| 8 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
ইতিহাস

আর্য জাতির ইতিহাস ও তাদের অবদান ।ফেরদৌস ওয়াজেদ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আর্যদের বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্য জাতি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Aryans’। আর্য সমস্যা ইতিহাসের একটি জটিল সমস্যা।আর্যদের পরিচয় এখনও রহস্যাবৃত।আর্য কারা,তাদের আদি বাসস্থান কোথায়,ভারতীয় উপমহাদেশে কবে তাদের আগমন,প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় তাদের কি অবদান-এই বিষয়গুলি নিয়ে একের পর এক বিতর্ক হয়েছে কিন্তু কোন নিশ্চিত সমাধানসূত্র আজও অধরা।

সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন শ্লোক অনুসারে “সর্বে গত্যর্থাঃ জ্ঞানার্থাঃ প্রাপ্ত্যর্থাশ্চ” – সমূদায় গমনার্থক ধাতু জ্ঞানার্থক ও প্রাপ্ত্যর্থক। সুতরাং, যারা জ্ঞানশীল অথবা যারা (শাস্ত্রসীমায়) গমন করেন কিংবা যারা (শাস্ত্রের পার) প্রাপ্ত হন, তারাই আর্য। যাস্কাচার্যের মতে ‘আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। পিতার অনেক পুত্র থাকা সত্ত্বেও পিতার অনুবর্তী, আজ্ঞা পালনকারী, সদাচারী, আদর্শ পুত্রকেই প্রকৃতপক্ষে পুত্র বলা হয়ে থাকে। সেইরূপ, যদ্যপি মানবমাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র অর্থাৎ ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।সোজা বাংলায় যারা সদ্ববংশজাত তারাই আর্য।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে ভিন্ন মত দেন, তারা বলেন, আর্যগণ প্রথমে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা দলবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো পশু সাথে নিয়ে ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বা প্রদেশে গমন করতেন। পরে সে স্থানের ঘাস পশু খাদ্য হিসেবে নিঃশেষিত হলে তারা পুনরায় অন্য অঞ্চল বা প্রদেশে যেতেন। এভাবে তারা প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতেন বলে আর্য (অর্থাৎ গমনশীল) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আর্যগণ নিরন্তর এরূপ স্থান পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক বিবেচনায় এনে এক স্থানে অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা চালায়। উপায় হিসেবে কৃষিকাজকেই তারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। এজন্যই তারা আর্য (অর্থাৎ কৃষিজীবি) নামে প্রসিদ্ধ হন। শেষোক্ত পক্ষের মতবাদে আর্য শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃষিকর্মকারী।

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ৫১ সুক্তে আর্য এবং দস্যু শব্দ পাওয়া যায়। এখানে বলা হয়েছে-[হে ইন্দ্র! কারা আর্য এবং করা দস্যু তা অবগত হও। কুশযুক্ত যজ্ঞের বিরোধীদের শাসন করে বশীভূত কর।]এক্ষেত্রে যজ্ঞ করতেন যাঁরা তাঁদেরকে আর্য বলা হয়েছে। ঋগ্বেদের কালে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দ), বেদের অনুসারী ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে হয়তো আর্য বলা হয়েছে, অন্যান্য অনার্য জনগোষ্ঠীকে বলা হয়েছে দস্যু।

ধারণা করা হয় যে, একদল মানুষ ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর পূর্বে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ৭৫ হাজার বৎসর আগে এদের একটি দল আরব উপদ্বীপে পৌঁছায়। আর ৬০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা এশিয়া সংলগ্ন ইউরোপে বসতি স্থাপন করে। ৪০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা ইউরোপের রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার বৎসরের দিকে এদের একটি শাখা দানিয়ুব নদীর তীরবর্তী বিশাল তৃণাঞ্চলে বসবাস করা শুরু করে। সে সময়ে এদের মূল পেশা ছিল পশুপালন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আন্তঃগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের সূত্রে এদের একটি দল এই অঞ্চল ত্যাগ করে দার্দেনেলিশ প্রণালী হয়ে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫ হাজার বৎসরের দিকে এরা ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদী পার হয়ে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এদের একটি দল চলে যায় ইউরোপের দিকে, অপর দলটি চলে আসে ইরানের দিকে। আর খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতে প্রবেশ করা শুরু করে। ইরানে যারা থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলা হয় ইন্দো-ইরানীয় আর্য। আর ভারতে যারা প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে বলা হয় বৈদিক আর্য।(আর্যরা ছাড়া ও ইরানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছিল )। ইরান শব্দটি একটা আর্য শব্দ , যার অর্থ “the land of Aryans” and Iranshahr,

ছোটো ছোটো দলে এদের ভারতে প্রবেশের প্রক্রিয়াটি প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত চলেছিল। আর্যদের রচিত ঋগবেদের ভাষার সাথে জেন্দাবেস্তার ভাষার অদ্ভুদ মিল রয়েছে। (জেন্দাবেস্তা হচ্ছে ইরানের প্রাচীন জরুথ্রুষ্টীয় ধর্মের বা, পারসিকদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম। এটিকে অনেক সময় এভেস্তাও বলা হয় যা লেখা হয়েছে এভেস্তিয়ান ভাষায়। এই ভাষাটি বেদের ভাষা সংস্কৃতের মতই)। এ কারণে ধারণা করা হয়, ইরানের প্রাচীন ভাষা এবং আর্যদের ভাষা একই ছিল। হাজার হাজার বৎসর অতিক্রম করে উভয় ভাষা স্বতন্ত্র রূপ লাভ করেছিল। এছাড়া উভয় ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত দেবদেবীদেরও অনেক মিল আছে। জেন্দাভেস্তায় বরুণকে দেবরাজ ও ইন্দ্রকে মন্দ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ঋগবেদে বরুণ জল ও মেঘের দেবতা আর ইন্দ্রকে দেবরাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে কশ্যপ মুণির নামানুসারে কাস্পিয়ান হ্রদের নামকরণ করা হয়েছে। কয়েকজন পশ্চিমা নৃবিজ্ঞানিও এ মতের সমর্থন করেছেন।

আর্যরা ভারতের সিন্ধু নদীর অববাহিকা জুড়ে স্থানীয় দ্রাবিড়দের বিতারিত করে আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল। ঋগ্বেদ থেকে জানা যায় আর্যরা আফগানিস্তান থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই বেদে যমুনা, গঙ্গা নদীর নাম নেই। ঋগ্বেদের আমলে এরা হিমালয় পর্বতমালা সংলগ্ন উত্তরভারতের সাথে পরিচিত হয়েছিল (আর্যদের একটা শাখা তখন নেপালে গিয়ে পৌঁছে )। এই কারণে হিমালয় পর্বতের নাম পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। কিন্তু বিন্ধ্যপর্বতের নাম পাওয়া যায় না। এই বিচারে ধারণা করা যায়, ঋগ্বেদের আমলে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত আর্যরা পৌঁছাতে পারে নি। হিংস্র জীবজন্তুর মধ্যে ঋগ্বেদে বাঘের নাম নেই। কারণ, বাঘের দেখা পাওয়া যায় ভার্তবর্ষের পূর্বাঞ্চলে। সে কারণেই বলা যায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের বঙ্গদেশ থেকে এরা অনেকদূরে ছিল। এই সময় পাঞ্চাব অঞ্চলের সিন্ধুসহ অন্যান্য নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে আর্যরা বসতি স্থাপন করেছিল। ঋগ্বেদ খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ বা ১১০০ অব্দের দিকে রচিত।

এই সময় অনার্য দ্রাবিড়দের সাথে তাদের প্রায়ই সংঘাত হতো। আক্রমণপরায়ণ অনার্যদের এরা নাম দিয়েছিল দস্যু। একসময় আর্যদের ছোটো ছোটো গোষ্ঠী এইসব দস্যুদের দমন করে, ছোটো ছোটো রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। এই দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের ভূমি সন্তান।এ ব্যাপারে শ্রী অমিত কুমার বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, “খৃস্টের জন্মের দেড় বা দুই হাজার বৎসর পূর্বে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে ভারত বর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কাছে আর্য জাতির এক শাখা পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। তাহাদের পূর্বে এদেশে কোল ভিল সাওতাল প্রভৃতি অসভ্য জাতি এবং দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করিত।”এদেশে বহিরাগত আর্যদের আগমনের পর হতেই দ্রাবিড়দের সাথে আর্যদের সংঘাত শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত অব্যাহত থাকে।এক পর্যায়ে তারা ভূমি সন্তান দ্রাবিড়দের উপর বিজয়ী হয়। কালক্রমে দ্রাবিড়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর্যরা রপ্ত করে নেয়। দুই সভ্যতার মিশ্রণে নতুন সাংস্কৃতিক ধারা এবং ধর্মীয় অনুভবের সূচনা হয়। এ সময় আর্যরা যে ধর্মমত প্রচার করে তাই বৈদিক ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম। ওদিকে পরাজিত দ্রাবিড়রা বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় অথবা আর্যদের অধীনে লাঞ্ছিত হতে থাকে। আর্যরা পরাজিত দ্রাবিড়দের ওপর তাদের নির্দেশনা চাপিয়ে দেয়। আর্যদের প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ প্রথার সর্বনিম্ন স্তরে দ্রাবিড়দের স্থান দেয়া হয়। পিরামিডের শীর্ষে স্থান নেয় আর্যরা। সর্ব নিম্নে অবস্থান হয় দ্রাবিড়দের। পিরামিডের স্তর বিন্যাস হয় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ দিয়ে। পুরো পিরামিডের ভার বহন করতে হয়- দ্রাবিড়দের। পর্যায়ক্রমে দ্রাবিড়রা আর্যদের বিন্যস্ত সমাজে হারিয়ে যায়।

রুশ ঐতিহাসিক এ জেড ম্যানফ্রেডের মতে, সে যুগে ব্রাহ্মণদের কোন কর দিতে হত না। ক্ষত্রিয় শুদ্র প্রভৃতি জাতিকে ছোট লোক শ্রেণীর ধরা হত। নব্বই বছরের বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়কে নয় বছরের ব্রাহ্মণের পদ সেবা করতে হতো। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির কাছে তাদের উৎপাদনের ৫ অথবা ৬ ভাগের এক ভাগ কর আদায় করা হত। নর হত্যা করলে শিরশ্ছেদ হতো বটে কিন্তু কোন ব্রাহ্মণ যদি শুদ্রকে হত্যা করতো তাহলে শুধু মাত্র সামান্য জরিমানা দিলেই চলতো। যেমন পোষা কুকুর মেরে ফেলার শাস্তিস্বরূপ কিছু জরিমানা হয়।শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষকে ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। অন্ধকারের পর যেমন আলো দেখা যায়, গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে অনুরূপ নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সম্বলিত সমাজে নির্যাতন বিরোধী প্রতিরোধ শক্তির অভ্যুদয় হয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ধারক ব্রাহ্মণ্য সমাজে জন্ম নেয় গৌতম বুদ্ধ। রাজকীয় সুখ সাচ্ছন্দ এবং প্রভুত্বের ব্যঞ্জনা তাকে আটকে রাখতে পারল না। যুগ যুগান্তর ব্যাপী দক্ষিণ এশিয়ায় মানবতার লাঞ্ছনা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যকার পুঞ্জিভূত দুঃখ ক্লেশ অসম্মান ও অবমাননা তার মধ্যে ভাবান্তরের সূচনা করে। তিনি রাজকীয় সুখ সম্ভোগের মোহ পরিত্যাগ করে দেশান্তরিত হন এবং প্রচলিত নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন কোন ব্যবস্থার ছক অর্জন না হওয়া পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে চিন্তার গভীরে ডুব দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন নতুন ব্যবস্থার সূত্রসমূহের আবিষ্কার তার সন্তুষ্টির সীমায় এসে পড়ে তখন তিনি তার মত প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সমকালীন ঘুণে ধরা বির্তনমূলক সমাজ কাঠামোর বিপরীতে তার নতুন চিন্তা শোষিত বঞ্চিত নির্যাতীত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবতর এক বিপ্লবের বার্তা হয়ে অনুরণিত হতে থাকে।

পর্যায়ক্রমে বৌদ্ধবাদ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে শোষণ ও বিবর্তনমূলক সমাজ কাঠামোর ধারক কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি তাদের প্রভুত্ব হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মানবিক বিপ্লব প্রতিহত করার জন্য বৌদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। বৌদ্ধদের ধর্মবিরোধী নাস্তিক এবং বিদ্রোহী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বৌদ্ধ বিরোধী উম্মাদনা সৃষ্টি করে বৌদ্ধদের উৎখাতে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা।ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে। মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বা জজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন…‘… এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়।


আরো পড়ুন: ভারতের টেরাকোটা শিল্প

দ্রাবিড় অধ্যুষিত সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারত আর্যদের দখলে চলে যাওয়ার পর এই যাযাবরদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ দ্রাবিড় দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর্যরা তাদের দখল বাড়াতে আরো পুবদিকে অগ্রসর হয়। সামরিক বিজয়ের সাথে সাথে বৈদিক আর্যরা তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির বিজয় অর্জনেও সকল শক্তি নিয়োগ করে। প্রায় সম্পূর্ণ উত্তর ভারত আর্যদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু স্বাধীন মনোভাব ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ায়। ফলে করতোয়ার তীর পর্যন্ত এসে আর্যদের সামরিক অভিযান থমকে দাঁড়ায়।আমাদের সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের এই প্রতিরোধ-যুদ্ধ সম্পর্কে অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু লিখেনঃ“প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল”। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, “আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই”। (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ২১)।

বাংলায় বঙ্গবাসী ও আশ্রয়গ্রহণকারী দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের ফলে দীর্ঘ দিন আর্য-প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এরপর খ্রিস্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্ত শাসনে আর্য ধর্ম, আর্য ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে শিকড় গাড়ে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্য বৈদিক হিন্দু ধর্মের কিছুই প্রসার হয়নি।আর্যরা বাংলা জয়ের জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। প্রতিবারই তারা পরাজিত হয় গাঙ্গেয় বদ্বীপের বীর জাতির কাছে। যে কারণে আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদে বাঙালি জাতি সম্পর্কে রয়েছে নানা ধরনের অবজ্ঞাপ্রসূত উক্তি। পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম গ্রন্থে এমন জঘন্য ভাষা ব্যবহার করা হয় নাই কোনো সুসভ্য জাতির বিরুদ্ধে।পরবর্তীতে “উত্তর-পূর্ববাংলায় ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে ওঠে। পঞ্চম ও অষ্টম শতকের মধ্যে ব্যক্তি ও জায়গার সংস্কৃতি নাম পাওয়া যায়। তা থেকে ড. নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন যে, তখন বাংলার আর্যয়করণ দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বাঙালি সমাজ উত্তর ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল। অযোধ্যাবাসী ভিণ প্রদেশী ব্রাহ্মণ, শর্মা বা স্বামী, বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট, গাঙি নামে ব্রাহ্মণেরা জেঁকে বসেছিল।“বাংলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা এসে স্থায়ী বাসিন্দা হতে লাগলেন, এরা কেউ ঋগ্বেদীয়, কেউ বাজসনেয়ী, কেউ শাখাব্যয়ী, যাজুর্বেদীয়, কেউ বা সামবেদীয়, কারও গোত্র কান্ব বা ভার্গব বা কাশ্বপ, কারও ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য বা বাৎসা বা কৌন্ডিন্য। এমনি করে ষষ্ঠ শতকে আর্যদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্বতম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল”। (ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ঃ বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃষ্ঠা ১৩২)

বর্তমানে ভারতবর্ষে আর্য নামে কোনো পৃথক নৃগোষ্ঠী নেই। কিন্তু ধর্ম ভাষাসহ আর্যদের সাংস্কৃতিক নানা উপাদান ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যামান রয়েছে।

তথ্যসূত্র:

বাংলায় আর্য আগমন | অনুশীলন | 

আর্য ও হিন্দু

বাংলায় আর্য-ব্রাহ্মণ্যের আগমন ও প্রভাবের ইতিহাস – পর্ব ১ | সংশয় – চিন্তার মুক্তির আন্দোলন

ভারত থেকে বৌদ্ধ উৎখাতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র। ইতিহাস কি মিথ্যাবাদী?

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত