“একটা পাখির ওপর তোমার এত রাগ?” প্রশ্ন করেছেন সর্বাণীদি।
আমার পাখিপ্রীতি কোনওদিনই নেই। বেড়াল দেখলেও তাড়া করি। একমাত্র কুকুর ছাড়া কোনও পোষ্যকেই আমল দিই না। কোন ছোট্ট বয়স থেকে মনে গেঁথে গেছে কুকুরই একমাত্র প্রভুভক্ত। বাকিরা থাকা, না থাকা সমান।
সেই আমি মানে সৈকত দাশগুপ্তকে এই পাখি বিদ্বেষ নিয়ে প্রায়ই কটাক্ষ করেন সর্বাণীদি। আজও করলেন। এ আর নতুন কি।
আসলে সর্বাণীদির ভাইপোকে আমি পড়াতে আসি এই মুখার্জি বাড়িতে। সপ্তাহে তিনটে দিন নিয়ম করে সন্ধ্যে সাতটা থেকে নটা অবধি পড়াই।
সর্বাণীদি অবশ্য আমার ছাত্র টুটুন ওরফে শ্রীমান সাত্যকি মুখার্জির তুতো পিসি। কম বয়সে বিধবা হয়ে এই মুখার্জি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মুখ দেখে অবশ্যই নয়। তার জন্য নিয়মিত এই বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম সামলাতে হয়।
মুখার্জি বাড়ির দালানেই টাঙানো থাকে মিঠি নামক টিয়া পাখিটার খাঁচা। এমনিতে সব ঠিক। কিন্তু, মিঠি আমাকে এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই এক নাগাড়ে চিলচিৎকার জুড়ে দেয়। যতক্ষণ না ওর চোখের আড়ালে যাচ্ছি ততক্ষণ হতচ্ছাড়াটা একনাগাড়ে চেঁচিয়েই চলে। খাঁচাটা এমনভাবে কামড়ে থাকে যেন সামনে পেলে আমায় চিবিয়ে খাবে।
পাখিটা এমনিতে খুব সুন্দর শিস দেয়। সর্বাণীদিকে ডাকে, “দিদি খেতে দাও। দিদি খেতে দাও।” এই বাড়ির সব্বাইয়ের সর্বজনীন দিদি ডাকটা এই পাখিটাও দ্রুত শিখে নিয়েছে। টুটুন ওকে খুব খ্যাপায়। সেজন্য টুটুনকে ধারেকাছে দেখলেই মিঠি আউড়ে চলে, “এই বাঁদর পড়তে বস। এই ভোদড় পড়তে বস।” কিন্তু, আমাকে দেখে যে অসভ্যতাটা করে, বাড়ি মাথায় করে, অন্য কাউকে দেখে মোটেই তা করে না।
এটা আমি জেনেছি, সর্বাণীদির থেকেই। উনি আক্ষেপের সুরে এও বলেন, “পাখিটা তোমায় দেখলে কেন এমন করে আমার মাথায় ঢোকে না।”
আমিও কথা শোনাতে ছাড়ি না। বলি, “তাও আপনিই তো আবার ওকে মিঠি মিঠি করে ডাকেন। টিয়াদের কমন নাম মিঠু। সেটা বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়?”
“আরে বাবা তোমাকে যদি সৈকত না বলে আমি সৈকতী বলি তোমার কেমন লাগবে বলো তো? পাখিটা তো মেয়ে। তাই ওকে মিঠি বলি। জেন্ডারটা তো মানতে হবে?” যুক্তির জাল বোনেন সর্বাণীদি।
“ও এই কথা। মেয়ে পাখি বলেই ওর এতো তেজ।”
“বাবা। মেয়েদের ওপর এতো রাগ তোমার।” সর্বাণীদি বরাবরের মতোই কৌতুক করেন।
মানুষটা হয়তো তথাকথিত ডিগ্রিধারীনি নন, কিন্তু প্রচুর পড়াশুনা। এখনও সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি সেরে বইপত্র পড়েন। সর্বাণীদির জন্য প্রায়ই কিছু না কিছু বই বা ম্যাগাজিন নিয়ে আসি আমি। পড়া হলেই বই ফেরত দেওয়ার জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়েন।
আমিই বরং বলি, “আরে দিদি এত তাড়াহুড়োর কি আছে। আমি তো এই বাড়িতে তিনদিন আসিই।”
সর্বাণীদি বলেন, “না ভাই বই কিন্তু মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। অনেকেই দেখবে খুব মিষ্টি কথা বলে বই নেবে। তারপর আর ফেরতের নাম করবে না।”
কথাটা খুবই খাঁটি। আমার সঙ্গে এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। অনেক চেনাজানা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এভাবে আমার অনেক মূল্যবান বই নিজের করে নিয়েছে। এই মূল্যবান কথাটা অবশ্য দামের কথা দিয়ে তুল্য নয়। এই অসামান্য বইগুলো অনেক খুঁজে পেতে আমি সংগ্রহশালায় সাজিয়েছিলাম। সেগুলিই বেহাত হয়ে গিয়েছে।
এর মধ্যে আবার সারা দুনিয়া উত্তাল হয়ে উঠেছে কোভিড মহামারী নিয়ে। বাদ যায় নি আমাদের দেশও। সারা দেশজুড়ে কড়া লকডাউন শুরু হয়েছে।
টুটুনের পড়াশুনা তা বলে থেমে থাকে কি করে? যদিও স্কুলের অনলাইন ক্লাসটা নিয়মিতই করছে। কিন্ত, অঙ্ক আর সায়েন্স সাবজেক্টে ভারী কাঁচা। তাই তো ওর বাবা মনোতোষবাবু আমাকে নিযুক্ত করেছেন।
নিজের হয়ে বলছি না, তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর টুটুনের অঙ্ক আর বিজ্ঞান বেশ ভাল লাগতে শুরু করেছে। এটাই আমার তরিকা। ছাত্রদের ওপর জোর করে পড়াশুনা চাপিয়ে দিই না। সাবজেক্টের প্রতি ওদের অনুরক্ত করে তুলি।
আর এর জন্য বলতে দ্বিধা নেই, প্রচুর টিউশন পাই আমি। আয়টাও মন্দ হয় না। আচ্ছা আচ্ছা খারাপ ছাত্রদের রেজাল্টও আমার হাতে পড়ে তুখোড় হয়। এই তো টুটুন গতবার সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে যথেষ্ট ভিরমি খেয়েছে। কিন্তু, আমার কাছে পড়া শুরু করার পর সেভেন থেকে এইটে উঠেছে ড্যাং ড্যাং করে। রেজাল্ট যথেষ্ট ভাল হয়েছে। আমার সাবজেক্টগুলো অর্থাৎ অঙ্ক, ফিজিক্যাল সায়েন্স আর লাইফ সায়েন্সে প্রচুর নম্বর পেয়েছে টুটুন।
মনোতোষ বাবু খুশি হয়ে আমাকে সামন্ত সুইটসের ইয়া বড় রাজভোগ আর রসগোল্লা খাইয়েই ক্ষান্ত থাকেন নি, না বলতেই আমার মাহিনাও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
গিন্নিকে ডেকে বলেছেন, “সোনালী পরের মাস থেকে কিন্তু স্যারকে দুহাজার টাকা বেশি দেবে।”
যেহেতু হোমফ্রন্টের দায়িত্ব গিন্নির ওপর ন্যাস্ত থাকে তাই এইভাবে আমার বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা হয়েছে।
তবে লকডাউন কয়েকদিন গড়ানোর পর নিজেই একদিন ফোন করে ছেলের পড়াশুনায় ফাঁকি দেওয়া নিয়ে আমার কাছে অনুযোগ করেছেন মনোতোষবাবু।
এহেন অবস্থায় আমিও বা কি করে চুপ থাকতে পারি। পুরনো স্কুটি টাকে জুতসই করে নিয়ে ফের মুখার্জি বাড়ি যাতায়াত শুরু করেছি। এখন অবশ্য সকালে যাচ্ছি। আর সপ্তাহে দুদিনের জন্য।
টুটুন একটু মুষড়ে পড়লেও অঙ্কের জাদু ছড়ি দিয়ে ওকে বশ করে নেওয়া তো আমার কাছে বাঁ হাতের খেল। হ্যাঁ, পড়ানোর সময় আমার মধ্যে একটা সম্মোহিনী ক্ষমতা চলে আসে। এটা বিলক্ষণ টের পাই আমি। কিন্তু, একটা পাখিকে কিছুতেই আমি বশে আনতে পারি নি। এটা আমার ব্যর্থতা তো বটেই।
সর্বাণীদি সেটা বলেওছেন আমায়। “ছাত্রকে তো এত সুন্দর কন্ট্রোলে নিয়ে এসেছ। পাখিটাকেই মানুষ করতে পারলে না।”
এর কি উত্তর দিই বলুন তো? একটা নাছোড় পাখিকে নাকি মানুষ বানাতে হবে। ধুর ধুর। আমার বয়েই গিয়েছে অমন একটা অসভ্য, বেয়াদব পাখিকে সবক শেখানোর।
তবে এই লকডাউন পর্বে মুখার্জি বাড়ি যাওয়ার সময়ই একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।
প্রথমদিনই সেই পরিবর্তনটা নজরে এসেছে আমার। অন্যদিনের মতো দালানটা পেরিয়ে যখন সিঁড়ির দিকে যাচ্ছি তখন পাখিটা মানে সর্বাণীদির আদরের মিঠিকে দেখলাম নির্বিকার সমাধিতে থাকার মতো ধ্যানস্থ হয়ে আছে। বারদুয়েক চা আর জমিয়ে ব্রেকফাস্ট সহযোগে যখন টুটুনকে পড়িয়ে বেরিয়ে আসছি তখনও দেখলাম মিঠি যেন আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না। দার্শনিকের মতো ড্যাব ড্যাব করে আমাকে দেখছে।
ব্যাপারটা কি হল? এতদিন যে পাখি আমাকে দেখলেই কর্কশ স্বরে ডেকে পাড়া মাথায় করত সেই এমন চুপ মেরে গেল কেন?
এভাবে দু-তিনদিন কাটার পর আমার সন্দেহ আরও বাড়ল। যে ডাকটা এতদিন অসহ্য লাগত সেটাকেই কেমন যেন মিস করতে শুরু করেছি।
সর্বাণীদিই তাঁর পোষা মিঠির এই অদ্ভূত আচরণের রহস্য ভেদ করলেন।
বললেন, “ওহো মাস্টারমশাই এতো ছাত্রদের পড়াচ্ছ আর এই সাধারণ অঙ্কটা বুঝলে না।”
“অঙ্ক মানে? পাখিটা আমাকে দেখে আর কোনওরকম শব্দ করে না। তার মধ্যে আবার অঙ্ক পেলেন টা কোথায়?”
“আরে বাবা লকডাউন হওয়ার পর থেকে এই যে মুখার্জি বাড়িতে পড়াতে আসছ, তাতে তোমার মধ্যে একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছে তো নাকি?”
“আমার মধ্যে পরিবর্তন? কি যে বলেন না, সর্বাণীদি। এই মহামারী মনে হয় আপনার চিন্তাভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে।” সর্বাণীদিকে ঠেস দিয়েই বললাম আমি। “তোমার শুধু নয়, গোটা বিশ্বজুড়েই এই পরিবর্তন টা এসেছে। আর সেটা হল মুখের ওই মাস্ক গো মাস্টার।” সপ্রতিভ সর্বাণীদি।
সত্যি তো সর্বাণীদি তো ঠিকই বলেছেন। লকডাউনের পর আমি নিয়ম করে নানারকম কালারের বাহারি মাস্ক পরেই এ বাড়িতে ঢুকছি। আর পকেটে রাখা স্যানিটাইজার দিয়ে ঘনঘন হাত কচলাচ্ছি। তাহলে ওই মাস্ক পরিহিত অবস্থায় আমাকে দেখেই…
আমার মনের কথা আন্দাজ করেই ফের সরব হলেন সর্বাণীদি। “পশুপাখিরা মানুষের মুখটাকেই চেনে গো। মুখোশ পরা লোকেদের ওরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। অথচ দেখো আমরা আবার মুখোশ পরা মানুষকে নিয়েই নাচানাচি করি।”
সর্বাণীদির কথার অকাট্য যুক্তি মেনে নিয়ে সেদিনের মতো স্কুটিতে স্টার্ট দিলাম আমি। এরপর থেকে মিঠির খাঁচার সামনে দিয়ে আসা-যাওয়ার সময়ে মুখের মাস্ক টা খুলে ফেলি আমি। আর কি আশ্চর্য মিঠিও কিন্তু আর “চেঁচিয়ে চ” হয় না। বরং আমাকে দেখলে মিষ্টি একটা প্রাণজুড়নো শিস দেয় ।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করার পর পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে বেশ কয়েকটি দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন লেখক। সুপরিচিত একটি সাপ্তাহিকেরও গুরুদায়িত্ব নিয়ে কাজ করে চলেছেন বিগত কয়েক বছর। সাংবাদিকতার বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাত পাকিয়েছেন ডিজিট্যাল মাধ্যমেও। অর্থনীতি তথা শেয়ার বাজারের ওপর কলম লেখার স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতার পাশাপাশি পুরোদস্তুর পলিটিক্যাল বিটেও সাংবাদিকতা করেছেন চুটিয়ে। গল্প লেখার জগতে মাত্র বছর দেড়েক পদার্পণ। ইতিমধ্যেই আনন্দমেলা, সুখী গৃহকোণ, শিলাদিত্য, একদিন, গণশক্তি, সুখবর, স্বস্তিকা, আলিপুর বার্তা, সংবাদ বিশ্ব বাংলা পোর্টাল সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় চুটিয়ে গল্প লিখছেন।