| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: অজুফা । কাজী লাবণ্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

      

                     (১)


    কোথাও এক বিন্দু আলো নেই, ক্ষুদ্র একটি কণাও নেই। প্রগাঢ় অন্ধকার থকথকে হয়ে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অনঢ় অন্ধকার ভারি পাথরের মতো নড়তে জানে না, ফিকে হতে জানে না। আলোকে ঢুকতে দিতে জানে না। রুদ্ধপথে ঢুকতে না পেরে আলোরা ফিরে ফিরে যায়। 
    ঠিক যেমন অজুফার জীবনেও কোনো আলো ঢোকেনি। চাক বা না চাক মানুষ পৃথিবীতে আসে কিছু স্বাভাবিক আশির্বাদের স্পর্শ নিয়ে। কিন্তু কোনো স্বাভাবিক আশির্বাদ অজুফাকে স্পর্শ করেনি।
   অজুফা একটু আলোর জন্য বন্ধ চোখে অপেক্ষা করে। চোখের খোলা বা বন্ধ ওর কাছে একই লাগে। আসলে সে কি অপেক্ষা করে? অপেক্ষা করা ব্যাপারটা কি সে জানে! তবে সে নির্বিকার পড়ে থাকে। প্রথমদিকে কিছুটা চিৎকার, একটু ডাকাডাকি করেছে। কিন্তু তার ফ্যাসফ্যাসে, স্তিমিত, করুণ আকুতি এতোটাই শক্তিহীন, এতোটাই দুর্বল যে কারো শ্রুতির আওতায় পৌঁছায় না। মাতৃগর্ভের অন্ধকার কি এমন অসহনীয় ছিল! থাকলে নয় নয়টি মাস সেখানে সে কিভাবে ছিল! এসব কিছুই জানা নেই অজুফার।


                       (২)
কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর থানা। এই থানার এক ইউনিয়ন পুবদি। পুবদির একটি গ্রাম ‘আতিরা’। আতিরা ঘনবসতির গ্রাম। আতিরা আটষট্টি হাজার গ্রামের মতোই স্বচ্ছলতা অস্বচ্ছলতার গ্রাম। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই দরিদ্র, কেউ কেউ হতদরিদ্র। মিজবার উদ্দিন একজন দরিদ্র মানুষ। সে কাজ করে স্থানীয় স্কুলের নাইটগার্ড হিসেবে। নাইটগার্ড শব্দটা যতটা ওজনদার এর বেতনের পরিমাণ ততটাই ওজনহীন। তারপরও সেই বেতনটা তো পায়।
বাড়িতে ছয়টা ছেলেমেয়ে, বুড়া মা, তারা নিজেরা দু’জন। এতোগুলা মানুষের জীবন ওই নাইটগার্ডের আয়ের উপর নির্ভরশীল। পরপর তিনটা ছেলে তারা স্কুলে যাওয়া আসা করে। তারপর তিনটা মেয়ে। মেজো ছেলেটা লেখাপড়ায় নাকি ভালো। মিজবার উদ্দিন এসবের খবর রাখে না। না রাখলেও কিছু খবরাখবর এমনিতেই কানে পড়ে। চোখের ঢাকনা বন্ধ করে রাখা গেলেও কান তো বন্ধ করা যায় না। সংসারের হাল হকিকত থেকে সে প্রায় সময় চোখ বন্ধই রাখে।  
 
তিন ছেলের পরে যে মেয়ে সে মায়ের সাথে ভাইবোনগুলোর খাওয়া দাওয়ার দেখাশোনা করে। সংসারে মায়ের হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে। এদিকে ছোট বোন দু’টারও দেখাশোনা করে। এই বড় মেয়ের নাম শরীফা। শরীফার পর অজুফা নামের এক মেয়ে এবং সবশেষে আর একটি মেয়ে।
ছোট দু’জন প্রায় একই সমান। বছর দু’য়েক যাবার পর দেখা গেল সর্ব কনিষ্ঠজন অজুফার চেয়ে বড় হয়ে গেছে। সে হাটে, দৌড়ায়, কথা বলে অথচ অজুফা কিছুই করে না। ডাকলে শোনে, চোখে দেখে কিন্তু হাটে না কথাও তেমন বলে না। ওদের দাদী প্রায় সময় বলে,
-মাইয়াটার কি একটা সমস্যা আছে। সে কইতে পারে না। দাদী একদিন ছেলেকেও জানায় একথা। ছেলে কানেই তোলে না। একসময় মায়ের কথায় ত্যক্ত হয়ে বলে,
-আরে বড় হইলে আপনে হাটপে। অস্থির হওয়ার কি হইল? হাঁটলে হাঁটুক না হাঁটলে নাই, হাটলে এক্কেরে দিল্লি জয় করবে নাকি?  
এরপরে দাদীর আর কিছু বলার থাকে না।
 
দাদী চুপ থাকলেও পাড়ার মানুষ বলতে শুরু করে। অজুফা যখন আরো কিছুটা বড় হলো তাকে দেখে সবাই কেমন যেন করে। সকলের চোখে বাচ্চাটাকে ‘কেমন’ ‘কেমন’ লাগে। এই কেমনের সঠিক বিবরণ কেউ দিতে পারে না। তবে তাকে স্বাভাবিক লাগে না।
অজুফার মায়ের মন মেয়ের জন্য অজানা আশংকায় কুঁকড়ে থাকে। সংসারের কাজ করে কিন্তু মনটা মেয়ের জন্য উচাটন হয়ে থাকে। সব সময় মায়ের একটা নজর এই দুর্বল, অস্বাভাবিক মেয়েটার দিকে থাকে।
অজুফার দাদী বুঝে যায় এই বাচ্চার উপর ‘তেনাদের’ নজর আছে। দাদী দোয়া কালাম পড়ে ফুঁ দেয়। নানারকম ঝাঁরফুক, তাবিজ কবজ সে করতে থাকে। অজুফার হাতে, কোমরে দিনে দিনে তাবিজের ঝোপা বাড়তে থাকে।  
আরো ক’বছর যাবার পরে অজুফা হাঁটতে শেখে। দেরি হয় তবে অন্য সবার মতো সেও একদিন হাঁটে, কথা বলে, বেড়ায়। সব ভাইবোন যখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে খেলে সেও যায় খেলতে। কিন্তু ও ওদের মতো খেলতে, দৌড়াতে বা চিৎকার করে কথা বলতে পারে না। খেলতে পারে না বলে ওরাও ওকে দলে নেয় না। ততোদিনে কিছু কিছু ছেলেমেয়েরা ওকে ‘বাইগোন বিচি’ বলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ সে খুব খর্বকায়, তার হাত পা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। দিনে দিনে সবাই ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে সে সবার থেকে আলাদা এবং একা হয়ে পড়ে। আলাদা ‘একজন’ হয়ে যায়।
ওর বড়ভাইয়েরা কয়েক ক্লাস পর্যন্ত পড়া শেষ করে, একসময় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কেবল একজন ভাই থেকে যায় বাড়িতে। এই ভাইটা অজুফাকে আদর যত্ন করে। অজুফা চুপচাপ বসে থাকলে সে এসে বোনের পাশে বসে দু’চারটে কথা বলে, খুনসুটি করে। বলে তুই এভাবে চুপ করে বসে থাকিস কেন? অজুফা কিছু না বলে হাসে। বোনের হাসিটা বড় মিষ্টি লাগে ভাইয়ের কাছে।
বোনদের বিয়ে হয়ে যায়। ঝাড়ফুঁক করা দাদী একদিন মারা যায়। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত অজুফাকে কাছে বসিয়ে দোয়া পড়ে ফু দিয়েছে, আদর করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছে,
-একদিন তুইও অদের মতো হবি। তোরও বিয়া হবে। এই আমি দোয়া দিচ্ছি তোর সংসার হবে বইন।

  ঘরের একটা কোণে বসে থাকতে থাকতে সেটাই অজুফার স্থায়ী জায়গা হয়ে যায়। মেয়েটা হাত পা গুটিয়ে এমন একা থাকে, মায়ের কষ্ট হয়। মা একদিন কাদা দিয়ে একটা পুতুল বানিয়ে রোদে শুকিয়ে মেয়েকে দেয়। এটা পেয়ে অজুফার আনন্দ আর ধরে না। সে পুতুল নিয়ে সারাদিন খেলে, ওই পুতুল নিয়ে রাতে ঘুমায়। পুতুলটাই হয় ওর বাঁচার অক্সিজেন। এভাবেই বছরের পিছে বছর চলে যায়। মাটির পুতুল ক্ষয়ে আসে। ভেঙে যায়। তারপরও ওই ভাঙাটাই ওর দিবারাত্রির সঙ্গী হয়ে থাকে। 

একদিন দূর থেকে ভালো মাটি যোগাড় করে, আরেকটা পুতুল বানিয়ে, কাঠি দিয়ে নকশা করে হাত পা চোখ নাক মুখ গড়ে তুলে এবারে আগুনে পুড়ে পুড়ে শক্ত করে মা। এরপর পুতুলের চোখ নাক মুখে কিছু রঙ লাগায়। পুতুলটা একেবারে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই পুতুলই হয়ে ওঠে অজুফার খেলার সাথি, অজুফার বিয়ে, সংসার, জীবন সব।
মেয়ের হাতে মাটির পুতুল তুলে দিয়ে অজুফার মা একদিন মাটির ঘরে আশ্রয় নেয়। 

সময় যায় সময়ের গতিময় চাকায়। ধীরেও নয় দ্রুতও নয়। মিজারউদ্দিনেরও ঠিকানা হয় ওই মাটির ঘরে। ভাইভাবির সংসারে অজুফার দিন যায় না।
একদিন এক প্রতিবেশি খালার সাথে সে রাজধানী ঢাকা শহর চলে আসে।

               

(৩)
ঢাকা শহরের এক বস্তিতে অজুফা সেই প্রতিবেশির ঘরে থাকে আর এক মার্কেটে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে। সে তেমন হাঁটতে পারে না, উঁচুস্বরে কথা বলতে পারে না, কারো কাছে দুঃখের কাঁদুনি গেয়ে কিছু চাইতে পারে না। তবে মানুষজন ওকে দেখলেই বুঝতে পারে রহস্যময় প্রকৃতির খেয়ালের সৃষ্টি এই প্রানটিও একটি মনুষ্য প্রান। মানুষের অবয়বে ওও একজন মানুষ। ওরও ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অসুখ বিসুখ সবই আছে কেউ কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। দিন শেষে যা পায় বস্তি ঘরে ফিরলে সেই প্রতিবেশি খালা সব নিয়ে নেয় তবে বিনিময়ে ওকে খেতে দেয়। এভাবেই অজুফার পোকামাকড়ের জীবন কাটতে থাকে।

আজ দিনটা অজুফার ভালো কেটেছে। সেই আফার লগে দেখা হয়েছে। যার সাথে দেখা হলে অজুফার ব্যাগ নানান সবজি, চিনি, তেল, লবণ বিভিন্ন বাজার সদাইয়ে ভরে ওঠে। কিছু টাকাও হাতে দেয়। সব পাওয়া হয়ে গেছে। এবারে ফিরে গেলে হয়। এতটা পথ ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া কঠিন। টাকা আছে রিকশা নিয়ে গেলে হয়। দুপুরটা হেলে দুলে বিকেলের দিকে গেছে। কিন্তু ভাদ্রের রোদ গরমে চারপাশটা যেন তন্দুরের ভেতরের গনগনে আগুন হয়ে আছে। ভ্যাপসা গরমে অজুফার মনে হয় ‘রইদটা মরুক তারবাদে এলা ফিরা যাব’।
বাজারের ভেতরটা সারি সারি বিভিন্ন দোকানে ভরা। অজুফা চালের দোকানগুলোর কাছে যায়। এখানে দুটো দোকান হওয়ায় চালের বস্তার মাঝে একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। ক্ষুদ্র অজুফা, খর্বকায় অজুফা বস্তার ফাঁকে একটু বসে। ভাবে, জিরিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে বস্তিতে ফিরে যাবে। ক্লান্তিতে সে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম আসবে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু সে ঘুম আর ভাঙ্গে না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নামে। কেনাকাটা শেষ হয়। মার্কেটের শেষ ক্রেতাও চলে গেলে একে একে দোকানের শাটার নামতে থাকে, আলো নিভতে থাকে। মার্কেটের বেরুবার পথগুলোও তালাবদ্ধ হয়।

(শেষ)

নিশুতি রাত ফুরিয়ে আসে। অজুফার ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে না সে কোথায়। এক রত্তি আলো দেখার আশায় সে চোখের তারা ঘুরায় এদিক সেদিক। কিন্তু প্রাগাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছুই নাই কোথাও। এমন সময় একেবারে আকস্মিকভাবে চারপাশ আলোর রোশনাই ছড়িয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, লকলকে আগুনের শিখা দাউদাউ করে ওঠে। সেই সাথে লেলিহান আগুনের হলকা, তীব্র আঁচ এসে লাগে। অজুফা তো এমন আলো চায়নি। সে একটু চোখের আলো চেয়েছিল দুনিয়াটা দেখার জন্য। কিন্তু এতো চোখ ঝলসানো আলো! এ কি ধরনের আলো! এই আলোতে কি কিছু দেখা যায়! এত আঁচ লাগছে কেন!     
আর কিছু ভাবতে পারে না সে। মায়ের দেওয়া সেই পুতুলটা পাশে পড়ে আবার পুড়ে পুড়ে শক্ত হতে থাকে। 
 
তেইশ সালের তেরো সেপ্টেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগে টিভি চ্যানেলগুলোতে ব্রেকিং নিউজ আসে, 
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভয়াবহ আগুন’।     
    


           

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত