| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ উপন্যাস: উচ্চাকাঙ্ক্ষা (পর্ব -২)।  হোমেন বরগোহাাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।


     আমাদের প্রত্যেকের উত্তর শোনার পরে স্যার আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন।সাধারণত স্যারের মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই আমরা তার মনের ভাব অনেকখানি বুঝতে পেরে যেতাম। কিন্তু সেদিন তার মুখে এরকম একটি নতুন ভাব ফুটে উঠল যে কিছুক্ষণের জন্য কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সেদিন স্যারের সমস্ত কথাগুলি আমাদের মনে খুব আশ্চর্য বলে মনে হল, প্রথমত তিনি আমাদের সবসময় বলার মতো গল্প না বলে একটা অভিনব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। দ্বিতীয়ত, আমাদের উত্তরগুলি শুনে ভালো খারাপ কিছু না বলে তিনি আমাদের মুখের দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ঘরটিতে এরকম একটি ধরনের নীরবতা বিরাজ করতে লাগল যে ধরনের নীরবতা এর আগে আমরা কখনও অনুভব করতে পারিনি।

    অবশেষে স্যারের মুখ থেকে কথা বের হল কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর আমরা সব সময় শুনে থাকা কণ্ঠস্বরের চেয়ে একটু আলাদা ছিল। স্যার বলতে শুরু করলেন আমার প্রশ্নের উত্তরে তোরা যা বলবি তাকেই বলা হয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। উচ্চ+ আকাঙ্ক্ষা= উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মানুষের আকাঙ্ক্ষা কখন উচ্চ হয় বা কেন উচ্চ হয়? মানুষের স্বভাবই এরকম যে সে কখনও এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। এক অবস্থায় থেকে সুখী হতে পারে না। কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে না পারা এই অস্থির স্বভাবের জন্যই মানুষ আদিম বন্য অবস্থা থেকে ক্রমশ উন্নতি করে আজকের এই অবস্থায় পৌঁছেছে। কিন্তু আজকের  এই  উন্নত অবস্থা পেয়েও মানুষ বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট হতে পারেনি। নতুন কিছু একটা হওয়ার জন্য, অন্য কিছু একটা হওয়ার জন্য মানুষ সব সময় চেষ্টায় রয়েছে। আর সেই চাওয়াটাই মানুষকে আরও কত দূরে বা উপরে নিয়ে যাবে সে কথা কেউ বলতে পারেনা।

    ‘আচ্ছা, সেই সব বড়ো বড়ো কথা আজকের মতো থাক। আমি তোদেরকে একটা  অন্য কথা বলতে চাইছি। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বোঝানোর জন্য অন্য ধরনের উদাহরণ দিতে পারি। একজন দুঃখী মানুষ ধনী হতে চায়।একজন ধনী মানুষ আরও ধনী হতে চায়। মনেশ্বর  দর্জির ছেলে সদানন্দ সিপাহি হতে চায়।একজন নামি ফুটবলার হওয়াার জন্য আমাদের স্কুলের মুখেশ্বর চায়েঙিয়াকের আর কিছু চাইনা। এইসবই হল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তোদের কার কী উচ্চাকাঙ্ক্ষা সে কথা আজ আমি জেনে নিলাম। কিন্তু আমার নিজের কী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল বা এখনও আছে সে কথা জানার জন্য তোদের ইচ্ছা করে না?’ 

    স্যারের কথা শুনে আমরা ছেলেরা খুব আশ্চর্য হলাম। সেই সুদূর সত্য যুগে অর্থাৎ আমাদের বাল্যকালে আমরা আমাদের শিক্ষকদের প্রায় দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করতাম।তারা পূজার যোগ্য ছিলেন।স্যারের প্রশ্ন শুনে আমরা নিজেকে প্রশ্ন করলাম— ‘সাধারণ মানুষের মতো স্যারদেরও কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে নাকি?’

     স্যারের কথা শোনার জন্য আমরা কান খাড়া করে রইলাম। ঘরটাতে নীরব নিস্তব্ধতা।কিন্তু স্যার কথা বলতে শুরু করতেই। আমাদের ভীষণ হতাশ করে দিয়ে পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘন্টা বেজে উঠল। স্যার বললেন— যা বলতে চাইছিলাম আজ আর বলা হল না। আমি কি বলতে চাইছিলাম সেই কথা জানার জন্য তোদের মনে নিশ্চয়ই খুব কৌতূহল হয়েছিল। 

    আগামীকাল পাঠ শুরু করার আগে আমি তোদের আজকে বলতে চাওয়া  কথাগুলি বলব। তখন পর্যন্ত তোদের কৌতূহল দমন করে রাখতে হবে। একটু আগে আমি তোদের বলেছিলাম যে মানুষ কোনো অবস্থাতেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে না পারা অস্থির স্বভাবই  মানুষকে আদিম অসভ্য অবস্থা থেকে ঠেলে ঠেলে এনে আজকের উন্নত অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে।আমি সেটাকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলেছি। এর আগে আমি তোদেরকে বলেছিলাম যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে থাকাটা হল মানুষের স্বভাব; প্রধানত এই স্বভাবটাই মানুষকে মানুষ করে তুলেছে।প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে করে নিজের সম্বন্ধে এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করেছে, আর সেই জ্ঞানের সাহায্যেই মানুষ ক্রমশ উন্নতির পথে এগিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে কেন? কারণ মানুষ নানা বিষয়ে কৌতূহল অনুভব করে । এটা কি? ওটা কেন ? ওটা কীভাবে হল? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটি কে কীভাবে সৃষ্টি করেছে?…  … মানুষের জীবনে অবিরাম ভাবে উদয় হয়ে থাকা এই প্রশ্নগুলোকে আমরা কৌতূহল বলে থাকি। তোরা ছোটো ছেলে হলেও একটু চিন্তা করে দেখলে তোরাও একথা বুঝতে পারবি যে মানুষকে কৌতূহল অনবরত বিরক্ত করে থাকে না সে কখনও জ্ঞান আহরণ করতে পারে না। মানুষের গুণ গুলির মধ্যে একটি প্রধান গুণ হল কৌতূহল। কৌতূহল কাকে বলে? তোরা সে কথা এখন খুব ভালোভাবে বুঝতে পারবি, কারণ আগামীকাল আমার কথা না শোনা পর্যন্ত কৌতূহল তোদেরকে খুব বিরক্ত করতে থাকবে।’

    বারান্দায় কারও গলার শব্দ শুনে আমাদের সবার চোখ দরজার দিকে গেল। ইতিমধ্যে পরের পিরিয়ডের স্যার এসে বারান্দায় পায়চারি করছে। তার মুখে একটা কৌতুকের হাসি, কারণ তিনি জানেন যে পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলেও আমাদের এই স্যারের কথা শেষ হয় না। বারান্দায় পায়চারি করে থাকার সময় স্যার গলায় শব্দ করে জানিয়ে না দিলে স্যার যে আর ও কতক্ষণ কথা বলতেন তার ঠিক নেই। সে যাই হোক না কেন, বারান্দায় স্যারের গলার শব্দ শুনে ঘরের ভেতরের স্যার হঠাৎ কথা বন্ধ করে লাজুক একটা হাসি হেসে  বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

    কৌতূহল  কী জিনিস এবার আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। স্যার ঠিকই বলেছিলেন যে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কী ছিল সে কথা না জানা পর্যন্ত কৌতূহল আমাদেরকে বিরক্ত করতে থাকবে। অন্য ছেলেদের কথা আমি জানিনা, কিন্তু আমাকে  কৌতূহল  এতটাই বিরক্ত করতে থাকল যে পরের দিন শ্রেণিতে গিয়ে না বসা পর্যন্ত আমি পড়াশোনা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি কোনো কিছুতেই ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারলাম না।

    স্যার আমাদের উপস্থিতি নেবার পরেই পাঠ্যপুথি মেলে ধরলেন। আমাদের মনে ভয় হল যে তিনি হয়তো আগের দিনের কথা ভুলে পাঠ্যপুথি  পড়াতে শুরু করে দেবেন।কিন্তু আমাদের ভয় অমূলক প্রমাণ করে তিনি বইটি সামনের টেবিলে রেখে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাদের কাছে  কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে  রইলেন। স্যারের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি আগের দিনের কথা মোটেই ভুলে যাননি।

     স্যার হঠাৎ বলতে শুরু করলেন—’ তোদের প্রত্যেকের উচ্চাকাঙ্খার কথা, অর্থাৎ বড়ো হয়ে তোরা কে কী হতে চাস সে কথা, আমি কাল শুনলাম। আমি তোদেরকে বলতে চাইছিলাম আমার নিজের উচ্চাকাঙ্খার কথা। আমার জন্ম হয়েছিল ১৯১০ সনে। সেই সময়ে সম্পূর্ণ মহকুমাটিতে একটি মাত্র হাই স্কুল ছিল; মিডিল স্কুল ছিল মাত্র দুটি। সেই সময়ে মানুষ মিডিল স্কুল এবং হাইস্কুলের শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষা বলে ভাবত; কিন্তু সেই উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগও কম ছেলেরাই পেত। গ্রামের চাষির  ছেলে নিশ্চিতভাবে এ কথা জানত যে  লাঙলের মুঠো ধরতে পারা বয়স হলেই তাকেও বাবা- কাকার বৃত্তিটাকে গ্রহণ করতে হবে; অর্থাৎ চাষির ছেলে চাষি হবে।আমি যে অর্থে কাল তোদের উচ্চাকাঙ্খার কথা বললাম সেরকম উচ্চাকাঙ্খা মনে জায়গা দেবার কথা আমাদের সময়কার ছেলেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমি কপালের জোরে শিক্ষক হলাম।কিন্তু তা বলে কোনো ধরনের উচ্চাকাঙ্খা আমার মনে ছিল না এমন নয়।’

    কিছু একটা ভাবার জন্য সময় নিয়ে স্যার কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। আমি তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমি তার মুখে আগে কখনও না দেখা একটা জ্যোতির মতো যেন দেখতে পেলাম।অবশ্য সেটা আমার মনের কল্পনাও হতে পারে,কারণ সেদিন স্যারের কথা এবং ভাবভঙ্গি আমার মনে কিছুটা আশ্চর্য আবেগ জাগিয়ে তুলেছিল।


আরো পড়ুন: উচ্চাকাঙ্ক্ষা (পর্ব -১)।  হোমেন বরগোহাাঞি


 

     স্যার পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন—’দাঁড়া,আসল কথাটা বলার আগে তোদের একটা অন্য কথা বলে নিই। কিছুদিন আগে ‘বাঁহী’ নামের একটি বিখ্যাত পত্রিকায় একটা গল্প পড়লাম।বাঁহীর সম্পাদক কে জানিস? সাহিত্যিক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া। তাকে অসমিয়া সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো সাহিত্যিক বলা হয়।তোদের অনেকেই তার  ‘বুঢ়ী আইতার সাধু’ (ঠাকুরমার গল্প) ‘ককা দেউতা এবং নাতি লরা’ ইত্যাদি গল্পের বই পড়েছিস। আমি নিজেও তোদেরকে লাইব্রেরী থেকে সেই বইগুলি পড়তে যাওয়ার কথা মনে আছে।(স্যার আমাদের লাইব্রেরী শিক্ষক ছিলেন)। যে গল্পের কথা বললাম সেই গল্পটি কবি যতীন্দ্রনাথ দুয়ারা ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন। কিন্তু পড়লে অনুবাদ বলে মনে হয় না। যতীন্দ্রনাথ দুয়ার বিভিন্ন বিদেশি ভাষার গল্প এবং কবিতা ইংরেজি থেকে অসমিয়াা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু সেগুলিকে অসমিয়া সাজ পোশাক পরিয়ে তিনি এমনভাবে অসমিয়া করে নিয়েছেন যে পড়ার সময় বিদেশি মূলের কথা মনে পড়ে না; নিজের জীবনের এবং নিজের মানুষের কথা পড়া বলে মনে হয় ।সে যাই হোক না কেন, আমি তোদের এখন পুরো গল্পটা শোনাব না; কেবল সারাংশটা বলব। সম্পূর্ণ গল্পটা বলতে গেলে কালকের মতো পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজবে; আমি তোদের বলব বলব বলে আশা দিয়ে রাখা কথাটা আজও বলা হবে না।

     একদিন একজন গ্রামের বুড়ো মানুষ অগ্রহায়ণ মাসের সকালের মিষ্টি রোদ পিঠে নিয়ে উঠানে বসে কিছু একটা হাতের কাজ করছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ একবার তিনি মাথা তুলে দেখলেন যে একজন অপরিচিত ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটিকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করে। বুড়োর প্রশ্নের উত্তরের ছেলেটি বলল যে এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই; সে আশ্রয় চেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায়। আশ্রয়ের বিনিময়ে সে কাজকর্ম করে দেয়। এখন সে বুড়োর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য  আশ্রয় চাইতে এসেছে। 

    ছেলেটির মুখটি দেখেই তার প্রতি বুড়োর খুব মায়া জন্মাল,এখন তার কথা শুনে সেই মায়া দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল। বুড়ো অতি আনন্দিত মনে ছেলেটিকে তার বাড়িতে থাকার অনুমতি দিলেন।

    বুড়োর বাড়িতে ছেলেটি থাকতে শুরু করার কয়েক দিনের ভেতরে বাড়িতে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে চলেছে বলে সবাই অনুভব করতে লাগল। কিন্তু পরিবর্তনের কারণটা কেউ স্পষ্টভাবে অনুমান করতে পারল না।বুড়োর তিন ছেলের বউ ।কিন্তু তাদের মধ্যে একেবারেই মেলামেশা  ছিল না।  সব সময় ঝগড়া  করে তারা ঘরটাকে অশান্তিময় করে রাখে।  কিন্তু সেই অপরিচিত ছেলেটি বুড়োর বাড়িতে থাকতে আসার কয়েক দিনের ভেতরে তার শান্ত স্বভাব, জ্ঞানী মানুষের মতো কথাবার্তা এবং মধুর আচরণ ঘরটাতে মন্ত্রের মতো কাজ করতে  লাগল। নিজেদের অজান্তে একদিন হঠাৎ তিন পুত্রবধূ আবিষ্কার করল যে তাঁরা ঝগড়া করতে পুরোপুরি ভুলেগেছে;অতীতে যে তাঁরা কখনও ঝগড়া করেছিল এমনকি সেকথাও তারা ভুলে গেছে। ঝগড়া-ঝাঁটি গালি গালাজের পরিবর্তে বাড়িটাকে এখন তিন বৌমা হাসি-আনন্দে মুখরিত করে তুলতে লাগল ।তিন বৌমা অহর্নিশ ঝগড়া করে থাকার সময় তাঁদের স্বামী এবং ছেলে-মেয়েরাও বিশেষ কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে নিজের নিজের স্ত্রী এবং মায়ের পক্ষ নিতে বাধ্য হয়েছিল;ফলে কেউ কারও সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারছিল না। ।প্রত্যেকেরই মুখগুলি ছিল গুরুগম্ভীর,কথাগুলি শুকনো।কিন্তু একদিন হঠাৎ একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল যে প্রত্যেকের মুখে আনন্দের হাসি ঝলমল করছে;মনের সুখে একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে।

    একমাস পরে ছেলেটি বুড়োকে জিজ্ঞেস করল—‘দাদু,আপনার বাড়িতে অনেকদিন খুব সুখে রইলাম।এখন আমার যাবার সময় হয়েছে।’

    ‘কারও বাধা-নিষেধ না মেনে ছেলেটি যে পথে এসেছিল সেই পথেই চলে গেল।সব সময় একই মানুষের বাড়িতে থাকতে নাকি তার ভালো লাগে না।সে এখন অন্য কারও বাড়িতে আশ্রয় খুঁজে বেড়াবে এবং আশ্রয়ের বিনিময়ে সেকাজ করে দেবে।তার কী কাজ জানার জন্য বুড়োর এখন আর বাকি রইল না।মানুষের মন থেকে অসূয়া-অপ্রীতি দূর করে প্রত্যেকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাটাই হল তার কাজ।

’এতটুকু বলে স্যার কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে পড়লেন।তিনি যেন অনেক দিনের আগের কিছু একটা কথা মনে করার চেষ্টা করছেন,সেরকম একটা ভাব তার মুখে ফুটে উঠল।তারপরে তিনি তাঁর স্বভাব-সুলভ কোমল মিষ্টি কণ্ঠে বলতে লা্গলেন—‘যতীন্দ্রনাথ দুয়ারার এই গল্পটি পড়ে আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল।আমার পিতা ছিলেন নিরক্ষর চাষি।কিন্তু অন্যের মুখে শুনে শুনে তিনি কীর্তন এবং নামঘোষার অনেক পদ মুখস্থ করেছিলেন,আর কাজ-কর্ম করে থাকার সময় সেইসব গুণগুণ করে গাইতেন।আমি বাবার মুখে কখনও দুঃখ এবং মন খারাপের ভাব ফুটে উঠতে দেখিনি।তিনি যেন সব সময় মনে এক গভীর শান্তি অনুভব করতেন এবং সেই শান্তি তাঁর মুখে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।একদিন আমি তাঁর শান্তির কারণ্টা জানার জন্য একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।সেদিন একাদশী না অমাবস্যার জন্য হাল-বাওয়া বন্ধ ছিল।বাবা  বারান্দায় একটা পিঁড়িতে বসে একটা লাঙল চাঁছছিলেন।আমিও বারান্দায় বসে স্কুলের বই পড়ছিলাম।এমনিতে আমাদের প্রতিবেশী একজন মানুহ আমাদের ঘরে প্রবেশ করল।আমি তার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম যে মানুষটা কিছু একটা কথায় মনে খুব কষ্ট পেয়েছে।বোধহয় সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য তিনি বাবার কাছে এসেছিলেন।কিন্তু বাবার শান্ত মুখের দিকে কিছুসময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাঁর মনে বোধহয় একটা অন্য প্রশ্নের উদয় হল।তিনি বললেন—কাকাবাবু ,আপনাকে দেখলেই আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্চছা করে।,কিন্তু কোনোদিনই জিজ্ঞেস করা হয় না।আজ ঠিক করেছি যে কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলি। আপনার মুখে আমি কখনও দুঃখ-মন খারাপ এবং অশান্তির চিহ্ন দেখতে পাইনি। সবসময় আপনার মুখটাতে একটা শান্তির ভাব লেগে থাকে।জীবনের এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও আপনি এত শান্তিতে কীভাবে থাকতে পারেন?’                                                                                                                                                                                                            

    মানুষটার প্রশ্ন শুনে আমি পড়তে থাকা বইটি বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখলাম।বাবা কী বলেন আমার শোনার ইচ্ছা হল। বাবাও লাঙলের কাজটা  সরিয়ে রেখে মানুষটার মুখোমুখি বসলেন। মনে  মনে কিছু একটা ভাবার মতো করে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপরে তিনি বলতে শুরু করলেন–’ মুখে যে শান্তির ভাব একটা লেগে থাকে সে কথা আমি নিজে জানতাম না। আজ তোমার কাছ থেকে জানলাম। কিন্তু মুখে শান্তি থাকুক বা না থাকুক মনে যে শান্তি থাকে সে কথা আমি নিজে জানি। তার কারণটা তোমাকে বলি শোনো। আমার বাবা লেখাপড়া  জানতেন না, কিন্তু তিনি বড়ো জ্ঞানী মানুষ ছিলেন।মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে একটা মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন– যখনই দুঃখ বা বিপদে পড়বি, তখন একটা কথা মনে রাখবি যে দুঃখ বা বিপদ কেবল তোর জন্য আসেনি।তোর চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভাগা কোটি কোটি মানুষ আছে– যারা দুঃখের সাগরে ঠাঁই পাচ্ছে না। ওদের দুঃখের সঙ্গে নিজের দুঃখ মিলিয়ে দেখলে তুই নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে ভাববি এবং মনে শান্তি লাভ করবি। কেবল নিজের দুঃখের কথা চিন্তা করে থাকাটা পাপ। লোকের দুঃখ কষ্ট দেখেও তা দূর করার চেষ্টা না করাটা আরও বেশি বড়ো ধরনের পাপ। আমাদের কোনো একটি পুরাণে নাকি লেখা আছে যে পরোপকারের চেয়ে বড়ো ধর্ম অন্য কিছু নেই। আমিও মনে মনে ভেবে দেখেছি যে এর চেয়ে বড়ো সত্যি আর কিছু নেই। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই যদি নিজের কথা একটু কম করে ভেবে অন্যের কথা বেশি ভাবে এবং অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই পরম সন্তোষ লাভ করে, তাহলে মানুষ স্বর্গ লাভের কথা ভাবার প্রয়োজনই পড়ে না; এই পৃথিবীটাই হবে স্বর্গ।’বাবার মুখে এই কথা শোনার পরে আমি অন্য নতুন কথা শেখার চেষ্টা করিনি; শেখার জন্য সুযোগও পাইনি। অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করা— একমাত্র সেটাকেই আমি আমার ধর্ম বলে গ্রহণ করেছি।’

     কথার মাঝে মাঝে নীরব হয়ে পড়াটা স্যারের স্বভাব। এবার কিন্তু স্যার অনেকক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। তারপরে তিনি নিজেকে বলার মতো করে বললেন—’ আমি সেদিনই ঠিক করেছিলাম যে অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করা— সেটাই হবে আমার জীবনের ব্রত।আজকালের ভাষায় উচ্চাকাঙ্ক্ষা।’ 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত