আরো একটিবার পৃথ্বীর গোপন আস্তানায় উপস্থিত হয়েছে প্রতিবিম্ব। পৃথ্বী নিজের উদ্যোগেই তার মিত্রকে তার ডেরায় নিয়ে এসেছে। বন্ধুত্বের উদযাপন এর মধ্যেই ঘটনা প্রবাহে সুন্দরগড়ের রাজকুমারী এসে পড়েছেন তাদের মধ্যে। কী ভাবে সব ঘটনা আশ্চর্য ক্রমে ঘটেছে তা চিঠির মাধ্যমে তার রাজকন্যা রাজেস্বরীকে লিখে রাখছে তার দস্যুরাজ প্রতিবিম্ব। দস্যুরাজ লিখছেন
প্রিয়তমা রাজকন্যা,
আজ এই চিঠি আপনাকে লিখছি পৃথ্বীর গোপন আস্তানা থেকে। পৃথ্বীর বন্ধুত্বের আতিথ্য গ্রহণ করেছি আরো একবার। কথা মতন সব ব্যবস্থা পৃথ্বীই করেছে। এখানে আসার পর থেকে যা সব অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে তা একে একে আপনাকে বলবো। রাজকোষের কাজ শেষ করে একদিন স্বগৃহে ফেরার সময় তার দলেরই একজন পাগড়ি মুখবন্ধের আড়াল থেকে চাপা স্বরে আমার কাছে এসে পৃথ্বীর নির্দেশ জানিয়ে যায়। মধ্যরাতে যেন তৈরী হয়ে গৃহের বাইরে অপেক্ষায় থাকি। কথামতো অপেক্ষায় ছিলাম। অন্ধকার চিঁড়ে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পৃথ্বী নিজেই এসে উপস্থিত হয় আমার সামনে। “উঠে পড়ো” নির্দেশে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার ঘোড়ায় উঠে পড়ি আর নিমেষের মধ্যে ঘোড়া ছুটতে থাকে নগর ছাড়িয়ে অরণ্য অভিমুখে। বৈকুণ্ঠপুর অরণ্যের শুরু যেখানে হয়েছে সেখানে আমার জন্য পৃথক ঘোড়া বাঁধা ছিল। অশ্বপৃষ্ঠে দুই ছায়ামূর্তি অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছিলাম। এবার আর আমার চোখ বাঁধলো না পৃথ্বী। মাত্র কদিনের আলাপেই এতটা বিশ্বাস করেছে আমাকে। ভালোবাসার মতো বন্ধুত্বও বোধহয় অন্ধই হয় রাজকন্যা। এখানে এসে সেই সব মানুষদের সঙ্গে আলাপ হলো যারা আগেরবার আপনার দস্যুরাজের সুস্থ হওয়ার পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান বুড়ো কালীকিঙ্কর। এখানে সবাই তাকে ভালোবেসে ‘বুড়ো বদ্যি’ বলে সম্বোধন করে। ইনিই আমার ক্ষত সেলাই করেছিলেন এবং তাঁর তৈরী করা ভেষজ প্রলেপেই ক্ষত তাড়াতাড়ি সেরে উঠেছিল। চারকসংহিতা এবং সুশ্রুতসংহিতা অধ্যয়ন করা বুড়ো কালীকিঙ্কর খরগোশের অস্থি এবং পেশী তন্তু থেকে নিজ হাতে ক্ষত সেলাই এর সুচ এবং গ্রন্থি প্রস্তুত করেন। অশীতিপর এই বৃদ্ধ এজন্যই পৃথ্বীর দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তাঁর পুত্র অম্বরীশ আর কন্যা অম্বা তাঁর কাছে এই শিক্ষা এই কৌশল শিখে পারদর্শী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আপনাকে বলা হয়নি রাজকন্যা, এই অম্বাই সময়ে সময়ে আমার ক্ষতের প্রলেপ বদলে দিয়ে নতুন পট্টি বেঁধে দিয়ে যেত। আজ এতদিন পর এদের সঙ্গে সঠিকভাবে আলাপ হলো।
আপনাকে আগেই বলেছিলাম দস্যু সর্দার পৃথ্বী, ধনী মানুষদের অর্থ লুঠ করে প্রান্তিক মানুষদের সাহায্য করে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম গতকাল। ছদ্মবেশ ধরে আমি আর পৃথ্বী সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম গ্রামে গ্রামে। ছদ্মবেশের কারণ রাজার ও ইংরেজদের খোচরদের নজর এড়ানো। কত মানুষ যে নিদারুণ দীনতায় জীবন অতিবাহিত করছে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। পৃথ্বী এদের সবার দেখাশোনা করে। কেউ খেতে পাচ্ছে না তার অন্নের ব্যবস্থা, কারুর ঘর ভেঙে পড়ছে তার মেরামতের ব্যবস্থা, কারুর বিবাহযোগ্যা কন্যার বিবাহের ব্যবস্থা, পড়াশোনার জন্য বই খাতার ব্যবস্থা, তালিকা বেশ প্রশস্ত। এবং এই সবটাই হয় অত্যন্ত গোপনে। এতটাই গোপনীয়তা অবলম্বন করে পৃথ্বী যে তাঁর আস্তানা কোথায় অবস্থিত সে ধারণা পর্যন্ত কারুর নেই। গ্রামের লোকেদের ভিড়ে মিশে তাদের কথাতেই সব স্পষ্ট হলো, পৃথ্বীকে নিজ মুখে একটি শব্দও খরচা করতে হয়নি। সুন্দরগড়ের মহারাজ মহীমহেন্দ্র সেন এর উপর পৃথ্বীর আক্রোশ না থাকলেও প্রান্তিক মানুষদের যথেষ্ট খেয়াল না রাখার জন্য যথেষ্ট ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। কথায় কথায় এটাও জানতে পারলাম যে এক সময় পৃথ্বীরাজ সৈন্য দলের সদস্য ছিল। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতায় বিরক্ত হয়ে দস্যুবৃত্তির এই পথ বেছে নিয়েছে সে। পৃথ্বীকে সারা রাজ্য দস্যু সর্দার হিসেবে চেনে রাজকন্যা, কিন্তু ভেতরের মানুষটাকে আমার মতো এতো কাছ থেকে কেউ দেখেনি হয়তো।
এরপর দিনান্তে আস্তানায় ফেরার মুহূর্তে এক অদ্ভুত ও আকস্মিক ঘটনা ঘটলো। অরণ্যে প্রবেশ করার মুহূর্তে হঠাৎ একাধিক অশ্ব খুরের শব্দ পেলাম। শব্দ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে বুঝতে পেরে আমাকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয় পৃথ্বী। একটু পরে দেখতে পেলাম একটি শ্বেত অশ্বের পিঠে চড়ে একটি দামী শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা এক যুবতী বিদ্যুৎ বেগে আমাদের সামনে দিয়ে অরণ্য পথ ধরে চলে গেলো। তার খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে আর যতক্ষণ তাকে দেখা গেলো ততক্ষণ বার বার সে পিছনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। আমার মনে হলো যেন যুবতীটি সুন্দরগড়ের রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতা। খুরের শব্দ এখনও থামেনি। একাধিক অশ্বের শব্দ এখনও আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এবার আমাদের দিকে আরও তিনজন অশ্বরোহী দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে দেখা গেলো। এরা সবাই পুরুষ এবং মুখ মাথা আবৃত। মনে হলো এরা ওই যুবতীটির পেছনেই ধাওয়া করছে। উদ্দেশ্য যে সাধু নয় বলাই বাহুল্য। পৃথ্বীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার শক্ত চোয়াল আরও শক্ত হয়েছে। নিজের কোমরবন্ধ থেকে একটি খাপ সমেত ছুরি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে একটি গাছের ডাল বেয়ে বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেলো সে। “এখানেই কোনো আড়ালে অপেক্ষা কোরো” বলে সে গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সবার পেছনে থাকা অশ্বরোহীর ওপর। দূরে চলে যেতে যেতে দেখলাম তাদের মধ্যে প্রবল ধস্তাধস্তি চলছে। চোখের আড়াল হওয়ার পূর্বমুহূর্তে দেখলাম পৃথ্বীর সঙ্গে পেড়ে না উঠে সে ঘোড়া থেকে নিদারুণ গতিতে ভূপতিত হলো। ঘটনার আকস্মিকতা আর পৃথ্বীর দুঃসাহসী পদক্ষেপ কিছুক্ষণের জন্য চলৎশক্তিহীন করেছিল আমায়। আমার অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার ছিলনা সেই মুহূর্তে। পৃথ্বীর নির্দেষ অনুযায়ী এটি বৃহৎ বটবৃক্ষের আড়ালে অপেক্ষা করতে থাকলাম। প্রায় অন্ধকার সময়ে দেখলাম পৃথ্বী একটি ঘোড়ায় চড়ে ফিরে এলো। তার সামনে আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে আছে অচৈতন্য যুবতীটি। বেশভূষা ও চেহারা দেখে মনে হয় সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের কেউ হবেন। আমি ভালো করে নিরীক্ষণ করে নিশ্চিত হলাম ইনিই রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতা। রাজকুমারীকে পৃথ্বীর আস্তানায় নিয়ে যাওয়াই ঠিক হলো। আহত হয়েছে কিনা বুড়ো কালীকিঙ্কর সব দেখে শুনে নিলে, জ্ঞান ফিরলে রাজকন্যাকে প্রাসাদে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। বুড়ো কালীকিঙ্কর রাজকুমারীকে পরীক্ষা করে বলেন মানসিক অভিঘাতের কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। শারীরিক আঘাত কিছু নেই। একটি ওষুধের নির্যাস কয়েক ফোঁটা তার মুখে ফেলে দিয়ে জানালেন ভয়ের কিছু নেই। তবে তার জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। রাজকুমারীকে এতো নিকট থেকে দেখার অবকাশ হয়নি আগে কখনো। অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারীনি রাজকুমারী। দুধে আলতা গায়ের রঙ, এক মাথা অবিন্যস্ত কোঁকড়ানো কেশরাশি। শুনেছি অত্যন্ত জেদি ও রাগী সুন্দরগড়ের রাজকুমারী। ডানপিটেও। মাঝেমধ্যেই রাগ করে একাই ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আবার রাগ কমলে ফিরে আসেন রাজপ্রাসাদে। আমি নিজেই একাধিক বার রাজকুমারীকে দেখেছি কখনো প্রসাদের মধ্যে ঘোড়সওয়ারি করতে কখনোবা অসি চালনার অনুশীলন করতে। রাজকুমারীর খোঁজ নির্ঘাত সেপাই পেয়াদারা শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। রাজপরিবারেরও কী মানসিক অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। রাজকুমারী দুষ্কৃতিদের পাল্লায় কীভাবে পড়লেন সেটা জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত জানা সম্ভব নয়। তাই এখন তারই অপেক্ষায় সবাই। অম্বা সারাক্ষণ তার শয্যার পাশে বসে আছে।
কাল মহালয়া রাজকন্যা। রাজ্যে ছুটির দিন। আমার অনুপস্থিতি নিয়ে হয়তো তেমন খোঁজ খবর হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমার মনে আছে মহালয়ার দিন ভোরে গঙ্গার ঘাটে পিতৃতর্পন এ যাওয়ার সময় প্রতি বছরই দেখতাম আপনি ঘাটে বসে আছেন আমার জন্য। জীবন বড় অনিশ্চিত রাজকন্যা। কিছুদিন আগেও কী ভেবেছিলাম এবার মহালয়ার দিন এরকম অরণ্য ঘেরা এক দস্যুর আস্তানায় আরেক রাজকুমারীর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় কাটাতে হবে? আশা করি কারুর অপেক্ষায় না থেকে আপনার মহালয়া এবার ভালো কাটবে।
আপনার সাত জন্মের শত্রু
“আপনার দস্যুরাজ”
দূর থেকে দেখলে মনে হবে দোআঁশ মাটির ওপরে এঁকেবেঁকে চলা একটি জাত গোখরো…কাছে গেলে মনে হয় দুরন্ত দস্যিমেয়ে যেন খরস্রোতা সঙ্কোশ। দমনপুরের এই দিকটায় খুব বেশি লোকজনের যাতায়াত নেই। এখানেই দেখা হলো পুষ্পদংশন গ্রামের যুবরাজ হৃদকমল রায় চৌধুরী, রাজনর্তকী রাজনন্দিনী এবং দস্যুরাজের রাজকন্যা রাজেশ্বরীর। প্রথম দর্শনে রাজেশ্বরীর প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটার পর সে বুঝতে পারছিল কেন হৃদকমল বিবাহে রাজী নন। হবেনইবা কী করে?রাজনন্দিনীর এমন হীরক দ্যুতিময় মুখশ্রীর পাশে শুধু মুগ্ধতাটুকুই যেন রেখে আসা যায়। কাহিনী এখানে এসে পাশ ফিরে শোয় জীবনের দিকে। কাহিনী এখানে বহতা নদীর মতো। সময় লিখিয়ে নিচ্ছে চিঠি রাজকন্যার হাতে।
দস্যুরাজ,
বিশ্বকর্মা পুজোর প্রায় মাসখানেক আগে থেকে যেমন রঙিন সুতোয় কাঁচের গুড়োর মাঞ্জা দেওয়া হয় ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য, ঠিক তেমন করেই যেন আমার জীবনেও চলছে অবিরাম মাঞ্জা দেওয়ার কাজ। সবাই বুঝতে অক্ষম ছিল, যত ভালোই কাঁচের গুঁড়োর লেপ পড়ুক, একবার যদি সুতোয় জট পড়ে যায়, সকলই বৃথা এবং যথাসময়ে সেই জট পাকিয়ে যাওয়া থেকেই আমাকে এবং হয়তো নিজেকেও বাঁচিয়ে দিয়েছেন হৃদকমল রায় চৌধুরী।
রাজনন্দিনী আসলে পুষ্পদংশন রাজপরিবারের ইতিহাসের একটি অলিখিত দলিল মাত্র। তবে প্রায় কেউই জানে না রাজনন্দিনীর জন্ম ইতিহাস। স্বর্ণপ্রভা দাসী ছিলেন ব্রজনাথ রায় চৌধুরীর ব্যক্তিগত নর্তকী। যখন ব্রজনাথ তাকে সুন্দরগড়ের রাজা এবং তাঁর পরম মিত্রের থেকে উপহার হিসেবে পান এবং নিয়ে আসেন নিজের রাজসভার নর্তকী করে। তখনই স্বর্ণপ্রভা দেড়মাসের অন্তঃস্বত্তা। অনেক চাপান-উতোর, বিতণ্ডা, মুখে কালিমা লেপন, এইসব বাক্যবিষ এবং বিভিন্ন উপায়ে মৌখিক বিষ ভক্ষণের অত্যাচারকে উপেক্ষা করে স্বর্ণপ্রভা জন্ম দেন তাঁর রাজনন্দিনীকে। একটু বড় হতেই সংস্কৃত পড়ার জন্য তাকে পাঠশালায় ভর্তি করানোর চেষ্টা করেন স্বর্ণপ্রভা। কিন্তু কোন নর্তকীর সন্তানের সঙ্গে সমাজ এক সারিতে বসে বিদ্যার্জনের কথা ভাবতে যেন অপরাধবোধে ভোগে। দস্যুরাজ, আমাদের এই মানসিকতার ন্যূনতম পরিবর্তনও কি আজকের দিনেও হয়েছে? আমরা কী সত্যিই কোনদিন স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখবোনা দস্যুরাজ? বিকলাঙ্গ সমাজের থেকে স্বাধীন হবোনা কখনও? যাইহোক, পাঠশালায় আর পড়া হয়ে ওঠে না রাজনন্দিনীর। কিন্তু এই মেয়ের রাজকীয় রূপ, চলনে বলনে রাজকীয় গাম্ভীর্য যেন মোহিত করে রাখতো সকলকে। পাঠশালার গুরু বিদ্যালঙ্কার মশাই অনুগ্রহ করে তাই তাকে একক শিক্ষাদানের প্রস্তাব দিলেন। শুরু হলো রাজনন্দিনীর শিক্ষাপর্ব। একই সঙ্গে রাজপরিবারে আরও একজন বড় হচ্ছিলেন, যুবরাজ হৃদকমল।ছোট্ট হৃদকমলের থেকে বয়সে বছর খানেকের বড়ই হবেন রাজনন্দিনী।অসমবয়সী দু’টি শিশুর সখ্য জমে উঠলো সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে। না দস্যুরাজ, এই দুই শিশুর বন্ধুত্বে কোন খাদ ছিল না। ছিল না সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, এরা দুজন বেড়ে উঠছিল নিজেদের নিয়মে।
আপনার মনে আছে দস্যুরাজ, যখন প্রথম আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল, আমরা একাধিক বন্ধুর মাঝে বসে থাকলেও পরস্পরকে বোঝার জন্য আমাদের শব্দের প্রয়োজন হতো না? অথচ দুজনের মাঝে আজ যোজন দূরত্ব। শেষ অভিমানটুকুও ব্যক্ত না করে চলে গেলেন আপনি। দস্যুরাজ, আপনাকে সবটা বলতে না পারলে চিরদিনই আমি অস্বস্তিতে ভুগি। আপনি তা জানেন, তাই যতটা হৃদকমল আর রাজনন্দিনীর থেকে শুনেছি, সবটা বলছি।
এই অসম সখ্যের মাঝে দুই সমান্তরাল পথের মতো দুজনেই এসে দাঁড়ালেন কৈশোরের প্রান্তে। বিদুষী রাজনন্দিনীর রূপের তেজ দিনের আলোর মতো প্রস্ফুটিত হতে শুরু করলো যেমন, তেমনই তাঁর বিদ্যার প্রতি আগ্রহ জনান্তিকে অপ্রকাশিত রইলো না।বাগানে একটি ফুলের বিকশিত হবার খবর যেমন মৌমাছিকুলের কাছে বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। ফুল যেমন তার সৌরভে জানান দেয় তার উপস্থিতি, রাজনন্দিনীর কৈশোরে পদার্পণের খবরও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল চারিদিকে।ব্রজনাথ রায় চৌধুরী মশাই ও তাঁর জায়া প্রিয়বালা দেবী এই ফুলকে নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখা সমীচীন মনে করলেন না।তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল রাজনন্দিনীর বিবাহের। আপনি তো জানেন দস্যুরাজ, আমরা প্রদীপের আলোটাই দেখি। প্রদীপের নীচের অন্ধকার অংশটুকু আকছার বিস্মৃত হই। এই কাহিনীতেও তেমনটাই ঘটলো। রায় চৌধুরানীর ইচ্ছেতে রাজনন্দিনীর বিবাহ স্থির হল পাশের রাধিকারঞ্জন গ্রামের জমিদারদের খাজাঞ্চিবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। স্বর্ণপ্রভা বাঁধ সাধলেন, তাঁর বিদুষী কন্যার বিবাহ কোন রাজ্যের রাজপুত্রের সঙ্গে হবে এই স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু রায় চৌধুরানী তাকে বোঝালেন, রূপ কখনও কারো জন্মের ইতিহাস বদলে দিতে পারে না। মানুষের জন্ম পরিচয়টা শেষ কথা এই পোড়া দেশে। এই আমাদের দেশ দস্যুরাজ। এখানে কর্মে নয়, মানুষের সম্মানমাপক যন্ত্র যেন তার জন্মের ইতিহাস।
কন্যার জন্ম প্রসঙ্গ সামনে এলেই স্বর্ণপ্রভা দমে যেতেন বরাবরই। এবারেও অন্যথা হলনা। রাজনন্দিনীর বিবাহ সম্পন্ন হল সুন্দর ভাবেই। এদিকে রাজনন্দিনীর আকস্মিক প্রস্থানের প্রাথমিক পর্ব কাটিয়ে উঠতে পারলেও অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিশোর হৃদকমল। বদ্যির আসা যাওয়াই সার হল।ওদিকে নববঁধূ রাজনন্দিনীও শয্যা নিলেন।আসলে এই দুই শরীরের আত্মা ছিল একটিই। প্রান্তিক কৈশোর যা বোঝাতে পারেনি। এই চরম সত্য এই দুটি মানুষকে বুঝিয়ে দিল নবাগত যৌবন। ওঁরা বুঝলেন পরস্পরকে ছেড়ে থাকা দুজনের পক্ষেই অসম্ভব।
দস্যুরাজ, এই কাহিনীর শেষটুকু গচ্ছিত রাখলাম আপনার রাজকন্যার কাছেই। এ যেন আমাদেরই মিলিত শব্দরাশি। অন্য এক যুগল নদীর ছলাৎছলে আমার আপনার সঙ্গেই বয়ে চলতে শুরু করলো। আপনার জন্য আমার অশেষ ভালোবাসা জানিয়ে আজ শেষ করলাম।
“আপনার রাজকন্যা”
[ চলবে ]
গত সব কটি পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ভালোবাসেন ছবি তুলতে। অবসর সময়ে ট্রেক করাও তার একটি নেশা। ইঞ্জিনিয়ার হলেও অক্ষর তাকে টানে অনেক বেশি,সেই থেকেই ভ্রমণকাহিনী দিয়ে লেখার শুরু।