সকাল দশটা। বাইরে মে মাসের চড়া রোদ এর মধ্যেই চড়বড় করছে। কাঁচের দরজা ঠেলে অফিস এসে ঢুকলো নুর। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম আর ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে।
আমি ওকে দেখে হেসে বললাম
-`গুডমর্নিং’
দায়সারা একটা গুডমর্নিং জানিয়ে রাগ রাগ ভাবে বললো,
– `তোমাদের অফিসে আসাটা এবার আমার বন্ধই করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।’
এতক্ষণে বুঝলাম, নুরের মুখ নাক লালচে হয়ে থাকার কারণটা শুধু সূর্যের রোদ নয়, আজ ও রেগে আছে কোনো কারনে।
নুর ইসমাইল- চব্বিশ বছরের এই মারাঠি মেয়েটি বিকম পাস করে সি এ পড়ছে।বাড়ির অবস্থা একটু খারাপ হয়ে গেছে হঠাৎ তার বাবা মারা যাওয়াতে। তাই পড়াশুনোর পাশাপাশি সপ্তাহে তিন দিন,সোম বুধ শুক্র আমার অফিসে আসে আকাউন্টস এর কাজ করতে। পার্ট টাইম জব।
আমার নিজের নতুন আর ছোট কোম্পানি তাই অ্যাকাউন্টস দেখার জন্য ফুল টাইম অ্যাকাউনট্যান্ট না রেখে, নুর কে পার্ট টাইম রেখেছি। তাতে কোম্পানির খরচ বাঁচে।সারল্যে ভরা ঝকঝকে সুন্দর তরুণী নুর কাজেও বেশ। ব্যবহারটিও বেশ মিষ্টি।
`সকাল সকাল এতো রাগ কিসের?’
আমি নুর কে জিজ্ঞেস করি।
এক গ্লাস জল খেয়ে মাথাটা এতক্ষণে নুরের একটু ঠান্ডা হয়েছে।
বলে,
– `বুঝলে,সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ঠিক অফিস বিল্ডিং এ ঢোকার মুখে ট্যাক্সি স্টান্ডে এই সময়টা দাঁড়িয়ে থাকে। আজ ওর অন্য বন্ধুরা আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে ওকে বললো, কিরে শঙ্কর তোর হিরোইনের দেখা তো মিললো, এবার তো কাজে যা, প্যাসেঞ্জার নিয়ে ট্যাক্সি বের কর।
আমি নুরকে বলি,
-`দাঁড়িয়েই তো থাকে শুধু বিরক্ত তো করেনি কখনও।কম বয়সী যুবক, হয়তো মনে মনে তোমাকে পছন্দ করে ও।’
`পছন্দের এ কেমন নমুনা? এটা মুম্বই শহর, এখানে রাস্তা ঘাটে মেয়েদের দিকে খারাপ মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হয় না, মেয়েদের সম্মান করা হয়।’ – নুর বলে ওঠে।
আমি বলি
-`আহা ও তো তোমাকে কিছু বলেনি । হয়তো বন্ধুদের মনের কথা টা বলেছিল মাত্র।
নাকি ও একজন নিতান্তই ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে তোমার এত রাগ?’
নুর মৃদু আপত্তি করে বলে,
-`না না ড্রাইভার তো কি? এ শহরে কোনো পেশাই ছোট নয়, পরিশ্রম করে উপার্জন করে, আজকাল শিক্ষিত মানুষেরা ও মুম্বইতে ট্যাক্সি চালাচ্ছে।
আমার রাগটা কেন হয় জানো? ও একজন অন্য ধর্মের মানুষ। আর আমি অন্য ধর্মের বুঝেও … কি স্পর্ধা ভাবো ওর।’
এবার গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়। মনে মনে ভাবি, নামটাই তোমার নুর, মনটা মোটেই আলোকিত হয়নি।
পরক্ষণেই মনে হয়, নুরের আর কি দোষ! সমাজ পরিবার এরাই তো ছোট থেকে আমাদের ধর্ম আঁকড়ে বাঁচতে শেখায়। সমাজের বাঁধা গুলি মনটাকেই অজান্তে বেঁধে ফেলে।
নুর আমার অফিসের কাজটা অবশ্য ছাড়ে না। সপ্তাহে তিনদিন যেমন আসছিল আসতে থাকে। শঙ্কর ওকে কখনও বিরক্ত করে না। শুধু সকালে ওই সময়টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে , নুরের দেখা পাওয়া পর্যন্ত। এই বড় বিল্ডিংটায় আরো অনেক অফিস আছে। নুর শঙ্করকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে গটগটিয়ে গেট দিয়ে অফিস বিল্ডিং এ ঢুকে যায়।
মাস দুয়েক পরের কথা। মুম্বইতে জোর কদমে বর্ষা এসে পড়েছে। মুম্বই শহরের উপর কোঙ্কণ উপকূলের জল ভরা কালো মেঘ রাশি রাশি জমা হয়ে বৃষ্টিপাত করে চলেছে একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন ধরে।
সকালে উঠে আকাশের মুখ ভার দেখেও অফিসে এসেছি সেদিন। নুর ও এসেছে অফিসে। বেলা বাড়ার সাথে বৃষ্টিও বাড়লো ভীষণভাবে। নিউজে শুনলাম বিভিন্ন জায়গা জলবন্দি হয়ে পড়ছে ক্রমশ , হাই টাইড আর সাথে প্রবল বর্ষণে। আর দেরী না করে দুটো নাগাদ অফিস বন্ধ করে বেরিয়ে পরলাম সবাই। ততক্ষণে অবশ্য যা দেরি হওয়ার হয়েই গেছে। অফিসের বাকি চার জন স্টাফ ছেলে, মোটামুটি কাছাকাছি অঞ্চলে থাকে। আমি সবচেয়ে দূরে থাকি, নর্থের দিকে। নুর থাকে সেন্ট্রাল লাইনে মসজিদ বন্দর বলে একটি জায়গায়। বাসে আধ ঘন্টার পথ।
আমায় নুর বললো, চিন্তা না করতে ও চলে যেতে পারবে। আমি তাই গাড়ি অফিসের পার্কিং এ রেখেই, একখানি ক্যাব বুক করে বেরিয়ে পরলাম বাড়ির দিকে।
তখনও বুঝিনি বাইরের অবস্থা এত খারাপ হয়েছে।
নুর বাসস্টপে এসে ছাতা মাথায় ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়েও একটিও বাস পেল না।দাদার,মাহিম,লোয়ার পারেল সব জায়গায় ব্যাপক জল জমায় বাস এদিকে আসতেই পারছে না। নুর বাসের আশা ছেড়ে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছল। চল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর যদিও একটি ট্রেন এলো সেটাও পরের স্টেশনে পৌঁছে ঘোষনা করলো, ট্রাক জলের তলায় ডুবে যাওয়ার জন্য ট্রেন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আর এগোবে না। শত শত লোক তখন ট্রেনের লাইন ধরেই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। বহু মেয়ে দল বেঁধে আবার অফিসেই ফিরে যাচ্ছে। রাত অফিসেই কাটাবে তারা।
নুরকে বাড়ি ফিরতেই হবে, বাড়িতে ওর বয়স্ক মা একা। অ্যাপগুলিতে কোনো ক্যাব অ্যাভেলেবল দেখাচ্ছে না যে একটা ক্যাব বুক করে বাড়ি ফিরবে। অনেক কাজ ফেরৎ লোকজন ও বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দিয়ে, একে অন্যের হাত ধরে, লাইন করে হাঁটছে। রাস্তায় কোথাও কোমর জল কোথাও হাঁটু জল। একসাথে না হাঁটলে ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে প্রাণ যাওয়ার ঝুঁকি।
নুর বেচারি ততক্ষনে ভিজে জুবজুবে। উপায় না দেখে সে ও রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলো। প্রায় বারো কিমি পথ।
দোকানপাট বন্ধ হযে যাচ্ছে ঝপাঝপ। দিনের আলো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে এসেছে। গোটা অঞ্চলটায় ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে নিস্প্রদীপ করে দেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে জলে পড়ে যাতে প্রাণহানি না হয়।
নুরের চোখ ফেটে জল এলো। কি করবে সে এখন, বৃষ্টি একটু ধরলে স্থানীয় লোকেরা সাহায্যের এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কখনও কমবে বৃষ্টি! কার কাছে সাহায্য চাইবে সে!
চার ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজে আর জলের মধ্যে হেঁটে তার শরীর অবসন্ন লাগছে, পা দুটো ভারি লাগছে। পা আর চলছে না। মাথা ঘুরতে লাগলো, মনে হলো এখনই পড়ে যাবে। মনে মনে আল্লাকে ডাকে সে- রহেম কর মালিক।
হঠাৎ পেছনে ডাক শুনতে পায়,
– ম্যাডাম আমার হাত ধরুন পড়ে যাবেন তো। পিছনে ফিরে দেখে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার শঙ্কর দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত বাড়িয়ে রেখেছে। এই বিপদে শঙ্কর কে দেখে নুরের মনে হয় সে যেন অন্ধকারে আলো খুঁজে পেল। অবজ্ঞা করতে পারে না অন্য দিনের মতো।
নুর ও হাত বাড়ায়।হাতে হাত রাখে। শঙ্কর শক্ত করে ধরে নুরের হাত।
বলে,
-একটু এগিয়ে চলুন, সামনে আমার ট্যাক্সি রাখা আছে, আপনাকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসি। আমি দূর থেকে আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি বিপদে আছেন। আমি এই কাছের চউল এ ভাড়া থাকি। যা অবস্থা আজ আর ট্যাক্সি বের করিনি আমি।
এত জলে আপনি যাবেন? নুর বলে।
আমার গাড়ি উঁচু, গণপতি বাপ্পার নাম করে, এগোই, ঠিক পৌছে যাব। আপনি ভয় পাবেন না, আমরাও মারাঠি, মেয়েদের সম্মান করতে জানি। পরম ভরসায় নুর শঙ্করের হাত ধরে এগিয়ে চলে।
ঘটনাটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু একটু খানি তবু বাকি আছে, বলে দি।
সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে নুর প্রবল জ্বরে পরে অসুস্থ হয়। অনেকদিন ভোগে। আমার অফিসের কাজটিও ছেড়ে দেয় দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য।
আমি ওর জায়গায় অন্য একটি মেয়েকে কাজে রাখি।
মাস চারেক পর। দিওয়ালির পর নভেম্বর শেষের এক হালকা শীতের ঝকঝকে সকাল। নুর আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
অনেক দিন পর ওকে দেখে মনটা খুশীতে ভরে ওঠে। সেই নিষ্পাপ মুখ আর সুন্দর হাসি। ডিসেম্বরে নুরের বিয়ে। তার জন্য নিমন্ত্রণ করতে এসেছে সে।
নুরের সাথে টুকিটাকি গল্প হয়। ওর একা অসুস্থ মা আর দেরি করতে চান না, তাই আত্মীয়র মধ্যেই একটি ভালো সম্বন্ধ আসাতে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
নুর যাওয়ার সময় আমাকে বলে, ভেবেছিলাম শঙ্কর কে নিমন্ত্রণ করবো, গেটের সামনে আজ আর দেখতে পেলাম না। আগের মতো দশটার সময়তেই এসেছিলাম, তাও নেই। ওকে তো সেদিন ভালো করে ধন্যবাদ টুকু জানাতে পারিনি অথচ সেদিন ও না এলে কি যে হতো আমার।
আমি বলি,
-যখন ও রোজ তোমার জন্য অপেক্ষা করতো তুমি তো ফিরেও দেখতে না আজ ও তোমার অপেক্ষায় নেই আর তুমি ওকে খুঁজছো।
আমাকে চমকে দিয়ে নুর বলে
-`কি করি বলো? আমি যে ওকে ভালোবেসেছি সেদিন থেকেই, কিন্তু তারপর থেকে ওর সাথে দেখা হয়নি। তাই তো একবার শেষ দেখা করতে এসেছিলাম’
– `সেকি! শঙ্কর তো অন্য ধর্মের, তোমার ওকে ভালোবসতে বাঁধলো না? সেদিন তো তুমি একথাই বলেছিলে।’
হালকা ব্যঙ্গ করে আমি বলি।
আমার ব্যাঙ্গটাকে গায়ে না মেখে বিষন্ন গলায় নুর বলে,
আচার অনুষ্ঠান সামাজিকতায় শুধু ধর্মের বাধা, সেই বাধা তো পেরোইনি আমি, কিন্তু মনে মনে অন্য ধর্মের কাউকে ভালোবাসতে তো কোনো বাধা নেই তাই সারা জীবন মনে মনে আমি শঙ্করকেও ভালোবেসে যাবো। নুর চলে যায়, চারপাশটায় আলো ছড়িয়ে রেখে।
পুনশ্চ:
[29শে আগস্ট 2017 এর মুম্বই এর ভয়াবহ বর্ষণ বিপর্যয় এর বর্ণনা এই গল্পটিতে দেওয়া হয়েছে। যদিও এটা গল্প নয় ।
দিনটির ভয়াবহতা উইকিপিডিয়াতে `29th August 2017 Mumbai flood’ হিসেবে বর্ণিত আছে।]
গল্পকার
সাহিত্যে স্নাতক, বিজনেস আডমিনিস্ট্রশনে স্নাতকোত্তর করে ১৪ বছর কর্পোরেট ক্ষেত্রে কর্মরত। এক যুগ হলো তিনি মুম্বাইয়ের স্থায়ী বাসিন্দা। কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততাতেও ভালোবাসেন বই পড়তে , লিখতে। রান্না , ভ্রমন আর সোসালাইজিং তার অবসরের নেশা।