| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-১২) । হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।


 

দ্বিতীয় পর্ব

     সমস্ত দেহ-মন আচ্ছন্ন করে রাখা একটা অদ্ভুত নেশার অবশেষে আমি সম্পূর্ণ নিমগ্ন হইয়ে ছিলাম,বাস এসে কখন গুয়াহাটি পৌছাল ,স্বপ্নে হেঁটে চলা মানুষের মতো আমি কখন বুড়ির পেছন পেছন বাস থেকে নেমে রাজপথে পা রাখলাম—কিছুই বলতে পারলাম না;রাস্তার বিপরীত দিক থেকে একটা রিক্সা বেল বাজাতে বাজাতে চট করে আমার শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল,আর রিক্সাওয়ালাটা চিৎকার করে উঠল, ‘এই যে বুড়ি মা’।তখনই আমি আমার জাগ্রত স্বপ্নাবেশ থেকে ধড়মড় করে জেগে উঠলাম,আর এবার বুড়ির মুখের দিকে একবার রিক্সাওয়ালাটার মুখের দিকে অতি আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগলাম।বুড়ি আমার দিকে না তাকিয়ে বলে উঠল,‘উঠ সুবালা,রিক্সায় উঠ।’


আরো পড়ুন: অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-১১) । হোমেন বরগোহাঞি


    অপরিচিত নগরের ততোধিক অপরিচিত রাজপথ দিয়ে রিক্সা চলতে লাগল।   কিছুক্ষণের জন্য আমি একটা বিরাট বিষ্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।রাস্তার যান-বাহনের দ্রুত গতিবেগের অদ্ভুত ছন্দ,অজস্র বিচিত্র-মুখর বিচিত্র বেশি মানুষের অবিরাম আসা-যাওয়া,নগরের রহস্যময় দেহ থেকে বের হওয়া একটা আশ্চর্য রকমের গন্ধ–এই সমস্ত কিছু মিলে একটা নতুন নেশার আবেশ পুনরায় আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।কিন্তু তার চেয়েও আমি বেশি আশ্চর্য হলাম বুড়ির মুখ-ভঙ্গির অদ্ভুত পরিবর্তনে।তার মুখটা যেন হঠাৎ একটা কঠিন মুখে পরিণত হয়ে গেল। জল জমাট বেঁধে বরফ হলে যেভাবে তাকে জল বলে চেনা যায় না, তার স্নেহ কোমল মুখটা হঠাৎ জমাট বেঁধে এরকম একটি রূপ নিল যে তাকে চিনতে পারাই কঠিন হয়ে পড়ল। মুহূর্তে মুহূর্তে রাস্তার দিক বদলে রিক্সাটা দ্রুতগতিতে কোনো এক নিরুদ্দেশ স্থানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে লাগল। রিক্সাওয়ালাটা বুড়িকে দেখতে পেয়ে প্রথমেই যে পরিচিত সুরে সম্বোধন করেছিল, তা থেকে আমি অনুমান করে নিলাম যে সে বুড়ির বাড়ি কোথায় জানে। তথাপি একটা বুঝাতে না পারা অস্বস্তিতে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। বুড়ির অস্বাভাবিক নীরবতা আমার মনে একটা আশ্চর্য ভীতি সঞ্চার করল। কিছুক্ষণ পরে সেই অবস্থা অসহ্য হয়ে ওঠায় আমি নিজেই বলে উঠলাম,’ রিক্সাওয়ালাটা আপনার  বাড়ি চেনে বোধ হয়?’

           বুড়ি উত্তর দেবার আগেই, রিক্সাওয়ালাটা হো হো করে হেসে চিৎকার করে উঠল্‌ ’ ছুকরিটা কী কথা বলছে বুড়িমা?গুয়াহাটিতে বুড়িমার বাড়ি চেনে না এমন কোনো রিক্সাওয়ালা আছে কি? …

          সে বোধহয় আরও কিছু বলতো, বুড়ি হঠাৎ করা শাসনের সুরে অনুচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল,’ চুপ থাক রামলাল, বেশি বকবক করবি না।’

           রামলাল অচল যন্ত্রের মতো তৎক্ষণাৎ নীরব হয়ে গেল। 

          আর কিছুক্ষণ গিয়ে রাস্তার একপাশে রিক্সাটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।বুড়িকে সেখানে রিক্সা থেকে নামতে দেখে আমি বুঝতে পারলাম ,’আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। আমিও রিক্সা থেকে নেমে বুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিকে তাকাতে লাগলাম। রাস্তার দুপাশে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ভালো- খারাপ ঘর, তার মধ্যে  দোকান এবং হোটেলই বেশি;কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বুড়ির ঘর কোনটা হতে পারে বা তার ঘর এই ধরনের জরাজীর্ণ কীভাবে হতে পারে,সে কথা ভেবে আমি আশ্চর্য হলাম। সেই ঘরের ভেতরে ঢোকার জন্য একটা নির্দিষ্ট  প্রবেশ পথ পর্যন্ত আমার চোখে পড়ল না।আমি এইসব ভাবনা- চিন্তা করতে করতেই বুড়ি রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে  দিল।হঠাৎ বুড়ি এবং রিক্সাওয়ালার ভেতরে দুটি মাত্র শব্দের একটি অদ্ভুত কথোপকথন আমার কানে এসে পড়ল। রিক্সাওয়ালাটা অনুচ্চ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’ আনব?’ বুড়ি উত্তর দিল,’ লাগবেনা।’ বিষ্ময়ের পরে বিষ্ময়ের আঘাতের মতো এই অদ্ভুত সাংকেতিক শব্দ বিনিময় আমাকে আরও বেশি হতভম্ব করে তুলল।

          ক্লিং ক্লিং শব্দ করে রিক্সাটা চলে গেল। বুড়ি আমার পাশে এসে বলল,’ চল।’

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত