| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
কবিতা সাহিত্য

তৈমুর খানের একগুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
 

সংকট

 

আমি সংকটের নিকটে রোজ যাই 

চেয়ে থাকি তার গর্তের দিকে 

দু’চোখ জুড়ে শুধু অন্ধকার 


ওখানে কি বিশ্রাম থাকে তবে? 

বিশ্রামের সঙ্গে কি বিবাহ আমার? 

তবে তো আঁধারগামী, আমাদের পাতালে বাসর! 


নক্ষত্রখচিত মেঘ কবরী সাজায় 

তাদের আলোর ঘ্রাণে জেগে ওঠে কাদের সমাজ? 

আমার সমাজ নেই ; সারারাত আগলাই মৃত বিশ্বাস। 


নিশিহাঁস উড়ে গেলে বুঝি তারও প্রাগভাষা আছে 

নিঃশব্দে স্মৃতির দাঁড় টেনে নিয়ে যায় এ-জীবন 

বাতাস কুড়িয়ে নেয় ঝরা দীর্ঘশ্বাস… 


আমি শুধু কলেবর দেখি 

অহংকার মোচন হলে এই শীর্ষদেশ 

ইন্দ্রিয় মুছে ফেলে দ্যাখে শুধু ধ্বংসাবশেষ। 


  

 নিশিবেলায়

 

পাখির মতো ক্লান্ত দিন 

চলে যায় 

যেতে যেতে ডাকে 

ডাকার সংকেতে 

নিভে যায় আলো 

আঁধারের চুলগুলি জড়াই 

প্রিয়ার মতোন চোখেমুখে




 

মিনতি

 

নত হতে পারি, বিপ্লবী হব না

গার্হস্থ্য নদীর তীরে তুমি

আমাকে সুরের কম্পন দাও

হৃদয় ভাসাব


সেরকম তীর্থ নেই কোথাও

শুধু কাক আছে, কাকের নির্জন নেই

পরন্তু আকাশ নীল; কল্পনারা যায়

মনে মনে অদৃশ্য রংধনু


বেলা যায়; নষ্ট সারল্যরা

ভাষা খুঁজে ফিরে এলে

তোমাকে কাঙ্ক্ষিত মনে হয়

বৈরাগ্য নিইনি কখনো


আঁচল পেতে দিলে

সুখের ইচ্ছেরা নির্বোধ সন্তান

তোমার মুখের দিকে চায়

বিশেষ্য-ক্রিয়ায় তুমি দেহ ধারণ করো।


 

 এ শরীর বেঁচে থাকে

  

সব যাতনার ভাষা লুকিয়ে ফেলি

আজ আর খুঁজি নাকো মৃতবিশ্বাসের চাবিগুলি

এ শরীর বেঁচে থাকে জৈবপদ্ধতির ক্রিয়ায়

আর তার মহিমা প্রকাশ করে


ক্লান্ত বৈরাগ্যের ছায়ায় তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে



 

এক একটি বন্ধ্যা যুগ

 


 ধুলোঘর বারবার ভেঙে গেলে

 তবুও নির্মাণ করি ঘর,

 জ্যোৎস্না এসে সঙ্গম শেখায়

 প্রতিরাতে আমি হই কল্পনার বর


 তবুও সন্তান নেই, এক একটি বন্ধ্যা যুগ

 কারুণ্য কেটে কেটে বিষাদ চুম্বন আঁকি

 স্তব্ধতার গার্হস্থ্য যাপন চলতে থাকে

 আমাদের অক্ষরগুলি প্রত্যাশিত ঐশ্বরিক হয়


ধারণার লাবণ্যলতায় কখনো কখনো ফুল ফোটে

সেসব ফুলের গন্ধ পেলে

বসন্ত সাজাই নির্বাসনে

শব্দের কোকিল ডেকে ওঠে নৈঃশব্দ্যের বিকেলে। 

 

 

 
 
কবিতারা উঠে দাঁড়াতে চায়
 
 
তোমার অসুখের বিছানার পাশে
আমার কবিতারা বসে আছে
কোথাও যায়নি ওরা
জানালার চাঁদে হাত বাড়ায়নি ওরা
স্নেহান্ধ পিচ্ছিল কান্না চেপে
সারারাত জেগে জেগে আছে।
 
কী বলল ডাক্তার?
 
হয়তো সেরে যাবে
তিনমাস বিশ্রামে তারপর একটু একটু করে
 
কে দেখবে সংসার? আমরা সবাই হাওয়া খাব?
ছেলেমেয়ে আর শীতের কুয়াশার হাত ধরে
রোদের অপেক্ষা করে করে আমরা কি বিপ্লবী হব?
 
মৃত্যুকে পুষে পুষে রোজ বড় করি
মৃত্যু কি কোনও দিন আলো হতে পারে?
ডাক্তারের কাছে কোনও সমাধান নেই
শুধু অ্যানাস্থেসিয়া আর ডেটলের গন্ধ ঘরময়
সেলাইন চুপচাপ শরীরে ঢোকে
যন্ত্রণারা উপশম চায় আমার শব্দের কাছে 
 
কবিতারা উঠে দাঁড়াতে চায়
সুসংবাদ এসে যদি দরজা খুলে ডাকে
 
 
  
 
আমি যখন আদি মানব
 
 
 এক একটা আপেলে কামড় দিতে দিতে 
 আমি আরও তীব্র হয়ে উঠছিলাম
 নুয়ে পড়া ডালগুলির শিহরন 
 আমার আসক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছিল
 চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়
 পাহাড় চিরে বেরিয়ে আসছিল ঝরনার স্রোত
 
 এক পাশে আপেল বৃক্ষ আর আমি 
 দূরে কোথাও কলরব হচ্ছিল
 অথবা পাখি উড়ছিল
 ঝরনার জলে মুখ দেখতে দেখতে 
 আকাশের মেঘ ভেসে যাচ্ছিল
 
 আমার শরীরের ভেতর বহু শরীর টের পাচ্ছিলাম
 আমার স্বপ্নের ভেতর বহু স্বপ্ন উঁকি মারছিল
 আমার ইচ্ছার ভেতর বহু অস্ফুট ইচ্ছা জেগে উঠছিল
 আমার ইন্দ্রিয়ের পেশীগুলি ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছিল
 
 আমি আকাশ নদী বৃক্ষলতা পাহাড় দিগন্ত
 সবকিছুকেই জড়িয়ে ধরতে চাইছিলাম
 আমি মাটির উপর দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করতে চাইছিলাম
 সমস্ত পৃথিবীকেই এক নারী বলে মনে হচ্ছিল আমার
 
 
   
 
বাড়ি ফিরতে ফিরতে
 
 
কিছুক্ষণ হারিয়ে যাই তারপর আবার ফিরে আসি
নতুন কলোনি আমার ঠিকানা
রাস্তা ঠিকঠাক বুঝতে পারি না
যদিও তেমাথা পানের দোকান
সামনেই বিস্কুট কারখানা
 
মহব্বত বলে কারও সঙ্গে দেখা হয়নি কোনওদিন
অথচ অন্ধকারে সেই নাকি রাস্তা দেখিয়েছে
বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার ম্যাপ তার হাতে
আজ সকাল সকাল চায়ের দোকান সে খবর বলেছে
 
আমার কামনা এখন পায়রা দেখছে
বিকেলের হলুদ পায়রাগুলি কেমন সব ডানা মেলেছে
কেউ ওরা রসগোল্লা খায় না
বড় বড় গামলায় সবাই ভাসছে আর হাসছে
রসগোল্লাদের কেবলই আমার বেশ্যা মনে হয়
 
রাস্তা পেরিয়ে যাই
যেতে যেতে এক ছাতুওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়
তার কাঁচা লংকা পেয়াজগুলি ডাকছে আমাকে
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দরজায়
 
মহব্বতের সঙ্গে আমার কোনও দিন দেখা হয়নি 
 
    
     
 
প্রেমের হরিণী
 
 
সান্ধ্যসরণিতে কল্লোল জেগে ওঠে 
থইথই শব্দ পারাবার 
কল্পনার নাও ভাসে একূলে ওকূলে 
ডুবু ডুবু হয় সংসার 
 
ভাসমান চাঁদকে আজ আলিঙ্গন করো 
কলঙ্কিনী যে বলে বলুক 
রাধাভাব জাগ্রত হলে গার্হস্থ্য সরোবর 
আয়না বসানো জলে পদ্ম ফুটুক 
 
ভ্রমর – ভ্রমরী আসে 
গীতমালা গুঞ্জন ছড়ায় 
প্রেমের হরিণী ডাকে 
কস্তুরী ঘ্রাণে উন্মাদ হয়
 
 
      
 
আমার তমসার কাছে
 
আমার তমসার কাছে কেবল নির্জন হই
হৃদয় জানালা খুলে চেয়ে থাকে দূরে
এবারও কি নতুন কলরব হবে পাখিদের?
কাননে কাননে কত পুষ্প ফুটে আছে
 
মালতী কবেই চলে গেছে
উন্মাদ শহরে মৃত ট্রাম
মৃত কুমিরের মতো পাহারা দেয়
মিছিলের অবৈধ সঙ্গমে ধুলো ওড়ে
 
তমসার প্রাচীন স্তন থেকে দুধ ঝরে
দূরের বৃংহণে চমকে উঠি
যদিও আমার ভ্রান্তির জাগরণ
খোলা আছে অন্ধকারের কোচিং সেন্টার
 
নির্জনতা ভেঙে ভেঙে শব্দগুলি গড়ে যায়
গড়ে যেতে যেতে এক একটি মানুষ হয়
আমি ব্যাকরণ থেকে মুখ তুলে লিঙ্গ বিচার করি 
লিঙ্গকরণেই নাকি মানুষের ধর্ম চেনা যায়!
 
 
  
 
তোমার বাগানে সাদাফুল
 
তোমার বাগানে এত সাদা ফুল ফুটছে
আর পাখিও এসেছে
আমি উন্মাদ হয়ে যাবার আগে
আর একবার দেখতে এসেছি
 
আমার সব নখগুলি ক্ষয়ে গেছে
চোখও ঝাপসা হয়ে যাবে
কোনো আলো নেই পৃথিবীতে আর
কোনো বিকেল নেই পৃথিবীতে আর
তোমার হাত ধরে নদীর ধারে বসবার
 
শিহরনগুলির পুরোনো জীবন
শুধু স্মৃতিতে ভাসমান হয়
শুধু তোমাকে নির্মাণ করে সারারাত
আর তোমার বাগানের সাদাফুলে
খুঁজে ফেরে বিগত ইতিহাস…
 
 
  
 
 
পৃথিবীটা ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছে
 
 
তোমার সঙ্গে দেখা হল
                           এই কিছুক্ষণ
পৃথিবীটা ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছে
আর ফেরা হবে না কখনও
                               দেখে নিও
জলের কাছে গিয়েছিলাম
                             ঘাসের কাছেও
রোদ্দুরেও ছিলাম অনেক
রাত্রি এল, রাত্রি গেল অন্ধকারে
 
তোমার সঙ্গে দেখা হল
এখানেই ছিল শয়নঘর
কান্নার মুহূর্তগুলি,তুলোর বালিশ
স্বপ্ন দেখে একলা হওয়া
আত্মহত্যার ভাবনাগুলিও আসত তখন
 
কথা বলতে পারিনিকো
মধ্যরাতে পেঁচা ডাকত
কালপেঁচারা এসভ্যতা পাহারা দিত! 
 
নিজেই নিজের দীর্ঘশ্বাসে
                             কেঁপে কেঁপে
সোনালি ভাত,রুপোলি ভাতের কাছে
                               হাঁটুমুড়ে বসেছিলাম
আসলে সব জ্যোৎস্নামাখা পাথর
                                               প্রাণ ছিল না
সকালবেলা উঠোন জুড়ে কাক
                   মনে মনে তোমার সঙ্গে দেখা হল
                                 আসলেই তা কাকতালীয়
 
               
 
  
 
আমাদের সংসার
 
 
বউ আছে, সন্তান আছে, ইটের গাঁথুনি দেওয়া ঘর
উঠোনে পাখি নামে রোজ, পাখিরা সব বৈরাগ্য খেচর
নিরিবিলি ভিক্ষা চাইতে আসে
আমি তাকে ব্যাকরণ পড়াই
মূর্খ রাত, মূর্খ দিন কিছুই বোঝে না
দুঃখ এসে সংসার চালায়।
 
ঈশ্বরের দোকান থেকে নুন কিনে আনি
আমাদের আলস্য ভেজাভাত
আমরা সবাই অবতার,অমৃতের স্বাদ পাই
দুঃখ এসে হাসে, ওরাও তো মনখারাপের ভাই!
 
চারিদিকে কাঁথা বুনছে মা
অনেক শীতে আমাদের কাঁপন থামাবে
স্বপ্নে দুলবে সব ইচ্ছার পোষা ময়ূরেরা
বাতাবি লেবুর গাছে রোদ পড়বে
অলৌকিক বিশ্বাসের সোনালি রোদ্দুরেরা…
 
 
     
 
 
বৃষ্টির নাম অপর্ণা
 
আজ বৃষ্টি এল, বৃষ্টির নাম অপর্ণা
সিন্দুক খুলে নতুন হার বের করলাম
আকাশি রঙের জামদানিটিও
আজ ভিজতে বেরোব আমি
 
নিম অন্ধকারে বাঁশি বাজছে
সুরের ঝরনায় বেশ কাতুকুতু লাগে
হাওয়ায় ভেসে যায় বিসমিল্লা খাঁ 
নরম ব্যালকনিতে বিদগ্ধ পাখি
 
বৃষ্টির অনুভূতি মাঝে মাঝে হেসে ওঠে
তনুর হিল্লোলে ছোঁয় আনন্দের ভাষা
মৃত শৈশব কল্পতরু হয়ে ফিরে আসে
জীবন আরও জীবন পেতে চায়
 
নন্দিত সময়টুকু অলৌকিক সান্নিধ্যের কাছে
যেতে চায় বলে আকাঙ্ক্ষারা নৌকা বানায়
নৌকায় বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে নৌকা দোল খায় 
আমরা পিছল হতে থাকি, হৃদয় গলে গলে ঝরে
                       
 
        
 
 
সোনার মঙ্গলকাব্য
 
 
রাতদিন সোনার হরিণ শিকার করি
আর হরিণের মাংস আনি ঘরে
ফুল্লরা রান্না করে দেয়
আমি ও আমার সন্তান মিলে খাই
 
সোনার সংসারে আমরাও সোনার মানুষ
রোদ্দুরে চিকচিক করে শরীর আমাদের 
অরণ্য প্রত্যহ হরিণ প্রসব করে
 
সোনার তির-ধনুক হাতে যখন দাঁড়াই
আমাদের গল্পগুলি পাখা মেলে ওড়ে
গল্পগুলি খুঁজে ফেরে মুকুন্দরামের ঘর
 
কত যুগ পার হচ্ছে, সোনার হরিণ হচ্ছে মায়া
আমরাও বদলে যাচ্ছি লোহায় পেতলে
ফুল্লরাও পাল্টে হচ্ছে ফেলু-ফেলানিতে
 
তির-ধনুকগুলি এখন বন্দুক-পিস্তল
অরণ্য নগর-রাষ্ট্র সমূহ শিকারভূমি এই সভ্যতার
সন্তান-সন্ততি মিলে আমরা সব মরীচিকা খাই 
 
 
     
 
নিমন্ত্রণ
 
দ্যাখো কেমন আলো জ্বলে!
প্রখর তমসা সব কেমন উজ্জ্বল
এ ওকে প্রেম নিবেদন করে
এ ওকে চুম্বনের নিমন্ত্রণ জানায়
 
বাজনা নেই, সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে মোহ
সবাই প্রশংসা করে তার, শুধু তারই বাহাদুরি
আমরা  ইতিহাস থেকে তুলে আনি জমিদার
 
আলোর সান্নিধ্য থেকে প্রাক্-বিবাহের বসন্ত উঁকি দিলে
কেউ কেউ কোকিল-কণ্ঠ হয়
কেউ কেউ সারা নিশি ঘুরে অন্ধকার কাক তাড়ায়
 
বিচার-বিবেচনাগুলি চিরুনি হারিয়ে কাঁদে
কে তাদের আঁচড়াবে চুল?
আলুথালু কবরীরা নাচের মুদ্রায় করে ভুল
চুপচাপ বসে পড়ে, যদিও ওরা সরস্বতী
যদিও বাজাতে পারে বীণা
 
শীত বেশ কমে গেছে বলে, হৃদয়ও এসেছে আজ
বৈরাগ্য অভ্যাস থেকে ফিরে এখন আমিষ খাবে
আর উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সব তমসার কাছে
তোমরাও আসবে নাকি? দেরি করা যাবে নাকো তবে!
 
 
     
 
আমরা সবাই
 
পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে
 আর আমরা অনবরত চোখ বন্ধ রাখছি
 কেউ ঘুমাচ্ছি না তবু বলছি: ঘুম পাচ্ছে আমাদের!
 
 আমরা সবাই ভালোলোক হয়ে যাচ্ছি
 
 আমাদের মাথার খড়্গ,হাতের থাবা, মনের অন্ধকার 
কেউকে দেখাচ্ছি না
 আমরা কেউ দুধ পান করতে শিখিনি 
 এমনই অভিনয় আমাদের!
 
 অথচ নিজেদের নাটক নিজেরাই দেখতে দেখতে
 আমরা সবাই বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি
     
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত