| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: মল্লিকাবনে । তুষ্টি ভট্টাচার্য 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

  

    ডঃ মজুমদারের চেম্বারে আজ খুব ভিড় দেখে একটু থমকে গেলেন মল্লিকা। যদিও তিনদিন আগে এগারো নম্বরে নাম লিখিয়েছেন তিনি নিজে। ভিড় দেখে চিন্তা একটাই, আজ হয়ত ডঃ মজুমদার বেশি কথা বলতে পারবেন না। মনে মনে খুব বিরক্ত হলেন। রাগ দেখাতেই যেন মায়ার হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। ‘সবসময়ে হাত ধরে থাকিস কেন? আমি কি হ্যান্ডিক্যাপড?’ হাতের স্টিকে অনাবশ্যক জোর দিয়ে একটু তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললেন মল্লিকা। 

   দশ নম্বর রোগী ঢুকেছে, এবার তাঁর পালা। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলেন চেয়ারে বসে। শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করলেন, ব্লাউজের পিঠ টেনে নামালেন, চুলে হাত বুলিয়ে নিলেন একটু। আজ তাঁর পরনে বেজ কালারের শিফন, গাঢ় খয়েরি রঙের ব্লাউজ। কানে হিরের কুচি, গলায় একটা ফিনফিনে সোনার চেন বারোমাস থাকে তাঁর। দুলটা চেঞ্জ করেছেন। তাঁর নুনমরিচ বয়েজ কাট চুলের জন্য কানের হিরে মাথা ঘোরালেই ঝিলিক দিয়ে উঠছে থেকে থেকে। হাতে দুটি সলিড সোনার চুরি যেমন পরে থাকেন, তেমনিই আছে, সঙ্গে একটা সরু ব্রেসলেট পরেছেন। আঙুলে অবশ্য তাঁর পুরনো আমলের বিয়ের আংটি এখনও চেপে বসে আছে। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে স্বাভাবিক বলিরেখা বা বার্ধক্যের লেশ তাঁর শরীর মুখ জুড়ে রইলেও, তাঁর দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না এখনও। গ্রেসফুল-এই শব্দটি তাঁর সঙ্গে একেবারে মানানসই। 

    ডঃ মজুমদার কি মুখিয়ে ছিলেন? নইলে মল্লিকা দরজা ঠেলে ভেতরে আসার সময়ে একমুখ হাসি নিয়ে অভ্যর্থনা করবেন কেন? ভালো লাগায় মন ভরে উঠল মল্লিকার। ডঃ সেই পরিচিত বিদেশী হাল্কা পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছেন। দরজা থেকে চেয়ারে আসাটুকুর সময়ে যেন এই চেম্বার, তার চেয়ার, টেবিল সবাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠল মল্লিকাকে দেখে। মুখোমুখি বসলেন দুজনে। মল্লিকার পাতলা ন্যাচারাল শেডের লিপস্টিকের দিকে চোখ গেল মজুমদারের। এই বয়সেও কোনো নারীর ঠোঁটে এত লাস্য থাকে! পুরুষের মুগ্ধতার পাঠ নিচ্ছেন মল্লিকা এত বছর ধরে। ফলে মজুমদারের দৃষ্টি তাঁর চোখ এড়ালো না। মনের ভেতরটায় কিশোরী মেয়ের মতো সলজ্জ ভালোলাগার অনুভূতি চেপে বসল। তাঁকে আরও অবাক করে মজুমদার বলে উঠলেন-

‘আপনি কেমন আছেন এখন? তবে যাই বলুন, আগের থেকে আরও সুন্দর হয়েছেন, বয়স কমে যাচ্ছে আপনার। প্রেমে পড়লেন নাকি আবার?’   

‘কী যে বলেন ডাক্তার! ভালো নেই আমি। সারারাত ঘুম আসে না। আর সেই বিরক্তিকর ইচিং! ওফ! হরিবল্‌! আপনি কিছু একটা ব্যবস্থা করুন এবার’।  

মল্লিকা এরপর তাঁর অসুখের বিবরণ দিয়ে যাবেন। ডাক্তার মন দিয়ে শুনবেন। তারপর ওঁকে পরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে প্রেসক্রিপশন লিখতে বসবেন। লেখার আগে অবশ্য বলবেন-

‘শুনুন, আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আপনার স্কিনে কোনো সমস্যা নেই। চুলকুনির অনুভূতি মানসিক। কিছু ভালো সাবান, ময়শ্চারাইজার লিখে দিলাম, এগুলো মাখুন। আর অল্প কিছু ওষুধ দিলাম, এতেই কাজ হবে। সেরে যাবেন। আর আসতে হবে না এইজন্য আপনাকে’। 

মল্লিকার মুখ থেকে যেন রক্ত সরে গেল। ফ্যাকাসে মুখে জানতে চাইলেন, ‘আর আসতে হবে না বলছেন? কিন্তু রাতে ঘুম না এলে? সারা গা চুলকলে?’

‘বয়স হলে এরকম একটু আধটু হয়, আপনি বরং মন ভালো রাখার জন্য ক্রিয়েটিভ কিছু কাজে মন দিন’। 

মিষ্টি একটা শ্রাগ করলেন উনি। তারপর বললেন, ‘মার্গারেট মিচেল হলে লোনলিলেস কাটাতে একটা ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ লিখে ফেলতাম, কিন্তু তা যখন নই…’

কথা শেষ হল না মল্লিকার, বাইরের মেয়েটি তেরো নম্বরের নাম ধরে চিৎকার করছে ইচ্ছে করেই। অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে, মায়াও হাত ধরে টানল মল্লিকার। ‘চল দিদিমণি, দেরি হয়ে যাচ্ছে…’

   ডাক্তার আরও একবার হেসে মল্লিকাকে বললেন, ‘তাহলে নাহয় আরও একটু রূপচর্চা করুন, আরও সুন্দরী হয়ে উঠুন’। রোগীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে ডাক্তার ভাবলেন, এই তুচ্ছ মিথ্যেগুলো যদি একজনকে বাঁচার শক্তি জোগায়, ক্ষতি কী? 

    মল্লিকা কিছু জানানোর অবসর পেলেন না। বাড়ি ফিরে নিজেকে চনমনে অনুভব করলেন। আজ যেন শরীরে কোনো অস্বস্তি নেই, রিপ্লেসড্‌ নি দুটো নতুন যৌবন পেয়েছে। কোমরের ব্যথাও আর নেই মনে হচ্ছে। কী আশ্চর্য না? ডঃ মজুমদার জাদু জানেন। গুনগুন করে একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে স্নানে গেলেন মল্লিকা। মায়াকে আজ ভেতরে আসতে বারণ করলেন। মায়া স্থিমিত মুখে টয়লেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। ‘ঠিক আছে, কিন্তু দরজায় ছিটকিনি লাগিও না’। 

   সশব্দে ছিটকিনি তুলে দিলেন মল্লিকা। আজ তাঁর একা হওয়ার দিন। নিজেকে ফিরে পাওয়ার দিন। আয়নায় নিজেকে দেখলেন বারবার। এই কি সেই মল্লিকা? কলেজ, ইউনিভার্সিটির অনন্যা তিনি, কী রূপে, কী গুণে। পড়াশোনায় কোনো ফাঁকি ছিল না তাঁদের সময়ে। এখনকার মতো অল্প জেনে পণ্ডিতি করা অধ্যাপকগুলোর কান মুলে দিতে ইচ্ছে হয়। কী ভুলভাল বিশ্লেষণ! আর তিনি যখন পড়াতেন, ক্লাসে নীরবতার স্রোত বয়ে যেত। দুষ্টু বাচ্চাগুলোও মুগ্ধ হয়ে তাঁর লেকচার শুনত। বাইরে থেকে শুনতে আসত কতজন…আহ! কী সব সময় কাটিয়েছেন। দরজায় ধাক্কা শুনে রোব জড়িয়ে বেরলেন। মায়া গজগজ করছে, এতক্ষণ জল ঢাললে, আবার না ঠাণ্ডা লাগে! কথা শোন না!’ 

‘শোন, আজ তোরা আমায় মুখ ঝামটা দিচ্ছিস! আর একদিন আমার ব্যক্তিত্বের ভয়ে করিডর দিয়ে গেলে সবাই চুপ করে সরে দাঁড়াত। সেই আমাকে তোরা মুখ করিস!’ 

    দুপুরে বেশ গুছিয়ে খেলেন মল্লিকা। ইজি চেয়ারে এলিয়ে ভাবছিলেন, ওই কাটলারি, ক্রিস্টালের গ্লাসগুলো আর কাজেই লাগে না। না পার্টি, না আমন্ত্রিত। আর আমাদের সেই অফুরন্ত এনার্জির লেডিস ক্লাব! সে কি ভোলার? ছোট ট্রিপে যাওয়া থেকে রেগুলার আড্ডা, হুল্লোড়। বাবান তখন কত বড়? পনেরো বছরের দুর্বিনীত কিশোর সে। কোনো এক ঘটনায় ক্ষেপে গিয়ে আমার দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ‘তুমি মা? নিজেরটুকু ছাড়া কিচ্ছু বোঝ না। কোনোদিন আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছ? এত যে কলেজে লেকচার দাও, নিজের ছেলের পড়ার দিকে নজর দিয়েছ? তবু বাবা মাঝেমাঝে এসে বসে কাছে। ঠিক ওইটুকু হলেই আমার চলে যেত’। মনে আছে থরথর করে কাঁপছিল ও, চোখে দিয়ে জল নাকি আগুন ঠিকরে বেরচ্ছিল ওর। আমি জড়িয়ে ধরতে গেলে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল… 

‘উহ!’ কঁকিয়ে উঠলেন মল্লিকা। কনুইয়ের সেই চোট এখনও ব্যথা দেয়। বাবান স্টেটস থেকে লাস্ট কবে যেন ফোন করেছিল? হ্যাঁ একমাস তেরো দিন আগে। আমি কাউন্ট করি রোজ। আমি মা। ছেলেকে ভুলতে পারি?    

    ধীরে ধীরে মল্লিকা ছেলের ঘরে গেলেন, ফোটো স্ট্যান্ডের ছবিতে হাত বোলালেন একটু। এই ছবিটা ওর বিয়ের আগে, মলিদির বাড়িতে তোলা হয়েছিল। আর এই ছবিটা ওদের বিয়ের ছবি, এটা আরুশিকে কোলে নিয়ে ওরা তিনজন। কবে কখন, সব, সব আমার মনে থাকে। আমি ভুলি না রে বাবান। 

   সাতদিনের মাথায় ব্যথা, যন্ত্রণা, চুলকুনি বাড়তে থাকল মল্লিকার। সারারাত ঘুমোন না। মায়াকে মাঝরাতে ডেকে বললেন, ‘শোন, কাল আবার একবার যাব ডঃ মজুমদারের কাছে। এতদিন বেশ ছিলাম। আমি সারাদিন কিছু খেতেও পারছি না। তোরা কি চাস, আমি মরে যাই?’ ঘুম জড়ানো গলায় মায়া উত্তর দিল, ‘আহা, বালাই ষাঠ! কাল আমি নাম লিখিয়ে দেব’।  

     সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়া দেখল, আলমারি খুলে বিছানায় একগাদা শাড়ি, জামা ছড়িয়ে রেখেছেন মল্লিকা। সঙ্গে কিছু জুয়েলারিও। ওকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দ্যাখ তো! আমি কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না। এই পিংক শাড়িটা পরব নাকি অফ হোয়াইট-টা? আর সঙ্গের ব্লাউজও তো পাচ্ছি না। তুই একটু খুঁজে দে’। 

   

#ঋণঃ ডঃ শর্মিষ্ঠা দাস।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত