আজ ০৩ জানুয়ারি কবি,অধ্যাপক ও সমালোচক উত্তম দত্তের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
শ্লোক
এই দুরারোগ্য জাহান্নামে বসে এখনো তোমার কথা ভাবি।
প্রাচীন বৃক্ষেরা বলেছিল:
রোমন্থন এক সোনালি অসুখের নাম।
দুহাতে রুমাল নেড়ে মেহের আলি বলেছিল:
শ্লোকের ভিতরে নেই কোনো সজল বসতি, শান্তি-চিহ্ন নেই___
শুধু এক মায়াবী জতুগৃহ,
উপবাসী রূপসীর মতো দরজা খুলে বসে থাকে।
এখনো সময় আছে, ফিরে এসো।
আমার ফেরার কোনো নৌকো ছিল না,
তাই
এই বর্ণময় জাহান্নামে বসে এখনো তোমার কথা ভাবি।
তুমি আছো বলে কোমাসের এই ক্যারাভান
সমস্ত নরক জুড়ে উত্সবের এত আয়োজন।
কাদার ভিতরে জেগে থাকে স্বপ্নের মাছেরা।
তুমি আছো তাই
রবিশস্যের মাঠে অশ্রুকেও বৃষ্টি বলে ডাকি।
ইন্টারভিউ
জ্ঞান দেবেন না স্যার
আরো বেশি মূর্খ হয়ে যাবো
আঠেরো বছর ধরে যা বলেছেন
গিলেছি
এখন পূর্ণকুম্ভ থেকে ভেসে আসছে
কিম্ভূত বাতাস
বিকলাঙ্গ শিশুর দুর্বোধ্য চিত্কার
বাবা রাজমিস্ত্রী
মা বিড়ি বাঁধে
আমি এক অষ্টম বিস্ময় :
এম এ পাশ গাধা
নিজের ঘাস
নিজে সংগ্রহ করতে শিখিনি আজও
কাল সারা রাত প্ল্যাটফরমে শুয়েছিলাম
আজ চতুর্থ বার
আপনার মুখোমুখি হবো বলে
আমার রোদে পোড়া মাথার ভিতরে
অর্থহীন শিস দিচ্ছে প্রজ্ঞাবান কাগজের পাখি
এই চার বছরে আপনার সোনার তরণীতে
সাড়ে চার ইঞ্চি মেদ জমেছে
গলায় সোনার শেকল
মুখে শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত হাসি
আপনার সব প্রশ্ন শেষ হলে
আমাকে বলুন – স্যার
প্রতিদিন ঘাসের ঝোল খেতে কেমন লাগে ?
ফুসফুসে ক্যানসার নিয়ে
প্রতিদিন কতগুলো বিড়ি বাঁধা যায় ?
আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে
সিমেণ্টের ক্ষত-চিহ্ন নিয়ে
প্রতিদিন গাঁথা যায় কতগুলো ইঁট ?
মানুষের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের মধ্যে
থেকে যায় কতগুলো বেজন্মা অক্ষর ?
একটু সংক্ষেপে বলুন স্যার
সময় তো বেশি নেই – বাইরের ঠা ঠা রোদে
পুড়ে যাচ্ছে অগণন বিমর্ষ উদ্বেগ …….
যদি মৌন থাকো প্রভু
জ্ঞান দিও না প্লিজ , আরো বেশি মূর্খ হয়ে যাবো ।
গণ্ডার
একদা মানুষ ছিলাম, মনে পড়ে
খুব মনে পড়ে
তখন প্রত্যেক শীতকালে আমরা
হাতির পিঠে চড়ে একশৃঙ্গী গন্ডার দেখতে যেতাম।
এখন পাকে চক্রে আমাকেও কবি বলে লোকে —-
যেন দশচক্রে ভগবান ভূত।
এখন অদ্ভুত অরণ্য থেকে মাঝে মাঝে
নির্বিকার মুখ তুলে দেখি
সমস্ত বৎসর ধরে উচ্চাবচ প্রেম ও উৎসবের ছলে
কারা যেন সস্তা ক্যামেরায় অবিরাম
তুলে রাখছে আমার রক্ত-মাংসহীন মুখ
শৃঙ্গহীন গণ্ডারের ছবি।
সুখ-পদাবলী
এ বাড়ির কেউ কখনো ধর্ষিত হয় নি
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ
বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে এখনো কেউ
পথের ধুলোর ওপরে পড়ে থাকে নি সারারাত
আমাদের চালাঘরে কেউ আগুন দেয় নি এখনো
আমাদের পিতৃপুরুষের দু টুকরো জমি
এখনো দখলে আছে
এখনো দু বেলা দু মুঠো অন্ন জোটে
এখনো শিশুটি ঘুমিয়ে পড়লে
মাঝরাতে হ্যারিকেন নিভিয়ে আমরা
যত্সামান্য কুটির-শিল্প রচনা করি
আহা এমন সুখের রাজ্যে
আজীবন জলকেলি করতে ইচ্ছে করে
তবুও অজস্র মিথ্যুক প্রতিদিন রটনা করছে
ধর্ষণের মিথ
কাগজের সেপাইরা অলীক নরহত্যার গল্প শোনাচ্ছে
এই নবান্নের দেশে চারপাশে এত ভাত এত কাক
তবু অনাহারে মৃত্যুর কাহিনী কারা যে রটায়
আমরা শান্তিপ্রিয় ছা-পোষা মানুষ
কারও পশ্চাদ্দেশে আগুন লাগানো আমাদের কম্মো নয়
এইসব কল্পিত পরিস্থিতির উপরে নজর রাখারও কিছু নেই
আমরা স্বজন-বন্ধুদের সততা ও পদোন্নতির প্রতি লক্ষ রাখছি
আমরা বেশ গুছিয়ে প্রেম ও পরাবাস্তব ছবি আঁকছি কবিতায় — ক্যানভাসে…
ঈর্ষা কোরো না — চেষ্টা করো
তোমারও হবে।
স্মার্টফোন
নতুন ব্র্যান্ড, নতুন রঙ, নতুন আহ্লাদ…পুরোনো খাটের পাশে আজো পড়ে আছে
সাবেক কালের কৃষ্ণবর্ণ টেলিফোন।
বকেয়া বিলের দায়ে কারা যেন
কেটে দিয়ে গেছে তার শিরা উপশিরা।
পাড়ার তরুণ সংঘের মাস্তানরা এসে
বলে গেল :
এভাবে ডেডবডি বেশিক্ষণ ফেলে রাখবেন না। দূষণ ছড়াবে।
আপনি ইশারা করলে
আমরাই লাশ ফেলে দিতে পারি।
পদচিহ্ন
তাদের পায়ের চিহ্ন থেকে উঠে আসছে বিষণ্ণ উটের চিৎকার।
দুর্বৃত্তেরা গেরস্থের ঘর ভেঙে চলে গেলে
যেরকম আর্তনাদ জেগে থাকে সারারাত।তবু আমাদের ঘরের ভিতরে থাকে
আরো এক অলৌকিক ঘর
সমস্ত রাত সেখানে নীল আলো জ্বলে।
সেখানেও অতিথিরা আসে শব্দহীন পায়ে, ফিরে যায়…
জলের প্রগাঢ় রঙ ক্রমশ মেদুর হয়ে আসে।
তবুও কোথাও কোনো প্রিয় পদরেখা নেই।
তুমিও তো জানো, সমুদ্রের জলে
মানুষের কোনো পদচিহ্ন দৃশ্যমান নয়।

আদিগন্ত ফসলের মাঠ ভরে আছে প্রিয় রোমন্থনে
সাজানো তৈজসপত্র ভেসে যাচ্ছে মণিকর্ণিকার জলে
ফেরিঘাটে কেউ নেই, তবু মুক্তো নিয়ে বসে আছি
এই ধানবনে ।
আগুনের দেশে নিয়ে গেল, আমি তার পাখনায়
লিখে দেব বসন্তের শান্ত শিলালিপি, লিখে দেব সুপ্রাচীন
জাতকের গাথা, বোধিসত্ত্বের নাম লিখে গেঁথে দেব
সোনালি ডানায় ।
লুকিয়ে রেখেছি ব্যক্তিগত ফেরিঘাটে মস্ত এক সুবর্ণগোধিকা
ঠোঁটে তার সোনার মোহর , মোহনার জলে
সে ভাসিয়েছে নীল চিঠি : ‘পুরোনো নূপুর খুলে এই শীতে
একদিন চলে এসো একা একা’ ।
আমি দেখেছি মানুষের গুপ্ত সিফিলিস।
ঝকঝকে জুতোর ভেতরে দেখেছি ছেঁড়া মোজা
বসন্তের ওড়নার নিচে কবেকার বিষণ্ণ অন্তর্বাস
সুবর্ণ-কঙ্কনের মধ্যে জমে থাকা কঠিন বিষাদ
আর রুপোর এসট্রের বুকে ছাই-রঙা অশ্রুবিন্দু দেখে
আমি মানুষের মহিমার কথা লিখে রাখি।

রাষ্ট্র এখনো খামচে ধরে নি টুঁটি
মৃত্যু এখনো কয়েকশ গজ দূরে
চাঁদের বাগানে দেখছি না পোড়া রুটি ।
অতএব এসো চুপি চুপি এই বেলা
আঁচলে জড়িয়ে হাজার হাজার পাখি
পায়ের নূপুরে নিঝুমগড়ের আলো
কিছু কথা বলা আজো রয়ে গেছে বাকি ।
