| 7 অক্টোবর 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

শিকাগোয় চিরন্তনের আত্মঘোষণা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

শঙ্করীপ্রসাদ বসু

আধুনিক ইতিহাসে চিহ্নিত এক মহাদিন—শিকাগো ধর্মমহাসভার উদ্বোধন দিন। শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যবাণীর যজ্ঞাগ্নি নিয়ে তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ উপস্থিত হয়েছিলেন ‘জীবন্ত ধর্মমহাসভা’ (শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন) থেকে ‘আয়োজিত ধর্মমহাসভায়’। ১১ সেপ্টেম্বর সেখানে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ধর্মের নিত্যসত্যকে—আহ্বান জানিয়েছিলেন জড়বাদের কেন্দ্রে অবস্থানকারী আমেরিকাবাসীকে, ‘Sisters and Brothers of America’। এটি শুধুমাত্র ‘আহ্বান’ ছিল না, ছিল ‘মহামানবতার ঘোষণা’—ভারত আমার দেশ, পৃথিবী আমার দেশ, মানুষ আমার ভাই। প্রয়াত অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর এই অপ্রকাশিত রচনা ‘চিরন্তনের সেই আত্মঘোষণা ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত’।


১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যা। স্থান, আমেরিকার শিকাগো শহরের একটি জনাকীর্ণ সভাগৃহ। সেখানে সমবেত নরনারী জানতে গিয়েছেন, পৃথিবীর প্রচলিত ধর্মগুলির মূলসত্য কী, আপাতভাবে সংঘাতপূর্ণ ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের সম্ভাবনা আছে কিনা! ধর্ম কি বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্ভব করতে পারবে? সেই সভা বহুক্ষণ ধরে চরম একটি উত্তর প্রত্যাশা করছিল, করতালিযোগ্য বহু উত্তম বাক্য শোনা গেলেও ধ্রুববাক্যটি তখনও উচ্চারিত হয়নি। শেষ লগ্নে সেই বাক্যটি তরুণ কন্ঠে ধ্বনিত হলো— ‘হে ভগিনী ও ভ্রাতৃগণ’। মন্ত্রের মতো কথাটি, সত্যের আলোকশরের মতো গিয়ে বিদ্ধ করল সকলের হৃদয়কে—ভাই আর বোন বলে মানুষকে ডাক দিয়েছেন একজন, তারই আনন্দতরঙ্গ আছড়াতে লাগল চতুর্দিকে।

বিবেকানন্দ নিশ্চয়ই সেই মুহূর্তে ভেবেছিলেন—ভেবেছিলেন নূতন ধর্মের মহাকবির মতোই—এ আমি কী বললাম!—শ্রোতারা তখন আনন্দে পাগল হয়ে ভাবছিল—এ আমরা কী শুনলাম!

‘তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রচণ্ড ও বৈদ্যুতিক’, কবি হ্যারিয়েট মনরো এই বিবেকানন্দ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘তাঁর কণ্ঠস্বর ব্রোঞ্জের ঘণ্টাধ্বনির মতো ঐশ্বর্যময়। তাঁর সংযত আবেগের অন্তর্লীন প্রবলতা—প্রতীচ্য জগতের সামনে প্রথম উচ্চারিত ও আবির্ভূত তাঁর বাণীর সৌন্দর্য— সমস্ত কিছু মিশ্রিত হয়ে চরম অনুভূতির নিখুঁত বিরল এক মুহূর্ত আমাদের দান করল। মানবভাষণের এই হলো সর্বোচ্চ শিখর।’

বিবেকানন্দ ‘দিব্যাধিকার প্রাপ্ত বাগ্মী’ বলে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তাঁর ‘সিংহের মতো গ্রীবা’, ‘ক্ল্যাসিক দেবতার মতো মুখমণ্ডল’ সকলকে অবশ্যই আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু  সর্বোপরি ছিল তাঁর বাণীর মহিমা। তাঁর দেবোপম দেহ আমাদের সামনে থেকে সরে গিয়েছে, রয়েছে সেই বাণীর উত্তরাধিকার, যা বিশ্বভ্রাতৃত্বের ও মানবপ্রেমের মহাসনদস্বরূপ।

ভারতবর্ষের বিশেষ একটি ধর্মের পক্ষে বলতে উঠেও বিবেকানন্দ সব ধর্মের সার সত্যের কথাই বলেছিলেন—‘আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্বিত, যে ধর্ম পৃথিবীকে সহিষ্ণুতা ও সর্বমত স্বীকারের শিক্ষা দিয়েছে। সর্ব মতকে আমরা কেবল সহ্য করি না—সত্য বলে গ্রহণ করি।’

তিনি বলেছিলেন—সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও তার দুষ্টতম সন্তান ধর্মোন্মত্ততা আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল ধরে গ্রাস করে আছে। পৃথিবীকে তা হিংসায় ভরিয়েছে, বারেবারে নররক্তে সিক্ত করেছে, সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, হতাশায় ডুবিয়েছে মানবসমাজকে। ওই সকল পিশাচ যদি না থাকতো তাহলে মানবসমাজের আরও কত বেশি উন্নতি হতো। কিন্তু এবার তাদের কাললগ্ন সমুপস্থিত। আমি মনেপ্রাণে আশা করি, আজ প্রভাতে এই মহাসম্মেলনের সম্মানে যে শুভ ঘণ্টাধ্বনি নিনাদিত হয়েছে, তা সর্বপ্রকার ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি বা লেখনীর নির্যাতন, একই লক্ষ্যে অগ্রসর মনুষ্যগণের পারস্পরিক অসদ্ভাবের মৃত্যুঘণ্টাধ্বনি হয়ে দাঁড়াবে।  

তিনি আরও বলেছিলেন—যদি কেউ এমন আশা করেন যে অন্য ধর্মগুলিকে বিনাশ করে কোনও একটি ধর্মের আধিপত্যের দ্বারা ঐক্য আসবে— তাঁকে বলি— ভ্রাতঃ, এ তোমার অলীক আশা। আমি কি চাই কোনও খ্রিস্টান হিন্দু হোক? ঈশ্বর না করুন। আমি কি চাই কোনও হিন্দু বা বৌদ্ধ খ্রিস্টান হোক? ঈশ্বর না করুন।…

খ্রিস্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না, হিন্দু বা বৌদ্ধকে খ্রিস্টান হতে হবে না। কিন্তু প্রত্যেককেই অপরের প্রাণসত্যকে গ্রহণ করে, বিশেষত্ব বজায় রেখে, নিজের স্বাভাবিক প্রকৃতি অনুযায়ী বিকশিত হতে হবে।…

যদি কেউ এখন স্বপ্ন দেখেন, অন্য ধর্ম ধ্বংস হয়ে, তাঁর ধর্মই মাত্র বেঁচে থাকবে—তিনি আমার কৃপার পাত্র। তাঁর জন্য আমি দুঃখিত। তাঁকে স্পষ্টই বলি, তাঁর ন্যায় মানুষদের বাধাদান সত্ত্বেও শীঘ্রই প্রতিটি ধর্মের পতাকার উপরে লেখা হবে—‘সংঘাত নয় সহায়তা, বিনাশ নয় স্বীকরণ, বিরোধ নয় শান্তি ও সমন্বয়।’

ধর্মসমন্বয় এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধে বিবেকানন্দ বিশ্বমঞ্চে তাঁর প্রথম আবির্ভাবের কালে যা বলেছিলেন—তা বলা তাঁর পক্ষে অনিবার্য ছিল, কারণ পূর্ববর্তী বৎসরগুলিতে ওই কথা বলবার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়েছিলেন। প্রথম যৌবনে পাশ্চাত্যশিক্ষা এবং ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শ তাঁকে সামাজিক সুবিচারের আদর্শ দিয়েছিল। ধর্মব্যাকুলতায় যখন তারপরে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন— দেখেছিলেন— কিভাবে বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা রামকৃষ্ণ-জীবনে মিলিত হয়েছে। ‘রামকৃষ্ণের একক জীবনই ছিল একটি ধর্মমহাসভার মতো’— বিবেকানন্দ পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন। রামকৃষ্ণের ‘ধর্ম’ বিবেকানন্দকে দেখিয়ে দিয়েছিল কোনও একটিমাত্র ধর্ম-ই সত্য, একথা মনে করা ভুল, যে পথেই যাওয়া যাক না কেন, শেষ পর্যন্ত একই তার পরিণতি। শ্রীরামকৃষ্ণ আরও বলেছিলেন, ‘জীব মাত্রেই শিব’, শুধু বলেননি— দেখিয়েও দিয়েছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের তখন শেষ পর্যায়। গলার ক্যানসারে আক্রান্ত। অসহ্য কষ্টে দিন কাটে। নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ তরুণ শিষ্যের দল দিনরাত সেবা করেন। শিষ্যদের পক্ষে নরেন্দ্রনাথ একদিন গুরুকে ধরে বললেন, আপনি তো বলেন, মা আপনার কথা শোনেন। তাহলে মা’কে বলুন, তিনি যেন আপনাকে সারিয়ে দেন—বলতেই হবে আপনাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তা হয় না, যে মন ঈশ্বরকে দিয়েছি, সেই মনে আবার দেহের জন্য প্রার্থনা চলে না। নরেন্দ্রনাথ কিন্তু নাছোড়। বলতেই হবে আপনাকে। তাঁর জেদে পড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, আচ্ছা চেষ্টা করে দেখব। সন্ধ্যায় নরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন—মা’কে বলেছেন?

ঠাকুর বললেন—বলেছি।

নরেন্দ্র উৎসাহে শুধোলেন—তিনি কী বললেন?

ঠাকুর বললেন, মায়ের কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা গেল। যখন বললাম, মা এ মুখ দিয়ে খেতে পারছি না, এমন একটা কিছু করে দাও যাতে একটু কিছু খেতে পারি। মা তখন তোদের দেখিয়ে বললেন— কেন, অতগুলো মুখ দিয়ে খাচ্ছিস—তাতে হয় না?

ধর্ম এতো সহজ ও সর্বজনীন আর কোথায় হয়েছে? শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরে নরেন্দ্রনাথ পথে নেমেছিলেন ওই সত্যকে ব্যক্তিসাধনায় লাভ করবার জন্য। পরিব্রাজক বিবেকানন্দ হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ধনী দরিদ্র সকলের দ্বারে গিয়েছিলেন; দেখেছিলেন ধর্ম জীবন্ত রয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষের মধ্যে; ভুনাওয়ালার কুটীরে, জেলে, মালো, মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে। তিনদিন অনাহারে ছিলেন, এক মুচি তাঁকে আহার্য দিয়েছিল, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় পথে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েছেন, এক মুসলমান ফকিরের দেওয়া শশা তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল। বিবেকানন্দের কাছে ধর্মের সকল গণ্ডি ভেঙে গিয়েছিল। ধর্ম ও ঈশ্বরকে তিনি ত্যাগ করতে পারলেন না, কারণ তার অনন্ত শক্তি ও সৌন্দর্য ব্যক্তিজীবনে তিনি লাভ করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর সমস্যা দাঁড়াল ওই ধর্মকে নানামুখী আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার পথ কি করে দেখাবেন? একদিকে বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ ধর্মকে আক্রমণ করছে, অন্যদিকে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কুশ্রীতা দুর্বল করছে তার আবেদনকে। ধর্মকে মানবের পক্ষে কল্যাণপ্রদ যদি প্রমাণ করতে হয়, তাহলে একদিকে দেখাতে হবে সুখলব্ধ নিছক ঐহিকতার মধ্যে মানুষের চরম পরিণতি নেই, অন্যদিকে দেখাতে হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনসেতু রচিত হতে পারে একমাত্র ধর্মের দ্বারাই। বিবেকানন্দ সেই ধর্মই প্রচার করেছিলেন— বেদান্ত তার নাম। এবং সার্বভৌমিক ধর্ম হবে এই বেদান্তই।

ভারতীয় হিন্দু ধর্মশাস্ত্র থেকে ‘বেদান্ত’ শব্দটি গ্রহণ করলেও বিবেকানন্দ কখনোই ব্যাপারটিকে নিছক ভারতীয় মনে করতেন না— নিখিল সত্য ভিন্ন সেটা আর কিছু নয়। বিবেকানন্দ যেহেতু ভারতীয় তাই ওই সত্যের উদ্‌ঘাটনে ভারতীয় শব্দের আশ্রয় তাঁকে নিতে হয়েছিল। ভারতীয় ও হিন্দু হয়েও তিনি বলতে পারেননি সার্বভৌমিক ধর্ম ভারতবর্ষেই প্রতিষ্ঠিত হবে। ‘যদি সত্যই কখনও কোনও সার্বভৌমিক ধর্মের উদয় হয়, তবে সে ধর্ম স্থান, কাল ও পাত্রের অতীত হবে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘সেই ধর্মের সূর্য সমভাবে কৃষ্ণ ও খ্রিস্টের অনুগামীদের উপর কিরণ বিস্তার করবে, কিরণ দেবে পুণ্যবান ও পাপীকে; সে ধর্ম ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অথবা মুসলমান হবে না; তা হবে সবকিছুর সমষ্টি এবং তারও পরে তাতে অনন্ত বিকাশের সম্ভাবনা থাকবে’।

ধর্ম মানুষের জন্যই। তাই বিবেকানন্দের ধর্মের মূল কথা মানুষের স্বরূপ নিয়ে। তাঁর ভাষায়—‘তরুণ ঈগলের মতো প্রতিটি আত্মা। ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বলোকে যতই সে পাখা মেলে উড়ে চলে, ক্রমেই সে বলীয়ান হয়ে ওঠে, অবশেষে পৌঁছায় যেখানে আছে বিরাট মহীয়ান সূর্য’। মানবমহিমার শ্রেষ্ঠ স্তোত্রের একটি বিবেকানন্দর রচনা— ‘অমৃতের পুত্রগণ! কী মধুর কী আশাপ্রদ ওই সম্বোধন! ভ্রাতৃগণ, অমৃতের উত্তরাধিকারীগণ। ওই নামে তোমাদের ডাকবার সুযোগ দাও। ঈশ্বরের সন্তান তোমরা, পুণ্যবান, পূর্ণ। এই পৃথিবীতে তোমরা দেবতা। তোমরা পাপী? মানুষকে পাপী বলার চেয়ে বড়ো পাপ নেই। উত্থিত হও, জাগ্রত হও, ছিঁড়ে ফেলো মোহজাল— তোমরা মেষ নও, সিংহ তোমরা!’

ধর্ম কী— বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশের নাম ধর্ম।’ কর্ম, উপাসনা, চিত্তসংযম কিংবা দর্শন— কোনও একটি বা একাধিক উপায়ে ওই দেবত্বকে বিকশিত করো। আর মুক্ত হও।

এই হলো ধর্মের মূল কথা। বাদবাকি যা কিছু শাস্ত্র, মতবাদ, আচার অনুষ্ঠান, মঠ মন্দির—সব গৌণ ব্যাপার। বিবেকানন্দ মানুষকে এই স্বরূপে দেখেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে মানবের সর্ববিধ অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছিল। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক—যে কোনও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা তিনি করেছিলেন এবং বঞ্চিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—আমি সমাজতন্ত্রী, জনগণের শাসনাধিকার ঘটবেই ঘটবে। বিবেকানন্দের ধর্ম মানুষকে তার মূল স্বরূপ দেখতে সমর্থ ছিল বলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব সেখানে কথার কথা নয়— স্বাভাবিক ফলশ্রুতি।

কিন্তু একথা কেউ যেন মনে না করেন, বিবেকানন্দ শুধুই তাত্ত্বিক মানবতাবাদী। তিনি সর্বাংশে আধ্যাত্মিক, উপলব্ধিই তাঁর সাধনা ও সাধ্য এবং সেই উপলব্ধিকে সঞ্চারিত করাই তাঁর জীবনোদ্দেশ্য। বিবেকানন্দ যখন কিছু বলতেন— তাকে সাক্ষাতে দর্শন করেই বলতেন। কীভাবে বলতেন, তার একটি অনবদ্য বর্ণনা করেছেন ভগিনী নিবেদিতা—

স্বামীজি বক্তৃতা করতে আসবেন, তার জন্য প্রতীক্ষারত….শিহরণ স্পন্দন ঘিরে ফেলেছে তাঁকে….বুঝি জীবনের মহাপরীক্ষার সময় সমুপস্থিত। তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন, যেন মহান স্তোত্র কিংবা সুবিশাল আরাধনা। তিনি উচ্চারণ করলেন: সর্ববস্তুর পরিণতি একত্বে। আজকের জড়, আগামীকালের চেতনা। আজকের কীট—ভাবী ঈশ্বর। সকল বিভেদই চরম ও পরম অস্তিত্বের অংশমাত্র। সে অস্তিত্বের নাম— মুক্তি। আমাদের সকল সংগ্রাম মুক্তির জন্য। আমরা সুখও চাই না, দুঃখও চাই না, মুক্তি চাই। মানুষের জ্বলন্ত অশান্ত অতৃপ্ত তৃষ্ণা—আরও—আরও—আরও। সে বাসনা মানুষের অসীমত্বের দ্যোতক। অসীম মানুষ তৃপ্তি পেতে পারে কেবল অসীম কামনায়—আর অসীম প্রাপ্তিতে।

বিবেকানন্দের ধর্ম কীভাবে স্পর্শ করত মানুষকে, এমনকী ভিন্ন ধর্মের প্রচারককেও, তার ছবি পাই ভারতে খ্রিস্টান ধর্মযাজক রিভ্‌স কলকিন্‌সের স্মৃতিকথায়। একই জাহাজে তাঁরা একবার ভারতে ফিরছিলেন। বিবেকানন্দ সম্বন্ধে পূর্ব থেকে প্রসন্ন ছিল না কলকিন্‌সের মন। পরে পরিচয় ঘটলে মনের বাধা দূর হয়ে যায়। দুজনে ডেকের উপরে পায়চারি করতে করতে গভীর আলোচনায় ডুবে গেলেন, ‘যেখানে ইংরেজ, আমেরিকান বা ভারতীয় বলে কিছু নেই, শুধু আছে স্ফুটিত অগণিত মানুষ, আর এক মানবপুত্র যাঁর উৎসর্গীকৃত রক্ত এখনও রয়েছে এশিয়া মাইনরের বাতাসে-ওড়া বালুকারাশির মধ্যে।’ ধর্মযাজক দেখেছিলেন বিবেকানন্দের ‘আশ্চর্য ও আকর্ষণীয় মিস্টিসিজমকে’। ‘তা কৃত্রিম নয়, সহজ স্বাভাবিক’, রিভ্‌স কলকিনস্‌ লিখেছেন, ‘যখনই আমাদের কথাবার্তা কোনও গভীর আত্মতত্ত্বকে স্পর্শ করত, করতই তা, তখনই তাঁর সঘন বিস্তৃত আঁখিপল্লব ধীরে ধীরে নিমীলিত হয়ে আসত, এবং আমারই সমক্ষে এমন এক অজ্ঞাত রহস্যরাজ্যে প্রস্থান করতেন, যেখানে আমার আমন্ত্রণই ছিল না।’ বিবেকানন্দের এই ব্রহ্মচেতনাকে ধর্মযাজক বরণ করতে রাজি ছিলেন না, তবু তাঁর ধর্মের স্বাধীনতা ও শ্রদ্ধা রক্ষা করেছিলেন। শেষ রাত্রির কথা। জাহাজ বোম্বাই পৌঁছে গেছে। সামনের ডেকে দুজনে দাঁড়িয়ে আছেন। নীরব। তারপর স্বামীজী সহসা ওঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ওরা ওদের বুদ্ধ, ওদের কৃষ্ণ, ওদের খ্রিস্টের কথা বলুক, কিন্তু একথা বুঝেছি, আপনি আর আমি সেই অদ্বৈতেরই অংশ। রিভ্‌স কলকিনস্‌ লিখেছেন, ‘তাঁর হাত তখনো আমার কাঁধের উপরে। এমনই বন্ধুর হাত তা, যে জোর করে তাকে সরিয়ে দিতে পারলুম না। তিনি নিজেই তারপর তা সরিয়ে নিলেন। আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিলুম।’

আমি বললুম, ‘স্বামীজি, আপনি আপনার নিজের কথাই বলুন, আমার হয়ে বলে কাজ নেই। আপনি যে অদ্বৈতের কথা বলেছেন তা নৈর্ব্যক্তিক, সুতরাং জ্ঞানের অতীত থেকে যাবে, তার মধ্যে যদি ডুবে যাই, তবু তাই থাকবে। আমি কিন্তু যাঁকে জানি, ভালোবাসি, তিনি ব্যক্তিমূর্তি, বাস্তব, অতি বাস্তব। স্বামীজি, তাঁর মধ্যেই সকল পূর্ণতা’।

স্বামীজি ঠোঁট থেকে চকিতে পাইপটি সরালেন, রেলিংয়ের উপরে ঝুঁকে পড়লেন—আঁখিপল্লব নামতে লাগল—বোঝা গেল বিবেকানন্দ এখন অনেক দূরে চলে গেছেন।

‘সেই সন্ধ্যায় স্বামীজি কাকে খুঁজেছিলেন, তা কি পরম অদ্বৈতকে, নাকি সকলের মধ্যে পরম ঈশ্বরকে?’—কলকিনস্‌ প্রশ্ন করেছেন।

এই প্রশ্নের চরম উত্তর কে দেবে? উত্তর বোধহয় পাওয়া যাবে বিবেকানন্দের জীবনের আরেকটি ঘটনায়।

আমেরিকায় সেন্ট লিওস চার্চে স্বামীজি গেছেন খ্রিস্টের ভোজ উৎসবে যোগ দিতে। বড়ো সুন্দর পরিবেশ। সেখানে স্বামীজি নতজানু হলেন, গির্জার বর্ণরঞ্জিত কাচের ভিতর দিয়ে নীল, লাল ও সোনালি আলোক এসে তাঁর পাগড়ির উপরে পড়ে তাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। পরিধানের গেরুয়া বসন থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে সূর্যের কঠোর দীপ্তি। পিছনের মর্মর দেওয়ালের পটভূমিকায় তাঁর সুন্দর মুখরেখা—তার মধ্যে প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে আছে অপরূপ মুখখানি। উৎসর্গ-অনুষ্ঠানের ঘণ্টা যখন বাজলো, বেদীর উপরে স্থাপিত খ্রিস্টের প্রণামে যখন নত হলো সকল মস্তক, তখন স্বামীজি মৃদু স্বরে বলে উঠলেন, সেই একই প্রভু ও ঈশ্বরকে আমরা সকলেই পূজা করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত