| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-৮) । হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।


(১৩)

‘মা,তোমার সঙ্গে আমার আজ একটা হিসেব-নিকেশ করতে হবে।তোমার মতলব কী আমাকে খুলে বল।’ঘরের ভেতর ঢুকেই আমি মাকে প্রশ্ন করলাম।

নরেনের ছেড়ে যাওয়া পুঁটলিটা খুলে তিনি তখন পরম তৃপ্তিতে ব্লাউজটা নেড়েচেড়ে দেখছিলেন।আমার কথা শুনে ব্লাউজটা কোলে রেখে তিনি কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা কঠিন দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।‘কীসের হিসেব-নিকেশ আছে?’-অত্যন্ত ক্রোধে তিনি আমাকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন।  

‘ হিসেব সহজ। আর একদিনও যদি নরেন আমাদের বাড়িতে এসে মদ খায় এবং এভাবে এসে মদ খাবার বিনিময়ে ব্লাউজ মেখেলা উপহার দেয় তাহলে তুমি আর আমাকে এই বাড়িতে দেখতে পাবে না। হাজার হলেও তুমি আমার মা,দশ মাস দশ দিন আমাকে গর্ভে ঠাঁই দিয়েছিলে, পেটের মেয়েকে তুমি গরু ছাগল বিক্রি করার মতো কীভাবে বিক্রি করে দিতে পার সে কথা ভাবলে আমার ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপ দিয়ে মরতে ইচ্ছা করে। এত পাপ পৃথিবী সহ্য করবে না মা। দিদির যা করেছ, করেছ। আমারও সেই গতি করবে বলে তুমি যেন কখনও না ভাব মা।’ ‘ তোর দিদির কী খারাপটা করেছি আমি? সে দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পাচ্ছে, পেটের ক্ষুধায় জ্বলে পুড়ে মরতে হচ্ছে না, এর চেয়ে জীবনে বেশি আর কী চাই? যৌবনের তেজে বেশি অহংকার করবি না। সেই অহংকার বেশি দিন বজায় রাখতে পারবি না। শরীরের রক্ত ঠান্ডা হলে একদিন বুঝতে পারবি, পেটের ভাতের মুঠো থেকে বড়ো জিনিস জীবনে কিছুই নেই।’

‘মান-ইজ্জত,ধর্ম-কর্মের চেয়ে পেটের ভাতের মুঠো বেশি বড়ো নাকি?’

‘মুখে হ্যাঁ না বললে কী হবে, কাজকর্মে তার পরিচয় পাওয়া যায়। বেঁচে থাকা পর্যন্তই তোর ধর্ম-কর্ম, মান-ইজ্জত, মরা মানুষের তো কোনো মান ইজ্জতের প্রশ্ন নেই। তার মানে আগে বেঁচে থাকতে হবে তারপরে মান ইজ্জতের কথা।কিন্তু খেতে না পেয়ে তুই যদি মরেই যাস,তোর শব দেহটা মান- ইজ্জত নিয়ে কী করবে?’

মরলেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের না হওয়া মায়ের মুখ দিয়ে অনর্গল ওকালতির তর্ক শুনে একটা অজানা আতঙ্কে আমি মনে মনে শিউরে উঠলাম। আমার মনে ধারণা হল, এটা নিশ্চয় ভালো লক্ষণ নয়। মা যখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলে তখন কিছু একটা অস্বাভাবিক এবং অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটবে বলে সন্দেহ করা উচিত। মনে পড়ল দিদিকে ষড়যন্ত্র করে পাঞ্জাবির হাতে সঁপে দেওয়া রাতের আগের দিনের কথা। সেদিনও মা এভাবেই স্থির এবং সহজভাবেই কথা বলেছিল। কিন্তু মা বোধহয় ভাবতে পারে নি যে দিদির ঘটনা আমার চোখ খুলে দিয়ে গেছে। আমার চোখের আড়ালে মা নিশ্চয় আর তার ফাঁদ পাততে পারবেনা।

‘মা মান সম্মানের চেয়ে পেটের ভাত মুঠো বড়ো বলে তুমি বললেই হবে নাকি? সংসারে  এরকম মানুষ আছে, যে কলঙ্কিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই বেশি ভালো বলে ভাবে,সেই কথাটাও তুমি ভুলে যেও না।’

আমার কথা শুনে মায়ের মুখটা হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে উঠল। প্রচন্ড ক্রোধে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে গিয়ে কিছু একটা ভেবে তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করে নিলেন। কিছু সময় তিনি আমার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন তিনি আমার মনের ভেতরটা ভালো করে দেখে নিতে চাইছেন। তারপর খুব ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,’শোন সুবালা, আমার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে, কোন দিন মরে যাব তার ঠিক নেই। আজ এই সুযোগে সারা জীবন দিয়ে শেখা,একটা কথা তোকে বলে রাখি। কখনও কখনও মনে করবি। সংসারে বেঁচে থাকতে হলে টাকা না হলে চলে না, কিন্তু মানুষ টাকা খেয়ে বেঁচে থাকে না। টাকার প্রয়োজন চাল ডাল কেনার জন্য, কাপড় কেনার জন্য। যে টাকা দিয়ে জিনিস কেনা যায় না তার কী মূল্য? আমার হাতে এটা আধুলি আছে; একদিন সেটা নিয়ে এক কিলো চাল কেনার জন্য দোকানে দোকানে ঘুরলাম, কিন্তু কেউ চাল দিল না। আধুলিটা নাকি অচল। তোর এই মান-সম্মান, ধর্ম কর্মের ধারণাও টাকাই। পেট ভরানো বা মন ভরানো জিনিস নয়। টাকা দিয়ে মানুষ চাল কিনে, ধর্ম কর্মের মাধ্যমে মনের শান্তি কিনে। কিন্তু টাকা যেভাবে অচল হয়, ধর্ম কর্ম মান সম্মান সেভাবে অচল হতে পারে, মানুষ বাজারে তার মূল্য দিতে না পারে। এসব কথা আমি কারও থেকে শুনে বা বই পড়ে শেখা কথা নয়, নিজে, এরকম অবস্থায় পড়ে অতি দুঃখে শেখা কথা। আমিও সারা জীবন আমার ধর্মের ধন বুকে বেঁধে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম, কিন্তু একদিন আমি জানতে পারলাম–সেই ধন অচল। মানুষ বা ঈশ্বর কারও কাছে তার কোনো মূল্য নেই। কিছু একটা মস্ত আঁচর লেগে সেই ধন একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। তোকে বলব নাকি সুবালা একথা আমি কীভাবে কখন জানতে পারলাম?’

অপার বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণ ধরে শুনতে থাকা কথাগুলি মায়ের মুখের কথা বলে বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হল। আমার মনে হল, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি এবং মায়ের কথাগুলি স্বপ্নের মধ্যে শুনছি। মায়ের প্রশ্নের উত্তরেও আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হল না। কোনোদিন না দেখা মানুষ দেখার মতোই আমি তার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। 


আরো পড়ুন: সুবালা (পর্ব-৭) । হোমেন বরগোহাঞি


মা হঠাৎ কিছুটা অস্থির হয়ে উঠল। তাঁর মনে যেন কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে এরকম একটা ভাব তার মুখে ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ উত্তেজিত হওয়ার মতো প্রায় চিৎকার করে উঠল,’বলব বলব, না বলার মতো আমার কী হয়েছে? আমি কাউকে ভয় করি না লজ্জা করি? লজ্জা ভয় কবেই পুড়িয়ে খেয়েছি। আমি যা করেছি তার জন্য ঈশ্বর যদি আমাকে মৃত্যুর পরে কৈফিয়ত চায়, আমি ঘুরিয়ে তার কাছে কৈফিয়ত তলব করব–কেন আমাকে এভাবে করতে দিলে বলে, আমি যা বলব ভালো করে শোন। তারপরে তুই আমার বিষয়ে যা ভাবার ভাববি। তোর বাবা তখন মারা গেছে,–বেঙা আমার গর্ভে, তিন মাস। তিন বিঘা মাটি ছিল, তোর বাবার শ্রাদ্ধের দিন সেটাও তার মৃত্যুর পরের দিনেই বন্ধক দিলাম। ভাঁড়ারে এক মুঠো ধান নেই, হাতে একটা পয়সা নেই। একবেলা খেলে অন্য বেলা উপোস দেবার মতো অবস্থা, সেই সময়ে আমার অসুখ হল, প্রচন্ড মাথা ব্যথায় বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারি না। কাজ করার মতো শরীরে এক ফোঁটা শক্তি নেই। কিন্তু আমি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে তোদেরকে কে খাওয়াবে? কোনোমতে ছেঁচড়ে গ্রামে বেরিয়ে গিয়ে এবাড়ি ও বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে তোদের তিনদিন খাওয়ালাম। আমি নিজে একটা খুদ কণা মুখে দেওয়ার মতো খুঁজে পেলাম না। তিনদিনের উপোস এবং অসুখে আমার তখন মৃতপ্রায় অবস্থা। একবার ভাবলাম, এভাবে না খেয়ে খেয়ে মরে যাওয়াই ভালো, কত আর লাজ লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াব। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার চোখ গেল আমার পাশে বিছানায় পেটে পিঠে লেগে শুয়ে থাকা তোদের দুজনের দিকে। আমি মরে গেলে তোদের দুজনের কী গতি হবে? ভাবলাম, বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়ে সবাই একসঙ্গে পুড়ে মরি। কিন্তু ভাবা মতে সমস্ত কাজ করতে পারলে মানুষের জীবনে এত দুঃখ থাকত না। মনের কথা মনের মধ্যে চেপে রেখে পুনরায় ভিক্ষা করতে বের হলাম। অসুস্থ শরীরে তো বেশি দূর যেতে পারি না, আগে ভিক্ষা আনা একজন মানুষের বাড়িতে ঢুকে গেলাম। আমাকে দেখা মাত্র বাড়ির মালিক কুকুরের মতো দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে উঠল–যা বেরো এখান থেকে, প্রতিদিন ভিক্ষা দেবার জন্য আমি দান সত্র খুলে বসিনি। যুবতি মানুষ, প্রতিদিন ভিক্ষা করতে লজ্জা লাগে না? কাজ করে খেতে পার না? কাজ করে খেতে না চাইলে অন্য রাস্তাও তো আছে, আমি থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বাড়ি এসে পৌঁছলাম। আমাকে দেখা মাত্র তোরা দুজন চিৎকার করে উঠলি,–মা মা ক্ষুধা পেয়েছে,ভাত দাও। আমি হঠাৎ রক্তের গন্ধ পাওয়া  বাঘিনীর মতো তোদের দুজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তোদের নাকেমুখে চড়, কিল, আর ঘুসি  মেরেও আমার আশ মিটল না। আধপোড়া একটা খড়ি দিয়ে দুজনকে মেরে ছাল বাকলা  উঠিয়ে ফেললাম। ভালো করে তাকিয়ে দেখবি, এখন ও তোদের গায়ে সেই মারের দাগ আছে। তোরা কাঁদার মতো সময় পেলিনা, মারের চোটে দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলি। আমিও তোদের পাশে মাটিতে শুয়ে পড়লাম, বোধহয় আমিও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন সকালবেলা জেগে উঠলাম। ব্যথায় যন্ত্রণায় তোদের দুজনের মুখ দিয়ে আওয়াজ না বের হওয়ার মতো অবস্থা। মুখ এবং শরীর ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। তোদের অবস্থাটা কী করেছি সেটা যেন তখনই বুঝতে পারলাম। পেটের মেয়েদের ক্ষুধার্ত মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে আমি তাদের মেরে আধমরা করে ফেললাম, তাদের একটাই মাত্র দোষ, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মায়ের কাছে খাবার চেয়েছিল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে না পেরে আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে তোদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার ভাব ভঙ্গি দেখে তোদের মনে বোধহয় একটু সাহস এল।হাঁপাতে হাঁপাতে  দুজনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাতর ভাবে বলতে লাগলি,-মা আমাদের বড়ো ক্ষুধা পেয়েছে…।’-সুবালা তুই এখনও ছোটো মেয়ে; তুই সন্তানের মা হসনি; আমি হাজার মুখে বললেও তুই বুঝতে পারবি না, ক্ষুধায় আধমরা হয়ে ছেলেমেয়েরা যখন মায়ের কাছে খাবার চায় আর মা তাদের মুখে একটা খুদের কণাও গুঁজে দিতে না পেরে চুপ করে থাকতে হয়, করার কোনো উপায় থাকে না– তখন সেই মায়ের মনে কয়েকটি রাবণের চিতা জ্বলে। তোদের কথা শুনেও আমি না শোনার ভান করে চুপ করে বসে রইলাম। এভাবেই বেলাটা পার হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে খাবার চেয়ে আমার কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে তোরা অবশেষে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলি। ঈশ্বর থাকলে সেই দৃশ্য দেখে তার আসনও টলে উঠত, তিনি নিজে মাটিতে নেমে এসে তোদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় করতেন। কিন্ত বিকেল পর্যন্ত যখন কোনো অঘটন ঘটল না, মুখের কথা হারিয়ে তোরা একসময় পুনরায় অসার হয়ে পড়ে গেলি— আমি নিশ্চয় বুঝতে পারলাম যে ঈশ্বর নেই। মানুষকে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে হবে। আমি কোনো মতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালাম। আমার শেষ সম্বল ছিল একটি সোনার আংটি। অলংকারের নামে সেটিই মাত্র বাবা আমাকে বিয়ের সময় দিয়েছিল। সেটা বন্ধক রেখে কিছু টাকা আনার আশায় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। সেই উদ্দেশ্যে যাবার মতো গ্রামে মাত্র এক ঘর মানুষই ছিল– নরেনদের বাড়ি। তখন নরেনের বাবা বেঁচে ছিল। আমি তার কাছে গেলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আসলে বাড়ি যেতে হয় না, বেশিরভাগ সময় রাস্তার পাশের অফিস ঘরটাতে থাকেন। আমি গিয়েই তার পা দুটি জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম, আর কাঁদতে কাঁদতে আমার দুঃখের কথা বলে আংটিটা খুলে টেবিলে রেখে দশ টাকা ভিক্ষা চাইলাম। আংটিটা হাতে নিয়ে অনেক সময় নাড়াচাড়া করি তিনি এবার গম্ভীরভাবে বললেন,’ শোন, এই আংটিটা যে তোকে দিয়েছিল সে তোকে পুরোপুরি ঠকিয়েছে। আংটিটাতে সোনা নেই, যা আছে তামা।’ তার কথা শুনে আমার মনে হল আমার বুকে কে যেন বল্লম ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে জায়গাতেই বসে পড়লাম।আংটিটা যদি বন্ধক রাখতে না পারেন তাহলে আমাকে দশটা টাকা ধার দিন।এখনই যদি বাড়ি ফিরে গিয়ে মেয়ে দুটির মুখে আমি কিছু একটা খাবার তুলে দিতে না পারি,আগামীকাল সকাল পর্যন্ত ওরা আর বেঁচে থাকবে না’-কাঁদতে কাঁদতে আমি তাঁর কাছে প্রার্থনা করলাম।আমার দ্বিতীয় বাক্যটা তাঁর কানে ঢোকার সুযোগ পেল না,প্রথম বাক্যটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাথা নেড়ে বলে উঠলেন-‘বন্ধক ছাড়া আমি কাউকে টাকা ধার দিই না।সেটা আমার নিয়মের বাইরে।কিন্তু টাকা আমি তোকে দেব,তুই যদি নিতে পারিস।’কথাটা বলেই তিনি আমার মুখের দিকে এই প্রথমবার তাকালেন।ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছিল,এতক্ষণ পর্যন্ত আমি তাঁর মুখটা ভালোভাবে দেখতে পাইনি।তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমদিকের জানালা দিয়ে বিকেল বেলার আলো এসে তাঁর মুখে পড়ল,আর সেই আলোতে তাঁর মুখটা দেখে আমি চমকে উঠলাম।কারণ আমি তাঁর চোখে পাপ দেখতে পেলাম।আমি মাথা নিচু করলাম।‘পারবি নিতে?’তিনি প্রশ্ন করলেন।‘আপনি দিলে কেন নিতে পারব না?’আমি উত্তর দিলাম।‘ভালো কথা।শোন,আমি কাউকে ভয় করে কথা বলার মানুষ নয়।আমি যা বলার খোলাখুলি বলি।আগেই বলেছি,বিনা বন্ধকে আমি কাউকে টাকা দিই না।তোর কাছে বন্ধক দেবার মতো এখনও একটা জিনিস আছে,সেটা যদি দিতে পারিস,দশ টাকা কেন,তারচেয়ে বেশি পাবি।’‘কী জিনিস সেটা?’আমি ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম।‘কেন তুই বুঝতে পারছিস না?’পেরেছিস পেরেছিস,বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করছিস।ভান করাটা মেয়েদের স্বভাব।’ ‘আপনি কী বলছেন আমি সত্যিই কিছুই বুঝতে পারছি না।আমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিন মালিক।আর একটু দেরি হলেই আমি হয়তো বাড়ি গিয়ে মেয়ে দুটিকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাব না,’—আমার মুখে পুনরায় কান্না এল।নরেনের বাবা বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন,’আমি তো তোকে ধরে রাখি নি।তুই আমি বাড়ি যাবার সময় আমার পা জড়িয়ে ধরেছিস।মনে রাখবি কেঁদে কেঁদে আমার মন ভোলাতে পারবি না।মেয়ের মৃত্যু হবে ভেবে অধীর হচ্ছিস কেন?আরও মেয়ের জন্ম দিতে পারবি,কেবল তুই ইচ্ছা করলেই হল।কিন্তু তোকে আমি একটা কথা বলছি ,টাকা পাবার সুযোগ একবার চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।তাড়াতাড়ি বল,তোর টাকা লাগবে কি না।’-মানুষ যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে সেকথা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারি নি।তারমধ্যে আমার বাবার বয়সী তিনকুড়ি বছরের একজন বুড়োর মুখে এই ধরনের কানে আঙুল দেবার মতো পাপ কথা শুনে আমার মুখে কথা নাই হয়ে গেল,আমি পাথর হয়ে বসে রইলাম।এভাবে কতক্ষণ বসেছিলাম বলতে পারি না,হঠাৎ নরেনের বাবার কথা শুনে চমকে উঠলাম,’তাহলে তোর মত আছে।টাকা বের করব?’চাইনা’-আমি উত্তর দিলাম এবং উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।আমার পিঠের সামনে নরেনের বাবা গহীন কণ্ঠে বললেন-‘দেখ,টাকা বের করে আমি আবার ঢুকিয়ে রাখলাম।এর মধ্যে যদি তোর মতের পরিবর্তন হয় এবং টাকারও প্রয়োজন দেখা দেয় ,তাহলে ইচ্ছা হলে পুনরায় আসতে পারিস।তোর জন্য আমি একশত টাকা আলাদা করে রেখে দিলাম।কিন্তু বেশি দেরি করলে সমস্ত ব্যাপারটা বিগড়ে যেতে পারে।মেয়েদের রূপ-যৌবন চিরকাল থাকে না।অন্যদিকে আমিও বুড়ো হব।আমি খোলাখুলি বলা মানুষ,তোকে জানানো দরকার জানিয়ে দিলাম।‘  ফিরে এসে আমি যখন বাড়ি পৌছালাম,বাড়ির বাইরে ভেতরে ঘুটঘূটে অন্ধকার।তোদের দুজনেরই কোনো সাড়াশব্দ নেই।আমি ,তোরা মরে গেছিস বলে ধরে নিলাম।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে একসময় তোদের খুঁজে পেলাম,দুজনেই বিছানায় শুয়ে আছিস।মরার পরে মানুষের শরীর পাথরের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় কিন্তু তোদের গা দুটি আগুনের মতো গরম ।আমি বুঝতে পারলাম, তোরা মরিস নি তোদের ক্ষুধা থেকে জ্বর হয়েছে। নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে দেখলাম নিঃশ্বাসের মাত্রা খুবই হালকা। ঘরটা একটু আলোকিত করে মুখ দুটি দেখব বলে ভেবে আগুনে ফুঁ দিয়ে দেখি,, আগুনের ঝাঁজ নেই। করার মতো কিছু ছিল না, আমিও তোদের পাশে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখে ঘুম এল না।তোদের দুজনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।সঙ্গে সঙ্গেই তোরা দুজন জেগে ওঠে ক্ষীণ কাতর কণ্ঠে বলতে শুরু করলি—‘ইস মা ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খাব।’সম্ভব হলে সেই মুহূর্তে নিজের কলজেটাকে কেটে আমি তোদের মুখে ভরিয়ে দিতাম কিন্তু তা করে কী লাভ? একশত টাকা আমার চোখের সামনে পড়ে আছে আমি তা কুড়িয়ে নিয়ে খেতে না পেয়ে তিল তিল করে মরতে চলা আমার সন্তানদের প্রাণ রক্ষা করার চেষ্টা না করে অন্ধকারে একা একা ভাবছি আমি বড়ো ধর্ম করছি, আমি আমার মান ইজ্জত রক্ষা করছি। আমার মতো স্বার্থপর পাপী সংসারে কে আছে?আমি যেন নতুন জ্ঞান লাভ করলাম।রসাতলে যাক আমার ধর্ম কর্ম। রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে গেলাম নরেনের বাবার কাছে। বাকি কথাগুলি আর তোকে বলছি না।মোটামুটি এটা জেনে রাখ আমার মান ইজ্জত বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে সেবার তোদের প্রাণ রক্ষা হল।’

এবার হঠাৎ আমার মনে হল, মা নীরব হয়ে পড়েছে। আমি তার মুখের দিকে তাকালা্‌ম, কতদিন পরে যেন আমি তার মুখের দিকে তাকালাম এবং আমার হারিয়ে যাওয়া আমাকে বহু যুগের শেষে নতুন করে পেয়ে আমি লাফ মেরে মাকে জড়িয়ে ধরলামঃ ‘মা ওমা মাগো।’ 

   




        



error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত