অনুবাদ: এ্যালকেমিস্ট । পাওলো কোয়েলহো (পর্ব-৭)। সায়মা মনি
পৃষ্ঠা ৬১
সে যাই হোক, বনিকটি তার দুপুরের খাবার খেতে কয়েক মিনিট দেরি করে যাবে স্থির করল যতক্ষণ না পর্যন্ত বালকটি কোথাও যায়।
* * *
দরজায় একটি কার্ড ঝোলান ছিল যাতে ঘোষণা করা ছিল যে কয়েকটা ভাষায় এই দোকানে কথা বলা হয়।বালকটি একজন লোককে কাউন্টারের পেছনে দৃষ্টিগোচর করল।
‘আমি জানালার ভেতরের ওই সব কাচের জিনিসগুলো পরিষ্কার করে দিতে পারি, যদি তুমি চাও,’ বালকটি বলল।’ওগুলো এখন যেমন দেখাচ্ছে, কেউই ওগুলো কিনতে চাইবে না।’
লোকটি তার কথায় সাড়া না দিয়ে তার দিকে তাকাল।
‘বদলে তুমি আমাকে কিছু দিতে পার যা খাওয়া যাবে।’
লোকটি তবুও কিছু বললো না, আর বালকটি বুঝতে পারল যে সে একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।তার বটুয়ায় তার জ্যাকেটটি ছিল – তার নিশ্চয়ই এটা মরুভূমিতে দরকার নেই। জ্যাকেটটি বের করে, সে কাচের জিনিসপত্রগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে।আধা ঘন্টার মধ্যে, সে জানালার সবগুলো কাচের জিনিস পরিষ্কার করে ফেলে, আর, যেহেতু সে এটা করছিল, দুইজন ক্রেতা দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে আর কিছু ক্রিস্টাল কিনে নেয়।
পৃষ্ঠা ৬২
যখন সে পরিষ্কার করা শেষ করল, সে লোকটির কাছে খাবার চাইল। ‘চলো দুপুরের খাবার খেতে যাই,’ ক্রিস্টাল বনিকটি বলল।
সে দরজায় একটি চিহ্ন দিল, আর তারা কাছেই একটি ছোট ক্যাফেতে গেল।যখন তারা ওই জায়গার একটি মাত্র টেবিলে বসল, ক্রিস্টাল বনিকটি হেসে উঠল।
‘তোমার কিছু পরিষ্কার করতে হবে না,’ সে বলল। কোরআন শরীফ আমাকে একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতে নির্দেশ করে।’
‘ভাল তাহলে, তুমি তবে আমাকে কেন খাওয়াচ্ছো?’ বালকটি জিজ্ঞেস করল।
‘কারন ক্রিস্টাল খুব নোংরা হয়ে ছিল।তুমি আর আমি দুজনেরই আমাদের মন থেকে নেগেটিভ চিন্তাগুলো পরিষ্কার করা দরকার ছিল।’
যখন তাদের খাওয়া হল, বনিকটি বালকটির দিকে ঘুরল আর বলল, ‘আমি চাই তুমি আমার দোকানে কাজ কর।দুই জন ক্রেতা আজ দোকানে এসেছে যখন তুমি কাজ করছিলে, আর সেটা ভাল একটা প্রতীক।’
মানুষ প্রতীক নিয়ে অনেক কিছু বলে, মেষপালকটি ভাবল।কিন্তু তারা সত্যিকারভাবে কি বলছে তা জানেনা।ঠিক যেমন আমি এতগুলো বছর ধরে বুঝতে পারিনি যে আমি মেষগুলোর সাথে শব্দবিহীন ভাষায় কথা বলে গেছি।
পৃষ্ঠা ৬৩,৬৪
‘তুমি কি আমার জন্য কাজে যেতে চাও?’ বনিকটি জিজ্ঞেস করল।
‘আমি দিনের বাকি সময়টাতে কাজ করতে পারি,’ বালকটি প্রত্যুত্তর করল। আমি সারারাত কাজ করব, সূর্যোদয় পর্যন্ত, আর আমি তোমার দোকানের প্রতিটা ক্রিস্টাল পিস পরিষ্কার করব।প্রতিদানে, আমার আগামীকাল মিশর যাওয়ার জন্য টাকা দরকার।’
বনিকটি হেসে উঠল।’তুমি যদি গোটা একটা বছর আমার দোকানের ক্রিস্টাল পরিষ্কার কর তবু—– এমনকি তুমি যদি প্রতিটা ক্রিস্টাল বিক্রি করে একটা ভাল কমিশন পাও, তোমাকে তার পরেও মিশরে যেতে টাকা ধার করতে হবে।এখানে আর ওখানে সহস্রখানেক কিলোমিটারের মরুভূমি মাঝখানে পড়ে।
সেখানে একটি নিঃশব্দ মুহুর্ত তৈরি হয় যা এত তাৎপর্যপূর্ণ যে মনে হয় যেন শহরটা ঘুমন্ত ছিল। বাজার থেকে কোন শব্দ আসছিল না, বনিকদের মধ্যে কোন তর্ক হচ্ছিল না, কোন মানুষ জমের চুড়ায় উঠছিল না।কোন আশা নেই, কোন এ্যাডভেঞ্চার নেই, কোন পুরনো রাজা নেই অথবা কোন গন্তব্য নেই, কোন সম্পদ নেই, আর কোন পিরামিড নেই।যেন মনে হচ্ছিল পৃথিবী নিঃশব্দ হয়ে পড়েছে কারন বালকটির আত্মাও এমন হয়ে গিয়েছিল।সে সেখানে বসেছিল, শুন্য দৃষ্টিতে দরজার ভেতর দিয়ে ক্যাফের দিকে তাকিয়েছিল, সে মৃত্যু কামনা করছিল, আর যাতে সবকিছু সেই মুহুর্তে চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যায়।
বনিকটি বালকটির দিকে উদ্বিগ্ন দৃস্টিতে তাকাল।সে যে সমস্ত আনন্দ সেই সকালে দেখেছিল, হঠাত করে করে তা উধাও হয়ে গেল।
‘আমি তোমাকে তোমার দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য যে টাকা দরকার তা দিতে পারি, আমার পুত্র,’ ক্রিস্টাল বনিক বলল।
বালকটি কিছু বলল না।সে উঠে দাঁড়াল, আর তার গায়ে পরে থাকা জামা কাপড় ঠিক করল, আর তার বটুয়া তুলে নিল।
‘আমি তোমার জন্য কাজ করব,’ সে বলল।
আর আরেকটি লম্বা নৈঃশব্দের পর, সে আরও বলল, ‘আমার কয়েকটা ভেড়া কেনার জন্য টাকা দরকার।’
আরো পড়ুন: এ্যালকেমিস্ট । পাওলো কোয়েলহো (পর্ব-৬)। সায়মা মনি
পৃষ্ঠা ৬৭
বালকটি বনিকের জন্য প্রায় এক মাস যাবত কাজ করল, আর সে দেখতে পেত যে এটা ঠিক তেমন কাজ নয় যা তাকে সন্তুষ্ট করবে।বনিকটি কাউন্টারের পেছনে বিড়বিড় করে গোটা দিন পার করছিল, বালকটিকে বলে যাচ্ছিল যেন কাচের জিনিসগুলো খুব সতর্কতার সাথে যত্ন নেয় আর কিছু যেন না ভেঙে ফেলে।
তবু সে কাজটার সাথে থাকছিল কারন বনিকটি, যদিও তিনি বিমর্ষ একজন বুড়ো, তার সাথে ভাল আচরণ করছিল; বালকটি একটি প্রতি পিস বিক্রি করে ভাল পরিমাণ কমিশন পাচ্ছিল, আর ইতিমধ্যে কিছু টাকা আলাদা করে রেখে দিতে পারছিল।সেই সকালে সে কিছু হিসাব পত্তর করে ফেলেছে: সে যদি প্রতিদিন কাজটা করে যেতে পারে, যেভাবে সে করে যাচ্ছে, তার পুরো একটা বছর লাগবে কযেকটা মেষ কিনতে।
পৃষ্ঠ ৬৮
‘আমি ক্রিস্টাল গুলোর জন্য একটি প্রদর্শক বাক্স বানাবো,’ বালকটি বনিককে বলল। ‘আমরা এটা বাইরে রাখতে পারতাম, আর ওই সব মানুষদের আকৃষ্ট করতে পারি যারা পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে পথ অতিক্রম করে।’
‘আমার কখনও এমন একটাও আগে ছিল না,’ বনিক প্রত্যুত্তর করল। ‘লোকজন পথ দিয়ে যাবে আর এটার মধ্যে আচমকা বাড়ি খাবে, আর ক্রিস্টালগুলো ভেঙে যাবে।’
‘ঠিক আছে, যখন আমি আমার ভেড়াগুলো মাঠের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতাম, আমরা যদি সাপের কবলে পড়তাম ওগুলোর কোন কোনটা মারা যেত।কিন্তু সেটাই মেষ আর মেষপালকের জীবন।’
বনিক একজন ক্রেতার দিকে ফিরল যে তিনটা ক্রিস্টাল গ্লাস কিনতে চেয়েছিলেন।সে যত ভাল ভাবে বিক্রি করছে, তেমন করে কখনও বিক্রি হয়নি… যেন সময় পুরোনো দিনের মত ঘুরে দাঁড়িয়েছে যখন তানজিয়ার রাস্তা ছিল অন্যতম আকর্ষন।
‘ব্যবসা সত্যিকারভাবে উন্নত হয়ে উঠছিল,’ সে বালকটিকে বলল, ক্রেতা চলে যাওয়ার পর।আমি অনেক ভাল করছি, আর তুমি শীঘ্রই তোমার ভেড়া ফেরত পাওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করবে। কেন জীবন থেকে আরও বেশি কিছু চাইবো?’
পৃষ্ঠা ৬৯
‘কারন আমাদেরকে ইশারায় সাড়া দিতে হবে,’ বালকটি বলল, একেবারেই অর্থহীনভাবে; তখন সে যা বলে ফেলেছে তার জন্য অনুশোচনা করল, কারন বনিকের কখনও রাজার সাথে দেখা হয়নি।
‘একে বলা হয় অনুকূলতার নীতি, আরম্ভকারীর ভাগ্য।কারন জীবন চায় তুমি যেন তোমার গন্তব্যে পৌঁছাতে পার,’ বৃদ্ধ রাজা বলেছিল।
কিন্তু বনিক বালকটি কি বলেছিল তা বুঝে ফেলে। বালকটির দোকানে উপস্থিতি সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ, আর, সময়ের সাথে সাথে যত টাকা তার টাকার দেরাজে পরছিল, বালকটিকে মজুরি দিয়ে কাজে লাগানোর জন্য তার কোন অনুশোচনা হচ্ছিল না। বালকটি যত টাকা পাওয়ার যোগ্য তাকে তার চেয়ে বেশি টাকা দেয়া হয়েছিল, কারন বনিক ভাবছিল যে বিক্রির পরিমান খুব বেশি হবে না, সে তাই বালককে উচ্চ হারে বিক্রির একটা অংশ প্রস্তাব করেছিল।বালকটি ধরে নিয়েছিল যে সে শীঘ্রই তার মেষের কাছে ফেরত যাবে।
‘তুমি কেন পিরামিডের ওখানে যেতে চাও?’ সে জানতে চাইল, ‘এই প্রদর্শনীর ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে।’
‘কারন আমি সব সময় এগুলো সম্পর্কে শুনেছি,’ বালকটি প্রত্যুত্তরে বলল, তার স্বপ্ন সম্পর্কে কিছুই বলল না।গুপ্তধন এখন একটা বিষাদময় স্মৃতি ছাড়া কিছুই না, আর সে এই সম্পর্কে ভাবনাগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
পৃষ্ঠা ৭০
‘এখানে চারপাশে এমন একজন নেই যে মরুভূমি পার হয় শুধুমাত্র পিরামিড দেখার জন্য,’ বনিক বলল। ‘ওগুলো শুধু স্তূপাকারে রাখা পাথর।তুমি তোমার বাড়ির উঠানে একটা তৈরি করে নিতে পার।’
বালকটি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কখনও ভ্রমণ করার স্বপ্ন দেখনি,’ একজন ক্রেতা যে দোকানে প্রবেশ করেছিল তার জন্য অপেক্ষায় বাঁক ঘুরিয়ে।
দুই দিন পরে, বনিক বালকটির সাথে প্রদর্শক তাকের বিষয়ে কথা বলছিল।
‘আমি খুব একটা পরিবর্তন পছন্দ করি না,’ সে বলল। তুমি আর আমি হাসানের মত নই, ওই যে ধনী বনিকটি।সে যদি কিছু কিনতে গিয়ে ভুল করে, এটা তাকে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ করবে না।কিন্তু আমাদের দুজনকে সেই ভুলের সাথে জীবন ধারণ করতে হবে।’
সেটা একদমই ঠিক, বালকটি ভাবল, দুঃখের সাথে।
‘তুমি কেন ভাবছ যে আমাদের একটি প্রদর্শক তাক থাকা উচিত?’
‘আমি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমার মেষগুলোকে ফেরত চাই।আমাদের ভাগ্য যখন আমাদের পক্ষে আছে, আমাদের সেই সুযোগটা নেয়া উচিত, আর একে ততো বেশি সাহায্য করা উচিত যত এটা আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য করছে।একে অনুকুলতার নীতি বলা হয়।আমাদের প্রারম্ভিক ভাগ্য।’
বনিক কিছুক্ষনের জন্য চুপ করে ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘নবী সাঃ আমাদের কুরআন দিয়েছেন, আর পাঁচটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য রেখে গেছেন যা আমাদের জীবদ্দশায় পালনীয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল একমাত্র সত্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করা।অন্যান্যদেরকে দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করতে হয়, রমজান মানে উপোস থাকতে হয়, দরিদ্রদের প্রতি দানশীল থাকতে হয়।’

তিনি ইংরেজি সাহিত্যের নিয়ে পড়াশুনা করে এখন এম ফিল করছেন টি.এস. এলিয়েটের কবিতা নিয়ে।বর্তমানে শিক্ষকতার সাথে জড়িত আছেন।