| 1 মে 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গর্বের রঙ যেখানে লাল হলুদ । মৈনাক দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার পরবর্তী’তে দেশভাগ বাঙালি  হিন্দু শরনার্থী মানুষগুলোর কাছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব হয়ে উঠেছিল একমাত্র আশ্রয়, একমাত্র অবলম্বন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু’রা প্রথম থেকেই অবজ্ঞা করে  ইস্টবেঙ্গল ক্লাব’কে ‘বাঙালদের  ক্লাব’ বলত। যদিও দেশভাগ হওয়ার প্রায় ২৭ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম। এরও এক ঘাত  প্রত্যাঘাতের ইতিহাস রয়েছে।

আমরা  অনেকেই হয়ত জানি না, ১৯১১ সালের মোহনবাগন ক্লাবের আইএফএ শিল্ড জয়ে’র কৃতিত্বে’র পেছনে যে  এগারো জন ফুটবলার ছিলেন, তারমধ্যে অনেকই ছিলেন পূর্ববঙ্গীয়। এরপর মোহনবাগনের কিংবদন্তী ফুটবলার গোষ্ঠ পালও ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ।  সে সময় ঢাকা ছাড়াও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু কৃতি ফুটবলার-  ফুটবলের প্রসারতা বৃদ্ধি’র সাথে সাথে কলকাতায় সুযোগ ও স্বীকৃতি লাভের আশায় খেলতে আসতেন। সেখানে তাদের যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও  পূর্ব বঙ্গের  খেলোয়াড় বলে এখানে অবিচার ও বঞ্চনার শিকার হতে হত প্রায়শই। তাদের এখানকার  দলগুলোতে নিয়মিত খেলতে দেওয়া হত না। আবার, কোনরকমে সেই দলগুলোতে সুযোগ পেলে নানা’ন অজুহাতে তাদের খেলায় বসিয়ে রাখা হত। এমনই এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে জন্ম হয় আজকে’র ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের।  এই রকম এক প্রতিভাধর খেলোয়াড় শৈলেশ বসু, ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার মালখাননগর থেকে কলকাতায় খেলা শুরু করলেন। ক্লাবটির নাম ছিল জোড়াবাগান ক্লাব। তবে, অধিকাংশ খেলাতে’ই তাকে বসিয়ে রাখা হত।  সে সময় ওই ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার নাগপুরের জমিদার সুরেশ চৌধুরী। ১৯২০ সালের ২৮ শে জুলাই  কোচবিহার কাপের ফাইনালে মোহনবাগান আর জোড়াবাগান ক্লাব মুখোমুখি।  জোড়াবাগান ক্লাবের পক্ষ থেকে ওই খেলায় ও নামানো হল না শৈলেশ বসুকে এবং নসা সেন’কে। আর এরা দুজনেই ছিলেন বাঙাল। অবশেষে, খেলা জেতে মোহনবাগান। এরপর একদল কর্মকর্তা এই দুই বাঙাল খেলোয়াড়কে দায়ী ও দোষারোপ করতে থাকেন।  আর এটা হয়েছিল শুধুমাত্র এদেশীও ক্লাব কর্তা ব্যাক্তিদে’র বাঙালদে’র প্রতি বিদ্বেষ থেকে। বলা হয় শৈলেশবাবুকে না খেলানোর পিছনে হাত ছিল মোহনবাগন ক্লাবের।  যদি, সেদিন জোড়াবাগান জিত’ত তাহলে হয়ত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে’র জন্ম হত না কোনদিন। তবে, ইতিহাস হয়ত এমনটাই লিখতে চেয়েছিল। সম্ভবত, দুই খেলোয়াড়ের অপমান সুরেশ বাবু (সুরেশ চৌধুরী)  মেনে নিতে পারেন নি। জোড়াবাগান ক্লাব কর্তাদের সাথে বিবাদ করে  সুরেশবাবু  সভাপতির পদ  ত্যাগ করেন ও ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।  এই ঘটনার ঠিক পরেই পূর্ববঙ্গের খেলোয়াড়-  ফুটবল প্রেমীদের মধ্যে এক তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। বলতে গেলে জোড়াবাগানের ঘটনা অবশ্যই  বাঙালদে’র কাছে আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার সমান ছিল। যারফলে, সুরেশ চৌধুরী ও তার মতন ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের কাছে  ক্লাব পত্তন’টা আত্মমর্যাদার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই সেদিন -পূর্ববঙ্গের সকল ক্রিড়াপ্রেমী ও খেলোয়াড়রা একযোট দাঁড়িয়েছিল তাদের পাশে।


আরো পড়ুন: ফুটবল খেলার ইতিহাস


সুরেশবাবু,  শৈলেশ বসু ও নসা সেনকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাব তৈরীতে ব্যস্ত হলেন। এরপর শৈলেশ বাবুর প্রস্তাবে ক্লাবের নাম ঠিক হল ইস্টবেঙ্গল। দিনটা ছিল সম্ভবত পয়লা অগস্ট ১৯২০।  সুরেশ বাবুর ভাবনায় প্রথম থেকেই ছিল পূর্ববঙ্গের সব খেলোয়াড় দের এক জায়গায় নিয়ে আসবেন। আর সে সময় পূর্ববঙ্গের একধিক খেলোয়াড় মোহনবাগান, এরিয়েন্স, জোড়াবাগানে  কুমারটুলী টাউনে খেলত। কুমারটুলী পার্কে ছোটদের একটা ক্লাব ছিল নাম ছিল ক্যালকাটা ইউনিয়ন আর তাকে কেন্দ্র করেই ইস্টবেঙ্গলকে এক বড় দল গড়ে তোলবার প্রয়াস শুরু করেন। সে সময় কুমারটুলির বাসিন্দা ভাগ্যকুলের রায়বাহাদুর ও কলকাতা হাইকোর্টের সলিসিটার তড়িৎভূষণ রায়ের মতন প্রভাশালী ধনি ব্যাক্তি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তার বাড়িতেই ক্লাবের প্রথম সভা বসে। এরপর মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ খেলাধুলো জগতের দিকপাল ব্যক্তিত্ব সারদারঞ্জন রায় ক্লাবের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। এরও অনেক পরে যদিও খেলার মাঠে ক্লাবের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন  কলকাতা প্রথম বিভাগের লীগ মোহন বাগন ও এরিয়ানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সুরেশবাবু ই লাল-হলুদ জার্সি পছন্দ করে  নিয়ে আসেন । কলকাতার শ্যামপার্কে সিক্স এ সাইড প্রতিযোগিতায় ইস্টবেঙ্গল এ ও বি  দল নামে দুটি দল অংশগ্রহণ করে। দুর্দান্ত খেলে ইস্টবেঙ্গল এ দল। এরপর ফাইনালে প্রচুর দর্শকদের মাঝে সৈনিক দল ডি.সি.এল.আই কে হারিয়ে জয়ী হয়।  দর্শক টানবার ক্ষেত্রে দলের নাম যে একটা বড় ভুমিকা নিয়েছিল তা অনিস্বীকার্য।

১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম আর সেবছরই হারকিউলিস কাপ জেতে ইস্টবেঙ্গল৷ এর ঠিক পরের বছর ১৯২১ সালে  শচীন শিল্ড ফাইনালে এরিয়ানকে ৫-০ হারিয়ে কাপ জেতে ইস্টবেঙ্গল। ১৯২৪ সালে মোহনবাগন কে ১-০ পরাজিত করে কোচবিহার কাপ জেতে ইস্টবেঙ্গল। এছাড়াও ১৯৪২, ১৯৪৩, ১৯৪৫, ১৯৬০ এ কোচবিহার কাপ। ১৯৪২ গিরিজা শিল্ড জেতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। ১৯৬০, ১৯৬৬, ১৯৭৫, ১৯৭৬ ট্রেডস কাপ জেতে যা স্মরণীয়। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ডার্বির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ফিফার রেকর্ড  অনুযায়ী  বলতে গেলে দুই ক্লাবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ৯৫ বছরের পুরোনো। কলকাতা লীগের প্রথম ম্যাচটি খেলা হয় ১৯২৫ সালে। সেখানে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগনকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয়।  সেই ম্যাচে নেপাল চক্রবর্তী জয়সূচক গোল করেন। এখন পর্যন্ত ৩৩৮ ডার্বি ম্যাচ খেলা হয়েছে  যা অবশ্যই ইতিহাস সৃষ্টিকারী এবং যাতে ইস্টবেঙ্গল ১২৩ ম্যাচে জিতেছে। মোহন বাগান ১০৩ টা ম্যাচে জিতেছে। ১১২ টা ডার্বি ম্যাচ  অমিমাংশিত।  ১৯৭৫ এ আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখানে ইস্টবেঙ্গল ৫- ০ গোলে মোহনবাগান কে পরাজিত করে।  এত বড় ব্যবধানে জয় কোন দলের নেই । এই খেলায় গোল করেন – প্রথমার্ধে সুরজিত সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয়ার্ধে শ্যাম থাপা আবার একটি গোল করেন এবং ম্যাচের শেষ গোলটি করেন শুভংঙ্কর সান্যাল। ইতিহাস হয়ত অনেক কিছুই সাক্ষী রেখেছে বা রাখেনি, তবে দেশভাগের পর থেকে ছিন্নমূল শরনার্থী মানুষগুলো ইস্টবেঙ্গল নামটার সাথে ধীরে ধীরে তাদের নাড়ির টান অনুভব করতে শুরু করেন। এরপর সেইসকল মানুষগুলোর কাছে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। সময়ের সাথে নানা বাধা -বিপর্যয় অতিক্রম করে গোটা দেশ ও সমাজব্যবস্থা’র সাথে এভাবেই জড়িয়ে গেছে ইস্টবেঙ্গল’র দীর্ঘ ইতিহাস।

 

 

 

 

 

 

 

তথ্য সংগ্রহ 

‘এই সময়’ সংবাদপত্র,

বঙ্গদর্শন নিউজ পোর্টাল

bengali.indianexpress.Com

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত