| 6 অক্টোবর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: বাসায় কেউ নেই । বরুণ কুমার বিশ্বাস

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

আজগর আলী বহু কায়দাকানুন করে দরজার বাইরে একটা নোটিশ টাঙালো। এ-ফোর সাইজে প্রিন্ট করা। রোল করে পকেটে পুড়ে আনতে গিয়ে ওটা চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে গেছে। অফিসের প্রিন্টারে কালি কম ছিল, ঠিকঠাক ছাপাও হয়নি। উল্টো দিকে রোল করে কাগজটাকে সোজা করার চেষ্টা করায় যথেষ্ট মলিন হয়ে গেছে। ওষুধের দোকানের ফেলে দেয়া একটা কার্টন থেকে কেটা নেয়া অংশে গাম দিয়ে লাগাতেই এক অদ্ভুত চেহারা হয়েছে নোটিশটার। বাসার ভেতরে মানুষ আছে। বাইরে হুড়কো লাগানো। হুড়কোতে ঝুলছে তালা। তালার সাথে ঝুলছে নোটিশ। লেখা ‘বাসায় কেউ নেই’। আজগর আলী সামান্য দূরে গিয়ে দেখছে নোটিশের পজিশন ঠিকঠাক আছে কিনা।

প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, এমনিতেই কোনো মাসে বেতন হয় কোনো মাসে বেতন হয় না। করোনা ভাইরাস আসার আগের দুই মাস বেতন হয়নি। কবে হবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আদৌ হবে কিনা কে জানে। এখন তো আবার সাধারণ ছুটির নামে লকডাউন। তারপরেও মাঝেমাঝে অফিসে যেতে হয়। আজও সে অফিসে যাবে। যাওয়ার আগে নোটিশ না সাঁটালে চলছিল না। পাওনাদাররা বাসায় আসে, ফোন করে বলে পুরনো সিম খুলে রেখেছে। নতুন নম্বরটা শুধু অফিসে দুই একজন আর স্ত্রী শাহনাজ ছাড়া কেউ জানে না। নতুন চাকরির চেষ্টাও করছে, হচ্ছে না। সারাবছর চাকরির বাজার এমনিতেই খারাপ থাকে, আর এখন তো করোনা কাল। ভেতরে ভেতরে কর্মী ছাঁটাই চলছে দেদারসে। একবার ছাঁটাইয়ের তালিকায় নাম উঠলে আরো বিপদ। সেই ভয়ে বেতন হোক বা না হোক অফিসে যায় আজগর আলী। বেতন অনিয়মিত হলেও কোনো বেতন বকেয়া থাকে না। অফিসের আয় হলে কর্মীদের বকেয়াও পরিশোধ হয়ে যায়। কিন্তু এতে বেতন নির্ভর মানুষের আয় ও ব্যয়ের হিসেব ঠিকঠাক থাকে না। বকেয়া বেতন পাওয়া মাত্রই মুদী দোকানের বাকি, বাড়ি ভাড়া, ধারদেনা শোধ করতে করতেই পকেট আবার গড়ের মাঠ হয়ে যায়। নোটিশ টাঙিয়ে বাসায় ঢোকে। সকালে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। শুধু আজ না, গত কয়েকদিন ধরেই খিচুড়ির ওপর চলছে। ওদের একমাত্র ছেলে আকিব, বয়স আট। কোনো কিছু নিয়েই ঝামেলা করে না। না কোনো বায়না, না কোনো আবদার। পড়ালেখায় তুখোড় বলতে যা বোঝায়। শুধু ওর জন্য ডিম বরাদ্দ আছে। চটজলদি খাওয়া শেষ করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় আজগর।

শাহনাজ তিনটে ছাত্র পড়াতো। ওরা বাসায় এসে পড়ে যেত। মাইনেও বেশ ভালোই ছিলো। করোনার কারণে এখন আর আসে না। সংসারের টুকিটাকি প্রয়োজনে তার এই আয় বেশ ভালোই সাপোর্ট দিতো। এখন আর ছাত্র আসে না, আয় তো দূরের কথা। তবে সে নৈরাশ্যবাদী নয়, ভীষণ আশাবাদী মানুষ। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে ঠান্ডা মাথায়। স্বামীর বেতন নেই, অফিস নেই, নিজের টিউশনি নেই; এমন অবস্থায় অন্য যে কেউ হলে অস্থির হয়ে যেত। দর্শনে অনার্স মাস্টার্স করার পর চাকরির চেষ্টা করার সময়ই পরিবারের ইচ্ছায় বিয়ে হয়ে যায়। তারপর আর চাকরির সন্ধান করা সম্ভব হয়নি। এখন সংসার আর আকিবের পড়ালেখা তার অলিখিত চাকরি।

করোনার প্রকোপ শুরুর সময়েই আজগর আলী তার পুরনো সাইকেলটা মেরামত করে নিয়েছে। সাইকেলটা একটু বেশিই পুরনো, লক্করঝক্কর ধরনের বলে ফেলে রেখেছিল। এখন ওটাই ভরসা। গণপরিবহন বন্ধ। দৈনিক রিকশা-সিএনজিতে অফিসে যাওয়াও সম্ভব না। অনেক ভাড়ার ব্যাপার। শেখেরটেক থেকে মতিঝিল হেঁটে যাওয়াও অসম্ভব। এ বিপদকালে এ ভাঙা সাইকেলটাই ভরসা। গ্যারজের এককোনায় পড়ে থাকতে থাকতে এটা আর সাইকেলের চেহারায় নেই। চাকায় হাওয়া নেই, চেইনে জং, পুরো বডিতে ধুলোর আস্তরণ। অন্যসময় রাস্তার পাশে রিকশা মেরামতের ভ্রাম্যমাণ দোকান থাকলেও এখন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। ওটাকে ঠেলছে আর হাঁটছে। রাস্তাঘাট ভূতুড়ে ফাঁকা। ঐ দূরে একজন মেকার একটা রিকশা ঠিক করছে।

শাহনাজ আকিবকে পড়তে দিয়ে বাসনকোসন মাজছে। মাথায় নানান চিন্তা। কবে যে এই দুর্যোগ শেষ হবে? কবে যে মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে? প্রতিদিন এই মৃত্যু আতঙ্কে থাকা খুব কঠিন। অথচ পেটের দায়ে ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে অনেকেই। হোম কোয়ারান্টাইনে তো অনেকদিনই কাটলো, তাতে সংক্রমণ কি খুব কমেছে? না কমেনি। এক শ্রেণির মানুষ ঠিকই ঘরে ছিল। আরেক শ্রেণির মানুষ বড্ড ড্যামকেয়ার ধরনের। এরা না থেকেছে ঘরে, বাইরে না মেনেছে স্বাস্থ্যবিধি। আড্ডা, চা-সিগারেট খাওয়া, যেখানে সেখানে কফ-থুতু ফেলাসহ সব ধরনের অনিয়ন্ত্রিত কাজ করেছে। একেকটা দিন যাচ্ছে আর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

সাইকেল মেরামতের কাজ প্রায় শেষ। মেকার পাম্পার দিয়ে চাকায় হাওয়া দেওয়ার আগে কাছা দিলো। আজগর আলী সাইকেলটা শক্ত করে ধরে আছে। মেকার পাম্পারের পিস্টনটা ওপরে তুলে চাপ প্রয়োগ করতেই অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দুই চাকা হাওয়ায় ভরে গেলো। পকেট হাতড়ে মেকারের মজুরি দিয়েই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। খাটো কাপড় যেমন টেনে লম্বা করা যায় না, তেমনি সীমিত টাকা দিয়ে সব ব্যয় মেটানো যায় না। মরার এই করোনা যে কবে যাবে? আর সাতপাঁচ না ভেবে সাইকেলে চড়ে বসে আজগর। প্রত্যাশার চেয়ে ভালো দৌড়াচ্ছে। সামনের মাডগার্ডটা শুধু চাকার সাথে ঘষা খেয়ে খসখস শব্দ করছে। গত সপ্তাহে সীমিত আকারে অফিস খুলেছে।

এ কয়েক দিনেই ঢাকা শহরটা কেমন বদলে গেছে। করোনা সংক্রমিত হলে মৃত্যুর হাতছানি। পরিবারের লোকজন ভয়ে কেউ কাছে আসে না। রাস্তাঘাটে মানুষ খুবই কুম। প্রধান সড়কে কোনো চায়ের দোকান খোলা না থাকলেও , গলির ভেতরে কিছু দোকান খোলা। সেখানে বেশ কিছু মানুষ জটলা করে আছে। সাইকেলের ওপর থেকে এসব দেখতে দেখতে অফিসের দিকে চলছে সে। মাথায় ঘুরছে নানান ইকুয়েশন। এভাবে আর কতদিন?

মুদিদোকানে অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে। দোকানদার জয়নাল আজ অজগর আলীর বাসায় এসেছে। এ বাসা তার চেনা। দোকানে কর্মচারী না থাকলে সে নিজেই এসে মালামাল দিয়ে যেত। এলাকার প্রায় সব বাসাতেই তার যাতায়াত আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে ফোন দেয়ার চেষ্টা করেছে। প্রত্যেকবারই ফোন বন্ধ পেয়েছে। নগদে বিক্রি কমে গেছে, এখন বাকির টাকাগুলো আদায় না হলে দোকান চালানো সম্ভব না। যা বেচা বিক্রি হয় তাতে দোকান ভাড়া উঠানোই কষ্টকর। জয়নাল দরোজার সামনে এসে থমকে যায়। দরোজায় তালা ঝুলছে। কাগজে লেখা বাসায় কেউ নেই। সে আর দরজার কাছে যায় না। শেষে কিনা আবার কোন বিপদে পড়ে। রাগে দুঃখে গজগজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে জয়নাল।

আজগর আলী অফিসের গ্যারেজে সাইকেলটা তালা দিয়ে ওপরে ওঠে। অফিসে প্রায় সবাই এসেছে। গুঞ্জন চলছে। কোম্পানির এমডি প্রত্যেক ডিপার্মেন্টে মেইল দিয়েছে। আজ সব স্টাফকে প্রাপ্য বেতন থেকে থোক কিছু করে টাকা দেয়া হবে। লকডাউন সময়ের জন্য কেউ বেতন পাবে না। কাজ নেই, বেতন নেই পলিসি চালু করেছে। সেইসাথে আজকে থেকে অফিস করার পর সব বিভাগের অধিকাংশ স্টাফদের অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনাবেতনে ছুটি দেয়া হবে। চাকরি থাকবে, বেতন থাকবে না। এটাও একধরণের কর্মীছাঁটাই। এ খবর শোনার পর আজগর আলীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কী উপায় হবে এখন? বাসা ভাড়া, সংসারের খরচ, দোকানের দেনার টাকা কোথায় পাবে? আর যদি ছাঁটাইয়ের তালিকায় নাম চলে আসে তবে তো সব শেষ। অন্যান্য কলিগদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চাপা ক্ষোভ ও দুঃশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়েছে।

শাহনাজ সব কাজ সকাল সকাল সেরে ফেলেছে। এখন হাতে কোনো কাজ নেই। ছেলেটাও ঘুমিয়ে আছে। আজগর আলী অন্যান্য দিন ফোন দিলেও আজ একবারও ফোন দেয়নি। শাহনাজ ফোনটা হাতে নেয়।
– কী অবস্থা তোমার অফিসে ? কোনো সমস্যা নাই তো ?
– অবস্থা বেশি ভালো না। সবকথা বাসায় এসে বলবো।
– খুব বেশি সমস্যা ?
– বললাম তো বাসায় এসে সব বলবো
টাকার দুশ্চিন্তায় থাকলে যেকোনো মানুষেরই মেজাজ খারাপ থাকে। আজগর আলীও এর ব্যতিক্রম নয়। এই মহামারীর কালে এমনিতেই বাড়তি টাকা প্রয়োজন। সেখানে বেতন নেই, চাকরিও যায় যায়। কার মেজাজ ভালো থাকে? একাউন্টস সেকশন থেকে ডাক এলো। বেতন একাউন্টে দেয়া হলেও থোক টাকা ক্যাশে দেয়া হবে। আজগর আলী বিশ হাজার টাকা হাতে পেল। আবার কবে টাকা পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। এই টাকা দিয়েই চলতে হবে। কয়দিন চলবে এই সামান্য টাকা দিয়ে? আর ভাবতে পারছে না।

অফিসের নোটিশ বোর্ডের সামনে বেশ ভিড়। তালিকায় ঝুলছে ছাঁটাইকৃতদের নাম। কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। তালিকায় নিজের নাম দেখে গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে আজগর আলীর। অফিসে থাকতে আর ভালো লাগছে না তার। ডিপার্মেন্টের প্রধানকে বলে আগেই বেরিয়ে পড়ে। বিকল্প আয় বের করতেই হবে। নয়তো না খেয়ে মারতে হবে। সাইকেলের প্যাডেলে পা যেন আর চলছে না। এখন বাসায় যাবে না। রাস্তার মধ্যে মধ্যে কিছু দোকান চোখে পড়ছে। গ্লাভস, স্যানিটাইজার, মাস্ক বিক্রি করছে। একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। খুব ভালো করে বেচাকেনা খেয়াল করে। হ্যাঁ, সেও এই আইটেমগুলোর ব্যবসা করবে। তোপখানা রোডের বিএমএ ভবনসহ আশেপাশে অনেক পাইকারি দোকান আছে। সে সেই দিকেই সাইকেল চালাতে থাকে।

কয়েকটা দোকান ঘুরে মোটামুটি দামের ধারণা পায়। এই দুর্যোগকালে এগুলোর ব্যবসা ছাড়া আর বাঁচার কোনো উপায় নাই। কিন্তু কীভাবে বেচবে? লোকজন যদি চিনে ফেলে? এই হলো ঢাকার নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থা। এরা না খেয়ে মারা গেলে কেউ দেখবে না। কারো কাছে হাত পাততেও পারবে না। সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতাও নিতে পারবে না। আবার হঠাৎ চলমান চাকরি ছেড়ে কোনো অস্বাভাবিক পেশায় গেলে সেটাতেও সমস্যা। কে কী বলবে, কেউ দেখে ফেলে কিনা এসব ভাবনায় এরা আটকা পড়ে থাকে। আজগর আলীও এসব ভাবনায় পড়ে। কিন্তু এসবে তো আর পেট চলবে না। বিকল্প একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দোকানে ঝুলন্ত পিপিই এবং গগলস দেখে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়।

পকেটের বিশ হাজার টাকাই ভরসা। প্রথমে বিনিয়োগ হবে পাঁচ হাজার। ব্যবসা ভালো হলে আস্তে বিনিয়োগ বাড়বে। প্রথম কিস্তি আজই শুরু কবে। তিন প্রকারের মাস্ক, আর অল্প কিছু গ্লাভস কিনে ফেলে সে। সেইসাথে একটা পিপিই আর গুগলস। একটু আড়ালে গিয়ে ওগুলো পড়ে ফেললো। মাস্কতো আগেই পড়া ছিল। এখন কারো চেনার উপায় নেই। আজগর আলীদের মতো মানুষের বিকল্প ভাবা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। একবুক স্বপ্ন, আর সাহস নিয়ে সে সাইকেলে চড়ে।

প্রথম দিনের বেচাকেনার জন্য জায়গা নির্বাচন করে ধানমন্ডি সাতাশ নম্বর এলাকা। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করিয়ে হাতে কয়েকটা মাস্ক ঝুলিয়ে হাঁক ছাড়তে যায়। কণ্ঠ কেমন যেন শুকিয়ে আসে। পরের বার ঠিকই পেরে যায়। ‘মাস্ক নেন, মাস্ক। সস্তায় মাস্ক নেন। একদম সস্তায়। দাম মাত্র বিশ টাকা। সামনে কোনো পথচারী এলেই আজগর আলী হাঁক ছাড়ছে। কেউ কিনছে না। কেমন যেন হতাশ লাগছে। ধৈর্য না ধরলে ব্যবসা করা যাবে না। আবার সে হাঁক ছাড়ে। একজন পথচারী দামাদামি না করেই পাঁচটা মাস্ক কিনলো। এবার আশার সঞ্চার হলো। মনে সাহস বাড়লো।

শাহনাজের বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। এখন যায়, তখন যায় অবস্থা। বড় বোন সাবিহা আগামীকাল দেখতে যাবে। মাইক্রোবাস ভাড়া করেছে। ওদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো। টাকা পয়সার কোনো সংকট নেই। ছোটবোন শাহনাজকে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এখন অব্দি সে কিছু জানায়নি। আজগর আলী বাসায় এলে তারপর আলোচনা করবে।

এক এক করে সবগুলো মাস্ক বিক্রি হয়ে গেলো। ভালোই লাভ হয়েছে। এখন সে বাসায় ফিরছে। এভাবে কষ্টেশিষ্টে যদি এই মহামারীর সময়টা পার করা যায়, তবেই শান্তি। কোথায় কাকে কয় টাকা দেবে সেই হিসেবে করতে করতে সাইকেলের প্যাডেলে পা চালায় সে। শেষ ভরসার এই টাকাগুলো নিয়েই সব জল্পনা-কল্পনা।জয়নালের দোকান এখনো খোলা। কিছু টাকা না দিলেই নয়। সাইকেল থামিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়ায়। পিপিই’র কারণে প্রথমে চিনতে পারে না জয়নাল। মাস্কটা একটু নিচে নামলে চিনতে পারে।
-জয়নাল ভাই, খাতায় আমার বাকি যেন কত?
-দাঁড়ান দেখতেছি।
পিছনে যতই ক্ষোভ ঝারুক খদ্দেরের সামনে খারাপ আচরণ করার মতো অভদ্র সে না। খদ্দেরের অনুপস্থিতিতে বাকির খাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বিড়বিড় করলেও সামনে এলে হাসি মুখেই কথা বলে। আজ আর তেমনটা পারছে না। দুশ্চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আছে।
-ভাই, আপনার মোট বাকি পাঁচ হাজার তিনশো টাকা
-আজ তিন হাজার দিলে চলবে?
-না, ভাই, এমনিতেই দিন সময় খারাপ। তারপর এগুলা আগের বাকি।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
পকেট থেকে টাকা বের করে গুনেগুনে দেয়। সব বাকি পরিশোধ করে বাসায় আসে।

শাহনাজ তার বাবার কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। অন্যদের মতো কাঁদতে পারে না। খুব কমই তার চোখে জল আসে। এই অবস্থায় যেতে হলেও বেশ কিছু টাকা সাথে নিতে হবে। বরং অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশিই নিতে হবে।
-তোমার কি ইচ্ছা? তুমি যেতে চাও?
-হ্যাঁ, কিন্তু আকিবকে কি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে?
-ঠিক হবে না। ওকে বাসায় একাও রেখে যাওয়া যাবে না।
-তাহলে নিয়েই যাই।
-ভেবে দেখো কী করবে।
আজগর অফিসের সব কথা খুলে বলে। এমনকি নতুন মাস্কের ব্যবসার কথাও বলে। শাহনাজ কিছুটা ঘাবড়ে যায়। ঘাবড়ানো ছাড়া তো আর উপায় নাই। বেঁচে থাকতে হলে বেশি ঘাবড়ানো যাবে না। দিন শেষে পকেটে টাকা না থাকলে চোখে মুখে অন্ধকার দেখা ছাড়া উপায় নাই।

মাস দশেক আগে বন্ধু রশিদের কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল আজগর। এখনো দেয়া হয়নি। আগে মাঝেমাঝে ফোনে তাগাদা দিতো। এখন আর ফোনে পায় না। এই রাত করে সে আজগরের বাসার গেটে এসেছে। এসে রীতিমতো রাগে দুঃখে জ্বলছে। এমনিতেই কোরোনার কারণে বাইরে বের হতে ভয় লাগে, তারপর আয় কমে গেছে। হাতেও বিশেষ টাকা নেই। দরোজার বাইরের ‘বাসায় কেউ নেই’ লেখা দেখে চিৎকার দেয়ার উপক্রম। এই তলায় আর কোনো ফ্ল্যাট নেই। মূলত ইটা ছাদের একাংশ। বাড়িওয়ালারা একটু বাড়তি পয়সার আশায় এমন ইউনিট করে ভাড়া দেয়। রশিদ নিরাশ হয়ে চলে যায়।

মাইক্রোবাস এসেছে। শাহনাজ আর আকিব মাস্কে মুখ ঢেকে গাড়িতে উঠলো। আজগর নিচে নেমে ওদের উঠিয়ে দিয়েই বাসায় চলে এলো। তৈরী হয়ে সোজা চলে যাবে তোপখানা রোড। তারপর এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে যাবে। আজ নতুন ব্যবসার দ্বিতীয়দিন। প্রথমদিনটা বেশ ভালোই গেছে। দেখা যাক কী হয়। কোরোনার প্রভাবে কত মানুষ যে এভাবে পেশা বদল করছে, আর কত মানুষকেই যে পেশা বদল করতে হয় সেটা বলা মুশকিল। এই ঢাকা শহর বড্ডো নির্মম। বহু মানুষ বছরের পর বছর রক্ত জল করা টাকা দিয়ে ঢাকায় জীবন যাপন করে গেলেও, এই বিপদের দিনে ঠিকই অনেককে পেশার সাথে সাথে বাসাও ছাড়তে হচ্ছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কেউ কারো খবর রাখে না। দেয়ালের ওপাশের মানুষের খবর এপাশের মানুষ জানেনা। পাড়া বা মহল্লার কথা না হয় বাদ।

বাড়িতে পৌঁছে শাহনাজরা দেখে বাড়ি ভরা মানুষ। তার মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে ঢাকার আগত মানুষে ভীষণ ভয়। এরাই বুঝি করোনা গ্রামে নিয়ে আসছে। ওদের দেখে বাড়ির মানুষগুলো দূরে দূরে সরে গেলো। কেউ কেউ নাকে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে ফেললো। এখনো ওদের বাবা বেঁচে আছে। তবে কতোক্ষণ টিকবে সেটা বলা যাচ্ছে না।
মাস্ক নিয়ে আজ কখনো ধানমন্ডি, কখনো বাংলামোটর, কখনো ইস্কাটন ঘুরছে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। একদম নতুন হলে যা হয়। বেচাবিক্রি মন্দ না। এভাবে চললে চারটে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা যাবে। আজগর আলী রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। কোথায় গেলো এই শহরের সড়কের দোকানিগুলো? ঠাসাঠাসি করে চলা গাড়ি এবং পথচারীরাই বা কোথায়? সব কোরোনা ভয়ে আড়াল হয়ে আছে। এই মহামারী শেষ হলে তারপর কি মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে ? নানান ভাবনা মাথায় আসতেই একজন খদ্দের এসে মাস্কের দামাদামি শুরু করে।

দুইদিন হয়ে গেলো শাহনাজরা বাড়িতে এসেছে। বাবার শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই। ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাড়ির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাইরে গেলেও প্রতিবেশীরা কথা বলতে চায় না। ঢাকার মানুষজন যেন হঠাৎ করেই অচ্ছুৎ হয়ে গেছে। অথচ একসময় ঢাকা থেকে মানুষ গেলে কত আন্তরিকতার সাথে আলাপচারিতা করতো।

প্রতিদিন পিপিই পড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাস্ক বেচতে বেচতে এই কয়দিনেই শরীরটা কেমন যেন হয়ে গেছে। কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। বেশ কয়েকবার হাঁচিও হয়েছে। খুসখুসে কাশিও আছে। উপসর্গগুলো আমলে নেয়নি আজগর। আজ আর বেচাকেনা করতে ইচ্ছে করছে না । কিন্তু এইটুকুতেই হাল ছেড়ে দিলে চলবে কীভাবে? আবার হাঁক ছাড়ে। ‘মাস্ক নেন মাস্ক’ । কখন থেকে যে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে তার সেটা খেয়াল নেই। সারাদিন পর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হওয়ার পর খেয়াল করে জ্বরটা বেশ ভালোই বেড়েছে। শেষমেশ কি করোনায় ধরলো ? উপসর্গগুলো তো সুবিধেজনক মনে হচ্ছে না। শাহনাজের সাথে একবার কথা হয়। জ্বরের কথা বলেনি। রাত বাড়ার সাথে সাথে মাথাব্যথা-জ্বর বাড়তে থাকে। সাথে হাঁচি-কাশি, মৃদু শ্বাসকষ্ট। বাসায় প্যারাসিটামল ছিল সেটাই খেয়েছে। জ্বর বাড়ছেই।

রাতেই হঠাৎ করে শাহনাজের বাবার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। দীর্ঘসময় অস্থিরতার পর কিছুটা শান্ত হয়। এখন ঘুমাচ্ছে। বাড়ির লোকজনের ভেতর অনেক আতঙ্ক। এরই মধ্যে কেউ কেউ ঘুমিয়েছে।
শাহনাজের বাবা ঘুমের ভেতরেই কখন যে মারা গেছে কেউ বলতে পারবে না। সকালে উঠে তাকে ডাকতেই সে আর সারা দেয় না। বিছানায় নিথর দেহটা পড়ে আছে। আজ আর কোনো অস্থিরতা নেই।
সকালবেলা খবরটা শুনে আজগরের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। শেষ দেখাটা দেখতেও পারবে না। কী এক অসুখ এসেছে, মানুষকে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রতিবেশী থেকে আলাদা করে ফেলেছে। শ্বশুরকে নিয়ে অনেক স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসছে। আবেগে চোখে হালকা জল আসে, গলাটা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যেই কাশতে শুরু করে।

এই শরীর নিয়েও আজগর বের হবে। একদিন বন্ধ থাকলে কতগুলো টাকা আয় হবে না। পরেরদিন আসতে পারবে কিনা সেই অনিশ্চয়তার কথা মাথায় আসতেই সে সব ভুলে যায়। তার মাধ্যমে যে আরো অনেকে সংক্রমিত হয়ে যাবে সেই কথা তার চিন্তাতেই এলো না। সাইকেল চড়ে বসে। ভীষণ অস্থির লাগছে। শরীরে যেন একরত্তিও শক্তি নেই। এভাবেই নানান জায়গায় দাঁড়িয়ে বেচাকেনা করে। আজ আর একেবারেই শরীরে কুলাচ্ছে না বলে বাসায় চলে আসে। শাহনাজকে তখন কিছুই বলেনি। একটা অনলাইন সার্ভিসের সাথে যোগাযোগ করেছে। ওরা সকালে এসে করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল নিয়ে যাবে। হাসপাতালের ভিড়ে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। খরচ একটু বেশি হলেও কিছু করার নেই।

সারারাত তেমন জ্বর ছিলোনা। অন্য অসুবিধাও ছিল না। কিন্তু ভোরবেলা থেকে হঠাৎ প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। কোনোভাবেই আর নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। বুক-পিঠ যেন চেপে আসছে আজগরের। তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নেয়। শাহনাজকে ফোন দেবে। ফোনে চার্জ নেই। কল করতে করতেই বন্ধ হয়ে গেলো। বুকের ভেতরে কেমন যেন বাতাস কমে যাচ্ছে। শরীরটাও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। চোখদুটো ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকার শক্তিটুকুও আর নেই। হঠাৎ আজগর শান্ত হয়ে পড়ে। আর কোনো সারা শব্দ নেই।
সকালে স্যাম্পল নিতে এসেছে। ঠিকানা অনুযায়ী ঠিকঠাক এসেছে। ফোন দেয়া হচ্ছে। ফোন বন্ধ। স্বাস্থকর্মীরা আজগরের বাসার দরোজায় সামনে আসে। দরোজায় নোটিশ ঝুলে আছে ‘বাসায় কেউ নেই’ ।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত