আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
গ্লাসডোর টা খুলে অফিস থেকে লাঞ্চ করবে বলে বাইরে বের হয়ে এসে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো অনীতা।মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুর। মাঝে মাঝে অফিসটাকে মনে হয় যেন সোনার খাঁচা। ব্যস্ত মতিঝিলের এই নামকরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্পোরেট অফিসের ঝকঝকে তকতকে হিমশীতল আরামদায়ক এসি রুম, যেখানে হঠাৎ বাইরের কেউ ঢুকলে ভুল করে এন্টার্কটিকার কোন জায়গায় চলে এসেছি বলেও ভাবতে পারে, তো তেমন জায়গায় বসে কাজ করতে করতেও সে হাঁপিয়ে ওঠে।
চাকরীটা তাড়াতাড়ি পাল্টানো দরকার , ভাবলো অনীতা। ওর চোখে লালমাটিয়ার গাছগাছালি ভরা নিরিবিলি পরিবেশের দোতলা, তিনতলা এনজিওদের অফিসগুলোর ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে, ওরাতো তাও দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য কাজ করে, ওইসব জায়গায় কাজ করার একটা অর্থ তবু দাঁড় করানো যায় কিন্তু কর্পোরেট অফিসগুলোর নিজেদের লাভ লোকসানের সারাক্ষণের হিসাব নিকাশের এই জীবন ওর একেবারেই পোষাচ্ছেনা। সবসময় মনে হচ্ছে অন্যের মুনাফা আর ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর জন্য নিজের গোটা জীবনের বিনিময়ে এই চাকরী করার জগতের মানুষ ও নয়, আরো একটু যেন অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার জীবিকার ব্যাপারটা। শুধু মাস গুনে টাকা পেয়ে গেলেই যেন হলোনা।
এসব ভাবতে ভাবতে শাপলা চত্বরের দিকে তাকালো সে, রায়হান আসছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো। অন্যদিন আগেই আসে! আজ নির্ঘাত কাজে আটকেছে। দুজনের একই অবস্থা, ভাবলো সে। তাদের চাকরীর ১ বছরও হয়নি। জীবন তো মাত্র শুরু। অনীতারতো মাষ্টার্সের রেজাল্টটাও দেয়নি এখনও। তবুও চাকরিটা হয়ে গেল।
কিন্তু মাথার মধ্যে তো মাঝেমাঝেই অন্যরকম কিছু ঝিঁঝিঁ পোকা ঘোরে ফেরে! কতদিন হয়ে গেল ছায়ানটে গানের রিহার্সেলে থাকতে পারছেনা। চারণের কতগুলো আবৃত্তির প্রোগ্রামে এরমধ্যেই সে বাদ পড়ে গেছে সময় বের করতে পারেনি বলে। অথচ চাকরিটা শুরু করতে হলো একেবারে আপাদমস্তক এক খোট্টা কর্পোরেট জায়গায়। টাকা পয়সার হিসাব ছাড়া যেখানে আর কিছুই নেই।
দূর থেকে লম্বা মানুষটার অবয়ব আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগলো। দুজনের কাছকাছি অফিস। হাঁটা দূরত্ব। সকালে মোহাম্মদপুরের যার যার বাসা থেকে বের হয়ে একসাথে বাস ধরে অফিসে আসা… ওকে নামিয়ে দিয়ে রায়হান চলে যায় তার জায়গায়। কাজের বেশী চাপ না থাকলে চেষ্টা করে দুপুরের খাবারটা দুজনে বাইরে এসে কোনো রেস্তরায় বসে খাওয়ার। কিছুটা সময় নিজেদের মত করে পাওয়া আরকি।
‘আর বলিসনা, ঠিক বের হওয়ার আগেই এমন একটা ঝামেলা এসে চাপলো!’- কাছে এসে বললো রায়হান,’চল এগোই।’
দুজনে এগোলো সামনেই কস্তুরী’র দিকে। দারুণ বাংলা খাবার ওদের। দুজনেরই পছন্দের জায়গা।
‘কি খাবি বল!’ মতিঝিলের অফিস পাড়ায় এই সময়টা খাবার দোকানগুলো গমগম করতে থাকে মানুষের ভীড়ে।দুপুরবেলা খাওয়ার উছিলাতে হলেও একটু বাইরে এসে দম ফেলতে পারে মানুষগুলো! চারিদিক থেকে নানারকম খাবারের গন্ধ মৌ মৌ করছে। কতরকম মানুষ তাদের জীবনের কতরকম গল্প নিয়ে যে এক একটা টেবিলে বসে আছে! ভাবলো অনীতা।
‘কি হলো বল কি খাবি!’ – সংবিত ফিরলো অনীতার রায়হানের কথা শুনে। তাকিয়ে দেখলো ওয়েটার ছেলেটা দাড়িয়ে অর্ডার এর জন্য।
‘আরে হাল্কা কিছু একটা বললেই হয়।’, অনীতার জন্য একটা চিকেন ঝাল ঝাল কারী আর নিজের জন্য একটা কাতলা মাছের ঝোল, টাকী মাছ ভর্তা আর পাতলা ডাল অর্ডার দিয়ে ছেলেটাকে বিদায় করে দিয়ে ওর দিকে ভালো করে তাকালো রায়হান। ‘কিরে, কি হয়েছে? কোন সমস্যা? মুখ দেখেতো মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।’
‘ওই আর কি! তেমন কিছুনা,’ বললো অনীতা। ‘বাইরে গেছিলি কোথাও?’ রায়হান জিজ্ঞাসা করলো আবার। ‘হু,’ মাথা ঝাকালো অনীতা। ক্লাইন্ট সার্ভিসে এক্সিকিউটিভ হিসাবে কাজ করে সে। প্রায়ই ক্লায়েন্টদের সাথে কাজের কারণে দেখা করার জন্য বাইরে যেতে হয়। যেহেতু নতুন এখনও, তাই বড় ক্লাইন্ট হলে প্রথমবার সিনিয়ররা কেউ কেউ থাকে সাথে, পরিচিত হয়ে গেলে এরপর থেকে অনীতা একাই যায় প্রয়োজন মতো।
‘কি হয়েছে কি বলনা,’ আবার বলে রায়হান।
‘আরে আজকে পিকলু ভাই এর সাথে আমাদের এক বড় ক্লাইন্ট এর অফিসে গেছিলাম, বললো অনীতা, এমন একটা ঘটনা ঘটলো মেজাজটা সেই থেকে চড়ে আছে একদম। ওদের একটা বড় রিপোর্ট এর কাজ চলছে আমাদের সাথে, কাজটায় অনেক ভুল রয়ে যাওয়াতে সেগুলো সব ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। ডেডলাইন শেষ, আজকে লাস্ট ড্রাফটটা দেখানোর জন্য গেছি। পিকলু ভাই হঠাৎ বলে কিনা, আপনি যেয়ে কথা বলেন আমি নীচে আছি। শুনেতো আমি অবাক ! কাজটা নিয়ে সে আমাকে কোন ব্রিফও করেনি যে সেটা কি অবস্থায় আছে। আমি সাথে এসেছি আজকে কাজটা বুঝে নেবো বলে যেন এরপর থেকে আমি বিষয়টা ডিল করতে পারি।
আচ্ছা, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাইন্ট এর সাথে এরকম করার মানে কি বলতো? ভদ্রমহিলা বিদেশী। আমি রুমে ঢুকে তাকে পরিচয় দিয়ে ড্রাফটটা দেখাতেই সেতো রাগে ফেটে পড়লো। কোন বিদেশী মহিলার এরকম চেহারাতো কখনও দেখিইনি, দেখবো তা কল্পনাও করিনি, তাও এভাবে! কাজের মান নিয়ে খুব অখুশি, নানান ভুল আমাকে দেখিয়ে দিল! অথছ এটা আজ কালের মধ্যেই প্রেস এ যাবে। কেমন লাগে বল! যাহোক আমি মহিলাকে পুরা বিষয়টা ভালো করে দেখছি এবং আর এরকম হবেনা বলে টলে … কাজটা ভালোমত বুঝে নিয়ে বের হলাম!
নীচে এসে দেখি পিকলু ভাই দাড়িয়ে আরামসে সিগারেট টানছে! এমন রাগ হলো দেখে। আমারকি ধারণা জানিস, পিকলু ভাই ভালো ইংরেজী বলতে পারেনা, সে ইচ্ছা করেই আমাকে ঠেলে দিয়েছে এভাবে।’
হোহো করে হেসে উঠলো রায়হান এই কথা শুনে!
‘কর্পোরেটদের ভিতরে এসব হরদমই হয়। আমাদেরও এরকম বহূত ঘটনা ঘটতেই থাকে। চাকরী মানেই এসব মেনে নিয়েই তো করা। চাকরের কাজ পুরাই বুঝলা? মাস শেষে কত গুলো কড়কড়ে টাকা ব্যাংকে ঢুকে যাবে, ব্যস সারা মাসে একটু গুছিয়ে চললে আর নো চিন্তা। কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা… এইতো। এর বিনিময়ে হয়ে গেলাম আমরা কেনা গোলাম, বুঝলেন বেগম সাহেবা?’ হাসতে হাসতে বলে রায়হান।
অথচ কত মানুষ এরকম একটা চাকরী পাবার জন্য হা পিত্যেশ করছে! কিন্তু আমাদের কেন এরকম অদ্ভুত ভাবনা হয়! ভাবে অনীতা।
খাবারএসে গেল ওরা কথা বলতে বলতে। একেবারে ধোয়া ওঠা খাবার। ঠিক এই টাটকা গরম খাবারের আকর্ষণেই মানুষের এত ভীড় এখানে।
‘তোর কি অবস্থা? ‘ অনীতা বললো। ‘ঐ একই’ … রায়হান তাকায় খেতে খেতে ওর দিকে। ‘কাজের জায়গার চেহারা সবজায়গায় কম বেশী একই! এগুলো নিয়েই চলতে হবে। কে কতটা কিভাবে মানিয়ে চলতে পারে সেটাই আসল কথা। আমারও মাঝে মাঝে খুব অস্থির লাগছে ! এত কাজের ভীড়ে নিজের আসল কাজের আর কোন সময়ই পাচ্ছিনা। আমার উপন্যাস টা অর্ধেক লিখে ফেলে রেখেছি আজ কতদিন হলো… রাতে বাসায় যেয়ে ক্লান্ত লাগে… মাথায় আর কিছু আসেনা, জানিনা… কতদিন এভাবে পারবো! মাত্র তো শুরু! সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরো দিনটা কত কত অহেতুক কাজের ভীড়ে আমার আসল কাজ চাপা পড়ে যায় মাস শেষে টাকাগুলো পাবো সেইজন্য। এই চিন্তাই আমাকে অস্থির করে মারে… অথচ টাকারও কত দরকার।আর ৬ মাসের মধ্যে আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি…’
অনীতারও অস্থির লাগে রায়হানের কথা শুনতে শুনতে.. ওর খাওয়া শেষ আগেই, রায়হানের কথা শুনতে শুনতে ওর খাওয়া দ্যাখে, মাছ খাওয়ার পোকা। খুব আরাম করে ফিসকারীটা খেয়ে ডাল নিয়ে খাওয়াটা শেষ করে। হাত ধুয়ে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, ‘চল তাড়াতাড়ি অফিসে ফিরেই মিটিং ধরতে হবে একটা।’
যাহোক এত চিন্তা করে কি হবে! এভাবেই চলবে, তুই শুধু আমার পাশে থাক, তাহলেই সব ঠিকঠাকা … ‘ একটু হেসে অনীতার দিকে তাকিয়ে হাতের উপর ওর হাতটা রেখে আলতো করে চাপ দিলো. সারাদিনের অক্সিজেন যেন। অনীতার কথা ভেবে ওরও খারাপ লাগে…চমৎকার একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল আছে অনীতার। এত ভালো গান গায়, আবৃত্তি করে অথচ চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই সেগুলো সবই যেন কত দূরের ব্যাপার হয়ে গেছে! কয়েকদিন আগেও খুব ভালো একটা কাজের প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলো অফিস এর টাইম এর সাথে মিলাতে পারলো না বলে। কিভাবে এরপরে সেগুলো এগিয়ে নিতে পারবে, গোটা দিনগুলো এই চাকরী নামক দানবটার পেটে দিয়ে, সেটাই ভাবলো।বিয়ের পর দুজনের নতুন সংসার… দায় দায়িত্বের আরো নানান রকম চেহারা বের হতে থাকবে।!
অনীতা’র একটু চিন্ন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চিন্তাগুলোও যেন সিগারেট এর ধোয়ার কুন্ডুলীর মত জট পাকিয়ে যেতে থাকে!!!
জন্ম যশোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক সংস্থায় কাজ করেছেন দীর্ঘদিন, সেই সূত্রে বাংলাদেশের বির্স্তীর্ণ গ্রামীণ ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংস্পর্শে যাওয়ার ও তাদের জীবনকে নানাভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। এক দশকের বেশী সময় ধরে বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ পরিবেশনার সাথেও যুক্ত আছেন। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির সাথে জড়িত থাকলেও দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বর্তমানে ছোটগল্পের মাধ্যমে আবারও লেখালেখির জগতে বিচরণ করছেন। ভ্রমণ করতে এবং ভ্রমণ নিয়ে লিখতেও ভালোবাসেন। বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত তার ছোটগল্প ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘সমুদ্রের কাছে দুঃখ জমা রাখি’।
i like the spontaneous way you wrote on regular but unavoidable challenges of our life , living and passions which we some time need to get rid of for survival ,may be for being in a bigger picture of life.