লেখক পরিচিতি: নিকোলাই গোগোল(১৮০৯-১৮৫২):
রুশ জাতীয় সাহিত্যে, বিশেষত রুশীয় সাহিত্যের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে লেখক-নাট্যকার গোগোলের নাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয়। জন্মের পর আয়ানোভস্কি( Ianovskii) নামকরণ করা হলেও তাঁর দাদাজান নিজের বংশগৌরবের অংশ হিসেবে পৌত্রের নামকরণ করেন গোগোল। এবং কালক্রমে এ নামেই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে অধিকমাত্রায় পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পুরো নাম নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগোল। জন্মসূত্রে ইউক্রেনীয় হলেও তিনি মূলত রুশ ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন, যেখানে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গোগোলের বয়স যখন দশ, তখন তাঁর ছোটো ভাই আইভানের আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় গোগোল শুধুমাত্র তার ভাইটিকেই হারাননি, একই সাথে সবচে প্রিয় বন্ধু হারানোর যন্ত্রণাও দিয়েছিল, আজীবন সে শূন্যতা যেন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি স্কুল-কলেজের ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু করেন। লেখালেখির শুরুটা তিনি সম্ভবত কবিতা দিয়ে শুরু করতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে নিজ খরচে তিনি তাঁর প্রথম মহাকাব্যিক কাব্যগ্রন্থ “হান্স ক্যুকলগার্টেন (Hanz Kuechelgarten)” প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যা তাঁর জার্মান রোমান্স পড়ার ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে তাঁর কবিতাগ্রন্থটি পাঠকের সমাদর পেতে ব্যর্থ হয়। যে কারণে গোগোল অতিমাত্রায় হতাশ হয়ে কাব্যগ্রন্থটি নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে আর কোনোদিন কবিতা লিখবেন না। কবি হিসেবে সমাদৃত না হবার দুঃখটা হয়ত তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারলে ভুলে যেতেন। বিশ্বসাহিত্যের কপাল ভালো সেটাতেও তিনি সফলতা পাননি। যে কারণে লেখালেখিকেই গোগোল একমাত্র ধ্যানজ্ঞান এবং জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। যার ফলাফল আজও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ উপভোগ করছেন।
মাত্র তেতাল্লিশ বছরের জীবনে নিকোলাই গোগোল বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারকে যে লেখনী উপহার দিয়ে গেছেন তার বুঝি তুলনা চলে না। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “ডেড সোলস” কে আধুনিক রুশ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া তাঁর আরেক বিখ্যাত সৃষ্টি ‘দ্য ওভারকোট’ নিয়ে ফিওদর দস্তোয়ভস্কি ভূয়সী প্রশংসা করেন।
স্বল্পায়ুর জীবনে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনেক বিশ্বমানের সাহিত্যকর্ম। তাঁর রচিত নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাসগুলোতে সে স্বাক্ষর পাওয়া যায় । তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে : ইভেনিংস অন এ ফার্ম নিয়ার ডিকাঙ্কা (১৮৩১-১৮৩২), মিরগোরোদ (১৮৩৫), দ্য ওভারকোট (১৮৪২), দ্য ইন্সপেক্টর জেনারেল (১৮৩৬), ডেড সোলস (১৮৪২)। দ্য নোজ(১৮৩৫) যা অপেরা হিসেবেও বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মার্চের ২৫ তারিখে সেন্ট পিটার্সবার্গে ইয়াকভলেভিচের বাড়িতে অদ্ভূতুড়ে একটা কাণ্ড ঘটলো। নাপিত আইভান ইয়াকভলেভিচ অ্যাসেনশন অ্যাভিনিউয়ের বহুদিনের পুরোনো বাসিন্দা। (ইয়াকভলেভিচের পিতৃপ্রদত্ত নামটি হারিয়ে গেছে, এমনকি তার দোকানের সাইনবোর্ডেও তার নামগন্ধ নেই- সেখানে গালে সাবানের ফেনা মাখা এক লোকের ছবির সাথে লেখা আছে: এখানে শিরা কেটে রক্ত বের করার চিকিৎসাও দেয়া হয়)। ওই বিশেষ সকালটিতে আইভান ইয়াকভলেভিচের ঘুম অন্য দিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই বাতাসে ভেসে বেড়ানো রুটি সেঁকার টাটকা গন্ধটা তার নাকে ঝাপটা দিলো। শোয়া অবস্হা থেকে বিছানায় উঠে বসতেই দেখতে পেলো তার কফি অন্তপ্রাণ স্ত্রী চুলা থেকে তৈরি হওয়া গরম রুটি তুলতে ব্যস্ত।
“ও সোনা বউ, আজ আর সকালে কফি চাই না, তার চেয়ে খানিক পেঁয়াজ দিও রুটির সাথে জমিয়ে খাওয়া যাবে।” স্ত্রীর উদ্দেশ্যে গলায় যতটা সম্ভব আহ্লাদ ঢেলে কথাগুলো বলে আইভান ইয়াকভলেভিচ। আসল কথা হচ্ছে রুটি কফি দুটোই খাওয়ার ষোল আনা ইচ্ছে তার, কিন্তু বউয়ের ঝামার ভয়ে কোনো ঝুঁকি নিলো না।
“মাথামোটাটা কফি খাবে না বলছে, ভালোই হলো, বাড়তি আরেক কাপ কফি জমিয়ে খাওয়া যাবে” ভাবতে ভাবতে আইভানের স্ত্রী এক টুকরো রুটি স্বামীর উদ্দেশ্যে টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিলো।
আইভান ইয়াকভলেভিচ জামার উপর একটি কোট চাপিয়ে ভদ্রস্থ হয়ে টেবিলে এসে বসে, তারপর দুটো পেঁয়াজ কেটে, তাতে লবন ছড়িয়ে, বেশ একটু গম্ভীর মুখে, ছুরি হাতে রুটি কাটায় মন দিলো। রুটিটা দুভাগ করার পর সেটার মাঝখানের অংশে সাদাটে মতো কিছু একটা লেগে থাকতে দেখে সে বেশ অবাক হলো। বউ তার শুধু পাকা রাঁধুনিই নয়, কিলিয়ে কাঁচা কাঁঠাল পর্যন্ত পাকাতে ওস্তাদ। সেই মানুষের সেকা রুটির ভেতরটা কাঁচা থাকার প্রশ্নই আসে না। খুব সর্তকতার সাথে ছুরি দিয়ে জিনিসটাকে সামান্য খোঁচা দিলো সে, নিজের আঙুল ছুঁয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো ওটা কী হতে পারে। “বেশ শক্তভাবে গেঁথে আছে দেখছি।” মনে মনে বললো আইভান, “কী হতে পারে এটা?”
কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে নিজের আঙুল ভরে জিনিসটা টেনে বের করে দেখলো সেটা একটা- নাক! বিস্ময়ে হতবাক আইভান ইয়াকভলেভিচের হাত দুটো শিথিল হয়ে পড়লো, বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে সে তার দুচোখ আচ্ছা মতো রগড়ে নিয়ে জিনিসটাকে আবারও ভালো করে দেখলো। হ্যাঁ তো, এটা একটা সত্যিকারের নাকই বটে! শুধু তাই না নাকটা তার পরিচিত কারো বলেই মনে হলো। ইয়াকভলেভিচের চোখে মুখে আতঙ্কিত ভাব ফুটে উঠলো। নিজের শরীরে রীতিমত থরহরি কম্প অনুভব করলো সে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে স্ত্রী প্রাসকোভিয়া যে নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখালো তার কাছে আইভানের আতঙ্ক নস্যিতুল্য।
“ওরে জানোয়ার কার নাক কাটলি আবার?” রাগে লাল হয়ে চেঁচালো আইভানের স্ত্রী। নেশাখোর খচ্চর! মাতাল কোথাকার! দেখাচ্ছি মজা। এক্ষুনি গিয়ে পুলিশে খবর না দেই তো তোর একদিন, কি আমারই একদিন। মিচকে শয়তান! বহুদিন থেকে কিছু খদ্দেরের অভিযোগ কানে আসছে, চুল দাঁড়ি কামাতে গিয়ে তুই লোকজনের নাক ধরে এমন টানাটানি করিস যে তাদের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকাই মুশকিল।”
এদিকে আইভান ইয়াকভলেভিচের অবস্হা শোচনীয়, সে যেন তখন জীবন্মৃত। কারণ নাকটা যে মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য জনাব কোভালিয়েভের, তা বুঝতে বাকী নেই আর। প্রতি রবিবার ও বুধবার নিয়ম করে লোকটা তার কাছে দাড়ি কামায়। অগ্নিশর্মা স্ত্রীকে সামাল দিতে আইভান ইয়াকভলেভিচ বলে ওঠে, “দাঁড়াও, ময়না! একটা ন্যাকড়াতে মুড়িয়ে ওটাকে বরং কিছু সময়ের জন্য ওই কোণটাতে রাখি, পরে বাইরে কোথাও ফেলে আসবো।”
“ওসব চলবে না। কী ভেবেছিস, এই ঘরে দিব্যি একটা নাক পড়ে থাকবে আর আমি সেটা মেনে নেবো? কোনো ধানাই পানাইয়ের চেষ্টা করবি না বলে দিচ্ছি। জানিস তো শুধু চামড়ায় ক্ষুর ঘষাঘষি করতে। সে কাজটাও যদি ঠিকঠাক মতো করতে পারিস! তোর জন্য এখন একজন সম্মানী মানুষের ভোগান্তি। ছন্নছাড়া, আমড়াকাঠের ঢেকি একটা! কী ভেবেছিস, তোর এসব সৃষ্টিছাড়া কাজের সাফাই গাইবো আমি পুলিশের কাছে? ওহ্ শখ কত হতভাগা মেনিমুখোর! এটাকে নিয়ে জাহান্নামে যাবি না কোথায় যাবি আমি জানিনা, কিন্তু এখনই সরিয়ে নিবি, আমার চৌহদ্দির মধ্যে যেন আর এটাকে দেখা না যায়।”
আইভান ইয়াকভলেভিচ পাথরের মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ পাতাল ভেবেও সে কোনো কূল কিনারা পেলো না। “এমন অদ্ভূতুড়ে একটা কাণ্ড কীভাবে ঘটলো কে জানে!” ডান হাতটা তুলে কানের পেছনটা চুলকে শেষমেশ কথা বলে উঠলো সে। “গতকাল রাতে মাতাল অবস্হায় ঘরে ফিরেছি কিনা সেটাও তো ছাতার ঠিক মনে নেই। আগুপিছু সবদিক খতিয়ে পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব, আষাঢ়ে মনে হচ্ছে। রুটি গরম চুলায় সেকা একটা তৈরী জিনিস, আর নাকটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। ঘটনার আগা মাথা কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না বাপ।”
আইভান ইয়াকভলেভিচ চিন্তা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে একদম চুপ মেরে গেলো। আইন বিরুদ্ধভাবে তার জিম্মায় একটা আস্ত নাক আছে, সে খোঁজটা পেলে পুলিশ নিশ্চয়ই জামাই আদর করবে না, বরং তাকেই অপরাধী ভেবে গ্রেফতার করা হবে। এমন ভাবনায় ইয়াকভলেভিচের মনের শান্তি উবে গেলো। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো, ‘রূপালি জরির কারুকাজ করা গাঢ় লাল কলারের তলোয়ার….’ উরি বাবা! পুলিশি উপস্হিতির ভাবনা তার শরীরে তীব্র কাঁপন ধরালো। কালবিলম্ব না করে সে কাপড়-চোপড় পরে তৈরি হয়ে নিলো, তারপর স্ত্রীর কঠোর নির্দেশ মানার উদ্দেশ্যে নাকটা একটা ন্যাকড়ায় মুড়িয়ে পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়লো।
যেকোনো এক জায়গায়, হতে পারে সেটা কারো বাড়ির দরজা, পাবলিক স্কয়ার কিংবা চিপা কোনো গলিতে জিনিসটা ফেলে কোনরকমে সটকে পড়তে চেয়েছিল সে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হওয়ার মতো আইভান পরিচিত কারো না কারো মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছিলো। স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে তারা তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, ” কী হে আইভান সক্কাল সক্কাল চললে কোথায়? কিংবা এই সাত সকালেই বুঝি কারো ক্ষৌরকর্ম করতে চললে আইভান? ইত্যাদি প্রশ্নে অতিষ্ঠ আইভান কিছুতেই জিনিসটা ফেলার সুযোগ পাচ্ছিলো না। একবার তো কাজটা সে প্রায় করেই ফেলেছিল, কিন্তু পাহারায় থাকা কনস্টেবলটি তার হাতের লাঠি উঁচিয়ে তাকে ডেকে জানায়, “ও মশাই, বেখেয়ালে আপনার হাত থেকে কিছু একটা পড়ে গেছে।” অগত্যা আইভান ইয়াকভলেভিচ বাধ্য হয়ে জিনিসটা আবার পকেটে পুরে নেয়।
গভীর এক হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। ইতিমধ্যে দোকানপাটের ঝাঁপ খুলে যাওয়ার সাথে সাথে রাস্তায় লোক চলাচল বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত আইভান ইয়াকভলেভিচ আইজাক ব্রিজের ওদিকটা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো, সেখান থেকে নেভা নদীর জলে জিনিসটা ছুঁড়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবার ব্যাপক সম্ভাবনা।
কিন্তু এটুকু লিখে পাঠকের কাছে একটা ত্রুটি স্বীকার করতে হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত স্বনামখ্যাত আইভান ইয়াকভলেভিচের বিস্তারিত পরিচয়টা দেয়া হয়নি।
অধিকাংশ রুশ কারবারীর মতো আইভান ইয়াকভলেভিচও ছিলো একজন পাঁড় মাতাল। যদিও সে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের গালে নিষ্ঠার সাথে ক্ষৌরকর্ম করতো, কিন্তু তার নিজের গাল ছিলো ক্ষুর বিবর্জিত। আইভান ইয়াকভলেভিচ কখনো লম্বা ঝুলের কোট গায়ে দিতো না। সে সচরাচর যে কোটটা গায়ে দিতো এক সময় সেটার রঙ কালো হলোও অতি ব্যবহারে সেটায় রঙের বেশ বৈচিত্র চলে এসেছে। কালো রঙটা ক্ষয়ে গিয়ে কেমন বাদামি হলদেটে ভাব ধরছে, তবে কলারটা বেশ চকমকে, আর কোটের বোতাম তিনটে হারিয়ে যাওয়ায় শুধু সুতোগুলো প্যাকাটে মুখে ঝুলে আছে।
আইভান ইয়াকভলেভিচ ছিলো ভয়ানক বাতিকগ্রস্হ মানুষ। মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়েভ তার রুটিন মাফিক দাড়িকাটার সময় প্রায় বলতেন, “তোর হাতে সব সময় এ কিসের দুর্গন্ধ পাই রে ইয়াকভলেভিচ?”
প্রশ্নের জবাবে আইভান উল্টো জানতে চাইতো, ” দুর্গন্ধ আসবে কোত্থেকে মশাই?”
“তা জানিনা বাপু, তবে গন্ধটা বেশ জোরালো, নিয়মিতই নাকে লাগে” উত্তরে বলতেন কোভালিয়েভ। পরের কথাটুকু চুপচাপ শুনে তারপর এক চিমটি নস্যি টেনে নিয়ে কোভালিয়েভের গালে, নাকে, ঠোঁটের উপর, কানের পেছনে, যত্রতত্র ইচ্ছামাফিক বেশ খর হাতে সাবান ঘষে দিতো।
জিনিসটা পকেটে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুশ সন্তান ইয়াকভলেভিচ একসময় আইজাক ব্রিজের কাছে পৌঁছে গেলো। সেখানে পৌঁছে প্রথমে সে আশপাশে তাকিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলো। তারপর ব্রিজের রেলিংটায় ঝুঁকে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়ালো যেন নদীতে মাছ কেমন সেটা দেখে নেয়াই তার উদ্দেশ্য। এরপর চট করে খুব সাবধানে পকেট থেকে ন্যাকড়ায় জড়ানো নাকটা বের করে ছুঁড়ে দিলো জলে। নাকটা ফেলে দেবার পর তার খুব হালকা বোধ হলো, যেন বুকে চেপে বসা কয়েক মণের বোঝাটা সরে গেলো। এবার তার ঠোঁটে স্বস্তির হাসি ফুটলো।
যদিও এ সময়ে তার সরকারি কর্মচারীদের দাড়ি কামানোর কথা, কিন্তু তার পরিবর্তে সে এককাপ চায়ে গলাটা ভিজিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে, ‘চায়ের দোকান’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলানো দালানটার দিকে হাঁটা দিলো। এমন সময় ব্রিজের শেষ প্রান্তে গালজোড়া জুলফিওয়ালা, তিনকোণা টুপি মাথায়, কোমরে তালোয়ার ঝোলানো জবরদস্ত এক পুলিশ ইন্সেপেক্টরের দিকে তার চোখ পড়লো। আতঙ্কে হৃদপিণ্ডটা বুঝি টপাং করে আইভান ইয়াকভলেভিচের পাঁজর খুলে পালিয়ে বাঁচতে চাইলো। ভয়ে তার জ্ঞান হারাবার অবস্হা হলো যখন দেখতে পেলো পুলিশটি তার দিকেই আঙুল ইশারায় ডেকে বলছে,
“এদিকে আয় দেখি।”
ভয়ে কাঁটা হলেও বুকটান করে, কায়দা মাফিক আইভান ইয়াকভলেভিচ পুরোদস্তুর ভদ্রলোকের মতোই ইন্সপেক্টরের উদ্দেশ্যে টুপি খুলে চটপট তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“হুজুরের শরীর মন ভালো তো!”
“আমার মনের আলাপ পরে হবে, এখন বল দেখি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কী করা হচ্ছিলো?”
“কিরে কেটে বলছি হুজুর, খদ্দেরের দাড়ি কামাতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়লো নদীটা কেমন কুলকুল করে বয়ে চলেছে, একটু থেমে সেটাই দেখছিলাম।”
” এমন ডাহা মিথ্যা বলে পার পাবি না রে ব্যাটা, বরং সত্যিটা ভালোয় ভালোয় বলে ফেল দেখি।”
“দয়া করেন হজুর, ভাতে মারবেন না। টু শব্দটি না করে সপ্তাহে দু’দিন এমন কি যদি বলেন তিন দিন আমি বিনে পয়সায় আপনার দাড়ি কামাতে রাজি আছি।” মিনতি ঝরে পড়লো ইয়াকভলেভিচের গলা থেকে।
“ওটি তো হবার নয় বাপ! তিনজন নাপিত আমার ক্ষৌরকর্মে নিযুক্ত, আর তারা কাজটাকে তাদের জন্য দারুণ সম্মানের বলে মানে, আমিও তাদের কাজটা উপভোগের সুযোগ দেই। এখন ভালোয় ভালোয় বলে ফেল দেখি কী করছিলি ব্রীজের উপর?”
আইভান ইয়াকভলেভিচের চেহারা বির্বণ হয়ে গেলো। কিন্তু এই সম্পূর্ণ ঘটনাটি যেন হুট করে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়, যে কারণে তারপর কি ঘটেছিল আমাদের পক্ষে আর জানা সম্ভব হয়নি।
চলবে…
নাহার তৃণা। জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে ইলিনয়ে বসবাস। মূলত গল্প লেখায় ঝোঁক। পাশাপাশি অনুবাদ, প্রবন্ধ, সিনেমা, সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একই বছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশি গপ্পো’। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘গল্পের পুষ্পিত কুঞ্জ’(২০২১, বইয়ের হাট প্রকাশনী), ‘গল্পপাঠ নির্বাচিত জাপানি গল্প সংকলন’(যৌথ সম্পাদনা, ২০২২, কবি প্রকাশনী)। প্রকাশিতব্য অনুবাদ গল্প সংকলন, ‘দূরদেশের গল্প(২০২২, চৈতন্য প্রকাশনী)’।