| 7 মে 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: আমি এবং মঞ্জরী । তপন রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আমি মঞ্জরীর ওপর খুব নির্ভর করি। আমি জানি, মঞ্জরী ঠিক থাকলে সব ঠিক থাকবে। সবকিছু ঘড়ির কাঁটা ধরে চলবে। আমার খাওয়াদাওয়া ঠিক সময়মত হবে, কাজকর্ম চলবে এক সুন্দর ছন্দে। সকলের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে। কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও মঞ্জরী আমাকে কারুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেবে না।  তাই মঞ্জরীর দিকে খুব খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু এই খেয়াল রাখাটা সবসময় ঠিকঠাক হয় না। দোষ আমারই। আমি আবেগতাড়িত হয়ে কিংবা অন্য কিছুর টানে মঞ্জরীকে ভুলে যাই। তখন হারিয়ে যায় মঞ্জরী আমার কাছ থেকে। আর, মঞ্জরীও খুব অভিমানী। চুপচাপ সরে যায় আমার কাছ থেকে। আমি দিশেহারা হয়ে যাই তখন। সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। একসময় ক্লান্ত নিঃস্ব হয়ে চুপ করে থাকি। তখন মঞ্জরী চলে আসে আমার কাছে। কিন্তু ততক্ষণে আমার যা খারাপ হওয়ার হয়ে গেছে। আমি বলি, কোথায় ছিলে তুমি, কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? মঞ্জরী কিছু বলে না। শুধু চুপ করে থেকে মুচকি মুচকি হাসে। সে-হাসির অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

আমি জানি, মঞ্জরী সরে গেলে বা বেঁকে বসলে আমার কিছু করার থাকবে না। কিন্তু তবুও আমি কিসের তাড়নায় যেন বিচ্যুত হই আমার পথ থেকে। মঞ্জরীকে বলি, তুমি সরে যেও না আমার কাছ থেকে। মঞ্জরী কিছু বলে না, শুধু মুচকি মুচকি হাসে, ভাবটা এই, ও যেন বলছে, আমি তো সরে যাই না, বরং তুমিই ভুলে যাও আমাকে। আমি ভাবি, হয়ত ঠিকই বলছে মঞ্জরী, দোষটা আমারই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, কীভাবে আমি মঞ্জরীর কাছে সবসময় থাকতে পারব!

একটা গুণ আছে মঞ্জরীর। ডাকলেই চলে আসে। অবশ্য যেমন তেমন করে ডাকা নয়, মন দিয়ে ডাকতে হবে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে। ওর আবার মান-সম্মান বোধ সাংঘাতিক। প্রত্যেকদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলি, দেখি, মঞ্জরী হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার ভেতরটা ভরে যায় আনন্দে। এই সময়টা না ডাকতেই চলে আসে। ইশারায় বলে, ভালো করে দিন শুরু করো। দিনটাকে কাজে লাগাও। মন খারাপ কোরো না, আমি সঙ্গে আছি তোমার। মনে মনে বলি, মন খারাপ কি সাধে হয়! হাজারটা কারণ। একবার মুখ ফুটে কথাটা বলেওছিলাম মঞ্জরীকে। মঞ্জরী বলেছিল, কারণ যাই হোক, মন খারাপ কখনোই নয়। আমি বলি, মঞ্জরী তুমি সঙ্গে থেকো, আমি চেষ্টা করব, তুমি ছেড়ে যেও না। মঞ্জরী মুচকি হাসে। আমি সে-হাসির অর্থ বুঝতে পারি না।

আমি দিনের কাজ শুরু করি। এই যেমন আজ সকালে যখন জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখি, পুকুরের কাছ দিয়ে কী একটা যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, ভাবলাম, একটা ছবি তুলে রাখি। ক্যামেরাটা অন করতে গিয়ে দেখি, আলোটা জ্বলল, কিন্তু ক্যামেরার কোনো বাটন কাজ করছে না। বেশ অবাক লাগল। সুইচ অফ করলাম। ও বাবা, স্ক্রিনের আলোটা নিভছে না। সবকিছু আটকে আছে। সেই অবস্থাতেই ব্যাটারী বার করলাম। সঙ্গে সঙ্গে আলোটা নিভল। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম ক্যামেরটাকে চালু করার জন্য। হল না। ক্যামেরাটা কি খারাপ হয়ে গেল? মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর তখনই মঞ্জরীকে স্মরণ করলাম। মঞ্জরী আসছে না। আমার মন খারাপ বাড়তেই থাকল। আমি আর জানালার কাছে গেলামই না। সকালবেলাতেই মন খারাপ। আমার অস্থিরতা তখন তুঙ্গে। আমি আবার মঞ্জরীকে ডাকলাম। মঞ্জরীর সাড়া নেই। মঞ্জরী কোথায় গেল?  আমার তো অনেক কাজ বাকি আছে। মন খারাপ থাকলে কী করে সেসব কাজ করব? আমি একাগ্র হলাম। ক্যামেরাকে ভুলতে চেষ্টা করলাম। ঠিক তখনই মনে পড়ল, মঞ্জরী একবার বলেছিল, কোনো ব্যাপারে মন খারাপ হলে ভেঙে পড়বে না, যুক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে, সমস্যাকে চেপে রাখবে না। চেপে রাখলেই আবার সে কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তাই একটু স্থির হলাম। আমি ভাবতে থাকলাম। হঠাৎ কুণালদার কথা মনে পড়ল। ক্যামেরার ব্যাপারে কুণালদা হচ্ছেন আমার ফ্রেন্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড। কুণালদার সঙ্গে আমার আলাপের সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছি সদ্য সদ্য। পাগলের মত ছবি  তুলছি আর ভাবছি, দারুণ তুলছি। যেগুলো মনে হচ্ছে, খারাপ তোলা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দিচ্ছি। এইভাবে আমার পছন্দের একশোটা ছবি ক্যামেরাতে রেখে দিলাম। আমার বন্ধু তপেশকে দেখালাম। তপেশ দেখে বলল, তুই তো দারুণ ফটোগ্রাফার হয়ে গেছিস, এক কাজ কর, আমার এক বন্ধুর দাদা, নাম কুণাল মল্লিক, দারুণ ফটোগ্রাফার, নিউজ চ্যানেলে কাজ করেন, ওঁর কাছে চলে যা, ছবিগুলো দেখা, উনি ভালো গাইড করতে পারবেন তোকে। তপেশ আমাকে কুণালদার নম্বর দিয়ে দিল। আমি একদিন ফোন করে কুণালদার কাছে চলে গেলাম। ছবিগুলো দেখালাম কুণালদাকে, প্রায় একশো ছবি। তার মধ্যে কুণালদা পাঁচটা না ছ’টা ছবি দেখে বললেন, এগুলো ঠিক তোলা হয়েছে, বাকিগুলো ডিলিট করে দিন, খারাপ ছবি চোখের সামনে রাখবেন না, চোখ খারাপ হয়ে যাবে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। একশো ছবির মধ্যে মোটে ছ’টা ভালো! আর, অদ্ভুত ব্যাপার, তাকিয়ে দেখলাম, যে-ছ’টা ছবি কুণালদা রেখেছেন, সেগুলো সব মঞ্জরীর। আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম, তার মানে, মঞ্জরী যখনই থাকবে, যেখানে থাকবে, যেভাবেই থাকুক না কেন, সবকিছু ভালো হয়ে যায়! বেশ নিশ্চিত একটা আন্দাজ পেলাম। একটু হাসিও পেল আমার। আমি মনে মনে হাসলাম। বোধহয় বাইরে তার প্রকাশ হচ্ছিল। কারণ,  কুণালদা হঠাৎ বলে উঠলেন, হাসছেন কেন? আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, না, না, কিছু না। একটু ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে এক্ষুনি হয়তো কুণালদা মঞ্জরী সম্পর্কে নানা প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি তখন একটু বিব্রত বোধ করব। কারণ, মঞ্জরী সম্পর্কে কেউ কিছু আমাকে জিজ্ঞেস করুক, এটা আমি চাই না। কিন্তু দেখলাম, কুণালদা ও ব্যাপারে কিছু বললেন না আর। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম। যাই হোক, বাতিল ছবিগুলোর প্রসঙ্গে কুণালদা অবশ্য পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ওগুলোর কোথায় কোথায় ডিফেক্ট। এই হচ্ছেন কুণালদা।


আরো পড়ুন:  একজন  সঞ্চালকের গল্প । তপন রায়চৌধুরী


তারপর মাঝেমধ্যেই কুণালদার বাড়িতে যেতাম, আমার তোলা ছবি দেখাতাম, ধীরে ধীরে আমার উন্নতি হতে থাকল। কুণালদাও সার্টিফিকেট দিতে থাকলেন, আপনার ছবি তোলার উন্নতি হচ্ছে।

তাই ঠিক করলাম, কুণালদাকে বেলার দিকে একবার ফোন করব। আমি জানি, কুণালদা ক্যামেরার ব্যাপারে এক্সপার্ট, উনি একটা সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারবেন।

বেলা এগারোটা নাগাদ ফোন করলাম কুণালদাকে। ক্যামেরার সমস্যার কথা বিশদভাবে বললাম। সবটা শুনে উনি ক্যামেরা সারানোর একটা দোকানের ঠিকানা দিলেন আমায়। সেই দোকানের একটি লোকের নাম বলে দিলেন। এও বললেন,  ওঁর হাতে ছাড়া ক্যামেরা আর কারুর হাতে দেবেন না। আর, আমার নাম অবশ্যই করবেন। তবে যেদিন যাবেন ওখানে, আমাকে বলবেন আগে থাকতে, আমি বলে রাখব, তাহলে আপনার সুবিধা হবে।  

যেন একটা দিশা পেলাম, আমার ভেতরটা কিছুটা ঠান্ডা হয়ে গেল। যেরকম একটা দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল প্রথমে, সেটা আর থাকল না। হঠাৎ খেয়াল করি, মঞ্জরী আমার সামনে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি একটা পরম তৃপ্তি এবং অখন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে। আমার মনে হল, এইবার, হ্যাঁ ঠিক এইবারই, মঞ্জরীর এই হাসির অর্থ আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম। আমার আর কোনো টেনশন থাকল না।     

     

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত