ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্গা পুজোর শেষে আসেন মা জগদ্ধাত্রী।তার সাজগোজ, জাঁকজমক শুধু আমাদের নয়, বিশ্বসংসারের সবার চোখেই ধরা পড়ে।প্রায় দোতলা সমান উচ্চতা।হাতির ওপরে সিংহ,তার ওপরে আসীন মাতৃমূর্তি।অলংকার,পোশাক,নানা প্যান্ডেলে নানা রঙের,নানা ঢং এর।তবে সাদা শোলার কাজের তুলনাহীন নমুনা,মাথার বিশাল মুকুটে, মাথার পেছনের চালচিত্রে।দেবী চতুর্ভুজা।
পুজোর আগে আগে স্কুল আর পড়ার সময়টুকু ছাড়া প্যান্ডেলেই সময় কাটে।কখনও শোলার সাজসজ্জা দেখার মগ্নতায়,কখনো বা প্যান্ডেল শিল্পীর পায়ে পায়ে।কখনও আবার নিজেদের খেলাধূলার ঝোঁকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে।সঙ্গে পাড়ার অন্য বন্ধুরা, কখনও কখনও অন্য পাড়ার ছেলেমেয়েরা।পুজোর আগের সেই আনন্দ যেন বিয়েবাড়ির ভিয়েনের মত।গন্ধেই মাতোয়ারা!কিংবা বলা যায় ‘গাছে না উঠতেই এককাঁদি।’পুজোর চারদিনের আনন্দে তো লাগামছেঁড়ার স্বাদ। ওই কটাদিন পুরোপুরি মুক্তাঞ্চলে বসবাস। কেউ বারণ করেনা,শাসন করেনা। খাওয়া ,শোওয়া ছাড়া বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
পুজো শেষ।শরীরের ওপর অত্যাচারের জেরে, তারপরেও বেশ কিছুদিন জ্বর জ্বালা সর্দি কাশির ভোগান্তি। সেসব তো আছেই, এমন যা ইচ্ছে তাই এর পরে অনেক কিছুই সহ্য করা যায়। এসবকিছু নিয়েই বার্ষিক পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির হিমশিম কষ্টের স্বাদ।
দুর্গা পুজোর বিসর্জনের পরে মন বড় খারাপ ।বারবার মনে হয় ওই মা দুর্গাকে সপরিবারে জলে না ফেলা ছাড়া আর কী কোন উপায় ছিল না।এমনকী সাংঘাতিক অসুরটার জন্যও মনের মধ্যে উথালপাতাল।
বিসর্জনের পরে আবার শুরু বিজয়া দশমীর তোড়জোর।সন্ধে হতে না হতেই তিনবার খাতার পাতায় লাল কালিতে ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ লিখে নতুন জামায় সেজেগুজে বাড়ির বড়দের,পাড়ার গুরুজনদের আর কাছের আত্মীয় স্বজনদের প্রণাম করে মিষ্টি খাবার প্রথা।তারপরে আবার কোজাগরী লক্ষীপুজো।কালীপুজোর আগে বেশ কিছুদিন সব চুপচাপ। দিনগুলোয় কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ভাব। নিঃঝুম দুপুরগুলো বিসর্জনের জলে ভেসে যাওয়া দেবী মুখ আর প্যান্ডেলের সঞ্চিত শোলার টুকরোর স্মৃতিমন্থনে অকারণেই বড় বিষণ্ন আর ভারী। কালীপুজোর পরে জগদ্ধাত্রী পুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই আবার একঘেয়ে থোড় বড়ি খাড়ার দিনযাপন। মনখারাপের ভার বইতে বইতে পরের বছরে আবার পুজোর জন্য অপেক্ষার শুরু। যে অপেক্ষা ফুরোতে চায়না। পুজো শেষের ঢাকের ঢ্যাম কুড়াকুড়ে ,“ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ,ঠাকুর যাবে বিসর্জন” বাজছে সারা আকাশ জুড়ে।
জড়ো করা বইপত্রের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে হাজার মজার স্মৃতি।
এখনও হয়ত তেমনি মধুর আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে ফ্ল্যাটবাড়ির আনাচে কানাচে পুজোর ধুনুচি নাচে,ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায়। মফস্বলের পুজো দালানে চুনকাম হয় দেবীর আগমনের প্রতীক্ষায়।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের বোন ,ভাই বা ক্ষুদে বন্ধুর হাত ধরে গন্ডি পেরিয়ে ঠাকুর দেখতে যায় বেশ কিছু দূরে, বাড়ির অভিভাবকদের সম্মতি ছাড়াই।সেইসব পুরনো দিনের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন দাদু ,ঠাকুমা বা দিদুন হয়ে ছোটদের বলে, “ওরে, তোরা বেশি দূরে যাসনা, ছেলেধরা ধরে নেবে।”
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-৩০) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
দিনকালের এই পালটে যাওয়ায় পুজো প্যান্ডেলে অপেক্ষারত কোন মৌমিতা বা রুমা মিতালিরা আর কষ্ট পায়না।অপেক্ষা করতে করতে প্রার্থীত মানুষটির মুখ কল্পনার বিষাদময় ভার আর তাদের বইতে হয়না।মুঠোফোনের অন্দরে হ্যাঁ বা না এর চট্জলদি সংবাদ এখন সহজেই আসে।সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদের কুয়াশারা ডানা গুটিয়েছে।দিনের আলোর মত সবকিছুই বড় সহজে জানা যায় বোঝা যায়।দুঃখেরা থাকে, টানাপোড়েনের ভার কমে।এইরকম যাপন ভালো না মন্দ কে বলবে?
আগেকার সময়ে যোগাযোগের জন্য বড় বেশি যোগাযোগ করতে হত।এসময়ে একটা ফোনেই নিউইয়র্কের খবর চলে আসে।কলকাতার শোলার দুর্গাপ্রতিমা বাক্সবন্দী হয়ে অন্য দেশের পুজায় আসর মাতায়।ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কারিগরেরা পুজোর প্রতি দিনের ব্যবস্থাপনা করে দিয়ে মোটা টাকার অঙ্ক পকেটে পুরে পরের বছরের মজুরি হাঁকে।অঢেল টাকার বিশাল ব্যবস্থায় হাতি গলে সূঁচ গলে না।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।