Categories
তন্ত্রে মদ,মাংস,মৈথুন সহ ‘পঞ্চ-মকার’-এর প্রকৃত তাৎপর্য
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
তন্ত্র শাস্ত্রে পঞ্চ-মকার হল — মদ,মাংস,মৎস্য,মুদ্রা ও মৈথুন।কিন্তু এগুলো সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত নয়।বর্তমানে যেভাবে তন্ত্রশাস্ত্রের ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে, তা প্রকৃত সাধনার অন্তরায়-স্বরূপ। বর্ত্তমান তন্ত্রসাধনায় পঞ্চ মকারের নামে যেরূপ ব্যভিচার দেখা যায় তন্ত্রশাস্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য কখনই সেইরূপ নয়।কেবলমাত্র অর্থ-বিকৃতির জন্য এইরূপ অনর্থের সৃষ্টি হয়েছে। কোন সৎ-শাস্ত্রই কখনই মানবকে বিপথগামী করে না।তন্ত্রশাস্ত্রের মূলতত্ত্ব যে পঞ্চ-মকার, তার সূক্ষ্ম অর্থ না বুঝে সাধারণ মানুষ স্বীয় প্রবৃত্তি অনুযায়ী বিপথে পরিচালিত হয়। বস্তুতঃ পঞ্চ-মকারের যথার্থ সাধনায় সাধক আত্মজ্ঞান তথা মোক্ষ লাভ করতে পারে।বাস্তবে তন্ত্রসাধনা -যোগসাধনা, তন্ত্রশাস্ত্র কঠোর যোগশাস্ত্র।
তন্ত্রশাস্ত্রের প্রধান অঙ্গ হল এই পঞ্চ-মকার—
“মদ্যং মাংসঞ্চ মৎস্যঞ্চ মুদ্রাং মৈথুনমেব চ”।
—মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পঞ্চ-মকারের প্রকৃত তাৎপৰ্য্য সম্বন্ধে
কুলার্ণব তন্ত্রে বলা হয়েছে—
মদ্যপানেন মনুজো যদি সিদ্ধিং লভতে বৈ।
মদ্যপানরতাঃ সর্ব্বে সিদ্ধিং গচ্ছন্তু পামরাঃ ৷।
মাংস-ভক্ষণ মাত্রেণ যদি পুণ্যা গতির্ভবেৎ।
লোকে মাংসাশিনঃ সৰ্ব্বে পুণ্যভাজো ভবন্তি হি ৷।
স্ত্রী সম্ভোগেন দেবেশি যদি মোক্ষং ভবন্তি বৈ।
সৰ্ব্বেঽপি জন্তুবো লোকে মুক্তাঃ স্যুঃ স্ত্রীনিষেবনাৎ ।।
—কুলার্ণবতন্ত্র।
—অর্থাৎ মদ্যপান করলে যদি মানুষ সিদ্ধিলাভ করত, তা হলে মদ্যপানরত পাপী পাষণ্ডগণ সকলেই সিদ্ধিলাভ করত। মাংস ভক্ষণ মাত্রেই যদি সদগতি লাভ হত,তা হলে মাংসাশী ব্যক্তিমাত্রই পুণ্যলাভ করতে পারত। স্ত্রী সম্ভোগেই যদি মোক্ষলাভ হত, তা হইলে তো জগতের সকল জীবজন্তুই স্ত্রীসম্ভোগের দ্বারা মুক্তিলাভ করিতে পারত।কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা নয়। তন্ত্রের মধ্যে যে গভীর যোগতত্ত্ব নিহিত আছে, তার গূঢ় রহস্য ভেদ করতে পারলেই সিদ্ধিলাভ করা যায়। পঞ্চ-মকারের প্রকৃত অর্থ যথার্থ বিবেকী সাধকগণ ‘যেরূপ নির্দ্দেশ করে গেছেন, তা এখন আলোচনা করা হল —
পঞ্চ-মকারের প্রথম তত্ত্ব—মদ্যপান। কিন্তু এই মদ্যপান সাধারণ মদ্যপান নয়।এই মদ্য হচ্ছে—ব্রহ্মানন্দ। মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ্রস্থিত সহস্র-কমলদল-বিনির্গত সুধাধারা
পান করে সাধকের যে মত্ততা জন্মে, এই হল সেই মদ্যপান। “আগমসারে” পরিষ্কার ভাবে
লিখিত আছে-
সোমধারা ক্ষরেদ্-যাতু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ্ বরাননে ।
পীত্বানন্দময়ীং তাং যঃ স এব মদ্যসাধকঃ ৷৷
— আগমসার
—অর্থাৎ যে বিবেকী সাধক ব্রহ্মরন্ধ্র হতে নির্গত সোমধারা পান করে ব্ৰহ্মানন্দে মত্ত হন তিনিই যথার্থ মদ্যসাধক।পঞ্চ-মকারের দ্বিতীয় তত্ত্ব—মাংস ভোজনও সাধারণ মাংস ভক্ষণ নয়। এর প্রকৃত শাস্ত্রীয় অর্থ—মা= রসনা + অংশ অর্থাৎ রসনার অংশ—বাক্য। মাংসভোজন অর্থ বাক্-সংযম বা মৌনাবলম্বন।
মা শব্দাৎ রসনা জ্ঞেয়া তদংশান্ রসনা প্রিয়ে।
সদা চ ভক্ষয়েৎ দেবি স এব মাংস সাধকঃ।।
—আগমসার
—অর্থাৎ মা শব্দে রসনা বুঝায়, তদংশে বাক্য বুঝবে। হে দেবী সেই বাক্য যিনি ভক্ষণ করেছেন অর্থাৎ বাক্-সংযম করে মৌনব্রত অবলম্বন করেছেন তিনিই যথার্থ মাংসসাধক।
অন্য অর্থ—রসনা জয় অর্থ আহার-সংযম বুঝায়। অর্থাৎ যে সাধক আহার-সংযম করে ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করেছেন, তিনিই যথার্থ মাংসসাধক বা রসনা জয়ী। “জিতং সর্ব্বৎ জিতে রসে” অর্থাৎ রসনা জয় করলে সমস্ত জয় করা যায়।
পঞ্চ-মকারের তৃতীয় তত্ত্ব– মৎস্য। সাধকের মৎস্যভক্ষণ অর্থ—শ্বাস-প্রশ্বাস
রোধপূর্ব্বক কুম্ভকযোগ অর্থাৎ প্রাণায়াম যোগ অভ্যাস।
গঙ্গাযমুনয়োর্ম্মধ্যে মৎস্যৌ দ্বৌ চরতঃ সদা।
তৌ মৎস্যৌ ভক্ষয়েদযস্তু স ভবেৎ মৎস্য সাধকঃ ।।
—অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনার (অর্থাৎ ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর) মধ্যে দুইটি মৎস্য (শ্বাস ও প্রশ্বাস) সতত চলছে। যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে অর্থাৎ সংযত করে,সেই যথার্থ মৎস্যসাধক।
পঞ্চ-মকারের চতুর্থ তত্ত্ব—মুদ্রা। মুদ্রা-ভক্ষণ অর্থ—আশা, তৃষ্ণা, গ্লানি, ভয়, ঘৃণা,মান, লজ্জা ও ক্রোধ—এই অষ্ট মুদ্রাকে জয় করা।
আশা-তৃষ্ণা-জুগুপ্সা-ভয়-বিশদ-ঘৃণা-মান-লজ্জাভিষঙ্গাঃ।
ব্রহ্মাগ্মাবষ্টমুদ্রাঃ পরসুকতি নঃ জপাচ্যমান: সমস্তাৎ ।।
—অর্থাৎ আশা, তৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয়, গ্লানি, মান, লজ্জা ও ক্রোধ—এই অষ্ট মুদ্রাকে ব্রহ্মজ্ঞানরূপ অগ্নির দ্বারা সুসিদ্ধ করে ভক্ষণ করাকে মুদ্রা ভক্ষণ বলে ।
পঞ্চ-মকারের পঞ্চম তত্ত্ব—মৈথুন। এই মৈথুনের অর্থ ব্যাভিচার বা স্ত্রীসম্ভোগ নয়,এর অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের সহিত ভক্তির সংমিশ্রণ। ব্রহ্মরন্ধ্রস্থিত সহস্রারের বিন্দুর সহিত কুলকুণ্ডলিনী শক্তির যে মিলন, তাকেই যথার্থ দিব্য মৈথুন বলিয়া ঋষিগণ বলে থাকেন—
সহস্রারোপরি বিন্দৌ কুণ্ডলা মিলনাৎ শিবে।
মৈথুনং পরমং দিব্যং যতীনাং পরিকীর্ত্তিতম্।
এমন সুন্দর পবিত্র নিগূঢ় অর্থ যার, তার প্রকৃত অর্থ না অনুধাবন করে সাধারণ মানুষ সাধনার নামে মহাপাপে নিমগ্ন হয়।এর চাইতে উৎকৃষ্টতর যোগভ্যাস বা চিত্তবৃত্তি-নিরোধ আর কি হতে পারে?সংসারের মধ্যে শত প্রলোভনে পরিবৃত হইয়াও নির্লিপ্ত ভাবে
সাধনার অভ্যাস হল তন্ত্র শাস্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য। কলিকালে কালপ্রভাবে জনসাধারণের মধ্যে পঞ্চ-মকারের প্রাধান্য হবে—এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই সবের সংস্পর্শে থেকেও এগুলির প্রতি আসক্তিশূন্য হয়ে সাধনা করিতে হইবে—এটাই সাধকের মহাপরীক্ষা। কেউ কেউ বুদ্ধিভ্ৰংশ হেতু
তন্ত্রের প্রকৃত অর্থ বুঝিতে না পেরে সাধনার নামে মদ্যপায়ী, মাংসাশী ও ব্যভিচারী হয়।
— সেইজন্য তন্ত্রশাস্ত্র দায়ী নয়। তন্ত্রশাস্ত্রে পরিষ্কার লেখা আছে— যারা সত্য ও সাধনায় শুদ্ধচিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় হয়ে কুলাচার পালন করবেন, দয়াশীল হবেন এবং স্বীয় পত্নীতে অনুরক্ত থাকবেন, তাঁরাই তন্ত্রোক্ত সাধনার দ্বারা শক্তি ও সিদ্ধিলাভ করবেন। পরস্ত্রীর সহিত সংসর্গে ও সেই জাতীয় পাপের গুরুতর প্রায়শ্চিত্ত এবং গুরুদণ্ড তন্ত্রশাস্ত্রে উল্লিখিত রয়েছে।তবে কিছু অপশক্তি,ভূত, প্রেত,পিশাচ এর সাধনায় মদ,মাংস,মৈথুন সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।কিন্তু সেগুলো তামসিক তন্ত্র সাধনা।এছাড়া কিছু গ্রন্থে যেগুলো সুপ্রাচীন নয় সেখানেও এই পঞ্চ – মকারকে ব্যভিচার হিসেবে দেখানো হয়েছে।কিন্তু আমাদেরকে প্রাচীন কুলার্ণব তন্ত্র,আগমসার ও মহানির্বাণ তন্ত্র এর সুপ্রাচীন গ্রন্থকে প্রকৃত মান্যতা দিতে হবে।
(তথ্যসূত্র:- হিন্দু শাস্ত্র পরিচয় — স্বামী অরুণানন্দ)