ছবিঘর
শোবার ঘরে দক্ষিনদিকের দেয়ালে মামড়ি উঠে গেছে। বর্ষার জল খেয়ে খেয়ে নোনা ধরেছে দেয়ালে। অনেকটা ছুলি ওঠা গালের মতো দেখতে লাগছে। পেস্তা রঙের ওপর এক টুকরো সাদা মেঘ। না মেঘ না।বসন্ত দেখল, একটা ছবি।
বসন্ত ওই দিকে পা করে শুয়েছিল। পিঠের নিচে বালিশ। হাতে সকালের খবরের কাগজ। সকালে পড়ার সময় পায় না। পাশে শিখা। শিখার পুরো নাম দীপশিখা। শুয়ে। শিখার মুখের সামনে ধরা রঙিন পাক্ষিক।বর্ষায় কীভাবেত্বকের যত্ন নেওয়া উচিত, সেই সব পড়ছিল।
বসন্ত দেয়ালের ছবির দিকে চোখ রেখে বিছানায় উঠে বসে। রোজ রাতে ঘুমতে যাবার আগে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে তার একটি সিগারেট খাবার বদ অভ্যাস আছে। সিগারেট ধরিয়ে বসন্ত ছোপ পড়া দেয়ালের দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের মতো দু’হাত সামনে রেখে ফ্রেম তৈরি করে। তারপর এক চোখ বুজে কিছুটা এগিয়ে কিছুটা পিছিয়ে ছবিটাকে ফ্রেমে ধরে। ছবিটা প্রথমে একটা ঘোড়ার মুখ হয়। তারপর এক পা কাছে এগিয়ে যেতেই হয়ে যায় একটা মানুষের মুখ। ফর্টি ফাইভ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘোরানো মুখের প্রোফাইল। মাথার চুল উলটে আঁচড়ানো। কিছুটা অবিন্যস্ত। লম্বা নাক। পাতলা ঠোঁট। বসন্তর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ঠোঁটে চোরা মুচকি হাসি।
শিখা বই-এর আড়াল থেকে বসন্তর ওই সব কান্ডকারখানা দেখছিল। সত্যজিৎ রায় হওয়া। মুখ থেকে বই সরিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কী হল তোমার? মাঝ রাতে এসব আবার কী পাগলামি শুরু করেছ অ্যা!”
বসন্ত হাত নামিয়ে ফ্রেম ভেঙে দেয়। ঠোঁটে সিগারেট। ধোঁয়ায় এক চোখ আধ-বোজা। ডান দিকে সরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ায়। ফের দু’পা পিছিয়ে আসে। শিখার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “বাবা।”
“বাবা? কার বাবা? এখানে বাবা কোথায় পেলে তুমি? তখন থেকে দেখছি আমি তোমার উদ্ভট কান্ডকারখানা! কী হলটা কী বলো তো? অফিসে কোনও গন্ডগোল পাকিয়ে আসোনি তো?”
বসন্ত শিখার কথায় আমল দেয় না। দেয়ালের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ফিস ফিস করে বলে, “আমার…”
বসন্তর পিতৃদেব স্বর্গীয় বনবিহারী সমাদ্দার গত হন তেত্রিশ বৎসর পূর্বে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ছাপ্পান্ন বছর। রিটায়ারমেন্টের দু’বছর বাকি। হার্ট অ্যাটাক। বসন্তর বয়স তখন ছাব্বিশ। একটা নড়বড়ে সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটছে। ভাল করে সেটেল্ড হয়নি। ডাক্তারবাবু বাবার বুকের ওপর থেকে স্টেথো উঠিয়ে নিয়ে এক পা সরে গিয়ে বসন্তকে বলেছিলেন, “দু’হাত দিয়ে চেপে চেপে বাবার বুকে পাম্প করো।” বসন্ত কোনওদিন বাবার গায়ে হাত দেয়নি। খুব সংকোচের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে সে বাবার বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বারকয়েক মৃদু চাপ দিতেই মুখটা হাঁ হয়ে গেছিল। ডাক্তারবাবু কাছে গিয়ে বাবার চোখ দুটো এক এক করে টেনে দেখে নিয়ে বলেছিলেন, “থাক, আর দরকার নেই।”
ঠিক করে সেদিন বাবার বুকে পাম্প করা হয়নি, নাকি বেশি চাপ দেওয়া হয়ে গেছিল, সেই অনুতাপ অনেকদিন পর্যন্ত দগ্ধ করেছিল বসন্তকে।
বনবিহারী সমাদ্দার রেলে কাজ করতেন। হেড ক্লার্ক। সরকারি চাকরি। কমপেনসেটারি গ্রাউন্ডে বসন্ত পেয়ে গেল। ক্লাস থ্রি। সাঁকো থেকে একলাফে ফ্লাই-ওভার। ওটাই বসন্তর জীবনে বনবিহারী সমাদ্দারেরসবচেয়ে বড়দান।… মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান!
বসন্ত ঝট করে ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে নেয়। হাত দিয়ে ধোঁয়া তাড়িয়ে, ইশারায় শিখাকে বলে, “…বাবা। বনবিহারী সমাদ্দার।”
শিখা কিছু না বুঝেই হাতের বই ফেলে বিছানায় উঠে বসে। আঁচল গুছিয়ে নেয়। বিরক্ত হয়ে বলে, “তোমায় ভূতে পেয়েছে নাকি বলো তো! কোথায় তোমার বাবা দেখছ?”
“দেয়ালে।” বসন্ত হাত তুলে মামড়ি ওঠা দেয়াল দেখায় শিখাকে। “দেখ, একদম বাবার মুখের মতো লাগছে দেখতে। ওইরকম নাক। চোখ। ঠোঁট। উলটে আঁচড়ানো চুল। একটু টেরচা হয়ে আছে মুখটা।”
শিখা মুখ তুলে দেয়ালের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, “কই, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি তো তোমার বাবাকে চাক্ষুস দেখিনি কোনওদিন, তবু ফোটোতে যা দেখেছি, মনে হচ্ছে না।”
“আহা, ভাল করে দেখ না, ঠিক বুঝতে পারবে। ওই দেখ, ওটা চোখ, ওইটা নাক। আর একটু নিচের দিকে দেখ, থুতনি। ওপরের দিকে….
“ভ্যাট। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি তো দেখছি একটা রাগি বেড়াল। সামনের পা দুটো মুড়ে তার ওপর মুখ পেতে রেখেছে। কান দুটো বুঝতে পারছ না! ছোট ছোট। খাড়া। এ মা…তুমি কী গো! এত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে…
বসন্ত দেখে বনবিহারী আর শিখা দেখে বনবিড়াল। যার যেমন চোখ।
বাবার সামনে বসন্ত সিগারেট খায় কী করে। জানলা গলিয়ে আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় শুনল, “ফেলে দিচ্ছিস? এখনও তো অদ্দেকটাও শেষ করিসনি। তোর দেখছি এখনও অপচয়ের বাতিক যায়নি। পুরোটা খেয়ে তারপর ফেলিস। কাল থেকে আর খাস না। ধোঁয়ার নেশা ভাল না।”
বাবার গলা। বসন্ত ফিস ফিস করে বলল, “আজ্ঞে। আপনি…!”
শিখা বিরক্ত হয়ে বলল, “কীসব ফালতু বকবক করছ তখন থেকে! তোমার মাথাটা গেছে দেখছি। আমি শুলাম। আমার ঘুম পেয়েছে। আলো নিভিয়ে তুমি যত খুশি আপনি আজ্ঞে করো বাবার সঙ্গে।”
সকালে ঘুম ভাঙতে আপনা-আপনি বসন্তর চোখ চলে গেল দেয়ালের দিকে। কাল রাত্রে টিউবের আলোয় দেখেছিলবাবাকে। এখন সকালে চোখ দুটো বোজা মনে হল। মুখের সেই মুচকি হাসিটাও নেই। দেয়াল শুষে নিয়েছে। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তাইতেই বোধহয় চোখ লেগে গেছে বাবার। ঠিক আছে বাবা, আপনি ঘুমোন, আমায় অফিসবেরতে হবে।
বাথরুমে ঢুকে চান করে গা মুছতে মুছতে বসন্ত বিড় বিড় করে, “বাবার থেকে এখন আমি বয়েসে অনেক বড় / আমার একুশটা হাত / তিনটে চোখ / প্রতিদিন সাতশো দরজা পেরিয়ে যাই…” সুনীল আওড়ায়। আর মাত্র একবছর বাকি তার রিটায়ারমেন্টের।রোজই সকালে উঠে বসন্ত টয়লেটে বসে হিসেব কষে আর কতদিন তাকে অফিসে যেতে হবে। অবসরের পর অখন্ড সময়। পড়ে পড়ে শুধু ঘুমবে।
গামছা জড়িয়ে দেয়াল-ছবির সামনে এসে বসন্ত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “নিজের থেকে কমবয়েসী কারুকে কি বাবা বলে ডাকা যায়?…”
বসন্তর কথা শুনে বনবিহারী হাসেন। কত বয়স হল তোর?
বসন্ত প্যান্ট গলাতে গলাতে বলল, এই তো উনষাট। পরের বছর রিটায়ারমেন্ট। তোমার চেয়ে আমি এখন তিন বছরের বড়।
কাল রাত্তিরের সেই হাসিটা ফিরে এসেছে বাবার। চোরা মুচকি হাসি। বাবাকে কোনওদিন হাসতে দেখেনি বসন্ত। ছোট থেকে ওরা জেনে এসেছে, বাবারা হাসে না। বাবাদের হাসতে নেই। মন খারাপ হয়ে যায় বসন্তর।
খেতে বসে শিখা বলল, “এবার ঘরগুলোয় রঙ ফেরাতে হবে কিন্তু! তুমি তো পরের বছর রিটায়ার করছ, করেই আগে ঘরে হাত দিও, বুঝলে। এই ড্যাম্প ঘরে বেশিদিন থাকলে শরীর খারাপ করবে। বয়স হচ্ছে আমাদের। আর কিপ্টেমি করে ফেলে রেখো না বলছি। অনেক হয়েছে। আগেই উচিত ছিল ঘরগুলোয় সব ড্যাম্প প্রুফ লাগিয়ে পিওপি করে নেওয়া। তখন কত করে বলেছিল হরিহরদা। তুমি শুনলে না। তাহলে আজ আর এই ভিজে দেয়ালে বাবার ছবি দেখতে হত না তোমাকে।”
হরিহর রঙ মিস্ত্রি। বসন্ত হরিদা বলত। খুব চটপটে লোক ছিল হরিদা। দেয়ালে রঙ করতে করতে গাইত, ইয়ে লাল রঙ কব মুঝে ছোড়েগা। এই একটা গানই গাইত হরিদা। বসন্ত একদিন কৌতূহলী হয়ে জানতে চেয়েছিল, “হরিদা তুমি রোজ রোজ রঙ করার সময় এই গানটা গাও কেন?”
হরিহর চটপট জবাব দিয়েছিল, “সিনেমায় রাজেশ খান্না মদ ছাড়ার জন্য এই গানটা গেয়েছিল, আর আমি গাই এই কাজটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য।”
বসন্ত অবাক হয়ে বলেছিল, “কেন, মুক্তি পেতে চাও কেন? এত সুন্দর রঙ করো তুমি, এত সুন্দর হাতের কাজ তোমার…”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিহর বলেছিল, “পরের ঘরে রঙ করতে আর ভাল লাগে না আমার।এতখানি বয়স হল, এখনও নিজের একটা ঘর করতে পারলাম না। বৌ মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকি। টালির চাল। আমাদের ওখানে এখনও রাত্রেবেলা শেয়াল ডাকে, জানেন!” হরিহরদা বড় কাঠালিয়ায় থাকত।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলেছিল, “বুঝলেন দাদা, যখন দশ বারো তলা বাড়ির গায়ে ভারা বেঁধে রঙ করি, তখন এক একবার নিচে তাকিয়ে মাথা ঘুরে যায়। সেই সময় এক আধ বার মনে হয়েছে হাত-পা ছেড়ে দি। গোঁত খেয়ে পড়ে যাই নিচে। বেশ হয়। থেঁতলে গিয়ে শরীরের সব লাল রঙ বেরিয়ে যাক। মুক্তি পাই। কিন্তু মেয়ে আর বৌ-এর কথা ভেবে পারি না। ওই পারি না বলেই, গানটা গাই। সান্ত্বনা পাই। ভীতু মানুষ তো!”
হরিদার কথা শুনে দুঃখ পেয়েছিল বসন্ত। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। কী বলবে! এরকম কত হরিদা আছে যারা রোজ মরতে চায়।পারে না। তারাও নিশ্চয়ই এরকম কোনও একটা গান গায়। গান গেয়ে মরে যাবার কথা ভুলে থাকে।
তা সেই হরিহর দেয়ালে ফাইনাল সিমেন্ট ওয়াশ করার পর রঙ করার আগে একদিন বসন্তকেজিজ্ঞেস করেছিল, “দাদা, এখনও বলুন, সময় আছে, দেয়ালে পিওপি করবেন, না ডিসটেমপার?”
বসন্ত ছোট থেকে বরাবর নিজেদের ঘরে কলি করতে দেখে এসেছে। তিন চার বছর পর পর কিংবা ঘরে কোনও অনুষ্ঠান হলে, সারা ঘরে কলি ফেরানো হত। চুনের মধ্যে নীল রঙ গুলে লাগানো হত দেয়ালে। কতদিন অবধি ঘরে সেই নতুন চুনের গন্ধ ম ম করত।
“একবার ডিসটেমপার করা হয়ে গেলে কিন্তু পরে আর পিওপি করতে পারবেন না দাদা।ফের সব রঙ তুলে পুট্টি মারতে হবে। হেভি ঝামেলা। ডবল খরচ। এখনই ভেবে-টেবে বলুন, সেইমতো আমি এসটিমেট দেব।”
হরিহরের সাজেসন মানেনি বসন্ত। তখন তার ল্যাজে-গোবরে অবস্থা। চারদিকে ধার দেনা। শিখার অনেক সখ ছিল,ঘরে মসৃন দেয়াল হবে। হাত রাখলেই পিছলে যাবে। নোংরা হলে যখন তখন রগড়ে ধুয়ে ফেলা যাবে।শিখার সেই শখ তখন মেটাতে পারেনি বসন্ত।
তবে শিখার ইচ্ছে অনুযায়ী বুবির ঘর পিংক হয়েছে। বুবি ওদের মেয়ে। বসার ঘরের দেয়াল বিস্কিট কালারের। বেডরুমে পেস্তা।সেই পেস্তা রঙের দেয়ালে এখন বর্ষার জল চুঁইয়ে বাবার ছবি। বুবির ঘরের দেয়ালেও ওরকম একটা সাদা রঙের দৈত্য ঝুলছে। বুবি এখন নেই। বিয়ে হয়ে বম্বে। বম্বে না মুম্বাই।
বসন্ত চুপ করে শিখার কথা সব শুনে গেল। খেয়ে উঠে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “একটা বাড়ি তিরিশ বছর চলে গেলেই এনাফ। আমাদের তো ছেলে নেই। মেয়ে। জামাইবাবাজি তো এমনিই বেচে দেবে এ-বাড়ি! বুবি তো আর বম্বে ছেড়ে এখানে এসে থাকবে না কোনওদিন। কী হবে ফের নতুন করে রঙ-টঙ করে। আমরা আর ক’দিন!”
“ওসব প্যান-প্যানানি ফিলজফি মার্কা কথা ছাড়ো তো!তোমার হরিদা-টরিদাকে দিয়ে হবে না। আজকাল কোম্পানি থেকে লোক এসে ঘর রঙ করে দিয়ে যায়। বাড়ির লোকদের কোনও ঝামেলা পোয়াতে হয় না। নিজেরাই সব করে। রঙ করা, ধোয়া, মোছা। সব। বাইরের ঘরের একটা দেয়ালে ডিজাইনার পেইন্ট করাব কিন্তু আগে থেকে বলে দিলাম। যাই খরচ হোক, ঠিক আছে? আজকাল কী সুন্দর সুন্দর রঙ করে সবাই ঘরের দেয়ালে। ডার্ক শেড। গ্লসি কালার। কী ভালো লাগে দেখতে।”
কথা বাড়ায় না বসন্ত। “তাই হবে।” বলে, অফিসে বেরিয়ে যায়।
রাত্রি বেলা শুতে এসে ফের বাবার মুখোমুখি হয় বসন্ত। সারাদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েছে। দেয়ালে আরও কিছু নতুন ছোপ সংযোজিত হয়েছে। বসন্তর মনে হল বাবার একটু বয়স বেড়েছে। কাল দেখেছিল পঞ্চাশ। আজ পঞ্চান্ন। চুলের সামনেটা পাক ধরেছে। মুখটা সামান্য ঝোলা।চোখের কোলে দুটো পাউচ। আজ আর বসন্ত ঘরে সিগারেট ধরাল না। বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করে ফিরে এসে শিখাকে বলল, “কী আশ্চর্য জানো শিখা, বাবার একটাও কথা মনে পড়ছে না আমার। সকাল থেকে কত ভাববার চেষ্টা করেছি। অফিসে কাজ করতে করতে অন্যমনষ্ক হয়ে গেছি। উঠেবাইরে গেছি। সিগারেট ধরিয়ে ভেবেছি। একটা কথা… একটা? ভাবতে গেলেই শুধু শেষ দৃশ্যটা ভেসে উঠেছে চোখে। আর মনে পড়ছে, একবার ইংরাজি পড়াতে গিয়ে বাবা, ভুল করেছিলাম বলে, খুব জোরে একটা চড় মেরেছিল। আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলাম। বাবা তখন রেগে মেগে বলেছিল, ‘এক চড়েই কাত! জীবনে এরকম কতবার চড় খেতে হবে, তখন কী করবি? ওঠ।’ ব্যাস এইটুকুই মনে পড়ছে বাবাকে। কী যে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে না। কাল ভাবছি ছোড়দিকে একবার ফোন করব। দেখি, বাবার কোনও কথা ওর মনে আছে কী না!”
“বাবা মায়ের একটা ফোটো বাঁধিয়ে রাখলেই তো পারো ঘরে। এখন তো কতরকম কায়দা বেরিয়েছে শুনি। পুরনো ফোটোও নাকি কমপিউটারে নতুনের মতো করে বানিয়ে দেয়। তোমার মেয়েকে বোলো, ও ঠিক কিছু একটা করে দেবে।”
একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বসন্ত বলল, “বাবা মায়ের ফোটো কেন টাঙাই না ঘরে জানো? তাহলে ওদিকে চোখ পড়লেই আমার মনে হবে, ওঁরা আর নেই। মৃত্যু ব্যাপারটা খুব প্রকট হয়ে যাবে তখন। মন খারাপ করবে। এখন যেমন মনে হয়, বাবা মা বেঁচে আছে। চোখের সামনে নেই, এই যা। কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে গেছে। ফিরে আসবে ক’দিন পর। এই অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমিও একদিন মরে যাব। আচ্ছা, তুমি কি এখনও বেড়ালই দেখছ, নাকি ওটা ফুলে গিয়ে বাঘ হয়ে গেছে?”
শিখা হেসে ফেলে। উঠে বসে দেয়ালের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। আজ আর বেড়াল খুঁজে পায় না। কিছুই বুঝতে পারে না। একটা পেঁপে গাছের পাতার মতো দেখতে লাগছে। হাই তুলে বলে, “নাহ্, আজ আর কিছু মনে হচ্ছে না। তোমার মতো আমি তো অত ভাবুক প্রকৃতির নই! নাও, এখন আর রাত জেগে ভাবতে হবে না বাবার কথা। শুয়ে পড়ো। কাল বাজার যাওয়া আছে কিন্তু।”
বসন্ত অফিসে বেরিয়ে গেলে সময় যেন থমকে যায়। দুপুরটা মনে হয় যেন কত লম্বা! সময় যেন আর কাটতে চায় না শিখার। দুপুরে যে একটু ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবে, তা-ও ঘুম আসতে চায় না। ছ’টা বাজলেই মন ছটফট করে বসন্তর জন্য। একটু দেরি হলেই রাগারাগি করে। “কী হল বাড়ি আসতে ইচ্ছে যায় না, নাকি?”
বাড়িতে না এসে আর কোন চুলোয় যাব? রাস্তায় জ্যাম ছিল। কিংবা বাস পেতে দেরি হয়েছিল। এই সব বলে।
শিখা উঠে যায় জল নিয়ে আসতে। চা বানাতে। তখন কত কাজ। হঠাৎ করে কাজ বেড়ে যায়। দু’জন লোককেই তখন মনে হয়, কত লোক। ঘর ভর্তি মানুষ।
চা খেতে খেতে শিখা বসন্তকে জিজ্ঞেস করে, “ছোড়দিকে ফোন করে কিছু জানতে পারলে? বাবার কথা কিছু বলতে পারল ও?”
বসন্ত একটা বড়ো মতো শ্বাস ফেলে বলল, “নাহ্! ছোড়দিও কিছু বলতে পারল না। ওরও কিছু মনে নেই। আশ্চর্য! আসলে আগেকার দিনে বাবারা তো ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলত না। তাই হয়ত হবে…, বাবার কথা আমাদের কিছু মনে নেই।” তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে দেয়ালে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু আধটু তখন কথা বললে পারতেন কিন্তু আমাদের সঙ্গে। অতটা বাঘ বাঘ হয়ে থাকার কি খুব প্রয়োজন ছিল? দেখুন তো আজ কেমন খারাপ লাগছে আমাদের সবার। না, সেইসময় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আপনাদের আচরণ কিন্তু মোটেই সুস্থ ছিল না, যাই বলুন।”
বসন্তর মনে হল, বনবিহারী সমাদ্দার যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না বাবা। তখনও না। আজও না।
রাতে শুতে যাবার আগে বসন্ত বারান্দায় সিগারেট খেতে গেলে, বাইরে থেকে ছিটকে আসা স্ট্রিট লাইটের আলোয় ভিজে দেয়ালের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে শিখা।তড়িঘড়ি উঠে বসে। প্রতুলদা না! হ্যাঁ, ওই তো, প্রতুলদাই। ওই তো ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি। পুরু ঠোঁট। বড়ো বড়ো টানা চোখ। একদৃষ্টে তাকিয়ে। অনেকদিন বাদে ফের বুক ধড়াস করে উঠল শিখার।
প্রতুল আর নন্দিনী। সাত আট বছর বিয়ে হয়ে গেলেও ওদের কোনও সন্তানহয়নি। নন্দিনীর ছিল নাচের স্কুল। ঘরেই শেখাত। আর প্রতুলদাবাজাত গিটার। ওদের কী একটা বিদঘুটে নামের ব্যান্ডও ছিল।
বসন্ত সেইসময় শিবপুরে থাকে। ভাড়া বাড়ি। দাদার সঙ্গে কীসব গোলমাল করে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে। বুবির তখন বছর ছয় বয়স। বুবিকে নাচ শেখানোর জন্য নন্দিনীর স্কুলে নিয়ে যেত শিখা। প্রতি রোববার। সেইসময় মাঝে মাঝে প্রতুলদাও এসে হাজির হত ক্লাসে। কোনও কোনওদিন গানের সঙ্গে গিটার বাজাত।
শিখার চেয়ে সম্ভবত এক আধ বছরের বড় ছিল প্রতুল। তবু শিখাকে ওরাদু’জনেই দীপাবৌদি বলে ডাকত। আপনি করে বলত। শিখা অবশ্য প্রতুলকে প্রতুলদা বলত। এক অদ্ভুত শারীরিক আকর্ষণ ছিল প্রতুলদার মধ্যে। চওড়া কাঁধ। বুকে কুচনো লোম। চোখদুটো অসম্ভব আকর্ষণীয়। প্রতুলদাকে দেখলেই শিখার শরীরে আর একটা শিখা জ্বলে উঠত। সারাটা সপ্তাহ শিখা রোববারগুলোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। ব্যাপারটা যে প্রতুলদা বুঝত না তা নয়। কিন্তু কখনও সেভাবে সাড়া দেয়নি।ওটাই শিখার অসহ্য লাগত।
একদিন ওরকম একটা রোববার, ওদের বাড়ি গিয়ে শিখা দেখে নন্দিনী বাড়ি নেই। কী একটা জরুরি কাজে কলকাতা গেছে। ফিরতে বেলা হবে। ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা তাদের মায়েদের সঙ্গে আসছে, ক্লাস হবে না জেনে, ফিরে যাচ্ছে। শিখাফিরে যায়নি। বসে পড়েছিল প্রতুলের সঙ্গে গল্প করতে। কত রকমভাবে যে সিডিউস করার চেষ্টা করেছিল সেদিন শিখা। কিন্তু প্রতুলদা কেমন যেন নির্বিকার ছিলেন। ভীতু ছিল বোধহয় মানুষটা। কাপুরুষ। অহংকারে লেগেছিল শিখার। তারপর থেকে সে আর ও-বাড়ি ঢোকেনি। বুবিকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে দোর গোড়া থেকে চলে আসত। ক্লাস শেষ হলে বসন্ত গিয়ে নিয়ে আসত। ধীরে ধীরে তার শরীরের ভেতরে যে শিখাটা জ্বলত, সেটা নিভে গিয়েছিল।
কাত হয়ে শুয়ে শিখা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে দেয়ালটার দিকে। না, প্রতুলদার দিকে। তারপর আলতো করে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, কেমন আছেন আপনি প্রতুলদা? কত দিন দেখিনি। আমার কথা কিছু মনে আছে? মনে পড়ে আমাকে?
পরদিন সকালবেলা স্বামী স্ত্রী মিলে জলখাবার খেতে বসেছে, সেইসময় শিখা বলল, “একদিন শিবপুরে চলো না। কতদিন আমাদের ওই পুরনো পাড়ায় যাইনি। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসিনি। যাবে একদিন?”
বসন্ত খাওয়া থামিয়ে বলে, “হঠাৎ, এতদিন পর তোমার শিবপুরে যেতে মন চাইছে? এখন কি আর সেই পুরনো পাড়া আছে আমাদের? কত চেঞ্জ হয়ে গেছে হয়ত। পুরনো লোকজনেরাও হয়ত আর কেউ নেই। ভাল লাগবে না গিয়ে। উলটে গিয়ে দেখবে মন খারাপ করছে।”
শিখা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তাও, খুব যেতে ইচ্ছে করছে গো। চলো না এই রোববার।”
এখনশিখার দুপুরগুলো আর তত একা কাটে না। ভিজে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে প্রতুলদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় বুঝতে পারে না। এখন আর এ-ঘরে সে নিরিবিলিতে শাড়ি ছাড়তে বা পরতে পারে না। প্রতুলদা অসভ্যের মতো চেয়ে থাকে। শিখার সংকোচ হয়। মনে মনে বলে, সেদিন তো খুব সাধু সেজে বসেছিলেন। যেন ভাজা মাছটি উলটেখেতে জানে না। এখন ড্যাবড্যাব করে চাওয়া হচ্ছে। খুব ন্যা!
প্রতুল হাসে। ওর সেই হাসিতে গিটারের স্ট্রামিং শুনতে পায় শিখা। …এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো / এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো…
অনেকদিন পর শিখার ভেতরে আবার সেই শিখাটা যেন জ্বলে ওঠে। মুখ আরক্ত হয়। দেয়ালের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, আপনি কি সময়কে এখন রিওয়াইন্ড করতে চাইছেন প্রতুলদা? আমার কত বয়স হল জানেন?
পরদিন বসন্ত অফিস থেকে এলে, চা মুড়ি খেতে খেতে শিখা বলল, “সেদিন তুমি ঠিকই বলেছিলে গো, আমিও ভেবে দেখলাম, নতুন করে ঘর রঙ করে আর কাজ নেই। শুদুমুদু একগাদা টাকা খরচ। আমাদের বয়স হচ্ছে। কার কখন কী অসুখ বাধে…! আজকাল চিকিৎসার খরচ অনেক। টাকা থাকলে জোর বাড়ে। থাক। বাদ দাও।”
কিছুক্ষণ হাঁ করে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে অল্প হেসে বসন্ত বলল, “তাহলে তোমার ওই ডিজাইনার ওয়ালের কী হবে? ডার্ক শেড। গ্লসি কালার।”
শিখা হেসে বলল, “ডিজাইনার ওয়াল তো শোবার ঘরেই আছে। নতুন করে আর তার দরকার নেই।”
জন্ম ১লা জানুয়ারি ১৯৫৩, বিহারে। আসানসোল, ধানবাদে বেড়ে ওঠা। চাকুরি জীবন শুরু দিল্লিতে.১৯৭৫-এ। কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে আগমন ১৯৮৩। নানান ধরণের চাকরির মধ্যে দিয়ে জীবনকে দেখা ও চেনা। কিশোর বয়স থেকেই লেখালেখির শুরু। তবে পাকাপাকি ভাবে লেখাতে মনোনিবেশ ২০১২র মাঝামাঝি। দেশ, আনন্দবাজার,
সাপ্তাহিক বর্তমান, অদ্বিতীয়া, মাসিক বসুমতি, আরম্ভ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছেএকাধিক গল্প।
প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার হিসেবে“গল্পমেলা” কতৃক সম্মানিত ২০১৫ স্মারক সম্মান।