– খানকির পুত, ব্যবসা জমাইতে হইলে বালা অবিনয় করন লাগবো।
– অবিনয় কোত্তে আরুম ত… কও কী করন লাগবো?
– সটান শুইয়া থাকবি, বুজ্ঝচোস! এক্কেরে সটান…
– আরুম।
– নড়নচড়ন করা যাইত না কিন্তু!
– কইলাম তো নড়ুম না…
– কতক্ষণ?
– যতখন থাকতে য়ারবি তত ব্যবসা…
– আইচ্ছা
– কহন?
– সক্কালে, এক্কেরে ভোর সক্কালে, নাইলে তো সমিস্যা…
– আইচ্ছা।
– অহন যা, জাইগামতো চইলা আইবি, সমুয়মতুন
পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় মতিঝিল পৌঁছে যায় তারা। খুব সাবধানে, যেন কেউই না দেখে, হুক্কুম্ম্যা শুয়ে পড়ে সটান। ছেঁড়া কম্বলটা তার উপরে বিছিয়ে দেয় ছাইদা। কম্বলের উপর একটা শাদা রঙচটা চাদর, চাদরের চারপাশে চারটা ইটের টুকরো, হুক্কুম্ম্যাকে সামনে রেখে ঠিক মাঝ বরাবর বসে পড়ে ছাইদা। কম্বলের নীচ থেকেই টুকটাক কথা বলতে থাকে হুক্কুম্ম্যা।
– যহন কমু, চুপ কইরা যাবি, লুকজন আইলে আরকি …
– দেহিস, কেউ য্যান না বুঝে…
– আরে বাল, ক্যামনে বুঝব! তুই নড়িস না চড়িস না তাইলেই হইব…
– হহ।
– কিছুক্ষণ পর থিকা লোকজন অফিসে আওয়া সুরু করব!
– মানে তহন থিকা কুনু কতা কমু না তাই তো?
– এইতো বুইজ্জা গেছোত।
সকাল সাড়ে আটটা থেকে অফিস পাড়ায় ব্যস্ত পায়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পূবালী ব্যাংকের হেড অফিসের সামনের জায়গাটাকেই উপযুক্ত ভেবেছে তারা। কয়দিন ধরে মতিঝিলের এই জায়গাটা বারবার এসে দেখেও গেছে।
হুক্কুম্ম্যার বয়স নয়-দশ, লিকলিকে, গায়ের রঙ আঁচ করার সুযোগ নেই। আর ছাইদার তেইশ, বড়লোকেরা মেয়ে-বউরা ডায়েট করে, ওজন কমায়, কিন্তু ছাইদা? এমনিতেই ছিপছিপে, না মুখে সেই লাবণ্য আর নেই, তবে যত্ন থাকলে তাঁর চেহারা অন্য কিছু বলত। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অযত্ন আর নেশা তাদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে আরও কয়েক বছর। ছাইদার বয়সে যোগ হয়েছে আরও কয়েকটি বছর। আগের ব্যবসার লস হিসেবে দুই- তিনটা বাচ্চা হয়েছিলো, অবশ্য সেই লসের কিস্তি টানতে হয়নি তাকে। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে মরে গেছে সেই পাপের ফসল, সেই বেজন্মা পুরুষ গাছ হয়ত অন্য ক্ষেতে বীজ ছড়াচ্ছে।
ছাইদাদের সাথে হুক্কুম্ম্যাদের পরিচয় হয় ঢাকা শহরের ফুটপাতে, পার্কে, কমলাপুরে, মাজারে, তবে ছাইদার সাথে হুক্কুম্ম্যার পরিচয় হয় সিটি কর্পোরেশনের পেছনে ফুলবাড়িয়ার ওখানে, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নীচে, নেশার আড্ডায়। ভাত খেতে বেশী টাকা লাগে, কিন্তু নেশা করতে কম লাগে, ভাতের চেয়েও নেশার দাম কম। এই নেশাটার সুবিধা হলো দাম একেবারেই কম, ক্ষুধাও খেয়ে ফেলে, কোন কিছু না খেয়েও দুই চার বেলা চালিয়ে নেয়া যায়। সাইকেলের লিক সারানোর গাম পলিথিনে ভরে কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে, তারমধ্যে মুখ ঢুকিয়ে টানলেই হয়। আজ এখানে আসার আগেও ছাইদা আর হুক্কুম্ম্যা মিলে পলিথিন টেনে এসেছে। অনেকদিন ‘টাকা’ খাওয়া হয় না, ‘বাবা’র নতুন নাম হয়েছে ‘টাকা’। জীবন চালাতে ছাইদাদের অনেক কিছু শিখতে হয়, কান্নার অভিনয়ে ছাইদা দশে দশ পাবে, এটা নিশ্চিত।
-‘আল্লাগো বাইচ্চাডা মোর মইরা গেছে গো… দ্যাশের বাড়ি নেওন লাগবো, ট্যায়া পয়সা কিচ্ছু নাই… স্যারগো।’
আড় চোখে আশপাশটা দেখে নেয় ছাইদা। নাটক আরম্ভ হয়েছে, মঞ্চ, অভিনেতা- অভিনেত্রী, রিহার্সাল সবই ঠিক আছে, কিন্তু দর্শক না এলে জমবে না। জমাতে না পারলে সব পরিশ্রম পণ্ড এটা ছাইদা জানে।
– আমার কেউ নাইক্কা, স্বয়মী নাইক্কা, বাপ মা নাইক্কা. পুয়াডাই সম্বল ছিলো, হেওও মইরা গেলো…আল্লা তুমি এডা আমার লগে কী করলা, ক্যান করলা?
দুই একজন তাকায়, একজন পাঁচ টাকার একটা কয়েন ছুঁড়ে মারল, সেটা এসে পড়লো হুক্কুম্ম্যার পেট বরাবর। তার আবার কাতুকুতু বেশী। ভয় পেয়ে গেছিলো হাইদা, যদি হেসে ওঠে!
না, হাসেনি হুক্কুম্ম্যা। তবে পেটে কিছু একটা এসে পড়েছে, তা হুক্কুম্ম্যা ভালোমতোই টের পেয়েছে। গরীবের পেটে ইঁদুর চরলেও বুঝে যায় এরা।
– গরীবের দিকে একটু চোক্ষু তুইলা তাকান স্যার… আপ্নেগোরও তো এই বয়িসের বাইচ্চা আছে….
এবার একটা ট্রিক ছাড়ে ছাইদা। এটা সম্ভবত খাবে পাবলিক। সে ওঁত পেতে থাকে। আরও তিনজন তাদের বিরক্তি ছুঁড়ে মারে৷ দুইটা দশটাকার নোটের সাথে একটা বিশ টাকা! শুরুটা ভালোই হলো।
রোদ বাড়ে, বাড়ে মানুষের আগ্রহ। মানুষের আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে ছাইদার ভয় বাড়ে, বাড়ে টাকা পয়সা। যদি হুক্কুম্ম্যা নড়েচড়ে ওঠে!
লোকজন কমে এলে ছাইদা কান্নার ফাঁকফোকরে ফিসফিস করে কথা বলে হুক্কুম্ম্যার সাথে,
–সবুর কর ব্যাডা! কাম হইতাছে। নড়িস না কইলাম…
–আইচ্ছা।
আর শ্বাসের চেয়েও ছোট করে উত্তর দেয় হুক্কুম্ম্যা। দুই একজন পাশে দাঁড়িয়ে আহা উহু করে, জিজ্ঞেস করে কীভাবে মারা গেলো…
–এক ব্যাডা, পাইভেট দিয়া ধাক্কা দিয়া গ্যাছেগা আমার পুলাডারে, মাথা ছিত্রা গ্যাছে…
–আহারে। এই শুয়োরের বাচ্চা বড়লোকগুলা আসলেও শুয়োর। একজন বলে উঠলো।
ছাইদার দ্বিতীয় ট্রিক্সও কাজে লেগেছে দেখে মনে মনে খুশী সে। বড়লোকদের কিছুই করতে পারে না গরীবরা, শুধু গালি দেয়া ছাড়া।
–হাসপাতালে নেও নি?
–স্যার লগে লগেই কাইত, একটু পানি খাইবার চাইছিলো পুলা আমার, সে সমুয়টুকুও বাঁচে নাই, এক্কেরে ঘিল্লু বাইর হয়া গেছে, দেখবেন! দেখবেন স্যার।
আবারও রিস্ক নেয় ছাইদা৷ বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তার সাজানো সন্তানের চৌচির মাথা দেখানোর রিস্ক নিতেই হয় তাকে।
– না, না। গাড়ির নাম্বার দেখোনি?
– পুলা আমার মইরা যাইতাছে, আমি কহন দেখুম। আপনি কই ছিলেন তহন…?
এবার একটু আক্রমণাত্মক হয় ছাইদা। এই লোক অনেকক্ষণ থেকেই পাশে দাঁড়িয়ে। তাকে তাড়াতে হবে, না হলে এ বুঝে যেতে পারে।
অন্যদিনের চেয়ে রোদ একটু বেশীই আজ। ঘামছে ছাইদা। ভেতরে ঘামছে হুক্কুম্ম্যা। ইতোমধ্যে জমেছে শ‘কয়েক টাকা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বেশী টাকা দেখলে মানুষ উৎসাহিত হয়ে আরও টাকা দেয়। এরা একজন আরেকজনকে নকল করে, যাচাই করার ক্ষমতা অনেক আগেই শেষ হয়েছে এদের।
মানুষজনের ভিড় কমে গেলে ছাইদা স্বর নামিয়ে হুক্কুম্ম্যাকে জিজ্ঞেস করে,
– কীরে ব্যাডা!
– কয় টেহা জমলো?
– ম্যালা, তুই খালি আরেকটু থাইকা দ্যাখ না!
– সমিস্যা নাইক্কা। খালি মুখডা শুকাই যায়…
– ব্যাডা জিহ্বা চোষ, আইজ রাইতে তোরে বড় হওন শিখামু।
কম্বলের নীচে চুপচাপ শুয়ে থাকা হুক্কুম্ম্যা পাবলিকের সাথে ছাইদার বলা সব কথা শোনে, কান্নার অভিনয় শোনে, তাঁর হাসি পায়, কিন্তু হাসতে পারে না। অবশ্য ছাইদার কথায় সে খুশি হয়, নিজের জিহ্বা চোষে, একটু আরাম পায়। শুয়ে শুয়ে সে ভাবে, এই বড় হবার ব্যাপারটা দারুণ।
রাতে মাঝেমাঝে গোলাপ শা‘র মাজারের উল্টোদিকের ফুটপাতে ঘুমায় ওরা। দল বেঁধে, অনেকে, একসাথে। তবে যেদিন বড় হবার খেলা আরম্ভ হয় সেদিন ছাইদা তাকে নিয়ে আলাদা শোয়। বুক টেপায়, চোষায়ও। আরাম লাগে হুক্কুম্ম্যার। শুরুর দিকে প্রস্রাব করার যায়গায় মুখ লাগাতে বললে খারাপ লাগতো তার, কেমন মুতমুত গন্ধ করত। পরে ক্যামন নেশার মতো হয়ে গেছে। এখন না চুষতে পারলে ভালো লাগে না তার, ‘বাবা’, ‘ডাণ্ডি’, ‘গাঁজা’র নেশার চেয়েও এ নেশা বড়। ছাইদা তাকে বলেছে, বড় হলে লাগালাগি শেখাবে তাকে, লাগালাগি কী আগে বুঝত না হুক্কুম্ম্যা, এখনও খুব পরিষ্কার বোঝে না ব্যাপারটা, তবে সে অবশ্য দেখেছে, রাত বাড়লেই রাস্তার ধারের ছাপড়াতে ছেলেগুলো মেয়েদের উপর চড়ে বসে, সকালে যারা পার্কে হাঁটতে এসে বুক ডন দেয় ঠিক সে রকম করে ছেলেগুলো। পলিথিনে কী আর এসব আটকায়, সব বোঝা যায়।
ছাইদা তাকে বলেছে, ‘শোন ব্যাডা, খিদা হইলো দুই ধরনের। প্যাড়ের খিদা আর চ্যাডের খিদা, চ্যাড হইলো, যেডা দিয়া মুতোস। তুই যহন আরেট্টু বড় হইবি, তহন যদি গরীব থাহোস তাইলে তোর প্যাডের খুদা বেশী থাকবো, আর বড়লোক অইলে চ্যাডের খুদা থাকবো বেশী। অহন ঠিক কর কোনডা বেশী খাবি… হি হি হি…” প্রথম প্রথম হুক্কুম্ম্যা এতো কিছু বুঝত কিছু বুঝত না।
ছাইদার আজকের টাকা ইনকামের ধান্দাটা পছন্দ হয়েছে তার, ‘কিন্তু কতক্ষণ আর! টাকা মনে অয় বালোই পড়তাছে। বুকের উপ্রে, মুখের উপ্রে, প্যাডের উপ্রে, চ্যাডের উপ্রে- ঘনঘন, তইয় শব্দ কম, তার উপ্রে কম্বল, কম্বলের উপ্রে চাদর, তাই মনে অয় কম শব্দ।’
হুক্কুম্ম্যা মনে মনে আনন্দিত হয়। ‘আইজ গাঁজা টানবো হেরা, ‘বাবা’ও খাইবো দুই একটা, গাঁজা টানোনের পর ছাইদার মুতার জায়গাটায় মুখ দিলে বিশ্রী আর ঝাঁঝালো গন্ধটা লাগে না, মন দিইয়া চোষা যায়, এ হালি যে কী কাম শিখাইছে! তখন ছাইদা কেমুন কেমুন জানি করে, পরে নিস্তেজ হইয়্যা ঘুমায় পড়ে, ছাইদাকে জরায় ঘুমায় পড়ে হে-ও।’
– আহারে আমার পুলাডা, কী সোন্দর ফুটফুট্যা বাইচ্চা গো… স্কুলেও যাইত…
গল্প ফাঁদে ছাইদা, কাঁদে।
-‘স্কুলে যাইত, আমার পুলাডা স্কুলে যাইত, কইছিল, পাস দিয়া আমারে আর কাম করতে দিব না, এহন আমারে কে দেখব?’
এটাও একটা ফাঁদ। ফুটপাতের বাচ্চা স্কুলে যায়, এটা শুনেও কেউ কেউ দশ বিশ টাকার নোট বের করে আস্তে করে রাখে হুক্কুম্ম্যার বুকের উপর, মনে মনে হাসে ছাইদা। ছয় সাতশো টাকা জমে গেছে এতোক্ষণে। এই শহরের মানুষ নিজেকে খুব চালাক মনে করে, কেউ কারো দিকে তাকায় না, তাকায় না যে এর উদাহরণ তো হুক্কুম্ম্যা। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারার কথা, হুক্কুম্ম্যার বুকের উঠানামা।
আজ কপাল ভালোই মনে হচ্ছে। এমনি চাইলে দূর দূরে করে তাড়িয়ে দেয়, অথচ ধোকা দিলে ঠিকই দেয়। আজব শহর একটা, আর মতিঝিল-গুলিস্তান তো আরও আজব, এখানে অক্সিজেন না, শ্বাস হিসেবে টাকার গন্ধ নেয় মানুষ, নিঃশ্বাসেও ছাড়েও টাকার গন্ধ।
– কীরে ব্যাডা?
– জিব্বা চুষতাছি। মনে অয়তাছে তোমার…
– বদ ব্যাডা, কাঁচা গোস্তের স্বাদ জিব্বায় লাগছে তো…
– চুপ কইরা পইড়া থাক।
শ্বাস চেপে কথাগুলো বলে ছাইদা। একদিনের ইনকামে কয়েকদিন সিটি কর্পোরেশনের পেছনে, ফুলবাড়িয়ায় যেতে পারবে ওরা। এই খুশীতে আনন্দ পাচ্ছে সে।
মাঝেমধ্যে পাঁচ টাকার কয়েনে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করে, সেই আলো ছাইদার মুখে গিয়ে পড়লে চকচক করে ওঠে তার মুখও। কম্বলের নীচে হুক্কুম্ম্যার জিহ্বা চোষার শব্দে নিজের ভিতরে রাতে হুক্কুম্ম্যাকে দিয়ে মুতের মুখ চোষানোর আনন্দ পায় সে।
কান্নার অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ছাইদা, জিহ্বা চুষতে চুষতে কম্বলের নীচে হুক্কুম্ম্যাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সম্ভবত। এতক্ষণ দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখাও কষ্টকর কিন্তু আরেকবার ডাক দিলে ‘হু‘ করে ওঠে হুক্কুম্ম্যা। লোভ বাড়ে ছাইদার। আর ঘন্টাখানেক থাকলে হাজার পনেরশো হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
‘মানুষ বড় অবাক’, ছাইদা ভাবে, হুক্কুম্ম্যাও। অবশ্য তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না, তারা ছাইদা, হুক্কুম্ম্যা। কিন্তু যারা ভাঁজ করা সুন্দর সুন্দর শার্ট-প্যান্ট- কামিজ-পাজামার মধ্যে ঢুকে নিজেদের উন্নত মানুষ ভাবে তারা কী জানে, পোশাক খুললে তাদের মধ্যে থেকে বাহির হবে কুত্তা, শুয়োর!’ ভাবে ছাইদা।
লতিফুন নাহারকে যারা ছাইদা বানিয়েছে, তাদের ধোকা দেয়ার মধ্যে কী যে আনন্দ! থাক, সে গল্প আরেকদিন করবে ছাইদা।
সকাল এগারোটা তো না, যেন জোহরের আজানের গনগনে দুপুর, রোদের ছুরিতে গলে যাচ্ছে সব। এবার গোটানোর কথা ভাবে ছাইদা। অনেক হয়েছে। শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় হুক্কুম্ম্যার অবস্থাও খারাপ।
হুক্কুম্ম্যার বুকের উপর থেকে টাকাগুলো তুলে গোছাতে থাকে ছাইদা। একটা পাঁচশো টাকার নোটও, নতুন। কয়েকটা একশো টাকা, পঞ্চাশ, বিশ, দশ, আর পাঁচ টাকার কয়েন। পেটের উপর পড়ে থাকা টাকা আর কয়েনগুলো খুব সাবধানে তোলে, হুক্কুম্ম্যার যে সুড়সুড়ি, একটু ছোঁয়া লাগলেই লাফিয়ে উঠবে, তবে আরও নীচ থেকে টাকা আর কয়েনগুলো তোলার সময় একটু ইচ্ছা করেই নেড়ে দিলো জায়গাটা। আজ রাতে একে কাজে লাগাতে হবে। তেরশো নব্বুই টাকা৷ চমকে ওঠে ছাইদা। এতো টাকা একসাথে দেখেনি কতদিন। ছাইদাও বুঝে গেছে, মানুষের হাতে টাকা এলেই চ্যাটের ক্ষুধাও বাড়ে।
– এই ব্যাডা, চুপ কইরা শুন, কথা কবি না, আশপাশে ম্যালা মানুষ। হোন, এহান থে মুই আস্তে কাইটা পড়তাছি, বুজ্ঝোস, খানিক পর সুযুগ বুইজ্জা তুই চইলা আইবি। এক লগে যাইতে দেখলে পাবলিকে পিডাইবো ব্যাডা।
খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বলে ছাইদা। হুক্কুম্ম্যার বুকের চাদরটা একটু নড়ে উঠলো মনে হলো। তার মানে হুক্কুম্ম্যা সিগনাল বুঝে গেছে।
– আমি থাকুম গোলাপ শা মাজারের ওইখানে, তুই চইলা আসিস। আজ রাইতেই তোরে লাগালাগি শিখামু, তুই ব্যাডা বড় অয় যাইবি… এসব কাম করনের লাইগা মাজার টাজারের আশপাশ ভালো জায়গা ব্যাডা, কেউ সন্দেহ করব না…‘
আবার নড়ে ওঠে হুক্কুম্ম্যার বুকের চাদর। সিগন্যাল কনফার্ম, বুঝে যায় ছাইদা।
– দেরী করিস না কইলাম। আমি মাম কিইন্না রাখতাছি, আইসা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানি খাইস।
এক পা দুই পা করে হুক্কুম্ম্যার সাজানো মরদেহ থেকে দূরে সরে ছাইদা, এগিয়ে যায় গোলাপ শাহ মাজারের দিকে।
এতক্ষণ যেভাবে নোট পড়ছিলো, তারচেয়ে দ্বিগুণ গতিতে নোট- কয়েন পড়তে থাকে হুক্কুম্যার বুকের উপর। একটা মৃতদেহ, শাদা কাপড়ে ঢাকা, আশপাশে কেউ নেই, এই দৃশ্যে করুণা উথলে পড়ে মিথ্যে শহরের মিথ্যে মানুষগুলোর মিথ্যে মায়ায় ভরা মিথ্যে হৃদয়ে।
সন্ধ্যা হতে হতে নোট আর কয়েনের ভারে চাপা পড়ে যায় হুক্কুম্ম্যা।
![আশরাফ জুয়েল](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2019/07/FB_IMG_1563815902394-150x150.jpg)
ডাক্তার,কবি ও কথাসাহিত্যিক