অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-১১) । হোমেন বরগোহাঞি
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।
(১৭)
মহিলাটি চলে যাবার পরে আমি অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে একই জায়গায় বসে রইলাম ।পুরো ঘটনাটি আমার মনে স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। কতদিন এরকম একটি সুযোগের জন্য আমি দিনরাত আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম এবং আজ তৃষ্ণায় জল খেতে এসে একজন পথিক মহিলা ঠিক সেই স্বপ্নের সুযোগের সন্ধান আমাকে দিয়ে গেল। হাজার বছর তপস্যা করার শেষে ঋষি মুনিদের ঈশ্বর যেভাবে বরদান করে ঠিক তেমনই আমাকে যেন বর দিয়ে গেলেন– এর চেয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা জীবনে আর কি হতে পারে? মনের উত্তেজনায় অনেক ক্ষণ আমি কোনো কথাই স্পষ্ট ভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। অতীত ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন বাস্তব– সমস্ত যেন আমার মনে এলোমেলো হয়ে গেল। এভাবে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থেকে ধীরে ধীরে মনটা যখন প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ফিরে এল, তখন ঘুম থেকে কেউ আমাকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দেওয়ার মতো ধড়মড় করে উঠে বসে আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, আমি সম্পূর্ণ নতুন একটি ভবিষ্যতের দরজা মুখে এসে উপস্থিত হয়েছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের দরজার সামনে এসে উপস্থিত হল আমার মা।
বিকেলের অন্ধকার তখন চারপাশ ঘিরে ধরেছিল। মা আমার মুখটা বোধহয় ভালোভাবে দেখতে পেল না। আমিও রক্ষা পেলাম। সেই মুহূর্তে আমার মুখটি ভালোভাবে দেখতে পেলে তিনি নিশ্চয় আশ্চর্য হতেন, হাজার চেষ্টা করেও আমি আমার মনের চাঞ্চল্য এবং উত্তেজনা গোপন করে রাখতে পারতাম না। তিনি অবশ দুর্বল পদক্ষেপে ভেতরে এসে উনুনের পাশে বসে পড়লেন।হঠাৎ আমার মনে হল আর কিছুদিন পরে তিনি একদিন বিকেলবেলা ক্লান্ত দেহে এভাবে ঘুরে ফিরে এসে ঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে দেখবেন– তার জন্য অন্ধকারে বসে আর কেউ পথ চেয়ে নেই। কিছুক্ষণের জন্য আমি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর চোখে সেই নির্জন ঘরটির ভীষণ নীরব অন্ধকারের বুকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা অবর্ণনীয় আতঙ্কে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। হঠাৎ একটা প্রচন্ড কান্না আমার বুকের ভেতর থেকে কণ্ঠনালী ভেঙ্গে মুচড়ে গলা পর্যন্ত ঠেলে বেরিয়ে এল, তাকে চেপে ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় আমার সমস্ত দেহ থর থর করে কাঁপতে লাগল। আমার আজন্ম দুঃখিনী মাকে এই শ্মশানের অন্ধকারে একা ছেড়ে রেখে আমি কোথায় চলে যেতে চাইছি ?এতটা স্বার্থপর আমি কীভাবে হতে পারলাম? এই যে আমার কাছ থেকে এক হাত দূরে অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে মা ক্লান্তভাবে বসে রয়েছেন, আমরা কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছি না, একবার কথাও বলছি না– তথাপি আমি যে কাছে আছি, সমস্ত দেহ দিয়ে তিনি অনুভব করছেন অন্য এক জীবনের উত্তাপ– এই অনুভবটাই তো পরিপূর্ণ করে রেখেছে তার সমস্ত ভুবন। কিন্তু যেদিন আমি এভাবে থাকব না, সেদিন দিক চিহ্নহীন অন্ধকারে একা বসে বসে তিনি কী কথা ভাববেন? শুধু নিজেকে নিয়ে সংসারে কেউ শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারে না। যার কেউ নেই বলে ভাবি, সেও নিজের নির্জনতার শূন্যতাকে পূর্ণ করে নেয় গানে, স্বপ্নে ,কল্পনায়,ঈশ্বর চিন্তায় ,দেশের দশের সমাজের কাজে,অন্য কিছু না হলে উন্মাদের প্রলাপে। যার এই সমস্ত কিছুই করার উপায় বা সামর্থ্য নেই, সে কি করবে? নিঃসঙ্গ আত্মার চেয়ে মানুষের বড়ো শত্রু বোধ হয় আর কিছু নেই। বাইরে প্রসারিত হওয়ার সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে সে যখন নিজের মনের অন্ধকার ঘরে জড়ো সড়ো হয়ে আশ্রয় নেয়, নিজের ভয়ে উন্মাদ হয়ে সে তখন সেই গহ্বরের দেওয়ালে মাথা কুটে রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হয়। হে ঈশ্বর্,আত্মার এই রক্তাক্ত যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে আর কার বেশি আছে। আর সেই যন্ত্রণার নরকাগ্নিতে মাকে পুড়ে মরার জন্য , ছেড়ে দিয়ে আমি এখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইছি।
আরো পড়ুন: সুবালা (পর্ব-১০) । হোমেন বরগোহাঞি
মানুষ সচেতন ভাবে জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে না বা করতে পারে না। মনের একটি আশ্চর্য প্রক্রিয়ার ফলে অনেক সময় সমস্যার সমাধান নিজে নিজে রূপ গ্রহণ করে। একটা রাত পার হয়ে গেল এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি অনুভব করলাম, আমার আগের রাতের আবেগের তীব্রতা অনেকখানি কমে এসেছে। রাতের অন্ধকারে মাকে যতটা নিঃসঙ্গ এবং দুর্বল বলে মনে হয়েছিল,তাকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া যতটা অমানুষিক নিষ্ঠুরতার কাজ বলে মনে হয়েছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে দিনের আলোতে সেটাকে ভাবের আতিশয্য বলে আমার মনে হল।একই সঙ্গে আমার মনে হল, রাতের বেলা পুরো সমস্যাটাকে আমি কেবল মায়ের চোখে দেখেছিলাম,কিন্তু আসলে সেই বিষয়ে আমার দিক থেকে আমার চোখ দিয়ে দেখার অনেক কথা আছে। মা তার মানসিক অসুস্থতা এবং উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, জীবনের যে পথে আমাকে নামিয়ে আনতে চাইছেন,সেই পথে একবার নামতে হলে আমার আর ফেরার পথ থাকবে না, আমি একেবারে রসাতলে ডুবে যাব। কিন্তু বাড়িতে থাকলে আমার সেই পরিণতি অনিবার্য। মা বুড়ি হতে চলেছেন, মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই,দুদিনের জন্য নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা থেকে তাকে বাঁচাতে গিয়ে তার মৃত্যুর পরে আমাকে হয়তো কেবল নিঃসঙ্গ নয়, একটা পাপ কলঙ্কিত জীবনের অপরিসীম ঘৃণা এবং কদর্যতার পূতিগন্ধ নরকে চিরকাল পচে মরতে হবে। মা যদি নিজের পেটের সন্তানকে সেই নরকে ঠেলে দিতে পারে, তাহলে কি মায়ার বন্ধন আমাকে তার কাছে ধরে রাখবে? হাতে এসে পড়া এই সোনালি সুযোগ আমি যদি একবার হারিয়ে ফেলি জীবনে দ্বিতীয়বার নিশ্চয় আর আসবেনা। নিশ্চিত পতন থেকে রক্ষা পাবার জন্য এটাই আমার একমাত্র সুযোগ। মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে আমি বাইরের জগতে কী পাব জানিনা, জীবনটাকে নিয়ে আমি কী করতে চলেছি সেই বিষয়ে আমার তিল মাত্রও ধারণা নেই, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে একটি কথাই মাত্র ভালো করে জানি, সেটা হলঃ আমি বেশ্যা হতে চাই না।
বেশ্যা হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একদিন আমি সেই অপরিচিত পথিক মহিলাটির হাত ধরে বের হলাম অপরিচিত জগতের বুকে, অজ্ঞাত অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে।
অনুবাদক