| 5 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৪) । আদনান সৈয়দ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের জীবন, তাদের স্বপ্ন, তাদের ত্যাগ, তাদের মন, মনন, প্রেম, ভালোবাসা আর বুক চাপা কান্নার গল্প । সব মিলিয়ে এই ধারাবাহিক লেখায় উঠে আসবে নিউইয়র্কের বাঙালির গল্পগাথা। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকছে পর্ব-৪।


প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

সে অনেক আগের কথা। নব্বই দশকের প্রথম দিকের কথা। নিউয়ইর্কে তখন আমি সদ্য আগত। রাস্তাঘাট চিনি না, কোন বাঙালির সাথে তেমন একটা হাই—হ্যালো নেই আর পকেট হল গড়ের মাঠ। বলা যায় সব “নেই” এর মাঝেই তখন আমার বসবাস। সেই সময় নিউইয়র্কের এই তামাটে মাটি ছিল আমার জন্য ছিল নিতান্তই পাথুরে আর প্রাণহীন। টি এস এলিয়ট তাঁর “ওয়েস্টল্যান্ড” কবিতায় যেমন ভাবে ক্যকটাস, মুরুভূমি আর অন্তসারশূন্যতায় ভরা এক জীবনের বর্ণনা দিয়েছিলেন আমার কাছে নিউইয়র্ক ছিল সত্যিকার অর্থেই তাই। কিন্তু কি আর করা! জীবনের এই সব আয়োজনের নায়কতো আমি নিজেই। জীবনের এই রং, এই ভূষন সব কিছুইতো আমি নিজেই সাজিয়েছি আমার মতন করে। কবি গুরুর ভাষায়, “রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আসা করি।” কিন্তু জীবনের এই অরূপ রতনের সন্ধান ক’জন পেয়েছেন বলুন? কিন্তু তারপরও আমরা নিত্য আমাদেরকে খুঁজে বেড়াই, আবিস্কার করি। বুকে আশা নিয়ে, আকাঙ্খা আর স্বপ্নগুলোকে সযত্নে আগলে ধরে এখানে—সেখানে আমরা এই ছোট্ট জীবনের নোঙর ফেলি।

নিউইয়র্ক এর এস্টোরিয়া ৩৪ স্ট্রিট আর ৪৪তম সড়কের দুবেড রুমের বাসায় গাদাগাদি করে আমরা চারজন প্রাণি মেস করে মাথা গুঁজে থাকি। এর মধ্যে মজিবুর ভাই হুজুর মানুষ । তিনি এ বাড়ি ও বাড়ি বাঙালি ছেলেমেয়েদের আরবি পড়ান, মাহবুব ভাই ট্যাক্সি চালান, ফজলু ভাই একটা গ্রোসারীর দোকানে কাজ করেন আর আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেকার। ফরেন স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকায় এলে এর যে কি জ্বালা—যন্ত্রনা তা ভুক্তভোগিরাই বলতে পারবেন। টিউশন ফি আকাশ ছোওয়া, যুতসই কোন চাকরি বাকরি পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের মত এই ফরেন স্টুডেন্ট নামধারী(যাদের বাপের সাধ্যি নেই তাদের সন্তানদের টাকা—পয়সা দিয়ে কোন সাহয্য সহযোগিতা করার) একদিকে যেমন নুন আনতে পান্তা ফুড়ায় অন্য দিকে “টিউশন ফি” নামের  বস্তুটি সারাক্ষন মাথার চারপাশে ভো ভো করে চক্কর দিতে থাকে। প্রতিদিন “কাজ” এর সন্ধানে বেড় হই আর মন খারাপ করে আবার সন্ধায় ছোট্ট ঘর নামের এই খোপটায় আস্তানা গাড়ি। মজার বিষয় হলো প্রতিদিন সন্ধায়ই রুমমেটদের সাথে আমার কাজের সম্ভাব্য “আপগ্রেড” নিয়ে আলোচনা করি।

 “আরে দেইখ্যেন, একটা কিছু হইয়্যা যাইবো, কোন টেনশন কইরেন না।”

 আমার রুমমেটদের এই ধরনের অভয়বাণী আমার প্রতিদিনের নিত্যদিনের বাড়তি এক চালিকা শক্তি। কিন্তু এত আশা—ভরসার পরও আমি নিত্য ভাবি শুধু আমার কথা। সত্যি সত্যি চাকরী পাবোতো? এরকম ভাবতে ভাবতেই ঘটনা একটা ঘটল। আমার প্রতিবেশি টেরি নামের এক ভদ্রলোকের সাথে আমার বেশ সখ্য হয়েছিল। টেরি ছিল একটা ইতালি রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। আমি কথায় কথায় একদিন টুক করে তাকে বলে রেখেছিলাম আমার কথাটা। একটা কাজ চাই। বাসবয়, ওয়েটার যাই হোক না কেন। টেরি হয়তো আমার করুণ চেহারাটা ঠিক তার মাথায় রেখে দিয়েছিলেন। এক বিকেলে ওঁর সাথে দেখা হতেই মুচকি হেসে আমাকে বললেন  তার রেস্তোরাঁয় কিছু ওয়েটার নেওয়া হবে আর আমি এই কাজটা করতে পারবো কিনা। আমি ব্যাকুলভাবে “হ্যাঁ” বলতেই টেরি ঝটপট আমাকে বলে দিলেন যে আমার একটা টক্সেডো প্যান্ট, একটা সার্ট, একটা বো টাই আর একটা ভালো কালো জুতা লাগবে। এসব নিয়ে আমি যেন তার সাথে দ্রুত দেখা করি। আমিতো খুশিতে আটখানা। মা লক্ষী বুঝি শেষ পর্যন্ত আমার দিকে তার সদয় দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন! কিন্তু হঠাৎ যেন মাথায় বাজ পড়ল! আরে তাইতো এই টক্সেডো প্যান্ট—সার্ট জুতা—মুজা এসব কিনতে এত টাকা আমি পাবো কোথা থেকে? পকেট যে গড়ের মাঠ। তখন নিউয়ইর্কে চেনা—পরিচিত এমন কেউ নেই যে যার কাছ থেকে অন্তত দুশো ডলার ধার করা যায়। মনের দুঃখে সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোকে সঙ্গে নিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে আছি। একে একে আমার সবকটা রুমমেটরা সন্ধ্যার পাখির মত তাদের নিজ ছোট্ট নীড়ে ফিরতে লাগলেন। আমি চুপচাপ বসে আছি আমার আপন ভুবনে। আমি আমার রুমমেটদের সবাই সবার ঘরের খবর রাখি। এখানে যারা আছেন তারা সবাই যাকে বলে মজলুম। টাকা—পয়সায় নিয়ে সবাই কমবেশি কষ্টে আছেন। টেনেটুনে কোনমতে অল্প কিছু টাকা বাংলাদেশে আত্মীয়দের পাঠান। তাই আমি তাদের কাছে টাকা ধার চাওয়ার কথা ভাবতেই পারছিলাম না। কিন্তু এগিয়ে এলেন আমাদের মেসের সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ ফজলু ভাই। আগেই বলেছি ফজলু ভাই স্থানিয় একটা গ্রোসারির দোকানে কাজ করেন। খুব সামান্য কটা টাকা পান। তার উপর বাংলাদেশে উনার স্ত্রী অসুস্থ। প্রতি মাসেই স্ত্রীর চিকিৎসাবাবদ তাকে মোটা অংকের টাকা পাঠাতে হয় । আমি জানি সে খবর। আমি জানি এই মুহুর্তে তিনি আমাকে কোন রকম টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে যে কতটুকু অসহায়! কিন্তু তিনি সেই কাজটি করার জন্যই এগিয়ে এলেন। ফজলু ভাই নাছোর বান্দা। “আপনি এইভাবে মন খারাপ কইরা থাকলে তো চলবো না। কী অইছে কন, দেখি কিছু একটা করন যায় কিনা!” আমাকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলতে হল। আমার অন্তত শ’দুয়েক ডলার ধার প্রয়োজন। আমি ওয়েটারির কাজে ঢুকেই তা দ্রুত শোধ করে দিতে পারব। আমার এই কথা শুনে ফজলু ভাই কিছুক্ষন কী যেন ভাবলেন। আড়াল করে চোখটা মুছলেন। তারপর আমাকে টেনে জোড় করে তার ছোট্ট রুমটায় নিয়ে গেলেন।  “এই কথাডা আপনে আমারে কইবেন না? এই রকম পর ভাবতে পারলেন? এই লন দুইশো। আপনার যখন খুশি তখন ফেরত দিয়েন।”


আরো পড়ুন: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৩) । আদনান সৈয়দ


 “কিন্তু ফজলু ভাই, আমিতো জানি আপনার এখন টাকা কত প্রয়োজন! স্ত্রী অসুস্থ! দেশে টাকা পাঠাতে হয়। হয়তো এই দুশো ডলার বাংলাদেশে পাঠানোর কথা ছিল আপনার  স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। আমি এই টাকাটা আপনার কাছ থেকে নেই কিভাবে?”  অস্পষ্ট ভেজা কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু আমাদের ফজলু ভাই আমার আর কোন আপত্তিই কানে তুললেন না। শেষ পর্যন্ত আামাকে প্রচন্ড একটা ধমক দিয়ে দিলেন। “আপনারে আমি আমার ছোট ভাই এর মত দেখি। আমারে যদি বড় ভাই এর মত মানেন তাইলে আর একটা কোন কথাও আমি শুনতে চাই না। ইনশাল্লাহ আপনার ভাবির চিকিৎসা নিয়ে কোন সমস্যা অইবো না। আপনি আপনার সুযোগ সময়মত টাকাটা আবার দিয়ে দিবেন। ঠিক আছে?” আমি আর “না” করার সাহস পেলাম না। সেদিন সেই মহুর্তে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। সেদিনের সেই দুশো ডলার ছিল আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। পরদিন সেই টাকা দিয়ে টক্রিডো প্যান্ট—সার্ট, জুতা—মুজা সব কিছুই কেনা হল। ওয়েটারের কাজটাও পেয়ে গেলাম। প্রথম বেতন পেয়ে সেই ধারের টাকাটা  ফজলু ভাই এর হাতেই ফেরত দিলাম। সব কিছুই হল। কিন্তু ফজলু ভাই এর সেই যে আদর মাখা হাত, সেই ভালোবাসায় ভরা দুটো চোখ, সেই দৃশ্য আমি ভুলি কেমন করে? অনেকদিন পর্যন্ত ফজলু ভাই এর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সেদিন জ্যাকসন হাইটসে পুরাতন বন্ধু মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেলাম তিনি নাকি স্থায়ীভাবেই বাংলাদেশে চলে গেছেন । খবরটা শুনে প্রথমেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আর কোনদিন ফজলু ভাই এর সঙ্গে দেখা হবে না? কিন্তু মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। কারণ ফজলু ভাইতো আছেন আমার হৃদয় মন্দিরে। সারাক্ষন আর সারাবেলা আমার ভালোবাসার একজন হয়ে।  আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তিনি থাকবেন আমার সাথেই। আমার প্রাণের বাঙালি ভাইটি হয়ে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত