ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব ৩৮)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধায়
ভ্রমণের বাতানুকূল ব্যবস্থা অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছে। এখন তা পুরোদমে চালু। গরমে ভ্রমণের কথা কেউ ভাবতেও পারেনা। আগে মানুষের আর্থিক ক্ষমতা হয়ত ততটা ছিল না। এত আরামদায়ক সুব্যবস্থাও ছিল সবদিক দিয়েই নাগালের বাইরে। তাই যেটুকু পেত তাতেই খুশি। অনেক না পাওয়া পুষিয়ে যেত অন্য পাওয়া দিয়ে।
এখন ভাবাই যায়না, প্রচন্ড গরমে ট্রেনের জানলায় ভিজে গামছা লাগিয়ে হাসিমুখে সবাই মিলে গল্পগুজব করবে।এসব এখন অলীক কথা।বাতানুকূল কামরাতেও মোবাইলে মগ্ন থাকার ছবিই বরং নিত্যপরিচিত ।জানলার বাইরের ছুটন্ত পৃথিবীর রূপ, রস, রঙ বা সহযাত্রীর আলাপচারিতা আর টানেনা তাদের।ডিজিটাল জগতের ভ্রমণ অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে দিন দিন বড় মোহময় হয়ে উঠছে।ওই স্বপ্ন ভ্রমণের আকর্ষণ কাটিয়ে ওঠা তত সহজকর্ম নয়।
আর একটা অন্যরকম চটজলদি ভ্রমণের কথা নাহয় বলা যাক।যাতে ভ্রমণের গন্ধ মিশে আছে, অথচ যা শুধুই ভ্রমণ নয়। আমি পিকনিকের কথা বলছি।সেই বনভোজন নয় যা বাড়ির পাশে যেকোন ফাঁকা পুকুরধারে,বা গোলাপের বাগানে, ক্ষেতে খামারে আকচার করা হয়।এই বনভোজন করা হয়েছিল অনেক দূরে, অফিসের ট্রাকে চেপে পাড়ি দিয়েছিলাম অনেক দূরের পথ।
আমরা সবে গিয়েছি তখন গৌহাটি-তে।এয়ারপোর্টের কলোনীর কোয়ার্টারে থাকি আর সকাল আটটায় অফিসের ট্রাকে চেপে যাই টাউনে মানে গৌহাটি শহরে আমাদের বেঙ্গলী গার্লস স্কুলে, পড়াশুনা করতে।শোনা গেল ওই ট্রাকে চেপেই নাকি যাওয়া হবে পিকনিক করতে পাহাড়ের একটা স্পটে।তার নাম ‘অন্ত্রু’।সেখানে একটা কী সরকারী জল সংক্রান্ত প্রকল্প ছিল,যার নাম আজ আর মনে নেই।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব ৩৭)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধায়
তখনকার দিনে পঁচিশ টাকা নেহাত কম ছিল না।পুরো পরিবারের জন্য ওই অর্থমূল্য ধরে দিয়ে মাবাবা আমাদের তিন বোন আর একমাত্র ভাইকে, পিকনিকে নিয়ে গেলেন।
গৌহাটি শহর পাহাড়ে ঘেরা।সকালে দাঁতে মাজন লাগিয়ে আমরা পাহাড় দেখি।আবার রাতে ঘুমোবার আগে পাহাড় দর্শন নয়, পাহাড় অনুভব করে ঘুমোতে যাই।অনুভব কথার মানে হল রাতের ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে পাহাড় দেখা যায় না।পাহাড়ের গায়ে জ্বলা অজস্র আলোর ফুটকি নজরে আসে। মাঝে মাঝে আগুন ধরে গেলে পাহাড়ের গায়ে দীর্ঘ রাত ধরে জ্বলে্ ।এছাড়া স্কুলে যাওয়ার পথে পাহাড়কে ‘গুডমর্নিং’ বলি প্রতিদিন।
তাই পাহাড় শুনে প্রথমেই নেচে উঠেছিলাম।সে যাই হোক ট্রাকের থেকে দেখা পাহাড় আর ওই পাহাড় তো এক নয়।পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে , ওরকম ভয়াল সুন্দরের সাক্ষ্যাৎ পাব ভাবিনি।
খুব একটা বেশি পরিবার যায়নি।আসলে ওই পাহাড়ি পথে যাবার সাহস সবার হবেনা, বা সবার সামর্থ্যেও কুলোবে না।ট্রাক দুর্গম পাহাড়ি পথে চলেছে তো চলেছেই।কিছু মানুষ বমি করে ভাসাচ্ছেন।আমরা চার ভাই বোনে খেলায় মত্ত।হঠাৎ নজরে এলো অনেকেই ওই পাহাড়ে ঠিক গা ভাসাতে চা্যনি ।আমাদের স্কুলের মাত্র একজন উপস্থিত।
ঝর্ণার জল খেলে খিদে বাড়ে জানতাম ,তাছাড়া বড়দের আইটেম টেবিলে সাজানো থাকলে ইচ্ছে না থাকলেও খাওয়া হয় ঠিক।আমাদের বাবা ছাত্রছাত্রীদের মত আমাদের প্রকৃতিপাঠ পড়াতে বসে গেলেন।যত বলি স্থান মাহাত্ম্যের কথা।ওনার কানে ঢোকেনা।
‘অন্ত্রু’ আবার কবে যেতে পারব জানিনা।ট্রাকেই আমাদের টিফিন দেওয়া হয়েছিল।কফির কথা মনে আছে।আর মনে আছে ওই গভীর বনে, অত কাছ থেকে ঝর্ণা দেখার কথা।ভেবেছিলাম, ঝর্ণার ধারে ছবি তুলে লাভ কী? যা করার করি,গোছের ভাবনা নিয়ে তাই যত খুশি পা বাড়িয়েছি তখন।
আমরা পাথর ডিঙোই, জল পেরিয়ে অন্য পারে যাই।আমাদের ছোটাছুটি করার আনন্দ ভরপুর থাকে। বড়রা মাইক বাজান। গানের তালে শরীর দোলান।সবশেষে সবাই মাটিতে বসে খাওয়া দাওয়া করা হয়।সন্ধে হয়ে আসছে,পাহাড়ি পথে ফিরতে হবে।পথ ও নেহাত কম নয়।ফেরার সময় আমরা ঘুমোতে ঘুমোতে ফিরি।বাড়িতে ঢুকে হাত পা ধুয়ে বিছানায় ঢুকে যাই।পরেরদিন মার ব্যাগ থেকে পিকনিকে প্রাপ্ত ইয়া বড় কমলালেবু বার করে খাওয়া হয়।পিকনিকে ভরপুর আগের দিনটির জন্য তখন শোক চলছে মনে মনে।
ওই পিকনিক সারা জীবন মনে থেকে যাবে।পাহাড়,ঝর্ণা,নীল আকাশ ,আর কিছু অসমবয়সী মানুষকে নিয়ে তৈরি ওই পিকনিকের চিত্রনাট্য একেবারেই আলাদা ছিল যে!

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।