অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২৮) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা।
আমরা পায়ে হেঁটে বেড়াতে বেরিয়ে এসেছিলাম।
পাহাড়ি গ্রামটা পেছনে ফেলে রেখে সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে আমরা পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রোদ ঝলমলে বিকেল– পাশের পাহাড় পর্বত ফটফটে হয়ে উঠেছে। উত্তর থেকে এক ঝাঁক পাতলা ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। এই বাতাসে বৌদ্ধ প্রার্থনার পতাকা গুলি পত পত করে উড়ছে, শীতল উজ্জ্বল রোদ আর উজ্জ্বল বাতাস সেই পতাকায় খোদিত প্রার্থনা–স্তোত্ৰ গুলি যেন বহন করে নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সারি সারি বিভিন্ন রঙের পতাকা দীর্ঘ বাঁশের ডগায় ঝুলছে। রঙ্গিণ কাপড় গুলির গায়ের রংগুলি যেন ম্লান হয়ে পড়েছে— অনুজ্জ্বল হয়ে পড়েছে কাপড়ের বুকে লিখে রাখা প্রার্থনা স্তোত্রের অক্ষরগুলি।আকাশটা ছিল স্ফটিকের মতো নীল। পতাকা গুলিকে নীল আকাশের একটি স্বাভাবিক অংশ বলে মনে হচ্ছিল।
পথটার একপাশে পর্বতের পিঠটা ঢালু হয়ে উঠে গেছে। সারি সারি ঘন সবুজ পাতার দেবদারু গাছ তাতে। পথের অন্য দিকটা নেমে গেছে অনেক নিচে। সেখানে গাছপালা খুব হালকা ধরনের। গাছগুলির মাঝে মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির পাথরের খন্ডগুলি। কোথাও এক টুকরো বিশাল শিলাখণ্ড বেরিয়ে আছে পাহাড়ের গা থেকে। সবুজ শেওলা এবং গাছ ঘিরে আছে শিলাখণ্ডের রোদ না পড়া জায়গাগুলি।
আমরা অনুচ্চ কন্ঠে কথা বলছিলাম । পথটা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গিয়েছিল। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা ভাবে দেবদারু গাছের ছায়ায় পথটা ওপরের দিকে উঠেছিল । আমার নিঃশ্বাস ক্রমে ছোটো হয়ে আসছিল । ‘আরেকটু এগোলেই একটা সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে’, আমি বলেছিলাম।
‘ সেখান থেকে কী দেখা যায়?’
‘ বলব না। নিজেই দেখবে।’
‘ আমার কিন্তু এখনই ক্লান্ত লাগছে।’
‘ এখনই?’
‘ ভাত খাবার পরে ওপরের দিকে হেঁটে যাওয়া ঠিক নয় নাকি, এরমধ্যে এতটা ভাত খেয়েছি।’
‘ সন্ধের খাবারটা মানুষটা ক্যাম্পে গিয়ে রেঁধে রেখে আসবে। আমি রাতের বেলা মুরগি নিতে বলেছি।’
‘কী রান্না করবে?’
‘ নানী এক ধরনের মুরগির তরকারি বানায়। খেতে ভালো লাগে। ঝাল দেয় অবশ্য, আমি আজ একেবারে কম-ঝাল দিতে বলেছি।’
‘ আজকাল বেশি ঝাল খাওয়া হয়না, ভুলেই গেছি। অথচ আগে গুয়াহাটিতে দুই তিনটি ধানি লঙ্কা না হলে ভাতই খেতে পারতাম না।’
‘ গুয়াহাটির কথা বলুন তো। যাবেন নাকি একবার গুয়াহাটিতে?’
‘ গুয়াহাটির কথা? গুয়াহাটির কথা পরে বলব… …?’
‘ না হলে আমেরিকার কথা বলুন।’
‘ আমেরিকার কথা? আমেরিকার কথা বলব,’ সে যেন কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে বলল।
‘ এই ট্রেকিংয়ে কেন এলেন? প্রসঙ্গটা ধরিয়ে দেবার জন্য আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ টেকিংয়ে? এই জেমস আর বাৰ্থা, এই যে সাহেব মেমরা ট্রেকিংয়ে গেল, ওরা আমার সহকর্মী। আমেরিকায় আমরা একসঙ্গে কাজ করি। ওরা জোর করে নিয়ে এল।’
আমার অবাক লাগল। একসঙ্গে এসেছে। জোর করে নিয়ে এসেছে। বুঝছ যখন ট্রেকিংয়ে যাব না বলে মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন ওরা বিশেষ কিছু বলেনি। একবারও যাবার জন্য জোর করেনি। সাহেব শুধু করমৰ্দন করে বলেছিল— আশা করি তুমি নিজের খেয়াল রাখবে, যত্ন নেবে। হ্যাঁ মাত্র এতটুকুই বলেছিল।সঙ্গের মেমটি জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল‘টেক কেয়ার হনী’–যত্ন নেবে। তারপর দুজনেই অবলীলা ক্রমে ট্র্যাকিংয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েটি আর কী বলে শোনা যাক।
‘ ওরা দেখা করার জন্যই চলে এলাম।’
‘ বাকিরা?’
‘ পরমেশ, মানে সেই শক্ত ভারতীয়টি। তিনি আমার পরিচিত। আমার প্রাক্তন স্বামীর বন্ধু, আমার ও বন্ধু… …’
আমি হঠাৎ মাথা তুলে তার চোখের দিকে তাকালাম।
‘ বাকিজন পরমেশের বন্ধু।’ কথাটা প্রথমে সে শেষ করল। তারপরে ধীরে ধীরে বলল,’ আজ এক বছর আগে আমার স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।’ খুব সাধারণ মন্তব্য করার মতো সে কথাটা বলল।
আমি কী উত্তর দেব কী বলা উচিত বুঝতে পারলাম না। তাই বলতে হয় বলেই ভদ্রতা রেখে বললাম,’ আই এম সরি।’
‘ না না ,দুঃখিত হওয়ার মতো কোনো কথা হয়নি। আমাদের আর বনিবনা হল না। এগারো বছরের বিয়েটা ভেঙে গেল। ভারতে এই সমস্ত কথায় আমরা এখন ও সহজ হতে পারিনি।’
‘ হ্যাঁ আমরা এখনও এই কথাগুলিতে সহজ হতে পারিনি, সহজে নিতে পারিনি’ আমি বললাম। ‘অসমে তো আরও পারেনি।’কিছুক্ষণ আমরা চুপ করে ছিলাম। পথটা ক্রমশ আরও উঁচু হয়ে যাচ্ছিল এবং আমাদের গতি আরও মন্থর হয়ে পড়ছিল। ভিউ পয়েন্টের কাছে একটা চালা আছে। সেখানে বসে বিশ্রাম নেওয়া যাবে। কাছেই এক ঘর মানুষ থাকে। চাইলে লাল চা করে দেয়। সেখানে বসে দুই কাপ চা খাওয়া যাবে। এক কাপ চা খেতেও ভালো লাগবে। আমি বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বাঁদিকে দেবদারু গাছের একটি গাঢ় দেওয়াল। এই দেওয়ালের পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তাটা বাঁদিকে একটা বাঁক নিয়েছে। বাঁকটা ঘুরেই ভিউ পয়েন্টটা দেখতে পাব।
আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
‘ ডিভোৰ্স বড়ো নোংরা কারবার— মেসি আফেয়ার,’ মেয়েটি কথা বলতে শুরু করল। ভেতরে কিছু একটা মরে যায় বুঝেছ।’
কী উত্তর দেব পুনরায় বুঝতে পারলাম না। বললাম,’ ডিভোর্স হওয়া কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার আগে দেখা হয়নি।।’
‘ আমেরিকায় ডিভোর্স যথেষ্ট সহজ। কিন্তু সেখানেও দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। উকিল টুকিল ধরতে হয়। আলাদা আলাদা থাকতে হয়। উকিলে উকিলে মিলে ডিভোর্সের কথাবার্তা গুলি, টাকা পয়সার কথা, ছেলে মেয়ের কথা সবকিছু ঠিকঠাক করে। ছেলেমেয়েদের খরচ কে কত দেবে, বাচ্চা কার জিম্মায় থাকবে এইসব।’,
‘মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইলেও এই সমস্ত সমস্যা হয় নাকি?’
‘ হয় হয়। আমাদের তো শেষ পর্যন্ত একপ্রকার মিউচুয়াল ডিভোর্সই হয়েছিল। কিন্তু তার কারণগুলিও দেখাতে হয়। অভিযোগ, প্রতি–অভিযোগ এইসব তো থাকেই। ক্রোধ ,রাগ, অভিমান ,ঘৃণা— সবকিছুই এসে পড়ে আর মনটাকে একেবারে জখম করে ফেলে। মনটাকে জখম করে ফেলে।এগারো বছরের বিয়ের সম্পর্ক একটা ভেঙ্গে ফেলা খুব সহজ কথা নয় বুঝেছ। বড়ো কষ্টকর।’
‘ বলবেন না ।এই কষ্টকর কথাগুলি বলে নিজেকে দুঃখ দেবেন না।’
‘ কারও সামনে তো বলতে পেরেছি। আজ পর্যন্ত কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি, বলতে পারিনি। কথাগুলি বুকের মধ্যে ঢুকে যেন ধাক্কা মারছে। তুমি অসমের ছেলে বলেই তোমার কাছে বলতে পারছি। বলতে আরম্ভ করে বুকটা কিছুটা হালকা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে । জেমস এবং বার্থা, সেই দুজন আমার ডিভোর্সের পরে কম সাহায্য করে নি। সাংঘাতিক সাপোর্ট দিয়েছে আমাকে।’
‘ এখন তো সেই সব সমস্যা শেষ হয়েছে।’
‘ হয়েছে ।ডিভোর্সের সমস্ত কাজ শেষ। টাকা-পয়সা ছেলের পড়াশোনা… …’
‘ ছেলে?’
‘ আমার একটি ছেলে আছে। নয় বছরের।’
‘ নয় বছরের ছেলে !আপনার?’
‘ অভিমন্যু।’
‘ কোথায় আছে সে?’
‘ তাকে ইংল্যান্ডের একটি পাবলিক স্কুলে পাঠিয়ে সেখানেই রেখে এসেছি।’
‘ ইংল্যান্ডে কেন? আমেরিকায় ভালো স্কুল ছিল না?’
‘ আছে ।অনেক আছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের স্কুলগুলি ভালো—আমেরিকার স্কুল গুলোর মতো উড়নচণ্ডী নয়। সেই স্কুলটিতে তার মামা-মামী দুজনেই কাজ করে।’
‘ইংল্যান্ডে?’
‘ হ্যাঁ ইংল্যান্ডে!ছেলেটির স্কুল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বোধ করি আমি এবং আমার এক্স হাজবেন্ড একমত হয়েছি। বাকি কোনো কথাতেই আমরা একমত হতে পারিনি।’
‘ খরচ?’
‘ খরচ পিতার। কিন্তু স্কুলের ফিস এবং আসা যাওয়ার ভাড়াটাই একটা ছেলেকে পড়ানোর একমাত্র খরচ নয়। কাপড় চোপর থেকে শুরু করে আরও কত খরচ আছে। ছেলেটি আমার জিম্মায় যখন সেই সব খরচ তো আমাকেই বহন করতে হবে।
‘ আপনি তো নিজেও চাকরি করেন।’
‘করি। সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হল দায়িত্বটা। আমি সেই দায়িত্বটা নিতে পারব বলে আমার আত্মবিশ্বাস নেই।’
‘ এসে যাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু এসে যাবে। এখনই এত চিন্তা করে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন। অভিমন্যু স্কুলে গিয়েছে মাত্র। সে যাবার জন্য আপনার বোধহয় বেশি খারাপ লাগছে। অযথা এই সমস্ত চিন্তা করছেন। সময় যেতে দিন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ যাবে, তাই না?’ সে যেন আমার কাছ থেকে নিশ্চয়তা চাইল।
‘ যাবে ,নিশ্চয় যাবে। মিছামিছি এই সমস্ত ভেবে নিজের মনটা ভারাক্রান্ত করবেন না। আমরা রাস্তার বাঁকটাতে এসে পড়েছি। বাঁকটা ঘুরেই ভিউ পয়েন্টটা। দেখবেন সেখানে আপনার জন্য কী সুন্দর সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে রয়েছে।’
আমরা নীরবে বাঁকটা ঘোরার জন্য এগিয়ে গেলাম।
নিঃশ্বাস ছোটো হয়ে আসছিল। ক্লান্ত লাগছিল। উরুর পেশী এবং হাঁটু দুটো ব্যথা করছিল। শেষ পদক্ষেপটা আমরা যেন বেশ কষ্টের সঙ্গে দিয়েছিলাম।
রোদ ঝলমলে বিকেল। আকাশ স্ফটিক নীল। কোথাও বিন্দুমাত্র মেঘের রেশ নেই। শেষ পদক্ষেপটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে নীল আকাশটা আমাদের সামনে আরও বিশাল উঠেছে। অবশেষে আমরা শেষ পদক্ষেপটা দিলাম এবং ভিউ পয়েন্টের জায়গাটাতে পৌঁছে গেলাম।
মেয়েটি হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সামনে দেখা গেল ধৌলাধার পর্বতের বিশাল উত্তুঙ্গ শৃঙ্গমালা।
মেটে এবং ছাই রংয়ের পর্বতের শিখরগুলি উদ্ধত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের বুক বিদীর্ণ করে। শৃঙ্গের মাথায় বরফের ধবল কিরীটী— ধবল আধার— ধৌলাধার। পাতলা বাতাসের শৃঙ্গ শীর্ষ থেকে সাদা পতাকার মতো, ধোঁয়ার মতো উড়ছে তুষার কণিকা। আমরা অপেক্ষা করে থাকা পথের পাশের খাড়াইটা নেমে গেছে অনেক নিচে। সেই খাড়াই এবং ধৌলাধার পর্বতের মধ্যে ঘন সবুজ শিলাময় পাহাড়। সেখানে একটাও গাছ নেই। সবুজ ঘাস এবং বেঁটে গুল্মে ভরা। এত নগ্ন সুন্দর প্রকৃতির সামনে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কথা সত্যিই বন্ধ হয়ে যায়।
আমি তাকে হাত দিয়ে ভিউ পয়েন্টের ছোট্ট পাকাচালিটা দেখিয়ে দিলাম।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীরবে সে চালাটার নিচে এগিয়ে এল। সিমেন্টের বেঁটে বেঞ্চটায় সে নীরেবে গিয়ে বসল। তারপরে নীরবে তাকিয়ে রইল ধৌলাধারের বিশাল উত্তুঙ্গ গিরিশিখরের দিকে। এইবার সে হাত দুটি মুখের কাছে নিল এবং দুই হাতের তালু দুটো গালে রেখে নীরবে কাঁদতে লাগল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি সে কী করছে। তারপরে যখন দেখলাম নীরব কান্নায় তার বাহু দুটি কেঁপে কেঁপে উঠছে, নিজের অজান্তে আমার হাতটা তার গায়ের দিকে উঠে গেল। কিন্তু আমি থেমে গেলাম। কাঁদুক ও কাঁদুক, কাঁদলে হয়তো মনের মধ্যে জমা হয়ে থাকা বিষাদের বোঝাটা কিছুটা হালকা হবে। আমি ওকে সেখানেই ছেড়ে দিয়ে পথের অন্য পাশে থাকা ছোটো ঘরটার দিকে চায়ের সন্ধানে গেলাম।
চা বানানো মানুষটির সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ বসলাম। ছোটোখাটো এটা ওটা কথা বললাম। মানুষটা বলল এক কাপ চায়ে পাঁচ টাকা করে না নিলে তার পোষাবে না। আমি বললাম পাঁচ টাকা করে নে কিন্তু কাপ গুলি বড়ো এবং নতুন দেখে দিবি। সে দুটো নতুন কফি মগ বের করল।এইগুলোতে হবে কি? সে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম হবে। সে হেসে মগদুটিতে লাল চা ঢেলে দিয়ে বলল— দশ টাকা। আমিও তাকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে মগ দুটি দু হাতে নিলাম। পথটায় উঠে আমি ভিউ পয়েন্টের চালার নিচে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালাম । দেখলাম সে একটি রুমাল দিয়ে দ্রুত চোখ মুছছে ।হোক সে, কান্নার পর্বটা শেষ হল।
আমি কাছে গিয়ে বসলাম । গরম চায়ের কাপটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম । চশমার নিচে তার চোখ দুটি লাল হয়ে ফুলে গেছে । ধন্যবাদ জানিয়ে সে কাপটা নিল ।
‘ তিব্বতি লোকেরা ফিকা চায়ে ইয়াকের মাখন মিশিয়ে খায় ,’ আমি ওকে বললাম। আমি কিন্তু ওটার টেস্টটা একদম পছন্দ করি না । আপনারও ভালো লাগবে না। ওরা চাং বলে।’
‘ এই চায়ে ইয়াকের মাখন দেওয়া আছে নাকি? না কুঁচকে সে জিজ্ঞেস করল ।
‘না না এর মধ্যে নেই। এটা প্লেন আসাম টি।’
‘ও, থ্যাংকস। আমি এমনিতেও মাখন খুব অপছন্দ করি।’
‘ এই পাহাড়ে চর্বি জাতীয় জিনিস বেশি খেতে হয়। এখানে হাঁটতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়।’
‘ বড়ো সুন্দর চা, চুমুক দিয়েও বলল।’ অনেক দিন এরকম করা চা খাইনি, বেগের চায়ে এরকম লিকার হয় না।’
‘ আমাদের গ্রামের বাড়িতে, মানে আমাদের দাদুর বাড়িতে, সব সময় একটা বড়ো কেটলি উনুনে বসানো থাকে। তাতে চা পাতা দেওয়া থাকে। কাউকে চা দিতে হলে সেখান থেকে কড়া লিকার বড়ো কাসার বাটিতে ঢেলে, গরম দুধ ঢেলে গুড়ের সঙ্গে দেওয়া হয়। খুব গণ্যমান্য ব্যক্তিকে চিনি দিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণের জন্য গুড়।’
‘কত দিন গুড় খাইনি জান।’
‘আমেরিকায় গুড় পাওয়া যায় না নাকি?’
‘পাওয়া যাবে না কেন,নিশ্চয় পাওয়া যায়।কিন্তু কোনোদিন খোঁজা হয় নি।গুড়ের কথা মনেই পড়ে নি।’সে বলল।আমরা কিছু সময় আবার চুপ করে রইলাম।
‘আমাকে একা কাঁদার সুবিধা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ,’সে আমার দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল।
আমি কিছুই বললাম না।বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধৌলাধার পর্বতের রূপ পরিবর্তন হয়ে আসছে।পর্বতের শিলাময় শরীরটা ক্রমে গাঢ় ছাই রঙের হয়ে আসতে শুরু করেছে,বরফটা রুপোলি এবং উড়ে যাওয়া তুষার কণিকাগুলি পাতলা মুগা রঙের।
আমাদের চোখের সামনে পাহাড় কীভাবে রূপ পরিবর্তন করছে দেখেছ,’তাকে বললাম।
‘সারাটা দিন এখানেই বসে থাকতে পারি।বসে বসে তাকিয়ে থাকা যায় পাহাড় আর প্রকৃ্তির রূপের দিকে।’একটা কথা জান ,বেশিক্ষণ আমি সুন্দর জিনিস ,সুন্দর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না,আমার মনটা বিষাদে ভরে উঠে।আগে থেকেই।কেন আমি এত ‘স্পয়েল স্পর্ট’ বলতে পারি না।এখন এত সুন্দর এত অবর্ণনীয় স্বর্গীয় দৃশ্য দেখলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের জল বেরিয়ে এল।’
‘দুঃখের কোনো কারণ থাকে না?’
আপাতত থাকে না,কিন্তু ভেতরে হয়তো থাকে।এই এখন আমার হঠাৎ ছেলেটির কথা মনে পড়ল।এত সাহসী সে।এমনিতে আমাকে ছাড়তেই চায় না,কিন্তু যখন ইংলণ্ডের বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার কথা ফাইনাল হল,সে এত শান্তভাবে যাবার জন্য প্রস্তুত হল তোমাকে কী বলব! উলটে সেই আমাকে বোঝাতে পারার মতো হয়ে উঠেছে।আমি হোস্টেলে থাকলে তুমি ফ্রি হয়ে থাকতে পারবে,নিজের পছন্দ অনুসারে কাজগুলি ভালোভাবে করতে পারবে।আমিও অসুবিধা করব না।আর আমি তো বন্ধে আসবই। আমাদের ডিভোর্সের পুরো প্রক্রিয়াটাতে সে এত সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।তার এতটুকু অন্তরটা যে দুঃখে মোচড় খেয়ে উঠছে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম।কিন্তু তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।সেপারেশনের সময় সে আমার সঙ্গে ছিল তখন বিশেষ কিছু মনে হয় নি।কিন্তু ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার প্রথম রাতে তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শোবার সময় বুকটা এত খালি খালি মনে হচ্ছিল ,ভয় হচ্ছিল,এত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলাম—ডিভোর্স হয়ে গেলে করব বলে ভাবা সমস্ত কাজের পরিকল্পনা কর্পূরের মতো উড়ে নাই হয়ে গিয়েছিল।
বিকেলটা কাত হয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে শীতের প্রকোপ বেশি হয়ে গিয়েছিল।ফুরফুরে বাতাস ছোটো ছোটো সূঁচ বেঁধার মতো গালে মুখে বিঁধছিল।মেয়েটি উঠার কোনো নামই নিচ্ছে না।আমি উঠে দাঁড়ালাম,তাকে বললাম,’উঠুন ঠান্ডা বেড়ে চলেছে।এখন কুয়াসা পড়বে।আমরা উঠি চলুন।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন সে উঠল।
আমরা কুঁড়েঘরটাতে চায়ের মগ দুটো ফিরিয়ে দেবার জন্য ঢুকলাম। সেখানে ঢুকে সে আরও দু কাপ চা খাওয়ার কথা বলল। চা বানানো মানুষটার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমরা দশ টাকা দিয়ে আরও দুকাপ চা বানিয়ে খেলাম।
ধূসর হয়ে পড়তে চলা ধৌলাধার গিরিশৃঙ্গ মালাকে সেদিন শেষবারের জন্য দেখে আমরা ঢালু পথ দিয়ে নিচে নেমে আসতে শুরু করলাম। পথটা ক্রমাগতভাবে নিচের দিকে নেমে গেছে। হাঁটলে সামনের দিকে ঠেলে আনা বলে মনে হয়। আমাদের হাঁটা মাঝেমধ্যে দ্রুত হয়ে পড়ে। যাতে পড়ে না যাই তার জন্য পা টিপে টিপে চলতে হয়।
‘ সাবধানে আসবে, এই কাচা রাস্তা গুলো কিন্তু বিপদজনক,’ ওকে আমি বললাম।
‘টেনে নিয়ে যাওয়া বলে মনে হচ্ছে।’
‘আমার হাতটা ধরে নিন।’
সে সঙ্গে সঙ্গে আমার বগলের নিচে একটা হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বাহুতে ধরে নিল।ওর শরীরটা আমার কাছে চলে এল। আমার একটা আশ্চর্য রকম অনুভূতি হল।ওর গায়ের গন্ধটা পাওয়া যায় নাকি ভেবে আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। ধৌলাধারের সেই স্ফটিক স্বচ্ছ শীতল বাতাসে কিন্তু আমি কোনো গন্ধ পেলাম না। হাত ধরাধরি করে আসায় আমাদের চলা মন্থর হয়ে এসেছিল। এবার অন্ধকার নেমে এল। পাহাড়ি জায়গায় এমনিতেও অন্ধকার তাড়াতাড়ি হয়। পথটার ডানদিকে থাকা দেবদারু গাছের ঘন অরণ্য্টির মাঝখানে অন্ধকার এসে জমা হয়ে ক্রমশ সমগ্র আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। রঙের আকাশটাতে আলো না থাকা একটা স্যাঁতসেতে অর্ধেক চাঁদ বেরিয়ে এল। সেই আলো-আঁধারির মাঝখান দিয়ে আমরা একেবারে নীরবে আসতে লাগলাম।
কতক্ষণ পার হয়ে গেল ঠিক নেই।
অন্ধকারের মধ্যে একটা দুটো প্রদীপের আলো চোখে পড়ল। তারমানে আমরা গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। একটা পেট্রোম্যাক্স লাইটের উজ্জ্বল আলো এবার চোখে পড়ল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পেলাম। নীরবতায় অবশ হয়ে পড়া স্নায়ুগুলি যেন এবার সক্রিয় হয়ে উঠল।
মেয়েটি আমার হাতটিতে হাত দিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে বলল’ তোমার মতো একজন অনাত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমার বড়ো আনন্দ এবং ভাগ্যের কথা বুঝেছ। আমার আর ট্রেকিংয়ে না যাবার দুঃখ নেই।’ সে কিছুটা নার্ভাস ধরনে অনুচ্চ শব্দে হেসে আমার হাতটা ছেড়ে দিল।
আমি তাকে কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না।

অনুবাদক