ইতিহাস: ‘খ্রিস্টাব্দ’ ও ‘খ্রিস্টপূর্বাব্দ’-এর জন্মকথা
খ্রিস্টাব্দ’ শব্দটির শুরুর কথা আমরা অনেকেই জানতে চাই। তাই এর উৎপত্তির একটু ধারণা দেওয়ার জন্যই আজকের লেখা। আসলে খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের জন্মের বছর থেকে যে বছর গণনা করা হয়, তাকেই খ্রিস্টাব্দ বলে। যিশুখ্রিস্টের জন্ম, জীবন, সেবা কাজ, মৃত্যু, পুনরুত্থান অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য সাধু গ্রেগরি নতুন এ বছরের গণনা শুরু করেছেন। আর বর্তমান পৃথিবীতে এ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও প্রচলিত।এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয় তার নাম মুলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার। ১৫৮২ সালে প্রথম এই ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করেন পোপ দ্বাদশ গ্রেগরি।
image source: Google
আমাদের অনেকেরই জানা আছে, বছর গণনায় ইংরেজিতে BC ও AD দুটি শব্দ প্রচলিত। BC শব্দের অর্থ হলো Before Christ, বঙ্গানুবাদ হলো খ্রিস্টপূর্ব বা খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আর AD এসেছে লাতিন শব্দ Anno Domini Nostri Jesu Christi-যার ইংরেজি অনুবাদ হলো The year of our Lord, বঙ্গানুবাদ হলো খ্রিস্টাব্দ। সহজ কথায় বলা যায়, যিশুখ্রিস্টের জন্মবছর থেকে যে বছরের গণনা শুরু করা হয়েছে, তা-ই হলো খ্রিস্টাব্দ (AD)। আর যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগ থেকে যে বছর গণনা করা হয়, তা হলো খ্রিস্টপূর্বাব্দ (BC)। এ গণনারীতি অনুযায়ীই কোনও শূন্য বছর নেই, অর্থাৎ যিশুখ্রিস্টের জন্মবছরই হলো খ্রিস্টপূর্ব (BC) বছরের শেষ বছর আর খ্রিস্টাব্দের (AD) প্রথম বছর।
image source: Google
এর পূর্বে যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হত সেটি ছিল ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’। খ্রিস্টপুর্ব ৪৫ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন শুরু করেন। দিনের হিসেবে সামান্য ফারাক থাকলেও মাসের নামগুলো কিন্তু দুটো ক্যালেন্ডারেই এক। তবে এখানে জেনে রাখা ভাল, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এর পুর্বসুরি ‘রোমান ক্যালেন্ডার’-এ মাসের নামগুলো ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এই ক্যালেন্ডারে বছর শুরু হত মার্চ মাস থেকে। এখন যে-যে নামে আমরা মাস চিনি, তার নামকরণ হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সময় থেকেই। এবার এক এক মাসের পেছনের গল্পগুলো জানা যাক।
জানুয়ারি :
‘জানুস রোমান দেবতা’image source: Google
‘জানুস’ নামের একজন রোমান দেবতার নামে এই মাসের নাম রাখা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা জানুস’কে বলা হয় ‘গড অফ ডোরস’। কোনও কিছু শুরু করার দরজা। বিভিন্ন জাদুঘরে এই দেবতার দু’দিকে দুটো মুখবিশিষ্ট মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এমনটা মনে করা হয় যে, ইনি ভূত এবং ভবিষ্যৎ দুটোই দেখতে পেতেন। তাই মনে করা হয় আগের বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরুর দিকে ঘোরানো তার দুই মুখ।
ফেব্রুয়ারি :
ফেব্রুয়া উৎসবে রোমান জনগণ; Image Source: Gente Digital · Información local, nacional e internacional · gentedigital.es
অনেক কাল আগে থেকে পাশ্চাত্যে বসন্তকালের শুরুর দিকে এক ধরনের উৎসব পালন করা হত যার নাম ছিল ‘ফেব্রুয়া’। এই উৎসবে বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট সব পরিষ্কার করা হত। এই শোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের আত্মা এবং মনেরও এক ধরনের শুদ্ধিকরন হত। আর এই উৎসবের নাম থেকেই মাসটির নামকরণ করা হয় ‘ফেব্রুয়ারি’।
মার্চ :
রোমান যুদ্ধদেবতা ‘মার্স’ image source:Google
মার্চ মাসের নামকরণের পেছনে দুটো তত্ত্ব আছে। আর দুটোই গড়ে উঠেছে রোমান যুদ্ধদেবতা ‘মার্স’ কে ঘিরে। এই মাস থেকেই প্রবল ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে বলে এর হিংস্রতা বা প্রচণ্ডতাকে তুলনা করা হত ‘মার্স’ এর সাথে। আবার আরেক মত অনুসারে, আগে মার্চ মাস দিয়ে শুরু হত রোমানদের বছর। তাই এই সময়ে সব যুদ্ধের অবসান ঘটত। সেই সুত্র ধরে যুদ্ধদেবতা মার্সের নামানুসারে নামকরণ করা হয় মাসটির।
এপ্রিল :
রোমান দেবী অ্যাফ্রোদিতি;image source: Google
এই মাসের নামকরণ নিয়েও আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ কেউ মনে করেন ‘দ্বিতীয়’ কথাটির লাতিন শব্দ থেকে এসেছে নামটি। আবার অনেকে মনে করেন লাতিন শব্দ ‘আপেরিরে’ যার অর্থ খোলা বা ফোটা, এর থেকে এসেছে নামটি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় এপ্রিল মাসে সবকিছু নতুন করে ফোটে। প্রকৃতি সাজে এক নতুন রূপে আর সেই বিচারেই এর নামকরণ। আরেক মতে এই নামকরণের পেছনে আছেন রোমান দেবী ‘অ্যাফ্রোদিতি’।
মে :
দেবতা অ্যাটলাসের মেয়ে দেবী মেইয়া; image source: Google
রোমানদের এক দেবী ছিলেন। তার নাম ছিল ‘মেইয়া’। তিনি দেবতা অ্যাটলাসের মেয়ে এবং মারকিউর তার ছেলে। কথিত আছে এই দেবীই ছিলেন সমস্ত শস্যের রক্ষাকর্ত্রী। তাই এই শস্য ফলনের মাসটিকে তার নামে উৎসর্গ করা হয়।
জুন :
বিয়ের দেবী জুনো;
রোমানদের সবচেয়ে বড় দেবতা ‘জুপিটারের’ স্ত্রী ‘জুনো’। রোমানদের মতে তিনি বিয়ের দেবী। আর প্রাচীনকাল থেকেই এই মাসে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। সেই বিবেচনায় মনে করা হয়, দেবী জুনোর নাম থেকেই এই মাসের নামকরণ করা হয়।
জুলাই :
জুলিয়াস সিজার;image source:Google
খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার যে ক্যালেন্ডার এর প্রচলন করেছিলেন তার নাম ছিল ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’। আর এই ক্যালেন্ডার এর প্রবর্তক জুলিয়াস সিজারের নামানুসারেই ‘জুলাই’ মাসের নামকরণ করা হয়।
অগাস্ট :
অগাস্টাস সিজার; image source: Google
এই মাসটি বছরের ষষ্ঠ মাস। পূর্বে এই ষষ্ঠ মাসটিকে ‘সেক্সটিলিয়া’ (লাতিন ভাষায় ছয়) বলা হত। পরবর্তীতে এই নাম পরিবর্তন করা হয় অগাস্ট নামে। জুলিয়াস সিজারের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন অগাস্টাস সিজার। তার পর তিনিই সিংহাসনে বসেছিলেন। মনে করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব অস্টম সাল নাগাদ অগাস্টাসের নাম অনুসারে এই মাসের নাম করা হয় অগাস্ট।
সেপ্টেম্বর :
লাতিন ভাষায় ‘সেপ্টেম’ মানে সাত। সেখান থেকেই এসেছে এই নামটি। গ্রেগরিয়ান এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে এটি নবম মাস হলেও দশমাস বিশিষ্ট রোমান ক্যালেন্ডারে এটি ছিল সপ্তম মাস। অপরিবর্তিত ভাবে সেই নামটিকেই ধরে রাখা হয়েছে পরবর্তী ক্যালেন্ডারগুলোতেও।
অক্টোবর
অক্টোবরের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই যুক্তি খাটে। ল্যাটিনে ‘অক্টো’ মানে বোঝায় আট। রোমান ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস পরবর্তীতে অন্যান্য ক্যালেন্ডার এ হয়ে গেল দশম মাস। কিন্তু উৎস একই বলে অক্টোবর মাসটিই পরবর্তিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নভেম্বর এবং ডিসেম্বর :
নভেম্বর এবং ডিসেম্বর দুটোই এসেছে লাতিন ভাষার নবম ও দশম মাসের নাম থেকে। লাতিন ভাষায় ‘নোভেম’ মানে নয় এবং ‘ডিসেম’ এর অর্থ দশ। কিন্তু লাতিন ভাষার এই দুটো মাসই পরবর্তীতে এগার এবং বারো মাসে রূপান্তরিত হয়। আর এই ডিসেম্বর মাস থেকেই একটি বছরের সমাপ্তি ধরা হয়ে থাকে। পুরনো বছরের জরাজীর্ণতাকে বিদায় দিয়ে নতুন করে নতুন বছরে বাঁচার প্রেরণার সাথে সাথে ডিসেম্বর মাসকে বিদায় দেয়া হয়। আর এই জন্যই ডিসেম্বর মাস খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করা হয়ে থাকে।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মাস গুলো প্রধানত উঠে এসেছে রোমানদের জীবনধারা, দেব-দেবীর প্রতি মান্যতা এবং পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ইংরেজি মাসের নামগুলো এখন আমাদের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও কখনও হয়তো মনের মাঝে উঁকি দিয়েছে কী করে এলো এই মাস গুলো? ভাবতে মাঝে মাঝে অবাকও লাগে কত আগে থেকেই এই দিন মাসের গণনা শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আজকের এই ইংরেজি ক্যালেন্ডার।