটোস ট্রাফিক জ্যামে আটকা পরেছেন। লকডাউন শিথিল করার এই হল ফল! মানুষ সব রাস্তায়! তাই হয়তো দেরি হচ্ছে!
চুপ! জিউস খেঁকিয়ে উঠলেন। কথাটা বলতে লজ্জা লাগছে না তোমার? ট্র্যাফিক জ্যামে পরে দেরি করে ফেলছেন? কই, সেতো তার মোবাইলটাও অফ করে রেখেছে? আমি হলাম মহা শক্তিশালী রাজা জিউস! আর সে কিনা আমার কল ধরে না? এত বড় সাহস! আমি থানাটোসের ব্যাপারে আগেই সন্দিহান ছিলাম। নিশ্চয়ই সে এই করোনা মহামারির সময়ে মদ খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কোন কাজকর্ম করে না। করলে প্রতিদিন মাত্র ৮জন ১০ দশজন মানুষ মারা যায়? খামোখাই ওকে আমি যমদূত মন্ত্রী বানিয়েছি। হায় কপাল আমার! আমি ওকে অর্ডার দিলাম প্রতিদিন যাতে গড়ে হাজার খানেক অন্তত মানুষের জান কবচ করতে পারে! আর কিসের মধ্যে কী? হাজারতো দূরের কথা সংখ্যায় দেখি সেটা ১০০ এর মধ্যেও নাই!
জিউস এমন চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতেই প্যান্থিওন সভাকক্ষের বিশাল গথিক দরজা ভেঙে হাসফাস করে ঘরে ঢুকলো থানাটোস। ঘরে ঢুকতেই থানাটোসের গা থেকে মদের ভুসভাস একটা পচা গন্ধ বের হয়ে এল! বেশ বোঝাই যাচ্ছে সে অর্ধ মাতাল। রাজা জিউসের সামনে এসেই সে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
”কিরে থানাটোস! এই তোর আসা! বলি আমার রাজ্যে হচ্ছেটা কী? আমি কিনা দুধ কলা দিয়া সাপ পুষছি?” জিউস রেগে গেলে আর হুস থাকে না। মুখে যা আসে তাই বলতে থাকে। রেগে গেলে সে কখনো তুই আবার কখনো তুমি বলতে থাকে।
”স্যার, রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। বিশ্বাস করেন হাতে অনেক কাজ। আসার আগেও দশ বরটার জান কবচ করছি। এই ধরেন গাজীপুরে ৫টা, কেরানীগঞ্জে ৩টা, ঢাকায় ৮টা আর এর মধ্যেই আপনার তলব। তাই একটু দেরি হয়ে গেল!
”চুপ থানাটোস! আবার চাপাবাজি! ন্যাকু আমার! আসার আগে জান কবচ করেছি!! বলি দিনে মাত্র দশটা বারটা জান কবজ করার জন্যে কি তোমারে আমি রাখছি! আমেরিকায় দিনে করোনায় মারা যায় তিন হাজার, ইংল্যান্ডে মারা যায় দেড় হাজার এমনকি পাশের দেশ ভারতেও মারা যায় শ দেড়েক। আর শালা তুমি কিনা মাত্র দশটার জান কবচ করেই হাপিয়ে উঠেছ? তোমার চাকরি আজ আমি খাব!
এবার থানাটোস একটু নড়েচড়ে বসল। করোনাকালে দুঃসময়ে যদি সাধের চাকরীটাও চলে যায় তাহলে তো মহা বিপদ! ভয়ে ভয়ে আবার সে কথা বলতে শুরু করল।
”স্যার, আমিতো আপনার গোলাম! আদেশ করেন। কার জান কবচ করতে হবে! এই অধম কে কেন আপনি স্মরণ করেছেন?”
এতক্ষণ মহারাজ জিউস যেন একটু ঠান্ডা হলো। শান্ত গলায় বললো-
”মন দিয়ে শোনো তাহলে। কানে তো অনেক কথাই আসছে। শুনতে পেলাম ঐ বেজন্মা সিসিফাসটা নাকি এজিন নামের একটা মাইয়ারে এটিকাসের একটা দ্বীপে লুকাইয়া রাখছে। তার বাবা এসোপাস তার মেয়েকে খুজে পাচ্ছে না। চিন্তা করতে পার? আমার দেশে এমন দিনেদুপুরে গুম! এমন পাপ আমার রাজ্যে? আরেকটা গুরুতর অভিযোগও আছে ঐ শালা সিসিফাসের বিরুদ্ধে। সে নাকি ইদানিং দেবতাদের গোপন খবরও ফাঁস করে দিচ্ছে। তলে তলে পৃথিবীর মানুষের সাথে এই কাহিনী? এতো দেখি মহা ষড়যন্ত্র! আমি ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। আমার রাজ্যে এমন শয়তানি আর বরদাস্ত করবো না। ঐ শয়তান সিসিফাসকে এক্ষনি ধইরা নিয়ে এসো। তার শাস্তি হবে ভয়াবহ!
”অর্ধমাতাল থানাটোস এবার মাথা দোলাতে দোলাতে রাজা জিউসের কথায় সায় দিল। হঠাৎ সে মাতলামির চোটে ফস করে বলে ফেললো, “স্যার। কিন্তু শুনলাম এই বাজে কাজটার হোতা নাকি আপনি নিজেই। রাস্তার মানুষজন এমনটাই বলাবলি করতাছে। মেয়েছেলের উপর আপনার এমনিতেই একটু বেশি পরিমানে দুর্বলতা আছে। সে খবর সবাই জানে। তারপর এজিন মেয়েটাও নাকি খুব সুন্দরী। আপনিই নাকি এজিনকে ঈগলের রূপ ধইরা অ্যাটিকার দ্বীপে লুকাইসেন। শুনলাম সিসিফাস নিজে কইছে এই কথা এজিনের বাপ এসোপাসকে।”
থানাটোস আরো কি যেন বলতে চাচ্ছিল। বেশ বোঝাই যাচ্ছে মাতলামির চোটে সে জিউসের সামনে কোন কথা বলবে আর কোন কথা বলবে না তা আর বুঝতে পারছিল না।
জিউস দেখলেন এতো মহাবিপদ! সভাসদদের সবার সামনেই সে হাড়ি ভেঙে দিচ্ছে!! এবার শান্ত হয়ে সে থানাটোসকে বললেন-
যাও, যেখান থেকে পার সিসিফাসকে ধরে নিয়ে আস।”
হুজুর জান কি কবচ করে ফেলবো নাকি শুধু বেঁধে নিয়ে আসবো?
আরে গবেট তুই জান কেন কবচ করবি? মাইরা ফেললে তো শাস্তি শেষ? সাবধান! ক্রসফায়ারে দিবে না। তারে শিকল দিয়া বাইন্দা মৃত্যু গহ্বর পাতালপুরি টারটারাসে ফেলে দিয়ে আসবে। সেখান থেকে সে ইহ জীবনেও আর বের হইতে পারবো না।
থানাটোস এবার প্রমাদ গুনলো। বললো, ইয়েস স্যার। আমি এক্ষুনি ধইরা আনতাছি। টারটারাসে নিয়া শালারে বাইন্দা রাখুম।
জিউস এবার থানাটোসের কথায় খুশি হলেন। খুশি হয়ে তিনি তাকে হাতে মোটা একটা ইনভেলাপ ধরিয়ে দিলেন। শুধু বললেন, সিসিফাসরে ধরতে যা লাগে তাই কর। শুধু মনে রাখিস। জানে মারিস না। আর টাকা পয়সা নো চিন্তা। এইবার লক্ষ্মী ছেলের মত কাজে নেমে পর দেখি!”
থানাটোস রাজা জিউসকে সালাম দিয়ে প্যান্থিউন সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলেন এলিফ্যান্ট রোডে সাকুরা থেকে মদ কিনতে। কিন্তু কাজ হল না। মনে মনে নিজেই নিজেকে একটা গাল দিল । শালা লকডাউন সব জায়গায়! তবে মনে মনে পরিকল্পনাটা আঁটতে ভুললো না। কালকেই অপারেশনে নেমে পরতে হবে। আপাতত জান কবচের কাজ থাক। আগে সিসিফাসকে সাইজ করাই হল আসল কাজ।
থানাটোস অনেক শক্তিশালী যমদূত। তাই সিসিফাসকে ধরতে তার কোন বেগ পেতে হল না। সিসিফাস তখন কুড়িল বিলের এক কোনায় বসে মনের সুখে মাছরাঙার মাছ শিকার ধরা দেখায় ব্যস্ত ছিল। ঠিক সেখানেই থানাটোস এসে তাকে ধরলো। ধরেই সে তাকে নিয়ে গেল সেই অন্ধকার পাতালপুরি টারটারাসে। সিসিফাস পুরো ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
আমি কী দোষ করলামরে ভাই? আমি তো নির্দোষ! থানা নাই, পুলিশ নাই, আইন নাই, উকিল মোক্তার কিছুই নাই বিনা দোষে আমারে তুমি এই শাস্তি দিবা?
”চুপ, আমি শাস্তি দেই নাই। দিছে বস জিউস। এই লও শিকল। নিজেই শিকল পইরা লও। তারপর আমি যাই।
সিসিফাস এবার আরো অনুনয় করতে লাগল। ভাইরে, আমিতো শিকল পরতে জানি না। একটু যদি শিখায়ইয়া দিতা!
থানাটোস এবার মহা বিরক্ত হয়ে সিসিফাসের দিকে এগিয়ে আসে। তারপর সিসিফাসকে দেখানো শুরু করে দিল কীভাবে শিকল পরতে হয়।
এই যে দেখ বলদ কোথাকার! সে শিকলটা হাতে নেয়। এইভাবে সামনে এক প্যাচ দিবি তারপর পেছনে দুই প্যাচ। বলতে বলতেই সিসিফাস খটাস করে থানাটোসের শিকলের গাযে দেয় তালা লাগিয়ে। এবার থানাটোস নিজের ফাঁদে নিজেই বন্দি হয়ে পরে। থানাটোস পুরো ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়! থানাটসের সঙ্গে আনা রথে চড়েই সিসিফাস রওনা দেয় পৃথিবীর পথে। রাস্তায় দেখা হয় পাতালপুরীর দেবতা প্লুটো আর তার স্ত্রী পার্সোফিনির সঙ্গে। তাদেরকেও ভুলভাল বুঝিয়ে সিসিফাস চলে আসে তার রাজ্যে। সেখানে সে আরামসে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে থানাটোস টারাটাসে বন্দী থাকার কারণে সে আর মানুষের জান কবজ করতে পারছে না। পৃথিবীর মানুষদের কারো মৃত্যুও হচ্ছে না। মানুষ অনেক খুশি। পৃথিবীর মানুষ ভাবলো কোন দেবতার দোয়ার বরকতে বুঝি তারা এমন অমরত্ব লাভ করল!
কিন্তু চতুর জিউস বুঝতে পারলো এ সবই সিসিফাসের কান্ড! শালাতো এমনিতেই মৃত! তার উপর আবার সে এই কাজ করলো! দাড়াও দেখাচ্ছি মজা! এই বলে বিশেষ ক্ষমতায় সে প্রথমে টারটারাস থেকে থানাটোসকে মুক্ত করল। তারপর আবার বিশেষ ক্ষমতা আইনে সিসিফাসকে পাকড়াও করল। এবার তার শাস্তি হল আরো গুরুতর। একটা ভারি পাথর ঠেলে পাহাড়ের উপর উঠাতে হবে। সেই পাথরটা গড়িয়ে আবার নীচে পড়ে যাবে। কিন্তু সিসিফাসকে আবার সেটি নীচ থেকে কুড়িয়ে উপরে উঠাতে হবে। এইভাবেই চলবে তার জীবন। এই হবে তার নিয়তি।
প্যান্থিওন রাজদরবার। আজ রাজা জিউসকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে। সামনের সোনালি রং এর টেবিলে আম জাম কাঁঠালসহ নানা রকম মৌসুমী ফলে ভর্তী। হঠাৎ ৬৬ ইঞ্চি টিভির স্ক্রলে একটা খবর ভেসে উঠল। WHO বলছে পৃথিবীতে করোনা পরবর্তী সময়ে দারিদ্র মানুষের সংখ্যা আরো দারিদ্র সীমার নীচে চলে যাবে। তাদের জীবনটাও হবে সিসিফাসের মতই। বিশাল অর্থনৈতিক বোঝাটাকে তারা মাথায় নিয়ে যেই গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াবে এবং মুক্তির দেখা পাবে ঠিক তখনই তারা আবার আরেক নতুন অজানা বোঝায় জর্জরিত হয়ে মুখ থুবড়ে পরে যাবে। এই বোঝা থেকে তাদের কোন পরিত্রাণ নাই। জীবন বাস্তবতার মাঝেই জীবনের এবসার্ড ফুটিয়ে তারা বেঁচে থাকে।
মহারাজা জিউস কায়দা করে ছুরি দিয়ে একটা আস্ত ফজলি আম কেটে খেতে খেতে টিভির এই দৃশ্য দেখে আর মুচকি মুচকি হাসে।
লেখক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ঢাকা, বাংলাদেশ। পড়াশুনা করেছেন বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকা থেকে ফাইনান্স এর উপর এমবিএ করেছেন। নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইমেলা, নিউইয়র্ক ফিল্ম সেন্টার, নিউইয়র্ক সাহিত্য একাডেমিসহ নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প-সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত। পেশায় আর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং আইটি পরামর্শক হিসেবে কাজ করলেও নেশা তাঁর লেখালেখি। ইতিহাস তাঁর প্রিয় এবং প্রধান একটি বিষয়। ভারত উপমহাদেশতো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের বৈচিত্রপূর্ণ জীবন, ঐতিহাসিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক ঘটনাবলীর উপর তাঁর রয়েছে গভীর আগ্রহ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রš’গুলো গ্রন্থগুলো হল্: শিপ জাম্পারঃ বাঙালির আমেরিকা যাত্রা(মুক্তধারা, নিউইয়র্ক, ২০২০), অ্যাকুরিয়ামের মাছ ও হলুদ প্রজাপতির গল্প(মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯), চেনা অচেনা শহীদ কাদরী (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৮), ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতি নারীরা (ইত্যাদি গ্রš’প্রকাশ, ২০১৭), পূর্ব-পশ্চিমের আলো (প্রিয়মুখ, ২০১৬),আমেরিকানামা (সূচীপত্র, ২০১৫), জানা-অজানা রবার্ট ক্লাইভ (সূচীপত্র, ২০১৪) । নেশা ভ্রমণ, সিনেমা দেখা এবং বই পড়া। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবতায় তিনি বিশ্বাসী।