| 14 মার্চ 2025
Categories
নারী

সুনীতা হাজরা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

বসিরহাটের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার। সেখান থেকে সোজা এভারেস্ট। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দর্শন করে ফিরেছেন এই এভারেস্টজয়ী। মাউন্টেনিয়ার সুনীতা হাজরার মুখোমুখি সায়নী দাশ শর্মা। 


১৯৮৮ সাল। বসিরহাটের মফস্বল শহর। ছোট থেকেই বেশ দুরন্ত ছিলেন তিনি। নিয়মিত খেলাধুলো করতেন। তবে পাহাড়ে চড়ার শুরুটা ঠিক কীভাবে হয়েছিল জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘‘একদিন জানতে পারি একটি রক ক্লাইম্বিং কোর্স হবে পুরুলিয়াতে। খেলাধুলো করতে বাড়ি থেকে কোনও নিষেধ ছিল না। তবে পাহাড়ে চড়ব শুনে, বাড়ির লোকেরাও একটু ইতস্তত করছিলেন। অবশ্য পরে তাঁদেরও সাপোর্ট পেয়েছি। সেই থেকেই শুরু।’’ পাহাড়ের প্রতি এত ভালবাসা কেন? উত্তরে বললেন, ‘‘পাহাড়ে চড়াটা এক অদ্ভুত নেশা। তবে এ নেশায় শেখার আছে অনেক কিছু। চারিত্রিক দৃঢ়তা আনতে শেখায়, কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়। একটু ভুল হলেই জীবনের ঝুঁকি। জীবনের মূল্যবোধটা গড়ে তুলতে এই নেশাটা খুব সাহায্য করেছে। সবটা মিলিয়ে এই নেশাটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করার সময় স্যরদের কাছেও নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনতাম। সেগুলো শুনেও ভীষণ উৎসাহিত হয়েছিলাম। তখন প্রত্যেক রবিবার এভারেস্ট এক্সপিডিশনের খবর ছাপা হত আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেটা পড়তাম। তখনই মনে হত যে এরকম একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করা দরকার। একটা আগ্রহ জন্মেছিল। সেই থেকেই স্বপ্ন দেখা।’’ বিয়ের পর সংসার, ছেলে, মাউন্টেনিয়ারিং—সবকিছু সামলালেন কীভাবে? ‘‘বিশ্বের উচ্চতম শিখরে পৌঁছনোর স্বপ্নটাই তো সব নয়। সেটার জন্য নিজেকে আলাদা করে তৈরি করতে হয়। আমার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের পক্ষে সেই স্বপ্ন সত্যিই অলীক ছিল। ২০০২ সালে আমার বিয়ে হয়। তবে শ্বশুড়বাড়ি থেকেও এ ব্যাপারে কোনও আপত্তি আসেনি। ২০০৫ সালে ছেলে হওয়ার পর বেশ কিছু মাস সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। তবে পাহাড়ের টানেই আবার ফিরে আসি। ছেলে যখন একটু বড় হল, তখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একমাস আমায় ছাড়া থাকতে পারবে কি না।

ও রাজি হওয়ায় আবার শুরু হল পাহাড়ে চড়া।’’ এভারেস্ট অভিযানের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বললেন, ‘‘পরপর তিন বছরে তিনটি সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হয়। আমার প্রথম এভারেস্ট অভিযান ২০১৪ সালে। সে বছর খুম্বু আইসফলের কবলে একটা এক্সপিডিশনের দলের মৃত্যু হয়। ফলে আমাদের এক্সপিডিশন পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। একরাশ দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। তবে পাহাড় যেন প্রতিনিয়ত আমায় টানত। তাই ২০১৫ সালে আবার পাড়ি দিই এভারেস্টে। সে বছর নেপালের ভূমিকম্পে আবারও একটি বেসক্যাম্পে ২২ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকে সেই প্রথম অত কাছ থেকে দেখি।ভূমিকম্পের এত প্রবলতা, মনে হবে যেন কোনও নৌকায় দুলছি। অথচ জানি না বিপদ ঠিক কোন দিক থেকে আসছে।যখন বুঝতে পারি, তখন বিপদ আর মাত্র ৫০ মিটার দূরত্বে।সেই বিশালাকার বরফের দৈত্যের সঙ্গে কীভাবে লড়াই করব, ভেবে ওঠারও কোনও সময় ছিল না। কোনওরকমে একটি ছোট পাথরের পিছনে আমি এবং এক কোরিয়ান ক্লাইম্বার একসঙ্গে প্রাণরক্ষা করি। তবে ২০১৬ সালের এভারেস্ট অভিযানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনও ভয়াবহতারই তুলনা চলে না। সামিটের শেষে যখন ফিরছি, আমার অক্সিজেন তখন প্রায় শেষের মুখে, প্রায় ২৪ ঘণ্টা জল খেতে পারিনি। কোনও শেরপা সঙ্গে ছিল না।হঠাৎই রাতের অন্ধকারে শুরু হল তুষার ঝড়। প্রায় মাইনাস পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, বেসক্যাম্পে ফিরে আসার মতো সচলতা বজায় রাখা যে কী কঠিন, তা অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝানো সম্ভব নয়। ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। হঠাৎ কানে এল একটি বাক্য, ‘‘মরনা হ্যায় কেয়া?’’ সেই কথাতেই যেন একটু শক্তি ফিরে পেলাম। ধীরে ধীরে নীচে নামতে নামতে হঠাৎই দেখি একটি আলোর রেখা।বুঝতে পারলাম পরদিন যাঁরা সামিট করবেন, তাঁদেরই দল সেটা।তাঁদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ ক্লাইম্বার, লেসলি জন বিনের কাছ থেকে অক্সিজেন নিই। মনে হচ্ছিল ভগবানই বোধহয় ওঁকে পাঠিয়েছেন আমার জন্য। লেসলি আমায় সত্যিই ভীষণ উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমি, লেসলি এবং আমাদের সহযাত্রী সুভাষ একসঙ্গে অ্যাঙ্কর বেঁধে নীচে নামছিলাম। কারওর শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। কিছুক্ষণ পরে দেখি লেসলি আমাদের সঙ্গে নেই। ইতিমধ্যে আবারও ব্লিজ়ার্ড শুরু হয়েছে। আমার হাতে ততক্ষণে ফ্রস্টবাইট হয়ে গেছে।

এক-একটা বরফের ফলা সূচের মতো বিঁধছে। সত্যি জানি না, ওই অবস্থাতেও কীভাবে অ্যাঙ্কর পরিবর্তন করে নীচে নেমেছি।যেখানে ব্রেন কাজ করছে না, একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলেই যে কোন অতল গহিনে তলিয়ে যাব, ঠিক নেই, সেখানেও আমি যন্ত্রচালিত মানবের মতো শরীরকে চালিয়ে গেছি। ঐশ্বরিক শক্তি ছাড়া এর কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এর কিছুক্ষণ পরে লেসলি ফিরে এসে জানান যে মিনিট দশেকের দূরত্বে একটি টেন্ট রয়েছে। আমি আর লেসলি কোনওরকমে সেখানে পৌঁছই। ওই অল্টিটিউডে যা যা ফার্স্ট-এড আমায় দেওয়া দরকার, সবটা লেসলি করেছিলেন। আমার যেহেতু হাইপোথার্মিয়া হয়েছিল, তাই আমায় কোনওরকমে গরম রাখাই ছিল আমায় বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায়। সেই সময় লেসলি নিজের গ্লাভস পর্যন্ত খুলে আমায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। পরদিন সকালে ডাক্তার ডেকে ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ হতে নিজের ক্যাম্পে ফিরি। বুঝতে পারি আমি, সুভাষ ছাড়া আমাদের টিমের আর কেউ ফিরতে পারেননি। সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে আমি মারা গেছি। আমার স্বামীকে অফিশিয়ালি জানিয়েও দেওয়া হয় সেই খবর। ২২ মে ক্যাম্প ৪ থেকে ক্যাম্প ৩-এ যাওয়ার ঘটনাটা আরও ভয়ংকর।দুপুর তিনটে নাগাদ আমাদের বলা হয় যেভাবেই হোক না কেন, আমাদের ক্যাম্প ৩-তে পৌঁছতে হবে। সেই সময় নীচে নামা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। আমি এবং সুভাষ তখন অসুস্থ, শেরপাদের অবস্থাও ভাল নয়। ওই শরীরে ওরকম ভয়ানক রাস্তা পেরিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। তবুও উপায়ান্তর না দেখে সেদিনই নামতে হয়। ইয়েলো ব্যান্ড, ব্লু আইস পেরিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরি, সেটা শুধুমাত্র ঈশ্বরের কৃপায় এবং মনের জোরে।২৩ মে ক্যাম্প ২-তে পৌঁছই। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে আমায় নীচে নিয়ে আসা হয়।’’ কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ফেরার  পর বাড়ির লোকের রিঅ্যাকশন কেমন ছিল?’’ শান্তস্বরে বললেন, ‘‘বাড়ি ফেরার পর ছেলের প্রথম কথা ছিল, ‘আমি আরও পাহাড়ের নাম লিখে রেখেছি। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো, মা।’’’

 

সূত্রঃ সানন্দা

 

 

 

.

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত