| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: তুমি খুশি থাকো । অদিতি ঘোষ দস্তিদার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“If you cannot transform and take care of the suffering in you and in the other person, that is not true love!”- Thich Nhat Han

“প্রকৃত ভালোবাসতে গেলে আমিটাকে একেবারে ধরে বাদ দিতে হবে বুঝলি!” ভুরু নাচিয়ে কথাটা বলে ঠোঙা থেকে একটা বাদাম নিয়ে মুখে ছুঁড়ল তিতির!

ঋজুর ভুরুদুটো কুঁচকে গেল নিমেষে, “মানে? আমি তোমাকে ভালবাসি থেকে আমি বাদ? তাহলে রইলটা কী শুনি?”

“দেখ! তোর কী আমিত্ব! আমি বাদ দিয়ে আর কিচ্ছু নেই! তোর দ্বারা ভালোবাসা হবে না!” দুষ্টুমির হাসি তিতিরের মুখে।

“হবে না মানে? আলবাত হবে! স্বয়ং কবিগুরু ঈশ্বরকে পর্যন্ত স্পষ্টাস্পষ্টি জানাতে দ্বিধা করেননি, “আমায় নইলে ত্রিভুবেনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে!” আর তুই কিনা বলছিস সেই আমিকেই বাদ দিতে হবে?”

দক্ষিণ কলকাতার লেক রোডের বুদ্ধ মন্দিরের বাইরের বেঞ্চে বসে আছে দুজনে। বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে! নাম না জানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে মন্দিরের ভেতরের ফুলের কেয়ারি থেকে। সামনেই আসছে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রেমদিবস- ভ্যালেন্টাইন্স ডে! তাই আজ কথা বলার বিষয় বলা বাহুল্য ভালোবাসাই! তাতেই ‘আমি’কে  নিয়ে চাপান উতোর চলছে দুজনের!

ঋজু বলেই চলে, “এই যে বাজারে দোকানে, শপিং মলে সর্বত্র যা জিনিসই দেখবি তাতে লেখা ‘আই লাভ ইউ!’ তো সেই ‘আই’ টির চোখই উপড়ে নিতে চাস তুই! এ আবার কী নতুন লীলা দেবি!”

“একদম ঠিক বলেছিস! আরে ওই ‘আই লাভ ইউ’ এর ‘আই’টিকেই বাদ দিয়ে ভাবতে হবে, এ কথা আমার নয়! শান্তির দূত ভিয়েতনামি জেন বুদ্ধিস্ট মঙ্ক থিচনিয়াট হান তাঁর True Love: A Practice for Awakening the Heart বইতে সাধারণ ভাষায় ভালোবাসাকে এত সুন্দর করে বুঝিয়ে গেছেন যে বলার নয়!”

“দাঁড়া দাঁড়া! সদ্য কদিন আগে চলে গেলেন না উনি!”

“হ্যাঁ রে, এই ২০২২ এরই জানুয়ারির ২২ তারিখে। আজকের এই স্বার্থপর আমিসর্বস্ব মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া দুনিয়ায় আসল জিনিস ভালোবাসাই গৌণ! অথচ হান গৌতম বুদ্ধের প্রেমের তত্ত্বকে সহজ সরলভাবে বুঝিয়ে শান্তি আর ভালোবাসার বাণী ছড়িয়ে ছিলেন সারা পৃথিবীতে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার শান্তির নোবেল পুরস্কারের জন্যে ওনার নাম মনোনয়ন করেছিলেন!”

“বুদ্ধের বাণীর সরলীকরণ? ইন্টারেস্টিং তো!”

“আসলে হান সহজ উদাহরণের মধ্যে দিয়ে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। তাঁর মূল শিক্ষা ছিলওই, যা বলছিলাম , আমি আমি বলা যাবে না ভালোবাসার সম্পর্কে! বলতে হবে আমরা! পারস্পরিক বোঝাপড়া! সে যে ধরণের ভালোবাসার ক্ষেত্রেই হোক না কেন! শুধু যে নারী পুরুষের সম্পর্ক তা নয়, যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই যদি একে অপরকে চিনতে, জানতে, বুঝতে না পারা যায়–তাহলে সেই সম্পর্কের, সেই ভালোবাসার কোন অস্তিত্ব নেই!”

“সে তো অবশ্যই! শোন তাহলে,” বলেই ঋজু উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, “দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে–মরু পথ তাপ দুজনে নিয়েছি সহে…পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,

“মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি!”

“আরে! ঠিক এমনটাই তো বলতে চেয়েছেন হান!কী অদ্ভুত মিল তাই না!

“হ্যাঁ রে, আসলে কথায় বলে না, ‘গ্রেট মেন্ থিঙ্ক অ্যালাইক!’ যাক আমি বোধহয় তোর কথার গতিকে একটু আটকে দিলাম,কী সহজ উদাহরণের কথা বলছিলি?”

“হানের বক্তব্য হল, ধর যদি একমুঠো নুন এক কাপ জলে গুলে তোকে দেওয়া হয় খেতে, তুই তো থু থু করে ফেলে দিবি। কিন্তু ধর, সেই এক মুঠো নুন যদি একটা বড় চৌবাচ্চায় ঢালিস তাহলে সেখান থেকে জল নিয়ে অনেকে রান্না করতে পারে। সে রকমই একজনের হৃদয়ের আধার ছোট, সে যদি শুধু নিজেকেই ভালোবাসে, নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়েই অস্থির হয়, তার মনের অবস্থা ওই এককাপ জলে একমুঠো নুনের স্বাদের মতই হবে। কিন্তু সে যদি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারে,অন্যের দুঃখ যন্ত্রণার ভাগ নিতে পারে, তাহলে তার নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসবে। নিজের শূন্যতা, একাকিত্ব তখন কমে যাবেএই অপার ভালোবাসার আস্বাদ পেয়ে। সেই ভালোবাসা প্রকৃতির জন্যে হতে পারে, পশু পাখির জন্যে হতে পারে আবার মানুষে মানুষে রোমান্টিক ভালোবাসাও হতে পারে!”


আরো পড়ুন: প্রেমের কবিতা । চৈতালী চট্টোপাধ্যায়


“গুরুদেবের গানের কথাই আবার মনে হল রে,“অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।

কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে “হায় হায়!”

এবার গলা মেলায় তিতিরও, “যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে, তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহা মহিমায়।” কবি এখানে তুমি বলতে ঈশ্বরকে বুঝিয়েছেন, পূজা পর্যায়ের গান এটা! কিন্তু হানের সংজ্ঞায় এই তুমি হচ্ছে বিশ্বমানব হৃদয় বা বলতে গেলে সব কিছু যা তুমি ভালোবাসো!”

“সত্যিই ভাববার মত!”

“হ্যাঁ রে। জানিস তো বুদ্ধ ভালোবাসাকে ভাগ করেছেন চারটি বিভাগে। হানও সে ভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু অনেক সহজ সরল ভাবে। এই যে ওপরের উদাহরণটায়যে আমি বাদ দিয়ে স্বার্থশূন্য ভালবাসার কথা বললাম, তার নাম বুদ্ধের ভাষায় উপেক্ষা…উপেক্ষা করতে হবে নিজেকে -নিজের স্বার্থের গন্ডি ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে, তবেই মিলবে অনন্ত ভালোবাসার সন্ধান।”

“সদা থাকো আনন্দে সংসারে নির্ভয়ে নির্মল প্রাণে!” তাই না? আচ্ছা একখানা বিভাগ তো মোটে শুনলাম— এবার বাকিগুলো বল ভালোবাসা নিয়ে যা বুদ্ধ বলেছেন।”

“দ্বিতীয় হল করুণা – ঠিকঠাক ইংরিজি করলে দাঁড়াবে কম্প্যাশন –“দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী।..হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব” দুজনের দুঃখই দুজনকে বুঝতে হবে। প্রকৃত ভালোবাসার সৌরভ তখন অনুভব করবে দুজনেই!”

“এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে;

আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি—লহো লহো করুণ করে!”

ঋজুর গানে তিতির মিষ্টি করে হাসল। সামনের বড় রাধাচূড়া গাছটা থেকে ঘুরে ঘুরে নামছে ফুলের পাপড়ি। মাটি থেকে তুলে রাখল ঋজুর পাঞ্জাবির ওপর।

“তিন নম্বরেরটা কী বলতো? আনন্দ। মুদিতা! অন্যকে কাঁদিয়ে নিজে শান্তি পাবে না, কিন্তু অন্যকে খুশি করে মিলবে অনন্ত আনন্দ!”

ঋজু গেয়ে উঠল, “তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে

তোমারআঙিনাতে বেড়াই যখন গেয়ে গেয়ে!”

“আর শেষটা হল মৈত্রী,মানে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান- সুখী করার অঙ্গীকার!নিজে সুখী হওয়াটাই শেষ কথা নয়, তোমার প্রিয়জনকে সুখী করাই হবে তোমার একমাত্র কাজ।, এই হল বুদ্ধের মতধারা। হান আবার আধুনিককালের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এটাকে আরো সহজভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তাহলে তোমার বিশ্বাস আর ধৈর্য রেখে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে ঠিকঠাক ভাবে বোঝো… যত দুজনে দুজনকে  বুঝবে তত ভালোবাসাও বাড়বে!”

“আচ্ছা এত কিছু মানেই কি আমিকে বাদ দেওয়া?”

তিতির হাসল ,”নয়ত কী?” আমি  মানে হচ্ছে মোহ আবরণ। হান সেটাকেই বলেছেন, ‘ego-shell!’…এই দ্যাখ এটা কী আমার হাতে?”

“ফুল!”

“কিন্তু তুই যদি ভালো করে ভেবে দেখিস ফুল তৈরিঅনেকগুলো আলাদা আলাদা জিনিস দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে ক্রোমোফিল, সূর্যের আলো, জল, আরো নানা রকমের রাসায়নিক উপাদান মিলেমিশে হচ্ছে এই সুন্দর ফুল-যা আমাদের আনন্দ দিচ্ছে। মানুষও তাই- আমাদের শরীর তো কতকগুলো রাসায়নিক উপাদানের যোগফল-তাই না? কিন্তু সব মিলেমিশে মানুষ হয়েছে! তাই আমি শুধু তো একা আমি নই…পঞ্চভূত, আমার বাবা মা, পুর্বপুরুষ সব নিয়েই আমি-একক আমির অস্তিত্ব কোথায়? তাই আমি যদি আমির খোলস থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াই…”

“মানে মোহ মেঘে অন্ধ না হয়ে?”

“একদম! মোহ মেঘই তো “তোমারে দেখিতে দেয়না!”

“তাহলে গুরুদেবের ভাষায় বলা যায়,

“তোমার আঁধার তোমার আলো দুই আমারে লাগল ভালো–

          আমার হাসি বেড়ায় ভাসি  তোমার হাসি বেয়ে বেয়ে।।”

ঋজুর উদাত্ত গলার গানের সুর মলয় বাতাসের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিকে। আশেপাশের পথচলতি লোক শুনে হাসি মুখে তাকাচ্ছে!

তিতির উঠে এসে ওর হাতটা ধরল!

“এটা যদিও পূজা পর্যায়ের গান, রবীন্দ্রনাথের গানে তো প্রেম পূজা একাকার! তেমনি বুদ্ধের বাণীতে রয়েছে যখন তুমি এই ভালবাসার এই চার অধ্যায় পার করতে পারবে- তখন তুমি যে আনন্দের যে ভালোবাসার স্বাদ পাবে- তার নাম মহাকরুণা, সেই প্রেমের সুর বাজবে বিশ্বজন মাঝে বিশ্ববীণা রবে!”

ঋজু দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “ওরে ঋজু রে! ‘আমি’ছাড়তে হবে বুঝলি!”

তিতির খিলখিল করে হেসে বলল, “ঢের ভালোবাসার তত্ত্ব হল, বুদ্ধ, হান, গুরুদেব সবার বাণী আলোচনা হল, এখন দেখি তুই কেমন ট্রেনিং পেলি! আমাকে ফুচকা খাওয়া এখন, তোর আমির খোলস থেকে বেরিয়ে!”

ঋজু হাহা করে হেসে উঠল! “তাহলে কালকে তুই চাইনিজ খাওয়াবি! মোহ মুক্ত হওয়া তোরও তো দরকার!”

ওরা দুজনে হাত ধরাধরি করে ফিরে চলল! বাতাসে ভালোবাসার মদির সুবাস!

 

 

 

তথ্যসূত্রঃ

Hanh NhatThich, Translated by SherabChodzinKohn:True Love: A Practice for Awakening theHeart: Boston and London: Sambala, 2011

Tagore Web

https://exploringyourmind.com/the-four-aspects-of-love-in-buddhism

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত